তোমার নিরব অভিমানীনি পর্ব ২০

তোমার নিরব অভিমানীনি পর্ব ২০
Israt Bintey Ishaque

গভীর রাত পর্যন্ত ঘুম পাখি ধরা দিল না রাহার নেত্রজোড়ায়। তার মাথায় শুধু নজরাত রুপকথা ঘুরে বেড়াচ্ছে। পাখি হলে সেই কখন উড়ে গিয়ে তার ভাইটি কে গিয়ে বলতো, ভাইয়া এইতো তোমার সেই রুপকথা! যাকে ভালোবেসে এতো গুলো দিন নজরাত নামক মেয়েটিকে অবহেলায় ফেলে রেখেছিল। কিন্তু বলতে হলে সেই সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।

এখন যদি রাহা কে জিজ্ঞাসা করা হত রাহা তুমি তো কলেও জানাতে পারতে? তবে কল করে জানালে না কেন?
তখন রাহার জবাব হতো, দূর এমন গুরুত্বপূর্ণ আবেগি কথা কি কলে বলা যায়? কলে বললে তো সেই আনন্দ, উচ্ছ্বাস থাকতো না। তার প্রিয় ভাইটির আনন্দ চক্ষু দেখা হবে না।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

রাহার ছটফটানি দেখে রূপক আর মৌন থাকতে পারলো না। আচমকা রাহা কে বুকের মধ্যে টেনে নিয়ে আদর করল। খুবই উষ্ণ, খুবই আন্তরিকভাবে। তারপর নিজের প্রশস্ত বুকে জরিয়ে রেখে বলল,
—” ”তি আমো”।
রাহা এতোক্ষণ লজ্জা রাঙা হয়ে থাকলেও এবার মুখ খুলল। বলল,
—” এর মানে কি?
—” ঘুমাও।
রাহা আর প্রতিউত্তর করার সাহস পেল না। এবার সত্যি সত্যিই ঘুমিয়ে গেল।

সাজেদা চৌধুরী গাড়ি নিয়ে বাসায় চলে গেছেন সেই কখন। যাওয়ার আগে ছেলে আর ছেলে ব‌উকে কিছু সুন্নাত সম্পর্কে অবগত করে গিয়েছেন। বলেছেন,
—” ইসলামে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক সবথেকে বেশি বন্ধুত্বের যেমন..
“বাইরে থেকে বাসায় ফিরে স্ত্রীকে সালাম ও কিছু হাদিয়া দেয়া সুন্নাত”।
“স্ত্রীর মুখে খাবারের লোকমা তুলে দেয়া সুন্নাত”।
“স্ত্রীর মেসওয়াক দিয়ে মেসওয়াক করা সুন্নাত”।
“স্ত্রীর সাথে এক প্লেটে বসে খাওয়া সুন্নাত”।

“পানির পাত্রে স্ত্রীর ঠোঁট লাগানো স্থানে ঠোঁট লাগিয়ে পানি পান করা সুন্নাত”।
“স্ত্রীর মুখের থেকে খাবার নিয়ে সেটা খাওয়া সুন্নাত”।
“নামাজে যাওয়ার আগে স্ত্রীকে জড়িয়ে ধরা ও চুমু দেয়া সুন্নাত”।
“স্ত্রীর সাথে সালাত আদায় করা সুন্নাত”।
“স্ত্রীর কোলে মাথা রেখে কোরআন তিলাওয়াত করা সুন্নাত”।
“স্ত্রীকে বেড়াতে নিয়ে যাওয়া ও সময় কাটানো সুন্নাত”।

“স্ত্রীর সাথে রাতের বেলা হাঁটতে হাঁটতে গল্প করা সুন্নাত”।
“দুজন একসাথে খেলার প্রতিযোগিতা করা সুন্নাত”।
“স্ত্রীর সাথে সৎ ব্যবহার করা সুন্নাত”।
“বিয়ের সময় স্ত্রীর মহরানা পরিশোধ করা ফরজ”।
“স্ত্রীর হক আদায় ও তাকে পর্দায় রাখা ফরজ”।
“স্ত্রীর ইজ্জতের হেফাজত করা ফরজ”।

সেই ব্যক্তিই সর্বোত্তম,যে তার স্ত্রীর নিকট উত্তম। স্বামী স্ত্রীর সম্পর্কে থাকে আল্লাহর রহমত। স্বামী স্ত্রী দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে হাসলে, আল্লাহ্ তা’আলাও তাদের দিকে তাকিয়ে হাসেন.. সুবহান আল্লাহ!
তোমাদের সম্পর্কে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন তার রহমত দান করুক, আমিন..!
নজরাত তখন বলল,

