তুমি নামক অনুভূতি পর্ব ৫৭

তুমি নামক অনুভূতি পর্ব ৫৭
Lutful Mehijabin (লেখা)

দুপুর শেষ হয়ে বিকেল গড়িয়েছে। ঘড়ির কাঁটা তিন এ গিয়ে ঠেকেছে। চৈত্র মাস হওয়ার সুবাদে উষ্ণতায় ভরে উঠেছে পরিবেশ। বিশেষ করে শহরের চার দেয়ালের মাঝে বন্দি গৃহিনীদের অবস্থা নাজেহাল! রান্না ঘর অবস্থান করছে মেহের। সেই দুপুর থেকেই একের পর এক কাজ করে যাচ্ছে। প্রচুর পরিমাণে কর্ম অর্পিত দুই বোনের উপর। জারার ক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম নয়। সেও মেহেরের সঙ্গে রান্নার কাজে ব্যস্ত।

ইয়াদ চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে সেই দুপুরে। তার বেরিয়ে যাবার মিনিট বিশের মধ্যে সমুদ্রের অতিশয় বৃহৎ ফ্লাটে অতিথির আগমন ঘটে। সমুদ্রের দুই ফুপু তাদের সন্তানদের নিয়ে হাজির হয়েছেন। এরমধ্যে অবশ্য রাফু আসেনি। রাফুর বোনরা এবং মা এসেছে। বর্তমানের তাদের আয়োজনে একের পর এক কাজে ব্যস্ত মেহের। ছোট মেহেরের কর্মের নিপুণতা দেখেই হতবম্ব জারা। তার ছোট বোন যে এতো বড় হয়ে গিয়েছে তার সত্যিই জারার অজানা!

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

মেহের মনোযোগ সহকারে কাজ করছে। ইতোমধ্যে তার শরীর ঘেমে একাকার! তার শুভ্র বর্ণের ললাট বিন্দু বিন্দু জল দ্বারা সিক্ত হয়ে উঠেছে। দুপুরে শাওয়ার নেওয়ার সময় পাই নি। সমুদ্র তার উপর ক্ষুণ্ণ হয়ে তখন তাকে রুম থেকে বের করে দিয়েছিল। মেহের অতিথি আপ্যায়ন এতোটা বিভোর যে সমুদ্রের খোঁজ নেওয়ার সময়ই পাই নি। শাশুড়ি মাকে ছেলের রুমে পাঠিয়ে নিশ্চিন্তে কর্মে মত্ত সে। অবশ্য নিশ্চিন্তে বললে ভুল হবে। সমুদ্রের কথাগুলো বারংবার মেহেরের কর্ণকুহুরে প্রতিধ্বনি তুলছে। এক অজানা সংশয় জাগ্রত হয়েছে তার অন্তরালে! উদাসীন মনে সে ভেবে চলছে কিভাবে লোকটার অভিমান ভাঙাবে? কীভাবে সমুদ্রের যাবতীয় সব বেদনা প্রশমন করবেন।

হঠাৎ মেহের কে মনোযোগ সহকারে লক্ষ্য করলো জারা। যে মেয়েটা কে দিন কয়েক পূর্বেও সে কোলে নিয়েছে আজ সেই মেয়েটা তার বড় জা! বয়সে অধিক ছোট হলেও মেয়েটাকে আজ তার নিকট এক পরিপূর্ণ নারী মনে হচ্ছে। লহমায় মেহেরের মুখশীতে দুশ্চিন্তার উপস্থিতি আন্দাজ করতে সক্ষম হলো জারা। তৎক্ষণাৎ মেহের উদ্দেশ্যে আদর মিশ্রিত কন্ঠে বলে উঠলো,

