তুমি নামক অনুভূতি পর্ব ২৬

তুমি নামক অনুভূতি পর্ব ২৬
Lutful Mehijabin (লেখা)

হ্যায়ার ম্যাথ বইয়ের পাতায় দৃষ্টি নিক্ষেপ করে রয়েছে মেহের। অত্যধিক মনোযোগের সহকারে সূত্র মুখস্ত করতে ব্যস্ত সে। কিন্তু তার মাধুর্যপূর্ণ মুখশ্রীতে বিরক্তির ছাপ স্পষ্ট! নিশ্চিত তার এই বিরক্তিগ্রস্ত মুখশ্রীতে একবার সমুদ্রের দৃষ্টি পড়লেই, সে স্তম্ভিত হয়ে উঠত। কারণ সমুদ্র মনে হয়, মেহেরের অন্তরালে কোন অনুভূতি নেই।

পৃথিবীর প্রতিটি মানুষ যেমন দুঃখ, কষ্ট, আনন্দ পেলে, তা না চাইতেও অন্যের নিকট প্রকাশ করে তার অনুভূতি প্রকাশ করে ধরণীর বুকে। কিন্তু সমুদ্রের ধারণা মেহেরে অনুভূতিহীন নির্বাক। তাই বিরক্ত নামক অনুভুতি মেহেরকে গ্রাস করতে পারে না।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

বারংবার মেহেরকে ইচ্ছে মতো বিরক্ত করে যাচ্ছে দিশানি। বর্তমানে মেহেরদের ক্লাসে শিক্ষক উপস্থিত নেই। এই সুযোগে ছাত্র ছাত্রীরা ক্লাসটা কোলাহল পূর্ণ স্থানে তৈরি করে ফেলছে। কিন্তু অসহায় মেহের, তার বড্ড অভিপ্রায় জাগছে পড়া বাদ দিয়ে তিতাস আর দিশানির সঙ্গে খেজুরে আলাপে যুক্ত হতে।

কিন্তু সে নিরুপায়। অদম্য আগ্রহে সূত্র পড়ছে সে। কারণ তাকে যে করেই ক্লাস টেস্ট পরীক্ষায় ফাস্ট হতে হবে। টিফিনের পরে ক্লাসে হ্যায়ার ম্যাথ টিচার তাদের পরীক্ষা নিবেন। দু দিন স্কুলে উপস্থিত হতে পারে নি মেহের। ফলে পরীক্ষার বিষয়টা তার অজানা ছিল। তাই এখন যে করেই হোক তাকে আজকে পরেই পরীক্ষা দিতে হবে। লহমায় দিশানি মেহেরের পিঠে স্পর্শ করে জোর গলায় বলে উঠল,

–এই মেহের, আশ্চর্য তো তুই এতো পরছিস কেন? দেখ আমি তিতাস কেউই পিপারেস নিয়ে আসি নি। সো নো টেনশন
দিশানির কথা কর্ণপাত হতেই মেহের বইয়ের পাতা থেকে মুখ তুলে তার দিকে তাকাল। ভ্রূ যুগল কুঁচকে মৃদু স্বরে বলল,
–উহু! দিশু বিরক্ত করিস না আমাকে। প্লিজ।
দিশানি কিছু বলে উঠার পূর্বে তিতাস অসীম প্রফুল্লের সহিত বলে উঠল,

–দেখ মেহের চিল। এতো টেনশন নিচ্ছিস কেন? আজকে আমারও হিসাব বিজ্ঞান পরীক্ষা আছে। তাই আমি আজকে টিফিন বাসায় চলে যাব। তুই ও চলে যাস। পড়তে হবে না।
তিতাসের কথা শুনে মুচকি হাসির রেখা ফুটে উঠল মেহেরের ঠোঁটের কোণে। তিতাসের কথার প্রত্যুত্তরে মেহের দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করে বলে উঠল,

–তোরা যা করার কর। আমি কাছে পরীক্ষা দিতে অনেক ভালো লাগে। তার চেয়ে বড় কথা হচ্ছে আমার রেজাল্ট পেতে খুব বেশিই ভালো লাগে। চাতক পাখির মতো, আমি পরীক্ষা দেওয়ার আগে রেজাল্টের জন্য অপেক্ষা করে থাকি। তাই দয়া করে আমাকে পড়তে দে ভাই।

মেহেরের বলা প্রতিটি বাক্য তিতাসের কর্ণকুহরে পৌঁছাতেই স্তম্ভিত হয়ে উঠল সে। দিশানি স্তব্ধ হয়ে রইল কিছুটা মুহূর্ত। খানিক বাদে দিশানি মেহেরের পিঠে আস্তে করে বারি দিয়ে বলতে লাগল,
–আচ্ছা, তোকে আর বিরক্ত করব না। শুধু একটা কথা বলতে দে। হুম?
দিশানির কথার প্রত্যুত্তরে মেহের ঠোঁট জোড়া কিঞ্চিৎ প্রসারিত করে বলল,
-হু, বল।

