তোমার নিরব অভিমানীনি পর্ব ১১

তোমার নিরব অভিমানীনি পর্ব ১১
Israt Bintey Ishaque

ব‌ইমেলায় সাধারণত লেখক-লেখিকা রা বিকালের দিকে আসে। তাই রাদ শাহমাত অফিসের পাঠ তাড়াতাড়ি চুকিয়ে র‌ওনা হয় সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের উদ্দেশ্যে। লেখিকা রুপকথা তার পেইজে জানিয়েছেন বিকাল চারটায় থাকবেন। সাথে স্ট্রলের নাম এবং নাম্বার জানিয়ে দিয়েছেন।

রাদ গাড়ি থেকে নেমে দৌড়ে আসে যেখানে সমস্ত স্ট্রলের নাম এবং নাম্বারের লিস্ট থাকে। সেখানে জেনে নিয়ে এগিয়ে যায় সেই দিকে। যেতে যেতে হাত ঘড়িতে দেখল চারটা বেজে সতেরো মিনিট। এতোক্ষণে নিশ্চ‌ই রুপকথা চলে এসেছে। রাদ মনে মনে এই ভেবে হাসলো যে, রুপকথা তাকে সারপ্রাইজ দিতে হয়তো এ কয়দিন যোগাযোগ রাখেনি।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

কিছুটা দূরত্বে থেকে দেখা গেলো ইতিমধ্যে লোকজন জড়ো হয়ে গেছে রুপকথা কে ঘিরে। কেউ ব‌ই এগিয়ে দিচ্ছে অটোগ্রাফ এর জন্য আবার কেউ সাদা কাগজে লিখিয়ে নিচ্ছে। রাদ শাহমাত দ্রুত পায়ে এগিয়ে গেল। ভিরের কারণে রুপকথার কাছাকাছি পৌঁছাতে পাচ্ছে না। মেয়েরা যেভাবে ঘিরে রেখেছে যাওয়ার কোন স্কোপ পাচ্ছে না রাদ শাহমাত। মেয়েদের তো ঠেলে ঠুলে ঢুকতে পারে না। কিছুক্ষণ চেষ্টা করে যখন পারলো না তখন স্ট্রলের পিছনের দিকে গিয়ে অল্প কিছু যায়গা দিয়ে ঢুকে গেল। তাকে দেখে একটা ছেলে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এসে বলল,

—” এই আপনি করছেন কি? এখান দিয়ে ঢুকেছেন কেন?
—” আমি রুপকথার সাথে কথা বলবো। সরুন প্লিজ?
ছেলেটা যেন বোকা বনে গেলো। খানিকটা বিরক্ত নিয়ে বলল,
—” সবাই যেভাবে দেখা করছে আপনিও সেভাবে ট্রাই করেন।
রাদ চাপা রা’গের গনগনে গলায় বলল,

—” আপনি জানেন আমি কে?
ছেলেটা ফেইসে ডোন্ট কেয়ার ভাব ফুটিয়ে তোলে বলল,
—” কে আপনি?
—” আমি ওর বয়ফ্রেন্ড! ওরে আপনি গিয়ে বলেন তাহলে বুঝতে পারবেন।
ছেলেটা দারুন হেসে বলল,

—” আচ্ছা ভাই আপনি কি পাগলা গারদ থেকে পালিয়ে এসেছেন নাকি বলেন তো? না মানে একজন বিবাহিত মেয়েকে! বলছেন আপনি তার বয়ফ্রেন্ড এটা কি আদৌ সম্ভব? তা-ও আমাদের লেখিকা রুপকথা আপুর সাথে যায়? কিছুতেই যায় না। আপনি যদি উনার গল্প পড়তেন তবে বুঝতে পারতেন। উনি যেমন ইসলামীক গল্প লিখেন তেমনি উনি একজন ধার্মিক মেয়ে। তাই এসব বলে নিজের মানসম্মান ক্ষুন্ন করবেন না প্লিজ।

রাদ এর চোখ মুখে বিষণ্নতা ছেয়ে গেল। মনে হচ্ছে সে বাস্তবে নেই। কি বলছে এই ছেলে? যার সাথে এত্তগুলা দিন কথা বলল, আর সে কিনা এক নিমিষেই বিবাহিতা হয়ে গেল? না না এটা কিছুতেই বিশ্বাসযোগ্য নয়। রাদ এর মুখের হাসি ধীরে ধীরে মুছে গিয়ে একটি কঠোরতা ফুটল। নিস্তেজ গলায় বলল,

