তুমি নামক অনুভূতি পর্ব ৩৮

তুমি নামক অনুভূতি পর্ব ৩৮
Lutful Mehijabin (লেখা)

বারংবার জারার ফোনে একের পর এক মেসেজ আসছে। নোটিফিকেশন শব্দ তাকে জানান দিচ্ছে কেউ তার কথা স্মরণ করে বার্তা পাঠাচ্ছে! যতো বার শব্দ বেজে উঠছে ঠিক ততবারই ধ্বক করে উঠছে। ফোন স্কিনে দৃষ্টি নিক্ষেপ করার সাহস পাচ্ছে না সে। পাবেই বা কি করে, সে তো জানে কে তাকে মেসেজ দিচ্ছে। তার বর্ষণ বললে ভুল হবে, এখন হয়তো অন্য কারো। ছেলেটা সত্যি বড় নাছোড়বান্দা!

এ পর্যন্ত দশের অধিক ভিন্ন ভিন্ন নম্বর দিয়ে মেসেজ দিয়েছে তাকে। সবগুলো নম্বর ব্লক লিস্টে ফেলে দিয়েছে সে। কিন্তু এখন তার একদমই সাহস হচ্ছে না। মনটা যে একটুও ভালো নেই। রাফুর কথাগুলো বারবার তার কর্ণকুহরে প্রতিধ্বনি তুলছে! হিংসে তৈরি হয়েছে তার অন্তরে। পুনরায় জারার ফোনটা ছোট করে আওয়াজ তুললো। একপর্যায়ে বাধ্য হয়ে ফোনটা হাতে নিলো সে। আজ সে শর্ত ভেঙে ফেলবে।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

এতো দিন পরিষ্কার করে লিখে দিয়েছে, সে আর বর্ষণকে ভালোবাসে না। কিন্তু আজ সরাসরি বলবে। জারা কটকট দৃষ্টিতে ফোনের দিকে তাকিয়ে রইলো। জোড়ে জোড়ে নিঃশ্বাস ত্যাগ করে, বর্ষণের নম্বরে কল করল। কয়েক বার ফোন রিনিং হলো কিন্তু কেউ ফোন করল না। কিন্তু মিনিট পাঁচেক পর কল ভেসে উঠলো জারার ফোনে। তৎক্ষণাৎ শুকানো ঢোক গিলল সে। তার বক্ষ পিঞ্জরের হৃদয় স্পন্দন দ্বিগুণ হয়ে। অজানা আশঙ্কায় ভরে উঠেছে তার অন্তর! একরাশ সাহস জুটিয়ে ফোনটা রিসিভ করল সে। অতঃপর এক বাক্যে বলে উঠলো,

–কতোবার বললো , আমি আপনাকে ভুলে গেছি।আমাকে দয়াকরে আর ফোন দিবেন না।আমি অন্য কাউকে ভালোবাসি।
বলেই ফোনটা কেটে দিলো সে। অতঃপর ফ্লোরে হাঁটু ভাঁজ করে বসে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলো।

মিনিট দশেক পূর্বে সকিনা বেগমের বাড়িতে উপস্থিত হয়েছে সে। বিশ্রী নোংরা গলি মধ্যে একটা ক্ষুদ্র দোতলা বাড়িতে থাকেন সাকিনা বেগম এবং তার সতেরো বছর বয়সী একটা মেয়ে। তার মেয়ে এবার এস এস সি পরীক্ষার্থী। কিছুদিন পূর্বে সকিনা বেগমের স্বামীর অপ্র্যাশিত মৃত্যুতে পুরো পরিবারের উপর বড়ো আঘাত হানে। মেয়েটার পড়ালেখা একদম নষ্ট হয়ে যায়। তার উপর ঢাকা ছেড়ে হঠাৎ রংপুরে চলে আসাতে দু বেলা খাবার জুটেছে না তাদের।

পেটের টানে সমুদ্রের খোঁজ নিতে বাধ্য হয়েছেন সকিনা বেগম। বর্তমানে একটা ভাঙা ক্ষয় চেয়ারে বসে রয়েছে সমুদ্র। তার মুখের সামনে ভীতি গ্রস্ত মুখশ্রী নিয়ে টুলে বসে আছেন সকিনা বেগম। তার চোখে মুখে আতংক ফুটে উঠেছে। ভীষণ তটস্থ ও শঙ্কিত তিনি। সমুদ্রের মুখ দেখে তার চোখ জোড়া ছলছল করছে! সমুদ্র রাগে থরথর করে কাঁপছে। রাগ যেন তার শিরাই শিরাই! যে সামান্য বিষয়ে রেগে যায়, সে এতো বড় সত্যি কথা জেনেও নিশ্চুপ হয়ে রয়েছে। শক্ত চাহনিতে সকিনা বেগমের মুখশ্রীতে দৃষ্টিপাত আবদ্ধ করে রয়েছে সে। হঠাৎ সকিনা বেগম সমুদ্রের হা জোড়া শক্ত করে ধরলো। লহমায় কেঁদে উঠলেন তিনি। কাঁদতে কাঁদতে সমুদ্রকে বলছেন,