— কি হয়েছে আমর পাঁকা বুড়িটার? এভাবে উদাস হয়ে কী ভেবে চলছে অনবরত?
গ্যাসের আগুনে উত্তপ্ত পাত্রের বুদবুদফাটা বাষ্পে কি দেখে যেন পলক হারিয়েছে মেহের। মন মরা হয়ে অপলক নয়নে তাকিয়ে ছিল অস্পষ্ট ধোঁয়াতে। আচমকা জারার কথা শুনে মেহেরের ধ্যান ফিরলো। ভদ্র মেয়ের মতো জারার মুখে দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলে উঠলো,
— ভালো লাগছে না আপু।
— কেন?
— আমি উনাকে নিজের অজান্তেই কষ্ট দিয়ে ফেলেছি। উনি ভীষণ অভিমান করছেন আমার উপর। রেগে আগুন হয়ে রয়েছেন।

মেহেরের কথা বলার ভঙ্গি দেখে খিলখিল করে হেসে উঠলো। ঠোঁটের কোণে তীর্যক হাসির রেখা ঝুলিয়ে বলল,
— কেন রে? কি হয়েছে? ভাইয়া বকেছে তোকে?
জারার কথার প্রত্যুত্তরে মেহের ম্লান কন্ঠে বলল,
— তুমি হাসছো আপু!
— কি এমন কর্ম করেছিস তুই, যে আমার ভাসুর মহাশয় রেগে আছেন?

আকস্মিক মেহেরের চোখ যুগল সজল হয়ে উঠলো। ঠোঁট ওল্টে দুপুরে সমুদ্রের কৃত ব্যবহার সম্পর্কে জারাকে পরিষ্কার খুলে বলল। সমুদ্রের অভিযোগ মাখা বাক্যে গুলো উপস্থাপন করেই কেঁদে দিলো সে।
মেহেরের সম্পূর্ণ বক্তব্য শুনেই জারা স্তম্ভিত, বিষ্ময়িত হয়ে পড়লো। সে পূর্ব হতেই ধারণা করেছিল সমুদ্র মেহেরের প্রতি দুর্বল। কিন্ত তাই বলে তার ভাবনার থেকে শত দুর্বল তা দিবা স্বপ্নেও কল্পনা করেননি সে। সবটা কর্ণপাত করে জারার মস্তিষ্ক বলে উঠলো, তার পাঁকা বুড়িটা একদমই ঠিক করেনি সমুদ্রের সঙ্গে। তার উপর একবার ও খোঁজ নেই নি লোকটার। এতে করে সমুদ্রের অভিমান পাহাড় আকার ধারণ করেছে নিশ্চয়ই। জারা কিছু একটা ভেবে মুচকি হেসে মেহেরের উদ্দেশ্যে বলল,

— কান্না করিস না। আমি যা বলব তাই করতে হবে তোকে। দেখবি ভাইয়ার রাগ একদম হাওয়া হয়ে যাবে। নাও, প্রমিজ কর করবি।
মেহেরের ক্রন্দনরত অবস্থায় উত্তর দিলো,
— তুমি যা করতে বলবে আমি তাই করব আপু, প্রমিজ।

আসরের আযান দিয়েছে কিৎক্ষণ পূর্বে। মেহেরের উপর ভীষণ অভিমান করে রয়েছে সমুদ্র। মেয়েটা তাকে সত্যিই বুঝলো না! এখন অবধি মেহেরের দেখা নেই। সেই দুপুরে ক্রন্দনরত অবস্থায় ঘর থেকে প্রস্থান করেছে মেহের। এর মধ্যে একবারও সমুদ্রের খোঁজ নিতে আসে নি। অতিথি এসেছে তো কী হয়েছে, মেয়েটা কী খুব ব্যস্ত? না ইচ্ছে করে তার ঘরে উপস্থিত হতে চাইছে না। দুপুর বেলা ইসরাত বেগম সমুদ্র কে নিজ হাতে খাইয়ে দিয়ে গিয়েছেন। মায়ের জোর জবরদস্তির ফলে খেতে বাধ্য হলেও, শার্ট চেঞ্জ করতে কারো হেল্প নেই নি সমুদ্র! মেহের উপর অভিমান, অভিযোগ এবং ক্রোধের বসে নিজেই শাওয়ার নিয়েছে। যার সুবাদে তার ব্যান্ডেজ সিক্ত হয়ে উঠেছে রক্তের স্রোতে!

