তুমি নামক অনুভূতি পর্ব ৩৪

তুমি নামক অনুভূতি পর্ব ৩৪
Lutful Mehijabin (লেখা)

–লুক এ্যাট মি পুচকি!
মুহূর্তেই মেহের ভয়ে চোখ জোড়া খিচে বন্ধ করে ফেলল। সমুদ্রের ফির কটমট করে বলে উঠল,
–এই যে কান খুলে শুনে রাখো পুচকি, আমি কিন্তু নিজের কোন কিছুতে অন্যের দৃষ্টি একদমই পছন্দ করি না। তাই এভাবে সেজেগুজে ঘুরে বেরোবে না। আমি যদি আবার তোমাকে বাইরে ঘুরতে দেখি তাহলে আমার চেয়ে খারাপ আর কেউ হবে না।

কথাগুলো বলেই এক মুহূর্তের জন্যও দেরি করল না সমুদ্র। মুখশ্রীতে গম্ভীরতা স্পষ্ট রেখে, পা যুগল ধাবিত করল ড্রইং রুমের উদ্দেশ্যে। সমুদ্রের প্রস্থান করার পর, মেহের যেন ব্যাপক স্বস্তির মাখা নিশ্বাস ত্যাগ করল। কেমন অদ্ভুত একটা অনুভূতি তাকে গ্রাস করে নিচ্ছে ক্ষণে ক্ষণে। মস্তিষ্ক যেন নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে! এ অনুভূতির গোপন কথা সে যদি ভুলে একবারও সমুদ্রের নিকট প্রকাশ করে, তাহলে বোধহয় সমুদ্র ভেবে বসবে এই বুঝি এক অবুঝ কিশোরীর বয়সের দোষ!

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

পিয়াস রহমানের সামনে মাথা নিচু করে বসে রয়েছে তিতাস। মেহেরকে আর একটি বারের জন্যও দেখতে পাইনি সে। তাই বিরক্তি যেন ভীষণভাবে তাকে ঘিরে ধরছে। বাবার পাশে থেকে উঠার জন্য ছটফট করছে। কিন্তু সাহস হচ্ছে না।
পায়ের উপর পা তুলে সোফায় বসে রয়েছেন শোয়াইব খান। তার নিকটবর্তী বসে রয়েছে নির্মল বর্ণের এক সুন্দরী রমণী। মেয়েটার পরনে ওয়েস্টান পোশাক। মেয়েটা বেশ লম্বা। তার চোখ জোড়া স্বল্প ধূসর বর্ণের।

এক কথাই অপরূপ সৌন্দর্যের অধিকারী নারী! অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছোট্ট বড় সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে মেয়েটা সক্ষম। মিষ্টি হাসি যেন মেয়েটার ঠোঁটের কোণে ঝুলে রয়েছে। তার এই সামান্য হাসিটুকু যেন কারো হৃদয় গেঁথে যাবার ক্ষমতা বহন করে। সত্যিই সে অত্যধিক সুন্দর। শোয়াইব খানের সঙ্গে কথা বলায় ব্যস্ত ছিল মেয়েটা। তৎক্ষণাৎ ড্রইং রুমে উপস্থিত হয় সমুদ্র। আকস্মিক সমুদ্রের উপস্থিতিতে মেয়েটা তার দৃঢ় দৃষ্টিপাত ফেলল সমুদ্রের মুখশ্রীতে। সমুদ্র তাদের কাছে পৌঁছানোর পূর্বে, শোয়াইব খান মেয়েটার উদ্দেশ্যে ঠোঁট জোড়া কিঞ্চিৎ সংকুচিত করে বললেন,

–সাকিলা!
সাকিলা তির্যক দৃষ্টিতে সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে রইল। সমুদ্র শোয়াইব খানের সামনে আসতে সাকিলা সোফা থেকে দাঁড়িয়ে পড়ল। অতঃপর মুচকি হেসে সমুদ্রের দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল,
–কেমন আছেন সমুদ্র?
তৎক্ষণাৎ সমুদ্র একপলক সাকিলা দিকে তাকিয়ে ফির দৃষ্টি সরিয়ে নিলো। সাকিলা প্রত্যুত্তরে গম্ভীর কন্ঠে বলল,
–গুড! হু আর ইউ?