—” রুপকথা তুমি এমনটা করতে পারো না!
বলতে বলতে চোখ দুটো ছলছলে হয়ে এল। মাটিতে বসে পড়ল, তবু নিজের সর্বো শক্তি দিয়ে রুপকথা বলে চিৎকার করে উঠল।
আসেপাশের সকলের নজর নিমিষেই তার উপর স্থির হয়ে গেল। সাথে লেখিকা রুপকথা ও। যে ছেলেটির সাথে রাদ এর কথা হয়েছে সে ছেলেটি দৌড়ে গিয়ে রুপকথা কে সবটা বলল। সবটা শুনে ভ্রু কুঁচকে তাকায় রুপকথা। ধীর পায়ে এগিয়ে আসে রাদ এর দিকে। রাদ পলকহীন চোখে তাকিয়ে আছে লেখিকার দিকে।

কালো বোরকায় আবৃত এক নারী। হুডি দিয়ে আবৃত করেছেন মস্তক। হাত মৌজা পা মৌজায় পরিহিত। শুধু বড় বড় নেত্রজোড়া অনাবৃত করে রেখেছেন। অশ্রুসিক্ত নয়নে তাকিয়ে আছে রাদ শাহমাত।
লেখিকা রুপকথা হাঁটু গেড়ে বসে রাদ হাত টেনে নিয়ে অটোগ্রাফ দিয়ে দিল! তারপর মিষ্টি কন্ঠ স্বরে বলল,
—” অন্য কাউকে আমায় ভেবে প্রতারিত হয়েছেন বুঝতে পেরেছি। এর জন্য‌ই কিছুদিন আগে আমার আইডি লিঙ্ক পেইজে পোস্ট করেছিলাম, যেন কেউ প্রতারিত না হয়। আফসোস আপনি আগেই প্রতারিত হয়ে বসে আছেন!
তারপর, রুপকথা দাঁড়িয়ে চলে যেতে পা বাড়িয়ে আবার থেমে গেল, ঘুরে ফিরে বলল,

—” পরিবারের বাহিরে কাউকে ততোটা গুরুত্ব দেওয়া উচিৎ নয় যতটা তাদের প্রাপ্য নয়।
রাদ মাথা চেপে ধরে বসে রইল কিছুক্ষণ। রুপকথা পুনরায় তাঁর পাঠকদের নিয়ে আছে।রাদ দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়ায়। কাঁপা কাঁপা পা দুটো। সব শক্তি যেন ফুরিয়ে এসেছে। তবুও শরীর টাকে বয়ে নিতে হবে তো?

বাসায় সবাই দুশ্চিন্তা করছে রাদ শাহমাত বাসায় ফিরেনি এখনো। ঘড়ির কাঁটায় রাত দুইটা বেজে তিন মিনিট। কলে পাওয়া যাচ্ছে না তাকে। দুশ্চিন্তায় সকলের ঘুম হারাম হয়ে গেছে। নজরাত সারা ঘর জুড়ে পায়চারি করছে। এক সময় বেলকনিতে এসে দাঁড়ালে গার্ডেনের দিকে নজর পরে।

বেঞ্চিতে কেউ বসে আছে! নজরাত একটু মনে করার চেষ্টা করল। আজকে রাদ শাহমাত কি রঙের শার্ট পরে বেরিয়েছিল? ও হ্যাঁ মনে পড়েছে পিচ রঙের শার্ট পরেছিলেন উপরে জ্যাকেট। নজরাত আরেক বার গার্ডেনে তাকিয়ে দেখলো, পিছন থেকে পিচ রঙের শার্ট ই মনে হচ্ছে। তাই আর সময় নষ্ট না করে এক প্রকার দৌড়ে নিচে নেমে এলো। ঘরের মেইন দরজায় রাদ শাহমাত কে আবিষ্কার করল নজরাত।

ধীর পায়ে এগিয়ে এসে মানুষটাকে দেখে বুক ধড়ফড় করতে লাগল। রাদ উদাস দৃষ্টিতে চেয়ে আছে নিচের দিকে। মাথায় চুল গুলো বড্ড এলোমেলো হয়ে আছে। চেহারার বিবর্ণ অবস্থা। এত্ত শীতের মাঝেও গায়ে জ্যাকেট নেই। কথায় আছে, হৃদয় যখন উত্তপ্ত তখন বাইরের শীতলতা অনুভব হয় না। ঠিক তেমনি রাদ শাহমাত কে এখন অনুভূতি শূন্য একজন মানুষ হিসেবে গণ্য করা যায়। নজরাত কোমল স্বরে বলল,