–আব্বা, আমাক মাফ কইরা দেও। মুই তোমাক কে দুক্ক দিবার চাই নাই।
সমুদ্রের সকিনা বেগমের বলা কথাগুলো শুনে চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়াল। বরাবরই সাকিনা বেগমের ভাষা তার নিকট লম্বা মনে হয়। চেষ্টা করেও সকিনা বেগমকে বইয়ের ভাষা অর্থাৎ শুদ্ধ ভাষা শেখাতে পারেনি। সর্বদা গ্রামের ভাষায় কথা বলেন। শত চেষ্টা করেও আঞ্চলিক ভাষা ত্যাগ করতে পারেন নি। শুদ্ধ ভাষায় সঙ্গে গ্রামের ভাষা মিশিয়ে কথা বলেন। সকিনা বেগম ফির দ্রুত গিয়ে সমুদ্রের হাত জোড়া ধরে কাঁদতে কাঁদতে বললেন,

–সুরি আব্বা, হামি(আমি) তোমার কথা শুনমু, শুদ্ধ কইরা কথা কমু‌। জানো, ওই চ্যাংড়া(ছেলে) ব্যাটাছাওয়া(পুরুষ) গুলি এটিকনে(এখানে) চলি আইছে। ওরা আমার বেটির(মেয়ের) পিছন‌ পিছন থাকে। আজ তো আমার মেয়েকে ওরা ডাংগাইছে(মেরেছে) আমাক তুমি ঢাকায় নিয়ে যাও।
সমুদ্র সকিনা বেগমের প্রত্ত্যুরে শক্ত গলায় বলল,

–তুমি আমাকে না বলে কেন এসেছো? তোমার তো উচিত ছিল আমাকে তোমার সব সমস্যা খুলে বলা। একে তো না বলে এসেছ তার উপর আমার পেইনড্রাইভ নিয়ে এসেছো তুমি। তুমি কী জান ওটা আমার জন্য কতোটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল। ওই ছেলেগুলো তোমাকে বলল আর তুমি চুড়ি করলে!
সাকিনা বেগম একটা শুকনো ঢোক গিললেন অতঃপর বললেন,

–মুই ভাবছি ওই কালা কলারের চাবির মতো দেখতে ওইটা তোমাক বিপদের কারণ। তাই নিয়ে আইছি। ভাবছি ওইডা না থাকলে তোমাক কোনো ক্ষতি হইব না। আর চলে আইছি কারন ওরা আমাকে ভয় দেখাইছিল। আমাক বাঁচাও তুমি আব্বা।

সকিনা বেগমের বলা বাক্য গুলো শুনে তপ্ত শ্বাস ত্যাগ করলেন সমুদ্র। গৃহকর্মী সকিনা বেগমের সাথে যে তার গভীর সম্পর্ক। একজন গৃহকর্মীকে মায়ের মতো ভালোবাসে সমুদ্র। সাকিনা বেগম নিজেও সমুদ্রকে অনেক ভালোবাসে। তাই সে বাধ্য হয়ে তিনি গ্রামে চলে এসেছেন। কিন্তু এসেইও কোন লাভ হয়নি।

সমুদ্রকে সব খবরাখবর নেওয়ার জন্য কেউ তাকে কিনতে চাইছে। আজ সকিনা বেগমের বোকামোর জন্য তার মেয়েটা আঘাত প্রাপ্ত হয়েছে। লোকগুলো মেয়েটার মাথায় পাথরের আঘাত করেছে। ভাগ্যকমে রক্তাক্ত দেহ নিয়ে দৌড়ে পালিয়ে এসেছে। সমুদ্র‌ তৎক্ষণাৎ বলল,

–তাড়াতাড়ি রেডি হও। এখানে তোমাদের থাকাটা একদমই ঠিক হবে না। আমি গুরুত্বপূর্ণ কাজ ফেলে এসেছি। অনেক কিছু জানার আছে তোমার থেকে। প্রস্তুত হয়ে থেকো। আর হ্যাঁ আংকেল ব্যবহৃত এখানে যা কিছু আছে সব প্যাকিং করো। আমাকে আজ রাতেই ফিরতে হবে। সো কুইক।
সমুদ্রের বলা বাক্য গুলো শুনেই এক চিলতে হাসি রেখা ফুটে উঠলো সকিনা বেগমের ঠোঁটের কোণে। খুশিতে আক্রান্ত হয়ে তার চোখ বেয়ে কয়েক ফোঁটা আনন্দের রহস্য টপটপ করে মাটিতে পড়ল। মনে মনে সমুদ্রের মঙ্গলের জন্য প্রার্থনা করলেন তিনি।

ঘড়ির কাঁটাতে ছুঁই ছুঁই দুটো। ডাগর ডাগর চোখ মেলে তাকিয়ে রয়েছে মেহের। নিদ্রা যেন ধরা দিতে চাইছে না তার চোখে। এতো রাত হয়ে গেলো তাও মেহের ঘুমাতে পারি নি। আজ তার বড্ড শাশুড়ি মা অর্থাৎ জারাদের কথা মনে পড়ছে। তার জীবনের এতো বড়ো স্মরণীয় ঘটনা ঘটে গেলো অথচ শাশুড়ি আম্মুকে বলল না!