সাকিলা কিছু বলে উঠার আগেই শোয়াইব খান বলে উঠলেন,
–ও হচ্ছে সাকিলা। তোমার মনে নেই! আমার বন্ধুর মেয়ে। সি ইজ ইউয়ার উডবি ওয়াইফ।
বলেই শোয়াইব খান আট্টহাসিতে ফেটে পড়েন। শেষোক্ত বাক্যটার শুনে সমুদ্র বেশ বিরক্ত। কথাটার গুরুত্ব দিল না সে। সাকিলাকে উপেক্ষা করে শোয়াইব খানকে জিজ্ঞেস করল,

–ওহহ, বাই দ্যা ওয়ে স্যার । খেয়েছেন?
সমুদ্রের প্রত্যুত্তরে শোয়াইব খান বলে উঠলেন,
–না। খাবার খেতে এসেছি কি! পরে খেলেও চলবে।
–ওকে স্যার।

সমুদ্রের মোবাইল ফোনের দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে মেহের। বারংবার বেজে উঠছে সমুদ্রের ফোনটা। বোধহয় সমুদ্র ভুলে রেখে গিয়েছে! এতে করে অত্যধিক অস্বস্তির স্বীকার হচ্ছে মেহের। যদি সমুদ্রের দরকারী কল হয় তাহলে? ফোনের দিকে তাকিয়ে রইলেও কে কল দিয়েছে তা দেখবার সাহস জুটেছে না তার হৃদয় গহীনে। কি রয়েছে ফোনটাতে? কারো ফোন দেখতে কি এতো সুন্দর হয়? ফোনটা মেহেরের নিকট বড্ড স্পেশাল।

তার মনে হচ্ছে ফোনটা কোন জড়ো পদার্থ নয়, বরং তার হৃদয় গহীন বারংবার বলে হচ্ছে ফোনটাতে যেন সমুদ্রের প্রতিচ্ছবি রয়েছে। হাস্যকর বিষয়! মেহের সমুদ্রের ফোনটা স্পর্শ করতে ভয় পাচ্ছে। মনে হচ্ছে স্পর্শ করলেই সমুদ্র কর্কশ ভাষা ভেসে উঠবে। কথাগুলো ভাবতেই মুচকি হাসি রেখা ফুটে উঠেছে মেহেরের ঠোঁটের কোণে। ইশ! কতো সুন্দর দেখতে ফোনটা। তৎক্ষণাৎ ফোনটা পুনরায় বেজে উঠলো।

মেহের কম্পনিত হাত জোড়া দিয়ে ফোনটা তুললো। মুহূর্তেই তার বুকের ভেতর অদ্ভুত অনুভূতির উদ্ভট ঘটলো। হাত জোড়া শীতল হয়ে উঠেছে! দু হাতের সাহায্যে ধরা সত্ত্বেও তার হাত থেকে ফোনটা পড়ে যাবার উপক্রম। মেহেরের এই পরিস্থিতি দেখলে যে কেউ বলল, মেয়েটা হয়তো ফোন ধরতেই জান না! কম্পনিত হাতে ফোনটা নিয়ে পা জোড়া ধাবিত করল সমুদ্রের নিকট যাবার উদ্দেশ্যে। সমুদ্র তাকে যা ইচ্ছে তাই বলুক, সে বের হবেই। নিশ্চয়ই গুরুত্বপূর্ণ কল এসেছে। তাই তো বিরতিহীন ভাবে বেজেই চলছে।