বর্তমানে দুর্বল দেহ নিয়ে বেলকনিতে দাঁড়িয়ে রয়েছে সমুদ্র। তার দৃষ্টি নীলাভ, স্বচ্ছ ওই আকাশ পানে। গভীর মনোযোগ সহকারে কোন কিছু ভেবে চলছে সমুদ্র। নিজের উপর বিরক্ত সে। ক্রোধ যেন তার শরীর হতে চিরন্তন বিদায় নিতে নারাজ! মেয়েটা কে ভর্ৎসনা করেও তার হৃদয় অশান্ত! অভিমান অভিযোগ বৃহৎ আকার ধারণ করেছে। এতো কিছু করেও ক্ষান্ত হয় নি সমুদ্র। আজ প্রকৃতির ইন্দ্রজাল বড্ড বিষাদ ময় তার আঁখিতে। বিশেষ করে মেহেরকে একপলক দেখার জন্য তার নয়ন জোড়া তৃষ্ণার্ত হয়ে উঠেছে। অভিমানে অভিভূত হয়ে উঠেছে তার অন্তরাল!

অতিথি আপ্যায়নে ব্যস্ত মেহের। ডাইনিং টেবিলে খাবার সার্ভে নিযুক্ত জারা। সমুদ্রের ফুপুরা আয়েশ ভঙ্গিতে বসে দুই বউকে একের পর এক কাজে আদেশ করছেন। সমুদ্রের বড় ফুপু আলেকা অর্ধ বয়স্ক বিধবা নারী। তার স্বামী মৃত্যু বরণ করেছেন বছর পনেরো পূর্বে। তার কোন সন্তান নেই। অন্যদিকে ছোট ফুপু মালেকার তিন সন্তান। রাফু, ইতি এবং সারা। ইতি এবং সারা দুইজন সমবয়সী।
— বউ তোমরা খেতে বসো।

হঠাৎ সমুদ্রের বড় ফুপু আলেকার কথা শুনে জারা মেহেরের মুখশ্রীতে দৃষ্টিপাত ফেলল। মেয়েটা পানি পর্যন্ত মুখে তুলে নি। অতিথি আপ্যায়ন কাজ করে গিয়েছে অবিরাম! জারা বারংবার মেহের কে কাজ করতে নিষেধ করেছে। কিন্তু মেহের অবাধ্য মেয়ের ন্যায় কাজ সমাপ্ত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত ক্ষান্ত হয় নি। এসব চিন্তা করতেই তার হৃদয়ে একরাশ ক্রোধের আবির্ভাব ঘটলো। তপ্ত শ্বাস ত্যাগ করে স্বল্প জোড় গলায় মেহেরের উদ্দেশ্যে বলে উঠলো,

— মেহের তুই কিন্ত কিছু খাস নি। এখন ভদ্র মেয়ের মতো খেতে বস। ফুপুর পাশে বসে পড়। আমি খাইয়ে দিচ্ছি।
জারার কথায় কোন প্রতিক্রিয়া করা হলো না মেহেরের। তার পূর্বে ছোট ফুফু মালেকা ফোঁড়ন কেটে জারাকে বলে উঠলো,
— এই আবার কেমন কথা ছোট বউ। বড় বউকে নাম ধরে ডাকছো? তার উপর তুই বলে সম্বোধন করছো?
নিমিষেই জারার মুখশ্রীতে আঁধার নেমে এলো। মেহের পরিস্থিতি বোঝাতে সক্ষম হচ্ছে। এই মুহূর্তে তার কেমন প্রতিক্রিয়া দেওয়া উচিত ভেবে পাচ্ছে না। দিশেহারা হয়ে পড়েছে সে!