তৎক্ষণাৎ অনুমতি পেয়ে দ্রুত ঠোঁট সংকুচিত করে দিশানি বলে উঠল,
–মেহের, তোর চুল গুলো দেখতে চাই। না করবি না প্লিজ। তুই তো স্কার্ফ পড়ে আসিস তাই তো দেখলাম না। শুধু একপলক দেখব। প্লিজ টিফিনের পর কমন রুমে গিয়ে দেখাবি। একবার,,,

দিশানির বাগযন্ত্র হতে নির্গত শেষোক্ত বাক্যটা মেহেরের কর্ণপাত হতেই হতভম্ব হয়ে উঠল সে। একরাশ দ্বিধা, সংকোচের উৎপত্তি ঘটল তার হৃদয় মনে। অতঃপর দিশানির মুখশ্রীতে বিহ্বল চাউনি নিক্ষেপ করে বিচলিত কন্ঠে বলে উঠল,
–সরি দিশু। দেখ, আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছে আজ টিফিন করন না। শুধু মাত্র পড়াগুলো কম্পলিট করব। আর তুই বলছি কমন রুমে যাওয়া কথা! তাছাড়া কত্ত ভিড় থাকে ওখানে। আমি যাব না।
মেহেরের কথার প্রেক্ষিতে দিশানি মন খারাপ করে বলে উঠল,

–আচ্ছা, তাহলে ছুটির পর?
দিশানির শেষের কথাটা শুনতেই খানিকটা চিন্তিত হয়ে উঠল মেহের। ছুটর পর তো তার জন্য সমুদ্র অপেক্ষা করবে। যদি লেট হয়ে যায় তাহলে তো তার ভাগ্যে দুঃখের শেষ নেই। বিষয়টা ভাবতেই অসীম জড়তার আবির্ভাব ঘটল। পুনরায় সে দিশানির মুখশ্রীতে দৃষ্টিপাত ফেলতেই সব চিন্তা ঝেড়ে ফেলে রাজি হয়ে গেল। চটজলদি উত্তর দিল,

–আচ্ছা ঠিক আছে তো। এখন আমাকে পড়তে দে।
মেহরের হ্যাঁ বোধক জবাব পেয়ে খুশি হয়ে পড়ল দিশানি। মেহেরকে এক কোণে বসিয়ে সে মাঝখানে বসে পড়ল। যেন তাদের আলাপে মেহরের পড়াই ডিস্টাপ না হয়।

মেহরেদের ক্লাসে সমুদ্র প্রবেশ করেছে মিনিট পাঁচেক পূর্বে। ক্লাসে আসতেই তার দৃষ্টি সর্বপ্রথম পড়ছে মেহেরের মুখশ্রীতে। আজ ও মেহের তিতাসের সঙ্গে একই বান্চে বসেছে। বিষয়টা দৃশ্যমান হতেই সমুদ্র মেজাজটা বেশ বিগরে গিয়ছে। মেহেরকে সে বারণ করে দিয়েছি যেন তিতাসের সঙ্গে না থাকে। কিন্তু মেয়েটা তার কথার অবাধ্য হয়েছে। প্রথমে বিষয়টা সমুদ্রের মস্তিষ্ক গুরুত্ব দেই নি। সমুদ্র ভেবেছে, মেয়েটা যার সঙ্গে ইচ্ছে তার সঙ্গে থাকুক। তার এতে কিছুই যাই আসে না। কিন্তু ক্লাসে সময় যত অতিবাহিত হচ্ছে, তার মস্তিষ্কে ততোটাই ক্রোধের আবিষ্কার ঘটছে। খানিক বাদেই আদিবা নামের মেয়েটা সমুদ্রকে ডাক দিল। তৎক্ষণাৎ সমুদ্র ধীর গতিতে আদিবার নিকটবর্তী এসে দাঁড়াল। কর্কশ স্বরে আদিবাকে জিজ্ঞেসা করল,

–কিছু বলবে?
–জী স্যার।
অতঃপর আদিবা মেহেরের দিকে ইশারা দিয়ে বলে উঠল,
— দেখুন স্যার, ওই মেয়েটা অন্য টিচারের হোম ওয়ার করছে। তার চেয়ে বড় কথা আপনার লেকচারে মনোযোগ দিচ্ছে না। আশা করি আপনি এই অপরাধের বিচার করবেন।

সমুদ্র আদিবার কথা মতো মেহেরের দিকে দৃষ্টিপাত নিক্ষেপ করল। কিছু বলে উঠার পূর্ব আকস্মিক সমুদ্রের ফোনটা শব্দ করে উঠল। সমুদ্র মেহেরকে কিছু না বলে ক্লাস রুম থেকে প্রস্থান করল। পকেট থেকে ফোন বের করতেই তার দৃশ্যমান হলো অহনা কল করেছে। মুহূর্তেই কল রিসিভ করে শক্ত কন্ঠে বলল,
–ফোন দিয়েছিস কেন?

