তুমি নামক অনুভূতি পর্ব ৩৩

তুমি নামক অনুভূতি পর্ব ৩৩
Lutful Mehijabin (লেখা)

তৎক্ষণাৎ রুমের মধ্যে উপস্থিত হলো আকাশ। বাইরে থেকে তড়িঘড়ি এসেই সমুদ্রের উদ্দেশ্যে বলে উঠল,
–ভাবির জন্য এনেছিস বুঝি? ভাবি খাইনি?
আকাশের বলা কথাগুলো শুনে রিয়ার চোখ জোড়া আপনা আপনি বৃহত্তর আকার ধারণ করে উঠল। রিয়ার বিষ্ময়কর মুখশ্রী সমুদ্রের চোখের আড়াল হলো না। মুহূর্তেই আকাশের দিতে কটমট দৃষ্টি নিক্ষেপ করল সে।

সমুদ্রের চোখের ভাষা পড়তে খানিক সময় লাগল আকাশের। সঙ্গে সঙ্গে ভয়ে শুকনো ঢোক গিলল। একপকল রিয়ার দিকে তাকিয়ে ফির ফিক করে হেসে উঠলো। অতঃপর পরিস্থিতিতে স্বাভাবিক করতে হাসির সহিত বলল,
–ওহ সরি ,আমি তো ভেবেছিলাম তুই ভাবির জন্যে খাবার এনেছিস। আচ্ছা তুই তোর পুচকি কে খাওয়া। আমরা আসি। রিয়া কাম উইথ মি।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

বলেই আকাশ রুম থেকে ধীরগতিতে প্রস্থান করল। রিয়া বাকরুদ্ধ হয়ে অবাকের সহিত বাধ্য হয়ে বেরিয়ে গেল। আকাশের বলা বাক্যগুলো তার মস্তিষ্কে প্রবেশ করতে ব্যর্থ হয়েছে। মেহেরকে নিয়ে তার অন্তরালে একরাশ প্রশ্নের উৎপত্তি ঘটেছে। বিষয়টা নিয়ে সে বেশি একটা নাক গলানোর সাহস পেল না। কারণ সমুদ্র স্যারের কাজ কর্ম হাবভাব সবকিছুই তার নিকট রহস্যময় মনে হয়। তার ধারণা সমুদ্র একজন কঠোর, বদমেজাজি, হৃদয় হীন ব্যক্তি। যে কখনোই কাউকে ভালোবাসতে পারে না। বিশেষ করে মেয়েদের তো সমুদ্র পাত্তা দেয় না। রিয়া মনে প্রাণে বিশ্বাস করে, তার সমুদ্র স্যার কোনদিন কোন‌ নারীর প্রেমে পড়বে না। কখনোই না, একদমই না। তার মতে সমুদ্র অনুভূতিহীন নির্বাক। যার অন্তরালে অনুভুতির জন্ম নেওয়া অসম্ভব!

আকাশরা চলে যাবার পর, সমুদ্র দ্রুত বেগে দরজা বন্ধ করে দিলো। অতঃপর পরপর দুটো স্বস্তির নিঃশ্বাস ত্যাগ করে মেহেরের নিকট ধাবিত হলো। মেহের হতে স্বল্প দূরত্বে বজায় রেখে, কর্কশ গলায় বলে উঠলো,
–দাঁড়িয়ে আছো কেন? যাও গিয়ে চুপচাপ বিছানায় বসো।
সমুদ্রের আদেশ পাওয়া মাত্রই মেহের বিছানার উপর নতজানু হয়ে বসে পড়ল। তার কেমন যেন অস্তিত্ব হচ্ছে। সমুদ্র টেবিলের উপর থেকে খাবারের প্লেট নিয়ে মেহেরের হাতে দিলো। অতঃপর মেহেরের মুখশ্রীতে শক্ত দৃষ্টিপাত আবদ্ধ করে বলল,

