তুমি নামক অনুভূতি পর্ব ৩৯

তুমি নামক অনুভূতি পর্ব ৩৯
Lutful Mehijabin (লেখা)

–তোমাকে না কালকে বলেছি, বেলকনির দরজা বন্ধ করে ঘুমোতে। আর তুমি বন্ধ করনি ! পুচকি হয়েও তোমার বিন্দু পরিমাণে ভয় নেই, তাই তো?
সমুদ্রের বলা বাক্যের প্রেক্ষিতে মেহের বোকার মতো কম্পিত কন্ঠে বলে উঠলো,

–আপনি তো বোধহয় রাতে কিছু খাননি!
মেহেরের কথার জবাবে সমুদ্র গম্ভীর কন্ঠে বলল,
–আমাকে কেউ খাইয়ে দেইনি। তাহলে খাবো কি করে!

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

সমুদ্রের প্রত্ত্যুরে স্তব্ধ হয়ে পড়েছে মেহের। আকস্মিক সমুদ্রের থেকে এমন সোজা জবাবের মোটেও প্রত্যাশা করেনি সে। ফলে অস্বস্তি যেন তাকে আষ্টেপৃষ্টে ঘিরে ধরেছে! তার গাল যুগলে স্বল্প রক্তিম আভার আবির্ভাব ঘটেছে। শুধু লজ্জা নয় তার সঙ্গে মেহেরের হৃদয় বড্ড ব্যাথিত। ইশ! লোকটা সারাদিন না খেয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তার উপর নিজে না খেয়েও ঠিকই তাকে সযত্নে খাইয়ে দিয়েছে।

মেহেরকে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সমুদ্র ভ্রূ জোড়া কুঁচকে ফেললো। অতঃপর দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করে, ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে বিছানায় গিয়ে বসলো। পকেটে থেকে ফোন বের করলো। মোবাইল স্ক্রিনে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে গম্ভীর কন্ঠে মেহেরের উদ্দেশ্যে বললো,

–তোমাকে কিছুই করতে হবে না। পুচকি, পুচকির মতো থাকো।‌ বাই দা ওয়ে ঘুমিয়ে পড়ো।
সমুদ্রের বলা বাক্যটা মেহেরের কর্ণপাত হতেই খারাপ অনুভূতি যেন আরো দ্বিগুন বৃদ্ধি পেলো। কন্ঠে যেন অভিমান নামক অনুভূতির ছাপ একেবারে স্পষ্ট! মেহের চোখ জোড়া নিচু করে ঠাই দাঁড়িয়ে রইলো সে।

কী করবে কিছুই তার বোধগম্য হচ্ছে না। সমুদ্র মেহেরকে পাত্তা না দিয়ে নিজের ফোনে কারো সঙ্গে কথা বললো। প্রায় মিনিট পাঁচেক এভাবেই কেটে গেলো। অতঃপর সে দ্রুত গতিতে টেবিলের উপর থেকে খাবারের প্লেটটা বিছানায় উপর রাখলো। সমুদ্র থেকে দূরত্ব বজায় রেখে এক কোণে বসে পড়লো।
মেহেরের পরিস্থিতি দেখে ফোন রেখে সোজা মেহেরের মুখশ্রীতে দৃষ্টিপাত আবদ্ধ করে বসলো সমুদ্র। খাবারের প্লেট দেখে শীতল কন্ঠে বলল,

–খাবার পেলে কোথায়! তুমি এখনো খাওনি?
সমুদ্রের বলা বাক্য হাল্কা কেঁপে উঠলো মেহের। মূলত সে রাতে ডিনার করেনি। দুপুরে সমুদ্র যে খাবার গুলো তাকে খাইয়ে ওগুলো যেন এখনো তার পেটে অবশিষ্ট রয়েছে। তাই রাতের খাবার অহনা রুমে দিয়ে গিয়েছে। তাই নিয়ে বেশ ভয়ে রয়েছে মেহের। এখন যদি সমুদ্র একবার টের পাই সে খাইনি। তাহলে নিশ্চয়ই নিজে খাবে না! তাই মেহের মিনমিন গলায় বলে উঠলো,