আকাশের সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনায় ব্যস্ত ছিল সমুদ্র। তাদের আলোচনার মূল বিষয় হচ্ছে আজকের অনুষ্ঠানে যেকোন সময় ভয়াবহ ঘটনা ঘটে যাবার আশঙ্কা। তাদের কাছে ইনফরমেশন এসেছে, তিন মাস ব্যাপী চলমান কেসটার মূল অপরাধী এই অনুষ্ঠানে উপস্থিত। এতে বেশ চিন্তির আবির্ভাব ঘটেছে সমুদ্রের অন্তরালে। চিন্তার কারনটা হয়তো স্বাভাবিক। এই বাড়ির প্রতিটি সদস্য থেকে শুরু করে তার পুচকিরও জীবনের ঝুঁকি রয়েছে। যে কোন সময় তাদের উপর এট্যাক হতে পারে। বিষয়গুলো চিন্তা করতে করতে পাইচারি করছে সমুদ্র। কপালে দু আঙুল রেখে নিস্তবদ্ধতা পালন করছে সে। কিন্তু লহমায় তাদের নিস্তবদ্ধতা ভেঙে আকাশ বলে উঠল,

–সমুদ্র দেখ, আমার তো মনে হয় লোকটা যে কোন সময় আমাদের উপর আক্রমণ করতে পারে। আমি নিশ্চিত অপরাধী বুঝে গিয়েছে যে আমাদের পুরো টিম এখানে। আমার তো ভয় হচ্ছে।
আকাশের কথার প্রত্যুত্তরে সমুদ্র বলে উঠল,

–আমার তো মনে হয় না অপরাধী এতোটাও কান্ডজ্ঞানহীন। লোকটা ভীষণ চালাক। তারপরেও আমাদের সতর্ক থাকতে হবে। আমারা যদি একটু এদিক সেদিক পা ফেলি তাহলে যে কোন অঘটন ঘটে যেতে পারে। সবাইকে ইনফরমেশন দিয়ে দে। আর হ্যাঁ শোন, তোর ভাবি, অহনা এবং অহনার ছেলের সবার সেফটির ব্যবস্থা কর। বিশেষ করে আমি তোর ভাবিকে নিয়ে কোন রিক্স নিতে চাইছি না।

সমুদ্রের কথাগুলো কর্ণপাত হতেই আকাশের ঠোঁট জোড়া কিঞ্চিৎ ফাঁক হয়ে উঠল। বারংবার তার কর্ণকুহরে প্রতিধ্বনি হতে লাগল ‘ভাবি’ শব্দটা। ভাবি শব্দটার তার নিকট অস্বাভাবিক লাগে। বিশেষ করে সমুদ্রের মুখ থেকে। যে লোক কিনা মেয়েদের সহ্য করতে পারে না। কারো সঙ্গে তেমন একটা কথা বলতে পছন্দ করে না। সবসময়ই স্তব্ধ, রাগী, গম্ভীর মুখশ্রী নিয়ে চলাফেরা করে। সেই লোকটার মুখে মেহেরকে তার কাছে ভাবি বলে উপস্থাপন করাটা বেশ অবাকের বিষয়। আকাশে নিজেকে স্বাভাবিক করে অবাকের সহিত সমুদ্রকে জিজ্ঞেসা করল,

–এই তোর কী হয়েছে রে? তুই ভাবিকে মেনে নিয়েছিস? কয়েকদিন আগেও যাকে বয়সে ছোট বলে অপমান করতি। যাকে স্ত্রী হিসেবে মানতে তোর ইগোতে বাঁধতো আজ তাকেই কিনা তুই নিজের বউ হিসেবে মেনে নিলি। আর ইউ ওকে? রিয়েলি আই কান্ট বিলিভ!

আকাশের বলা বাক্যগুলো সমুদ্রের কর্ণকুহরে পৌঁছনো মাত্রই চোখ যুগল ছোট ছোট করে ফেলল সে। তার কপালে যেন সুক্ষ্ম ভাঁজ স্পষ্ট ফুটে উঠেছে। আকাশে কথার প্রত্যুত্তরে চোখের গরম চাহনি নিক্ষেপ করল সমুদ্র। কিন্তু আকাশ বিষয়টা পাত্তা না দিয়ে ভ্রূ যুগল কুঁচকে, ফির সমুদ্রের দিকে জিজ্ঞেসা সূচক দৃষ্টি ফেলে বলে উঠল,

–তুই কী ভাবির প্রেমে পড়েছিস?
আকাশের কথার উত্তরে সমুদ্র দাঁতে দাঁত চেপে বলে উঠল,
–কি আছে ওই পুচকিতে যে আমি ওর প্রেমে পড়ব? অসম্ভব!
কথাগুলো বলেই জড়ে জড়ে নিশ্বাশ ত্যাগ করল সমুদ্র অতঃপর চোখ জোড়া বন্ধ করে বলে উঠল,