–ফিনিস ইট!
মেহের খাবারগুলো দেখে দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করল। অসম্ভব অস্তিত্ব হচ্ছে তার সমুদ্রের সামনে খেতে। এতো দিন সে কতোবার সমুদ্রের সামনে খেয়েছে, কই তখন তো এমন‌ অস্বাভাবিক লাগে নি! তাহলে এখন এমন অদ্ভুত অস্তিত্ব হচ্ছে কেন? মেহেরের পরিস্থিতি লক্ষ্য করে সমুদ্র তার অচঞ্চল চোখ জোড়ার দৃঢ় দৃষ্টি সরিয়ে নিলো। নিজেকে স্বাভাবিক রাখার উদ্দেশ্যে প্যকট থেকে ফোন বের করে মনোযোগ সহকারে স্কোল করতে লাগল।

ইসতার বেগমের ঘুমন্ত মুখশ্রীতে ছলছল দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে জারা। আজ জারার মন‌ মানসিকতা একদমই ভালো নেই। বড্ড ব্যথিত হয়ে উঠেছে তার হৃদয় গহীন। হঠাৎ তার শাশুড়ি আম্মু খানিকটা দুর্বল হয়ে পড়েছে। দুপুরবেলা সেন্স লেস হয়ে পড়েন তিনি। এর ফলে দুশ্চিন্তার উৎপত্তি ঘটেছে জারার হৃদয়মনে। সকাল থেকেই তার শাশুড়ি আম্মুর অভিপ্রায় জেগেছিল , বড় ছেলে সমুদ্রের কন্ঠস্বর কর্ণপাত করার।

অত্যধিক শখ জেগেছিল একটি বারের জন্য ছেলেটার মুখশ্রী দর্শন করার। জারা দিশেহারা হয়ে পড়েছে, একদিকে তার পুরোনো বিষাক্ত অতীত পুরনায় হাজির হয়েছে। অন্যদিকে তার শাশুড়ির অসুস্থতা। মনের দিক দিয়ে ভেঙে পড়েছে সে। একথাই বাজে পরিস্থিতির স্বীকার হয়েছে।

অবিরাম ইয়াদের মোবাইলে কল করে যাচ্ছে জারা। কিন্তু ইয়াদ কল রিসিভ করার প্রয়োজন বোধ করছে না। এর ফলে অতিরিক্ত কান্না পাচ্ছে জারার। তার যে এখন‌ ইয়াদের কন্ঠস্বর শুনা খুব প্রয়োজন! বর্তমানে তার অন্তরাল অস্থির হয়ে উঠেছে ইয়াদকে একটিবারের জন্য দেখতে। বর্ষন নামক খারাপ লোকটার স্মিতি মস্তিষ্ক থেকে মুছে ফেলাল একমাত্র মাধ্যম যে ইয়াদ।

ইয়াদের ফোন রিসিভ না করাতে, অজান্তেই জারার চোখ যুগল থেকে দুফোঁটা দুর্বোধ্য রহস্য টপটপ করে ধরণীর বুকে বিসর্জিত হলো। তৎক্ষণাৎ চোখের অশ্রু মুছে ফেলল সে। নিজেকে স্বাভাবিক করে কল লিস্ট থেকে রাফুর নম্বরে ফোন করল। সেকেন্ড পাঁচেক পরেই তার কর্ণকুহরে পৌঁছাল রাফুর কন্ঠস্বর,

–জারা কেমন আছো?
জারা কন্ঠস্বর স্বাভাবিক রেখে বলল,
–ভালো আপনি?
–ভালো। কিছু হয়েছে কী? হঠাৎ ফোন‌ দিলে যে?
রাফুর প্রত্ত্যুরে জারা মলিন কন্ঠে বলে উঠলো,
–ভাইয়া , আম্মু হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েছে। আজ অজ্ঞান হয়ে পড়েছিল‌।