–খেয়েছি তো। আপনি খান।
মেহেরের প্রত্ত্যুরে পেয়ে তপ্ত শ্বাস ছাড়ল সমুদ্র। অবশেষে মেহেরের নিকটবর্তী এসে‌ পড়লো। মেহের দ্বিধা সংকোচ ঝেড়ে ফেলে চামচে খাবার তুলে সমুদ্র মুখের সামনে ধরলো।
মেহেরের কম্পমান হাত জোড়ার উপর দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো সমুদ্র। মেয়েটা ভয় পাচ্ছে! লজ্জা, সংকোচ, দ্বিধা সঙ্গে বড্ড ভয় পাচ্ছে সে। সমুদ্র পরাপর কয়েকটা নিঃশ্বাস ত্যাগ করে, টান দিয়ে মেহেরের হাত থেকে প্লেটটা নিয়ে নিলো। কন্ঠে গম্ভীরতা বজায় রেখে বলে উঠলো,

–কুল মেহের, ভয় পাচ্ছ! আমাকে দেখে ভয়ের কিছু নেই। তুমি নিশ্চিন্তে থাকো। তোমাকে খাইয়ে দিতে হবে না। এখানে স্পুন আছে। আমি খেয়ে নিতে পারব। তুমি বরং ঘুমিয়ে পড়ো। ওয়েট আমি খাচ্ছি তুমি বসে থাকো।
সমুদ্রের বলা বাক্য গুলো শুনে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল মেহের। কথাগুলো সাধারণ হলেও এর মধ্যে মিশ্রিত ছিলো অধিক পরিসরে অভিমান।

সে অভিমান বুঝতে হলো মেহেরকে যে সমুদ্র নামক অনুভূতিতে গভীরভাবে আক্রান্ত হতে হবে! সে বিষয়টা খুব বেশি একটা গুরুত্ব দিলো না। চুপচাপ সমুদ্রের সামনে নতজানু হয়ে বসে রইলো। সমুদ্রে খাবারের দিকে তাকিয়ে খেতে লাগলো। বেশ মার্জিত ভাবে পরিপাটি করে খাচ্ছে সে। তৎক্ষণাৎ খাবার চিবুতে চিবুতে বলতে লাগলো,

— কালকে কিন্তু বাসায় ফিরতে হবে তোমাকে। এখান থেকে একদম স্কুলে যাবে।
সমুদ্রের কথার প্রত্ত্যুরে মেহের মুখ বন্ধ করে নিম্ন স্বরে উত্তর দিলো।
–হুম।

সমুদ্র হঠাৎ সতর্ক দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো মেহেরের মুখশ্রীতে। সিরিয়াস হয়ে বলে উঠলো,
–পুচকি, আমি তো তোমার পড়ালেখা সম্বোধন জিজ্ঞাসা করতে ভুলে গিয়েছে। মনে আছে সেদিন পড়া দিতে পারো নি ম্যাথ ক্লাসে। নাইনে বাসায় প্রাইভেট পড়তে?
সমুদ্রের কথাগুলো শুনে মন খারাপ করে বসলো মেহের। সেদিন অংক গুলো সলভ করতে না পেরে অত্যধিক লজ্জিত সে। তাই নিম্ন কন্ঠে বললো,

–আমার তো প্রাইভেট সেভাবে পড়া হয়নি। অনেক স্বপ্ন করে মা আমাকে সাইন্স বিভাগে ভর্তি করে দিয়েছে। কিন্তু বাবার সামর্থ্য নেই সাইন্সের প্রাইভেটের খরচ বহন করা। তাই পড়া হয়নি কিন্তু পাশে বাসায় একটা আপু ছিলেন, সমস্যা হলে তার কাছে গিয়ে পড়তাম।

এই প্রথম মেহেরের কন্ঠে এতো গুলো বাক্য শুনে আনন্দে আত্মহারা সমুদ্র। বাহ্, বেশ মিষ্টি করে কথা বলতে পারে তার পুচকি! তা সে জানত না। আস্তে আস্তে মেয়েটার ভয় কেটে যাচ্ছে। কারণ মেহের ছোটবেলা থেকেই শান্ত,নিরব, নিশ্চুপ প্রকৃতি। একা থাকতে ভীষণ ভালোবাসে। তাই অত্যধিক জড়তা তার মধ্যে বিদ্যমান। বিশেষ করে ছেলেদের সঙ্গে কথা বলার স্বভাব তার একদমই নেই। এককথাই ভীষণ অপছন্দ। সমুদ্র মেহেরের কথাগুলো মনোযোগ সহকারে কর্ণপাত করলো। বাক্য গুলোর মাঝে অত্যন্ত বেদনা খুঁজে পেলো সে। অতঃপর শান্ত গলায় বলল,