–দেখ, আমি জানি না প্রেম ভালবাসা কী? আমি শুধু এতটুকু জানি,,,,
বাক্যগুলো সমাপ্ত করার পূর্বে আকাশের ফোন বেজে উঠল। তৎক্ষণাৎ আকাশ ফোন রিসিভ করল। অতঃপর কল কেটে সমুদ্রকে বলে উঠল,

–এসিপি স্যার ফোন দিয়েছেন। সে তোকে খুঁজছে। তোর ফোন হয়তো সাইলেন্ট করা। আজেন্ট কাজ বোধহয়। তুই যা।
লহমায় সমুদ্র দ্রুত পদে পা সংকুচিত করে, ড্রইং রুমে উপস্থিত হলো। অবশেষে শোয়াইব খানের নিকটবর্তী পৌঁছয়ে সম্মানের সহিত বলে উঠল,
–স্যার কী হয়েছে, আর ইউ ওকে? কোন সমস্যা?
সমুদ্রের প্রত্যুত্তরে শোয়াইব খান মুচকি হেসে বললেন,

–ইয়াস, আই এ্যাম ওকে। তুমি একটু সাকিলাকে নিয়ে ওয়াশরুমের দিকে নিয়ে যাও তো। ওর ড্রেসটা জুস পড়ে নষ্ট হয়ে গিয়েছে। তাই ওয়াশ করার দরকার। তুমি যাও, কুয়িক। না করবে না কিন্তু। না শব্দটা আমার একদমই পছন্দ নয়।
শোয়াইব খানের মুখের উপর কোন কথা বলতে পারল না সমুদ্র। তার অন্তরাল যেন বিরক্তিতে ভর্তি হয়ে উঠেছে। অতঃপর সাকিলাকে নিয়ে ওয়াশরুমে দিকে ধাবিত হলো সে।

সমুদ্রের পিছু পিছু সাকিলা এগুতে লাগল। তার চোখে মুখে আনন্দের আভাস স্পষ্ট! বারংবার সমুদ্রের সঙ্গে কথা বলার জন্য ব্যাকুল প্রত্যাশা করছে সে। হঠাৎ তার মস্তিষ্কে খারাপ উদ্দেশ্যর উৎপত্তি ঘটল। লহমায় সে আচমকা সমুদ্র হাত টেনে ধরল। বাঁকা হাসির সহিত সমুদ্রের হাত স্পর্শ করে নিম্ন কন্ঠে বলে উঠল,

–হেই মিস্টার সমুদ্র! আপনি এতো গম্ভীর কেন? জানেন আপনার এই গম্ভীরতাতে আপনাকে বেশ মানায়। পারফেক্ট বয়, আই লাভ ইউ।

কথাগুলো সমুদ্রের কর্ণকুহরে পৌঁছনো মাত্রই স্তম্ভিত হয়ে পড়ল সে। সাকিলাকে কিছু বলার জন্যে অগ্নি যুক্ত চোখ জোড়া দৃষ্টি সাকিলার মুখশ্রীতে ফেলল। মুহূর্তেই কিছু বলে উঠার পূর্বে সমুদ্রের দৃশ্যমান হলো মলিন মুখশ্রীর অধিকারী তার পুচকি অর্থাৎ মেহেরকে। তার ফোনটা হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে মেহের। চোখে মুখে ফ্যাকাসে ভাবটা প্রকাশ পাচ্ছে।

তুমি নামক অনুভূতি পর্ব ৩৩

সমুদ্র গভীর দৃষ্টিতে মেহেরের দিকে তাকিয়ে রইল। মেয়েটা এমন পরিস্থিতিতেও মুচকি হেসে তার নিকট এগিয়ে আসছে। বেশ রহস্যময় হাসি! এর পেছনে হয়তো লুকিয়ে রয়েছে এক পাহাড় সমান অবুঝ হৃদয়ের ব্যাপক বেদনা।

তুমি নামক অনুভূতি পর্ব ৩৫