মায়ের কথা শুনে ইতির ভ্রূ জোড়া কুঁচকে এলো। আলেকা বেগম নিশ্চুপ ভঙ্গিতে খেতে লাগলেন। সারা মোবাইল ফোন থেকে দৃষ্টি সরিয়ে মেহেরের মুখ পানে দৃষ্টিপাত ফেলল। অতঃপর গম্ভীর কন্ঠে বলে উঠলো,
— এতটুকু পিচ্চি মেয়েকে ভাবি বলা আদৌ সম্ভব আম্মু? হাউ ফানি !
সারার কথার প্রেক্ষিতে ইতি কঠিন স্বরে বলে উঠলো,
— সারা! মেহের তোর বড় ভাবি। বয়সে ছোট হলেও তুই ভাবিকে সম্মান করতে বাধ্য।
তৎক্ষণাৎ আরক্তিম হয়ে উঠল সারা। মেহের দিকে এক পলক তিক্ত দৃষ্টি আকর্ষণ করে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
— আমি পারব না এই থ্যাড ক্লাস মেয়ে কে ভাবি বলে ডাকতে।

বাক্যেটা সমাপ্ত করে দ্রুত পদে প্রস্থান করলো সারা। আসার পর থেকেই মেয়েটা বারংবার মেহেরের সঙ্গে বাজে ব্যবহার লিপ্ত হচ্ছে। বিয়েতে উপস্থিত ছিল না সারা। তাই সমুদ্রের বউকে দেখার সৌভাগ্য হয় নি তার।
সারা ব্যবহার উপর ভিত্তি করে আলেকা বেগম বললেন,
— তোমারা কিছু মনে করো না সারার কথাই। আর হ্যাঁ জারা সবসময়ই মনে রাখবে মেহের তোমার শুধু ছোট বোন নয় ও তোমার একমাত্র বড় জা। ওকে সম্মান করবে।
জারা কিছু বলার মতো ভাষা খুঁজে পেল না। আলেকা বেগম ফির বলে উঠলেন,
— তোমার সঙ্গে কিছু দরকারি কথা রয়েছে বড় বউমা। জানি এই পরিস্থিতিতে বলা অনুচিত। তবুও বলল। কিন্তু আজ নয় কাল সমুদ্রের সামনে।

ঘড়ির কাঁটায় ছুঁই ছঁই বারো। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে লজ্জায় কুঁকড় উঠলো মেহের। শুভ্র রঙের শাড়িতে অত্যন্ত অপূর্ব লাগছে মেহের কে। নব্য স্বপ্নের উৎপত্তি ঘটেছে তার অন্তরালে! ইশ, মারাত্মক সুন্দর লাগছে তাকে। সে হয়তো ধারনা করতে সক্ষম হচ্ছে না পৃথিবীর কোন এক পুরুষ তার এই রূপে উন্মাদ হতে বাধ্য। নিজের এমন পরিস্থিতি মোটেও কামনা করেনি মেহের। জারার কথা মতো বাধ্য মেয়ের শাড়ি পড়েছে মেহের। উদ্ভুত অনুভূতির আবির্ভাব ঘটেছে তার হৃদয় মনে। জারা মেহের কে সুসজ্জিত করার পর থেকেই লক্ষ করছে মেকআপ হীনা মেয়েটার মুখশ্রীতে রক্তিম আভা বিদ্যমান। মেয়ের যে ভীষণ দ্বিধাদন্দে ভুগেছে তা বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। জারার দৃষ্টি পলক হারিয়েছে মেহের মুখ পানে।