—” সুম্মা আমিন!
তার থেকে শুনে রাদ শাহমাত ও বলল।
নজরাত এখান থেকে বেশিরভাগ সম্পর্কেই আগে থেকে অবগত ছিল। তবুও শ্বাশুড়ি মায়ের কাছ থেকে শুনতে খুব ভালো লাগে তার। বিয়ের পূর্বে বাবার থেকে হাদীস সম্পর্কে অনেক কিছু শুনেছে, শিখেছে।

তারপর সাজেদা চৌধুরী বিদায় নিয়ে চলে যান। বলে যান তার জন্য তো তারা আলাদা সময় অতিবাহিত করতে পারেনি তাই এখন করুক। তার কথা মতই নজরাত আর রাদ শাহমাত একটি ঝিলের ধারে হাতে হাত রেখে পাশাপাশি হাঁটে। শীতের মৌসুম শেষের দিকে হলেও রাতের বেলা বাহিরে ঠান্ডা অনুভব হয়। পানিতে যেন ধোঁয়া ওঠে। শরীরে কাঁটা দিয়ে ওঠে। রাদ শাহমাত নজরাত এর ঠান্ডা হাত দুটো তার হাতের মুঠোয় নিয়ে, ঘসে গরম করার প্রয়াস চালায়। এতে সুরসুরি অনুভবে হাসে নজরাত।

সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠেই রাহা থ্রিপিস চেঞ্জ করে কালো রঙের সাথে সবুজ মিশেল কাতান শাড়ি পড়ে তৈরি হয়ে নেয়। রূপক তখনো ঘুমিয়ে আছে। তাই রাহা ইতস্তত বোধ করে কি বলে ডাকবে সেই নিয়ে। কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থেকে ভাবল এভাবে বসে থাকলে তো হবে না। তাই কাছে গিয়ে বলল,
—” এই শুনছেন? না না এই শুনছো?

রাহার এমন ভুল করে আবার শুধরে নেওয়া দেখে মুচকি হাসে রূপক। রাহা যখন চুল চিরনি করে তৈরি হচ্ছিল তখন তার চুড়ির ঝনঝন শব্দে ঘুম ভেঙ্গে যায় রূপক এর। তাই তো রাহার এমন বাচ্চামো কান্ড শুনতে পেল। তবে তার মাথা এখনও ঘুমের ধোঁয়াটে ভাবটা কাটিয়ে ওঠেনি।
রাহা ফের আবারো ডাকলে রূপক অস্ফুট গলায় বলল,

—” কয়টা বাজে বলতো? এত সকাল সকাল কেউ শ্বশুরবাড়ি যায় নাকি? লোকে কি বলবে? বলবে নতুন জামাই ঘুম থেকে উঠেই শ্বশুরবাড়ি দৌড় দিয়েছে।
রাহা বিরস মুখে বলল,
—” এমন কথা বলার মত আমাদের বাসায় কেউ নেই, প্লিজ চলো না?
রূপক গা ছাড়া ভাব ফুটিয়ে তোলে বলল,

—” আচ্ছা তাহলে আমাকে টেনে তুল দেখি! তবে আমি উঠবো এর আগে নয়।
—” কি! আমি তোমাকে টেনে তুলবো?
রাহার গলার স্বর হঠাৎ আতঙ্কিত একটা আর্তনাদের মতো শোনাল। আসলে সে তো রূপক এর এই আলসেমি রোগে অভ্যস্থ নয় তাই আর কি। নজরাত হলে এতক্ষণ কাজে নেমে যেত। কিন্তু রাহা বিছানার বসে হতাশ গলায় বলল,
—” তুমি এরকম করছ কেন? প্লিজ উঠ না? আমাদের যেতে হবে তো নাকি?