–ওহহ্,নো টেনশন। সামনে পরীক্ষা। আই থিংক তোমার পড়ালেখার অবস্থা বেগতিক। তাই প্রিপারেশন নেও। কাল থেকে বাসায় টিচার আসবে। তোমার নতুন শিক্ষক।
সমুদ্রের বলা বাক্যটা মেহেরের হৃদয় গহীনে আশার আলোর উৎপত্তি ঘটাতে সক্ষম হয়েছে। আনন্দের তার চোখ জোড়া ছলছল হয়ে উঠেছে। তার মানে সমুদ্র তাকে আর বাড়িতে পাঠাবে না। সে এখন থেকে এখানেই থাকবে সমুদ্রের কাছে! খুশিতে বিভোর হয়ে মেহের অস্ফুট স্বরে জিজ্ঞাসা করলো,

–আমাকে বাড়িতে পাঠিয়ে দিবেন না?
মেহের বলা বাক্যটা শুনে খাবারের প্লেটটা জোরে করে টেবিলের উপর রাখলো। এখনো অবধি খাবার খানিকটা অবশিষ্ট রয়েছে। লহমায় কঠোর দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো মেহেরের মুখশ্রীতে। কটকট করে বলে উঠলো,
–আসলে পুচকিদের নিয়ে এক মহা সমস্যা। তারা কখনো অন্তরালের অনুভূতির বুঝে উঠতে পারে না। আমার সেদিনের বলা কথাগুলো জাস্ট তুচ্ছ।

যাইহোক আই উইশ আমার হৃদয়ে যে বাজে অনুভূতিটা গ্রাস করে আমাকে ছাড়খাড় করে দিচ্ছে। যা আমাকে ভালো করে বুঝিয়ে দিচ্ছে তুমি হীনা আমি অসহায়! তোমার থেকে দূরে গেলে, খানিকক্ষণ তোমাকে না দেখলে অনুভূতিটা আমার হৃদয় রক্তক্ষরণে ভাসিয়ে দেয়। সেই বাজে অনুভূতিটা যেন খুবই শীঘ্রই তোমাকে আক্রান্ত করে নেই নিজের মায়াজালে।আমি প্রার্থনা করি তুমি নামক অনুভূতিতে আমার হৃদয় যতটুকু রক্ত ঝড়িয়েছে, আমার অন্তরলার যে ব্যাপক পরিমাণে বিষিয়ে তুলেছে।

আমি চাই সে অন্তত বাজে অনুভূতিটাতে তোমার হৃদয় থেকে দ্বিগুণ রক্ত ঝড়িয়ে আমাকে শান্তি দেই। আমি চাই প্রশান্তি! আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করো আমার চাওয়াটা যেন শেষ চাওয়া হিসেবে পূর্ণ করে দেয়। জান এতো দিনে আমার হৃদয় থেকে কতবার টপটপ করে রক্ত ঝড়েছে! হয়তো তুমি অনুভব করতে পারলে আমার মস্তিষ্কের অবস্থা বুঝতে পারতে। মস্তিষ্ক যে দিন দিন নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে।

কথাগুলো বলেই দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করলো সমুদ্র। মুখ ফিরিয়ে অন্য দিকে দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে রইলো।
মেহের শিউরে উঠেছে সমুদ্রের বলা প্রতিটি শব্দ শুনে। কথাগুলো তার ছোট্ট মস্তিষ্ককে বোধগম্য না হলেও তার হৃদয়ে অস্তিত্ব হচ্ছে ফলে তার স্পন্দন তড়িৎ বেগে ছুটছে।

তুমি নামক অনুভূতি পর্ব ৩৮

বারংবার শুকনো ঢোক গিলছে সে। অসম্ভব অস্থিরতার স্বীকার মেহের। তৎক্ষণাৎ তার লক্ষ্য হলো সমুদ্র সম্পূর্ণ খাবার খাইনি! মুহূর্তেই তার মস্তিষ্ক কর্ম ক্ষমতা হারাতে বসেছে। সারাদিন না খেয়ে রয়েছে লোকটা। বাক্যটা বারবার তার কর্ণকুহরে প্রতিধ্বনি তুলছে। অতঃপর মেহের হুট করে কম্পিত গলায় বলে উঠলো,
–আপনি খাবার শেষ করেন নি কেন? আপনার হাতে কী খুব বেশি ব্যাথা করছে?

তুমি নামক অনুভূতি পর্ব ৪০