— আপু এই ভাবেই কি উনার সামনে যেতে হবে? না গেলে হবে না।
হঠাৎ মেহেরের কম্পনিত কন্ঠস্বর জারার কর্ণকুহুরে পৌঁছানো মাত্রই অতীতের স্মৃতিচারণ হতে বেরিয়ে এলো জারা। মেহেরের পরিস্থিতি লক্ষ্য করলো জারা। মেয়েটা অত্যধিক বিব্রত বোধ করছে। তৎক্ষণাৎ ঠোঁটের কোণে তীর্যক হাসির রেখা ঝুলিয়ে জারা বলল,
— এই মেয়ে বল তো তুই কোন ধাতুর তৈরি? আমি বুঝি না সামান্য শাড়ি পড়ে ভাইয়ার সামনে যেতে লজ্জা পাচ্ছিস তুই! সামাজিক হতে শিখ। তুই জানিস ভার্সিটির যাবতীয় সকল অনুষ্ঠানে আমি শাড়ি পড়ে উপস্থিত হই। আর তুই?

জারার কথার প্রত্যুত্তরে মেহের নিম্ন কন্ঠে ভদ্রতার সহিত বলল,
— আপু পর পুরুষের তীর্যক দৃষ্টি আমার শরীরে তীরের ন্যায় বিঁধে। আমার অস্বস্তি হয়। সৃষ্টিকর্তা নারীর পর্দা হীনা চলাফেরা বড্ড অপছন্দ করেন।
মেহেরের কথার প্রেক্ষিতে জারা ভ্রূ কুঁচকে বলে উঠলো,
— তাই বলে ভাইয়া সামনে যাবি না?
— উনি যদি বকা দেন।
মেহেরের জবাবে জারা চোখ যুগল ক্ষুদ্র আকার ধারণ করে ভাব বিলাসীন হয়ে বলল,
— আমি তিনশ পাছেন্ট শিউর বকা দিবে না। কিন্তু,,
মেহের উত্তেজিত হয়ে জিজ্ঞেস করল,
— কিন্তু কী আপু?

মেহেরের প্রশ্নের উত্তরে জারা কাতার কন্ঠে বলল,
— বাদ দে, কিছুই না। আমার ভীষণ চিন্তা হয় তোর জন্যে। তোর বয়স অনেক কম। এ বয়সে তোকে সংসার করতে দেখে আমার প্রচন্ড কান্না পাই। আমি বুঝি না এতো জলদি মামি কেন তোকে রণক্ষেত্রে নামিয়ে দিল? আমি সত্যিই বিশ্বাস করতে ব্যর্থ তুই এতো বড় হয়ে গেলি! জানিস এখানে এসে আমার হৃদয় সীমাহীন পুলকিত। ভাইয়ার আচরণে আমি মুগ্ধ! ভাইয়া তোকে এই কয়েক দিনে অত্যধিক ভালোবাসেন।
অধির মনোযোগ সহকারে জারার বক্তব্য শুনলো মেহের। কথাগুলো যেন তাকে দ্বিগুণ অস্বস্তিতে ফেলল। ভীষণ ইতস্তত বোধ করল মেহের।
জারা দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করে ফির বলল,
— যাইহোক, বিশ্বাস কর তোকে এসব বলতে মোটেও অস্তিত্ব হচ্ছে না। আই উইশ, খুব শীঘ্রই বড় হবি তুই।