জারা কথাগুলো শুনে ক্রোধে ফুঁসতে লাগল রাফি। কন্ঠস্বরে রাগ স্পষ্ট রেখে বলল,
–আবার নিশ্চয়ই ইয়াদ কিছু একটা করেছে। ছেলেটা কি কখনোই মানুষ হবে না!
রাফু বলা বাকগুলো শুনে‌ স্তম্ভিত হয়ে উঠল জারা। সবকিছুই তার নিকট বিষাদময় লাগছে। ইয়াদ কী করেছে যার জন্য তার শাশুড়ি আম্মু অসুস্থ হতে পারে? জারা তড়িৎ বেগে রাফুকে জিজ্ঞাসা করল,

–ভাইয়া ,ইয়াদ কী করেছে?
রাফু জারা প্রশ্নের জবাবে বলে উঠলো,
–তুমি হয়তো শুনলে অবাক হবে যে আজ ইয়াদের জন্য মামি বাকশক্তি হারিয়েছে। সুস্থ স্বাভাবিক মামিটা ওর জন্যে কথা বলতে পারে না। তুমি হয়তো লক্ষ্য করেছ, সমুদ্রের সঙ্গে ইয়াদের সম্পর্ক একদমই ভালো নয়। ওরা‌ দু জন সবসময় একে অপরের থেকে আলাদা থাকে। জানো কেন?
জারা অবাকের সহিত বলল,

–কেন ভাইয়া?
–কারন‌ সমুদ্রের ধারণা ইয়াদের পাগলামির কারনেই মামি স্টোক করেন। শুধু ওর ধারণা বললে ভুল হবে অমিও তাই জানি।
শেষোক্ত বাক্যটা কর্ণপাত হতেই বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েছে জারা। সে যেন ক্রমশ কথা বলার শক্তি হারিয়ে ফেলেছে! জারার স্তব্ধতা লক্ষ করে রাফু শীতল কন্ঠে বলল,
— জিজ্ঞাসা করবে না কেন ইয়াদ পাগলামির করতো?
রাফুর প্রত্ত্যুরে জারা অস্ফুট স্বরে বলল,
–কেন ভাইয়া?বলুন না!

রাফু তপ্ত শ্বাস ত্যাগ করল। স্বল্প সময় নিরবতা পালন করে বলল,
–কারনটা শুনলে তুমি সহ্য করতে পারবে না।
রাফুর বলা ছোট্ট বাক্যটা শুনে জারা বুকের ভেতর অস্থির হয়ে উঠল। উত্তেজিত গলায় বলে উঠল,
–প্লিজ ভাইয়া, বলুন না।
রাফু জারার প্রত্যুত্তরে দাঁতে দাঁত চেপে বলতে লাগল,

–প্রায় বছর দুয়েক আগের ঘটনা। একটা মেয়েকে অত্যধিক ভালোবাসাতো ইয়াদ। মেয়েটা কে এতোটাই ভালোবাসাত যে, ওর জন্য ইয়াদ চোখ বন্ধ করে মরতেই রাজি ছিল। কিন্তু মেয়েটা একটা বিশ্বাস ঘাতক। ও কখনোই ইয়াদকে ভালোবাসেনি। সবকিছু ওদের মধ্যে ঠিক ঠাক ছিল। হঠাৎ একদিন ইয়াদ খবর পায় মেয়েটা অন্য একজন ছেলের সঙ্গে রিলেশনে যুক্ত। সেদিন থেকেই ইয়াদ পাগলামি শুরু করে দেয়।

তার কিছুদিন পর আমারা খবর পাই মেয়েটার বিয়ে হয়ে গিয়েছে। তারপর থেকেই ইয়াদ নিজেকে শেষ করে দিতে মত্ত হয়ে পড়ে। সবার সঙ্গে ইয়াদ উন্মাদ পাগলালের মতো অস্বাভাবিক আচরণ করতে শুরু করে। ইয়াদের এই পাগলামি মামি সহ্য করতে পারেন নি। তাই,,