—” তুমিও গুটিয়ে বসে আছো কেন? আমাকে টেনে তুললেই তো আমি উঠে যাই নাকি?
অগত্যা রাহাকে নিজের সর্ব শক্তি দিয়ে টেনে তুলতে হল লম্বা চওড়া পেশীবহুল ভারী শক্তিশালী দেহের অধিকারী রূপক কে। রাহা যেন ঘন ঘন শ্বাস ফেলছে যেন সে এভারেস্ট জয় করার মত কাজ করেছে। যা দেখে মজা পাওয়ার হাঁসি হেঁসে রূপক বলল,

—” তোমার ভাবীমণি কি তোমাকে শিখিয়ে খাইয়ে, পড়িয়ে শক্তি করে পাঠায়নি?
রাহা কটমট দৃষ্টিতে তাকায় যা দেখে রূপক আমতা আমতা করে বলল,
—” না মানে, আচ্ছা থাক।
তারপর সে বাথরুমে ঢুকে।

নজরাত গার্ডেনে হেঁটে হেঁটে ফুলের কথা বলছে। এতো দিনে এই বাগানের ফুল গুলোর সাথে তার একটা নিবিড় সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। ফুল গুলো কথা না বললেও তার একাই কথা বলতে ভালো লাগে। তার মনে হয় ফুল গুলো কথা বলতে না পারলেও তার কথা গুলো যেন খুব মনোযোগ দিয়ে শুনে। আরেকটি কাজ হলো লজ্জাবতী গাছের পাতা গুলো ছুঁয়ে দিলে যখন পাতা গুলো নুইয়ে পড়ে তখন খুব আনন্দ উপভোগ করে নজরাত। এটা তার কাছে একটা দুষ্টুমি খেলার মতো লাগে। তাই এই একটা কাজ সে করেই।

বাড়ির পশ্চিম দিকে নুইয়ে এই কাজ করছে সে। তখন গাড়ির হর্ণ শুনতে পেয়ে চকিতে পিছনে ফিরে দাঁড়ায়। এই সকাল বেলা কে এসেছে? দেখার জন্য।
গতকাল অনেক রাতে বাসায় ফিরে তারা, যার ফলে রাদ শাহমাত এখনো ঘুমিয়ে আছে। ফযর নামায এর পর নজরাত এর ঘুমানোর অভ্যাস নেই তাই সে ভোরের আলো ফুটতেই গার্ডেনে হাঁটতে চলে আসে। এখন তার দৃষ্টি গাড়িটার দিকে নিবদ্ধ। গাড়িটা পার্ক করার পর রাহা কে নামতে দেখে নজরাত খুশী হ‌ওয়ার বদলে দুশ্চিন্তায় পড়ে গেল। এতো সকাল বেলা কোন খবর না দিয়ে এসেছে যে কেউ বিষ্মিত হবে স্বাভাবিক।

নজরাত দ্রুত পায়ে এগিয়ে গিয়ে রাহার হাত ধরে বলল,
—” আসবে আগে বললে না যে?
রাহা মুখ চোখে গম্ভীর ভাব ফুটিয়ে তোলে বলল,
—” তোমার সাথে আমার কোন কথা নেই ভাবীমণি! ভাইয়া কোথায়? ভাইয়ার সাথে আমার জরুরি কথা আছে।
নজরাত বিষন্ন মুখশ্রী করে, অবিশ্বাসের গলায় বলল,

—” আমি কি করেছি বলো না? আমার ভীষণ টেনশন হচ্ছে। প্লিজ বলো?
রূপক গাড়ি থেকে নেমে আসে। বোনের মাথায় সস্নেহে হাত রেখে বলে,
—” কেমন আছিস বোনু?
নজরাত জোরপূর্বক হেসে বলল,
—” আলহামদুলিল্লাহ ভালো। তুমি কেমন আছো ভাইয়া? আব্বু কেমন আছে?
—” আলহামদুলিল্লাহ ভালো।

তোমার নিরব অভিমানীনি পর্ব ১৯

তাদের দুজনের কথার মাঝে রাহা গটগট পায়ে ঘরের ভেতরে চলে যায়। এদিকে রূপক আর নজরাত কথা বলতে বলতে ভিতরে ঢুকে। রাহা ভাইয়া ভাইয়া বলে চেঁচাচ্ছে। তার চেঁচামেচি শুনে সাজেদা চৌধুরী তার ঘর থেকে বের হয়ে আসেন। এমন সাজ সকালে মেয়েকে দেখতে পেয়ে চোখ বিস্ফোরিত হয়ে উঠে। খারাপ কিছু ভাবনার আগেই সাথে রূপক কে দেখতে পেয়ে সস্তির নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। কাছে এসে কুশলাদি জিজ্ঞেস করেন। কিন্তু রাহার একটাই ভাবনা সব সত্যি রাদ শাহমাত কে বলা…..

তোমার নিরব অভিমানীনি পর্ব ২১