অন্ধকার আচ্ছন্ন চারপাশ। বর্তমানে সমুদ্র কক্ষে অবস্থান করছে মেহের। বিছানা নতজানু হয় বসে, নির্বাক হয়ে অপেক্ষার প্রহর গুনছে সে। মিনিট পাঁচেক পূর্বে জারা তাকে সমুদ্রের কক্ষ রেখে গিয়েছে। সমুদ্র ক্রোধের ইতি টানার উদ্দেশ্যে মেহের আজ সুসজ্জিত হয়েছে। হৃদয়ে একরাশ আকাঙ্ক্ষা নিয়ে জারার কথা অনুযায়ী সমুদ্রের কক্ষে উপস্থিত হয়েছে! লোকটা কী তাকে দেখে পুনরায় গর্জে উঠবে? বাক্যেটা বারংবার মেহেরের কর্ণকুহুরে প্রতিধ্বনি তুলছে। ভয়, সংকোচ, দ্বিধার প্ররোচনা তে ইতোমধ্যে কাঁপতে আরম্ভ করেছে মেহের। যার সুবাদে ঘন ঘন বিদ্যুৎ চামকাচ্ছে তার অন্তরে! সিদ্ধান্ত নিয়েছে ক্ষমা চাইবে সমুদ্রের নিকটবর্তী।

অবশেষে অপেক্ষার প্রহরের সমাপ্তি ঘটলো। দরজা চাপানোর মৃদু আওয়াজ কর্ণপাত হতেই কেঁপে উঠলো মেহের।
রাত এগারো নাগাদ ফ্লাট থেকে বেরিয়েছিল সমুদ্র। অসুস্থ শরীর নিয়ে এতক্ষণ ছাদে প্রকৃতি বিলাস করতে মত্ত ছিলো সে। মেহেরের সঙ্গে সন্ধ্যার দিকে দেখা হয়েছিল তার। তাকে দেখে দুর্বোধ্য রহস্য বিসর্জিত করেছে মেহের। কথা বলার প্রচেষ্টা করলেও সমুদ্র উপেক্ষা করেছে তাকে। বর্তমানে অন্ধকার কক্ষে উপস্থিত হতেই খানিকটা বিরক্ত হলো সমুদ্র। বিছানার উপর মেহেরের অবস্থান পরিলক্ষিত করে তার কপালে সুক্ষ্ম ভাঁজ স্পষ্ট ফুটে উঠেছে।

মেহেরের অবস্থান গুরুত্ব না দিয়ে অন্ধকারের সমাপ্তি ঘটালো সমুদ্র। মুহূর্তে লাইট অন করতেই সম্পূর্ণ কক্ষ আলোকিত হয়ে উঠল। পকেটে মুঠোফোন রেখে মেহেরের দিকে দৃষ্টিপাত ফেললো সমুদ্র। তৎক্ষণাৎ তার হৃদয় গহীন ঝড় রাত্রির উত্তাল সমুদ্রের ন্যায় অসংযত হয়ে গেল। মেহের গভীর দৃষ্টিতে লক্ষ্য করলো সে। সমুদ্র পর্যবেক্ষণ করলো মেহের কে। মেয়েটা গাল অশ্রু সিক্ত হয়ে। মুখশ্রী জুড়ে রক্তিম ভাব স্পষ্ট! তৎক্ষণাৎ শুকনো ঢোক গিলল সমুদ্র। হঠাৎ মেহেরের উদ্দেশ্যে মৃদু এবং কঠোর কন্ঠ বলে উঠলো,

তুমি নামক অনুভূতি পর্ব ৫৬

— এভাবে বউ সেজে বসে রয়েছে কেন? বলেছি না পুচকি পুচকির মতো থাকবে। বড় হওয়ার শখ জেগেছে?
সমুদ্রের প্রত্যুত্তরে মেহের ক্রন্দন রত কন্ঠে বলে উঠল,
— আমাকে ক্ষমা করে দেবেন। আমি আর কখনও আপনার কথার অবাধ্য হবো না।
বলেই ডুকরে কেঁদে ফেলল মেহের।
সমুদ্র মৃদু হাসলো। অতঃপর ধীর পদে মেহেরের নিকটবর্তী হাজির হয়ে, গম্ভীর এবং ফিসফিস কন্ঠে বলে উঠলো,
— আমার বাচ্চার মা হওয়ার শখ হয়েছে বুঝি! ওকে ফাইন।

তুমি নামক অনুভূতি পর্ব ৫৮

1 COMMENT

Comments are closed.