সমুদ্রের কথার প্রত্যুত্তরে অপর প্রান্ত হতে অহনা বলে উঠল,
–ওই শুনছিস তো, আমারা আজকে দেশে ফিরেছি। তাই আমি চাচ্ছি মেহেরকে আজকে বিকেলে ছুটির পর স্কুল থেকে আমার বাসায় নিয়ে আসব। সো তুই মানসিক ভাবে প্রস্তুত হ। তুই যদি আমাকে বারণ ও করিস তাহলেও আমি কিন্তু শুনব না। স্কুল ছুটির আগেই আমি তোদের স্কুলে উপস্থিত থাকব। আচ্ছা বাই। তোকে বিরক্ত করার জন্য সরি।

অবিরাম কথাগুলো বলেই কল কেটে দিল অহনা। সমুদ্রের প্রত্যুত্তর জানার প্রয়োজন বোধ করেনি সে। অহনা বলা কথাগুলো শুনে একরাশ বিরক্তির আবির্ভাব ঘটেছে সমুদ্রের মুখশ্রীতে। অবশেষে তপ্ত শ্বাস ত্যাগ করে ক্লাস রুমে উপস্থিত হলো সমুদ্র। পরিশেষে আদিবার কথার পরিপ্রেক্ষিতে সমুদ্র শক্ত কন্ঠ মেহেরকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠল,
–স্টান্ড আপ মেহের!

হঠাৎ সমুদ্রের কন্ঠস্বর মেহেরের কর্ণপাত হতেই কেঁপে উঠল সে। মুহুর্তে বই থেকে দৃষ্টি সরিয়ে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে পড়ল সে।
মেহেরের পরিস্থিতি দেখে সমুদ্র তার হাত ঘরির দিকে একপলক দৃষ্টিপাত ফেলে গম্ভীর কন্ঠে বলে উঠল,

–দাঁড়িয়ে থাকো ক্লাস শেষ না হওয়া পর্যন্ত।
মেহেরকে শাস্তি দিতে সমুদ্রের মন না চাইলেও একপর্যায়ে মস্তিষ্কের কথা শুনতে বাধ্য হলো সে। এটাই একমাত্র উপায় যা তার রাগ নিমন্ত্রণ করতে সফল হবে।

স্কুল ছুটি দিয়েছে খানিক পূর্বে। পুলকিত মন নিয়ে একটা ফাঁকা রুমে এসেছে মেহের, তিতাস এবং দিশানি। সমুদ্রের দেওয়া শাস্তি সম্মুখীন হয়েও মেহের বর্তমানে বড্ড আনন্দিত। কারণ মেহেরের আজকের পরীক্ষা খুব ভালো হয়েছে। তার ধারণা মতো রেজাল্টে সে সম্পূর্ণ মার্কস পাবে। তাই আনন্দিত মনে দিশানির সঙ্গে ফাঁকা রুমে এসে উপস্থিত হয়েছে সে।

স্কুলে ছুটির পর তন্নতন্ন করে মেহের কে খুঁজে চলছে সমুদ্র। তখন মেহেরকে শাস্তি দেওয়াতে তার অন্তরালে ক্ষোভ ও ধিক্কারের উপস্থিত ঘটেছে। মেয়েটা তো অসুস্থ ছিল। তাছাড়া এখনো মেহের সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠে নি। এমন অবস্থায় তাকে এভাবে শাস্তি দেওয়া একদম উচিত হয়নি সমুদ্রে। এক কথাই সমুদ্র নিজ কৃতকর্মে বড্ড অনুতপ্ত।

তার হৃদয় গহীন পিপাসীত হয়ে উঠেছে মেহেরকে একপলক দেখার জন্য। তাই মেহেরকে খুঁজে চলছে সে। কিছুদূর অতিক্রম করতে সমুদ্র দৃশ্যমান হয় তিতাস কে। তৎক্ষণাৎ দ্রুত পদে ক্লাস রুমটার সামনে উপস্থিত হয় সে। তিতাসের মুখশ্রীতে মনোযোগ সহকারে খানিকক্ষণ পর্যবেক্ষণ করে সমুদ্র। লহমায় তার শরীরে অত্যধিক রাগ এসে হাজির হয়। শরীরের শিরা উপশিরাতে রক্ত চলাচল দ্বিগুণ হারে বেড়ে যায়। তিতাস তাকে দেখে কিছু বলে উঠার পূর্বে রুমের ভেতরে প্রবেশ করে সে।

তুমি নামক অনুভূতি পর্ব ২৫

ক্লাসে ভেতরে উপস্থিত হতেই সমুদ্র দৃশ্যমান হলো লম্বা চুলের অধিকারী মেহেরকে। মুহূর্তেই সমুদ্রের শরীর রাগে থরথর করে কাঁপতে আরম্ভ করল। মেহেরের পরিস্থিতি দেখে তার মস্তিষ্ক কার্যকর ক্ষমতা হারিয়ে ফেলল। অত্যধিক রাগে সাংঘাতিক কান্ড করে বসল সে। ক্রোধের বসে নিজের সমস্ত শক্তি দিয়ে মেহেরের ডান গালে হঠাৎ থাপ্পড় দিয়ে বসল।
থাপ্পড়টা এতোটাই শক্তিশালী ছিল যে মেহের তাল সামলাতে না পেরে ফ্লোরে উপর আঁচড়ে পড়ল।

তুমি নামক অনুভূতি পর্ব ২৭