রাফুর কন্ঠস্বর হতে নির্গত বাক্যগুলো কর্ণপাত হতেই জারার হাত থেকে ফোনটা পড়ে যায়। স্তম্ভিত হয়ে পড়ে সে। তার বুকটা ফেটে যাচ্ছে। হৃদয় গহীন ঝড় রাত্রির উত্তাল সমুদ্রের ন্যায় অশান্ত, অস্থির হয়ে উঠেছে। তার গলার কোথাও একটা কান্না দলা পাকিয়ে আটকে আসছে। প্রচুর কান্না পাচ্ছে জারার। তার হৃদয় স্পন্দন তৎক্ষণাৎ তড়িৎ বেগে ছুটতে আরম্ভ করেছে।প্রচন্ড অস্থির লাগছে! না চাইতেও তার বলতে বড্ড ইচ্ছে করছে, ইয়াদ একমাত্র তার। তাকে ছাড়া অন্য কাউকেই ইয়াদ ভালোবাসাতে পারে না। তা হকো অতীত কিংবা বর্তমান।

খাওয়া শেষ করে নিশ্চুপ হয়ে বসে রয়েছে মেহের। তার এখন বমি বমি ভাব অনুভব হচ্ছে। জোর করে সমুদ্র তাকে খাইয়েছে। খাবার খানিকটা বাকি রেখেছিস সে। কিন্তু সমুদ্র তাকে এমন একটা শর্ত দেয় যে, অবশেষে পুরোটা খেতে বাধ্য হয় সে।

বর্তমানে মেহের নাজেহাল পরিস্থিতি দেখে, সমুদ্রের ঠোঁটের কোণে কিঞ্চিৎ হাসির রেখে ফুটে উঠেছে।
লহমায় আকাশের কল পেয়ে উঠে দাঁড়িয়ে পড়ল সমুদ্র। তাদের এসিপি স্যারের আগমন ঘটেছে অনুষ্ঠানে। তাই তৎক্ষণাৎ আকাশ তাকে ড্রইং রুমে উপস্থিত হতে বলেছে। সমুদ্র রুম থেকে বের হওয়া উদ্দেশ্য যাওয়ার পূর্বে হঠাৎ মেহেরের নিকট চলে এলো। মেহের নতজানু হয়ে বসে রয়েছে। একরাশ লজ্জার আবির্ভাব ঘটেছে তার হৃদয় গহীনে। মুহূর্তেই সমুদ্র মেহেরের উদ্দেশ্য গম্ভীর কন্ঠে বলে উঠলো,

–ভালোই তো আমাকে খাইয়ে দিতে হবে দেখে, খাবারটা সমাপ্ত করলেন আপনি। মনে রাখবেন ম্যাম, আজকে জোর করেনি আমি। বাট সময় হলে আপনি আমাকে খাইয়ে দিতে বাধ্য হবেন। আই হোপ উয়ার আন্ডারস্টান্ড!
সমুদ্রের বলা বাক্যগুলো মেহেরের কর্ণকুহরে পৌঁছনো মাত্রই তার শান্ত হৃদয় অশান্ত হয়ে উঠেছে। এতো শীতল পরিবেশেও বারংবার ঘেমে উঠছে সে! মেহের নিজের পরিস্থিতি সামালানোর পূর্বে পুনরায় সমুদ্র দাঁতে দাঁত চেপে বলে উঠল,

তুমি নামক অনুভূতি পর্ব ৩২

–লুক এ্যাট মি পুচকি!
মুহূর্তেই মেহের ভয়ে চোখ জোড়া খিচে বন্ধ করে ফেলল। সমুদ্রের ফির কটমট করে বলে উঠল,
–এই যে কান খুলে শুনে রাখ পুচকি, আমি কিন্তু নিজের কোন কিছুতে অন্যের দৃষ্টি একদমই পছন্দ করি না। তাই এভাবে সেজেগুজে ঘুরে বেরোবে না। আমি যদি আবার তো,,,

তুমি নামক অনুভূতি পর্ব ৩৪