তার অন্তরাল অস্থির হয়ে উঠেছে। বারংবার তার চোখের পাতায় ভেসে সমুদ্রের গম্ভীর মুখশ্রী। তখনই সে চোখ বন্ধ করে ফেলছে। কিন্তু তাও শান্তি পাচ্ছে না সে। খুব ভয় হয় লোকটাকে দেখে। সমুদ্রকে কখনোই সে হাসতে দেখে নি। ইদানিং লোকটা তার সঙ্গে অদ্ভুত ব্যবহার করছে। সমুদ্রের বকুনির মাঝে ভিন্ন এক সেন্হ উপলব্ধি করতে পারছে সে। আগের মতো নেই সমুদ্র কিন্তু তারপরেও রাগ যেন লোকটার নাকের ডগায় থাকে!

সমুদ্র তার সঙ্গে দেখা করে যাইনি বলে বেশ অভিমান হচ্ছে তার। একে তো দেখা করে নি তার উপর সারাদিন কিছু খাইনি‌! এখান কোথায় গিয়েছে কে জানে? মেহের ভাবছে সমুদ্র বোধহয় আজ রাতে আর আসবে না। কালকে তো শুধু মাত্র সরি বলতে এসেছিল। কিন্তু রাতে কি খেয়েছে তা জানতে বড্ড ইচ্ছে করছে মেহেরের। সে অত্যাধিক রেগে গিয়েছে নিজের উপর। নিজের বিবেককে সে শত গালি দিচ্ছে। ইশ!

সকাল বেলা লোকটা তার হাতে খেতে চেয়েছিল। কিন্তু সে কি করলো? কে জানতো সমুদ্র খাইনি। মেহেরের ভয় হয় সমুদ্রকে দেখে। তাছাড়া এতো বড়ো একজন মানুষের সঙ্গে কথা বলতে সংকোচ বোধ হয়। ভাবলেই যেন তার শরীর শিউরে উঠে। বর্তমানে সমুদ্র ব্যবহার তাকে মানসিক ভাবে চিন্তিত করে তুলেছে। সমুদ্রের কথা চিন্তা করছে সে। ঠিক তৎক্ষণাৎ তার কর্ণপাত হলো দরজার চাপানোর মৃদু আওয়াজ। মুহূর্তেই উঠে বসলো সে। বেড সুইচ অন করে থতমত মুখ করে বসে পড়লো। হা করে তাকিয়ে রইলো সমুদ্রের মুখশ্রীতে।

–বেলকনির দরজা খুলে রেখেছো কেন?
বলেই সমুদ্র দরজা বন্ধ করে দিলো। অতঃপর ক্লান্তিমাখা শরীর নিয়ে এগিয়ে এলো মেহেরের নিকটবর্তী। সারাদিন না খেয়ে দৌড়াদৌড়ি করে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে সমুদ্র। তার সুন্দর পরিপাটি সাজানো চুলগুলো এলোমেলো হয়ে কপালের সীমান্তে এসে ঠাই নিয়েছে। এতে করে বোঝা যাচ্ছে লোকটা বেশ ক্লান্ত! মেহের আজ প্রথম সমুদ্রের মুখশ্রীতে দৃঢ় দৃষ্টিপাত ফেললো। তৎক্ষণাৎ তার মনে পড়ে গেলো, লোকটা তো সারাদিনে কিছু খাইনি। অতঃপর মেহের বিছানা থেকে উঠে দাঁড়াল। ঠিক তখনই সমুদ্র গম্ভীর কন্ঠে রাগের সহিত বলে উঠলো,

–তোমাকে না কালকে বলেছি, বেলকনির দরজা বন্ধ করছ ঘুমোতে। আর তুমি বন্ধ করোনি ! পুচকি হয়েও তোমার বিন্দু পরিমাণে ভয় নেই, তাই তো?
সমুদ্রের বলা বাক্যের প্রেক্ষিতে মেহের বোকার মতো কম্পনিত কন্ঠে বলে উঠলো,

তুমি নামক অনুভূতি পর্ব ৩৭

–আপনি তো বোধহয় রাতে কিছু খাননি!
মেহেরের কথার জবাবে সমুদ্র গম্ভীর কন্ঠে বলল,
–আমাকে কেউ খাইয়ে দেইনি। তাহলে খাবো কি করে!

তুমি নামক অনুভূতি পর্ব ৩৯