—” এই শীতের মাঝে এখানে বসে আছেন কেন? রুমে চলুন ঠান্ডা লেগে জ্বর চলে আসবে।
—” আপনারা নারীরা এমন ছলনাময়ী কিভাবে হতে পারেন?
নজরাত এর মুখে রক্তোচ্ছাস ভাব। তবুও মুখে কিছু বলল না, ফিচেল হেসে বলল,
—” আমি আপনাকে মুক্তি দিচ্ছি না বলে হঠাৎ এই কথা বললেন?
রাদ শাহমাত বিনা বাক্য ব্যয়ে বলল,

—” না।
—” তবে? এমন কথা কেন?
—” ঠকিয়েছে ও আমাকে!
—” রুপকথা!
—” কি করেছে?
রাদ শাহমাত এর চোখমুখ রা’গে অপমানে অস্বাভাবিক জ্বলজ্বল করতে লাগল। নিস্তেজ গলায় বলল,
—” আমাকে ধরে ঘরে নিয়ে যেতে পারবেন? না পারলে কাউকে ডাকুন।
নজরাত দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
—” পারবো আসুন।

রাদ ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়ে। বিছানা থেকে উঠার শক্তি টুকু পায় না। গতকাল প্রেশার লো হয়ে খুব খারাপ অবস্থা হয়েছিল। নজরাত বুঝতে পেরে তৎক্ষণাৎ ডিম সিদ্ধ করে খাওয়ায়। এর ফলে আল্লাহ তা’আলার রহমতে কিছুটা ভালো হয়। কিন্তু দূর্বলতা কাটেনি এখনো। খুব কষ্টে উঠে বসলেও দাঁড়ানোর শক্তি লোপ পেয়েছে তার।
ছেলের অসুস্থতার কথা শুনতে পেয়ে সাজেদা চৌধুরী অভিমান করে থাকতে পারে না। দেখতে এসে চোখের জলে একাকার করেন। রাদ শাহমাত মায়ের কোলে শুয়ে কাতর স্বরে বলল,

—” মা গো তুমি কি আমাকে অভি’শাপ দিয়েছিলে যার দরুন আমার এই পরিণতি। মা আমাকে ক্ষমা করে দিও। তোমাকে অনেক কষ্ট দিয়েছি। দো’আ করো আমি যেন খুব শীঘ্রই আল্লাহ তা’আলার মেহমান হতে পারি।
সাজেদা চৌধুরীর চোখ দুটো ছলছলে হয়ে এল, কান্না রোধ করার চেষ্টা করে বললেন,
—” আমি জানি মা-বাবার বদদু’আ বা অভি’শাপ নিজ সন্তানের জন্য ক্ষতির কারণ হতে পারে! কেননা আল্লাহ কখন দো’আ কবুল করেন তা কারো নির্দিষ্ট করে জানা নেই। আর তাই আমি কখনোই তোকে বদদু’আ বা অভি’শাপ দিতাম না।

হাদীসে এসেছে, নিজেদের বিরুদ্ধে দো’আ করো না, তোমাদের সন্তানাদির বিরুদ্ধে দো’আ করো না, এবং তোমাদের সম্পদের বিরুদ্ধে দো’আ করো না; কেননা এই আশঙ্কা হতে পারে যে এটা এমন এক সময়ের সাথে মিলে যেতে পারে যখন আল্লাহর কাছে কোন কিছু চাওয়া হয় আর তিনি তা কবুল করে নেন।[১]
আমি কখনোই আমার ছেলে মেয়ে দুটোর ক্ষ’তি চাইনি। সবসময় চেয়েছি তাদের যোগ্য জীবনসঙ্গী নিয়ে তারা যেন ভালো থাকে।

—” তাহলে আমার পাপের শা’স্তি আল্লাহ নিজে থেকে দিয়েছেন তাই না বলো মা?
সাজেদা চৌধুরী নিঃশব্দে চোখের পানি মুছেন।

মন যখন অশান্ত হয়ে থাকে তখন আশেপাশের সব কিছু তিক্ততায় আচ্ছন্ন হয়ে থাকে। ভালো কথা ও ভালো লাগে না। তাই নজরাত সবসময়ের মতোই মৌন থাকে। তখন রাদ শাহমাত বলে,
—” আপনি শুধু শুধু নিজের প্রাণবন্ত জীবন নষ্ট করে পরে আছেন। আপনি চাইলে এখনো কিন্তু মুক্তি পেতে পারেন!…

তোমার নিরব অভিমানীনি পর্ব ১০

রেফারেন্স:-
[১] মুসলিম:৩০০৯

তোমার নিরব অভিমানীনি পর্ব ১২