তোমার নিরব অভিমানীনি পর্ব ২৪

তোমার নিরব অভিমানীনি পর্ব ২৪
Israt Bintey Ishaque

সূর্যের তাপ এখন রয়ে গেছে। গাছের ফাঁকফোকর দিয়ে সূর্যের আলোক রশ্মি উঁকি দিচ্ছে। পরিবেশটা বেশ ফুরফুরে হয়ে আছে। চারিদিকে ছোট বড় গাছ গাছালি পরিবেশকে মনমুগ্ধকর করে তুলে সর্বদা।
নজরাত যখন হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে সূর্যের তাপ থেকে নিজেকে আড়াল করার চেষ্টা চালায় ঠিক তখনি রাদ বলে,
–” রূপকথার ব্যাপারে তোমাকে কিছু জানানোর আছে!

ভীষণ চমকায় নজরাত। এই রুপকথা নামক মেয়েটিকে সে কখনো শ’ত্রু ভাবে না। তবুও মেয়েটার কারণেই তো যত জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে। আবার নতুন করে কি বলতে চাইছে রাদ? টেনশনে পড়ে যায় নজরাত। বড় বড় নেত্রজোড়া মেলে মায়াবী চোখে চেয়ে থাকে রাদে’র দিকে। তার এমন চাহনিতে রাদ অস্বস্তিতে পড়ে। যা দেখে নজরাত মুখ নত করল। হাসি নেই মুখে, তবে একটু স্মিত ভাব। চোখের দৃষ্টি কাঁচের মতো ভাবলেশহীন, মুখ সাদা।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

রাদ স্বগতোক্তির মতো বলতে শুরু করে,
–” আমি ওর শা’স্তির ব্যবস্থা করে এসেছি!
এ কথা শুনে নজরাত দ্রুত মাথা তুলে তাকায় রাদ এর দিকে। থমথমে মুখ করে চেয়ে বলে,
–” শা’স্তি! কেমন শা’স্তি?
–” পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে! জে’লে আটক করে রেখেছে!
নজরাত খানিকক্ষণ সময় নিয়ে বলে,

–” তাহলে তো আপনাকে ও জে’লে থাকা উচিৎ!
রাদ চাপা রা’গের গনগনে গলায় বলল,
–” আমি জে’লে! কিন্তু কেন? কি অপরাধ করেছি আমি? এমনটা বলতে পারলে তুমি?
–” আপনিও তো সমান অপরাধী ছিলেন। শুনেছি মেয়েটাকে প্রথমে আপনি ই নক করেছিলেন। যদিও অন্য কেউ ভেবে করেছেন তবুও শুরুটা তো আপনি করেছিলেন। তা কি অস্বীকার করতে পারবেন?

রাদ এর মেজাজটা কিছু চড়া হলো। মুখে রক্তোচ্ছাস ভাব ফুটিয়ে হঠাৎ জ্বলে ওঠে বলল,
–” মেয়েটা একটা চরিত্রহীন। ছেলেদের বরাবরই ধোঁকা দিয়ে টাকা পয়সা হাতিয়ে, সেই টাকায় ন*ষ্টা*মি করে বেড়ায়। তার সাথে আমার তুলনা করলে তুমি?
চোখে মুখ রা’গে অপমানে অস্বাভাবিক জ্বলজ্বল করতে লাগল রাদ এর। আবারো নজরাত এর দিকে তেজী চোখে চেয়ে বলল,

–” আমি তো প্রথমেই জিজ্ঞাসা করেছিলাম যে, সে কি লেখিকা রুপকথা কিনা? তখন মিথ্যা বলল কেন? কেন দিনের পর দিন আমার সাথে নাটক করে গেল? লেখিকা রুপকথা সেজে বসেছিল কেন? ও যা চেয়েছে তাই দিয়েছি আমি। এগুলো আমার অপরাধ ছিল? তাকে বিশ্বাস করা আমার অপরাধ ছিল?

রাদ এর প্রত্যেকটা উচ্চ বাক্যে কেঁপে কেঁপে উঠে নজরাত। রাদ এর কথার প্রতিউত্তর করার সাহস পায় না। আর প্রতিউত্তর করবেই বা কি? রাদ তো ভুল কিছু বলছে না। নজরাত তো ঐ মেয়েটার নামে এতো কথা জানতো না। জানলে নিশ্চ‌ই ওর হয় কিছু বলতো না। বিষন্ন গলায় নজরাত কিছু বলতে যাবে তার আগেই রাদ উঠে দাঁড়ায়। নজরাত শশব্যস্তে বলল,

–” আমাকে মাফ করুন..
রাদ তার দিকে স্থির দৃষ্টিতে একটু চেয়ে থেকে মৃদু কঠিন সুরে বলল,
–” আমাকে একটু একা থাকতে দাও।
নজরাত নতচক্ষু নিয়ে অকপটে গভীর গলায় বলল,

–” আমার জ্ঞানের পরিধি খুবই নগণ্য। তাই আমার কথায় আপনি কষ্ট পেলে আমি সইতে পারবো না।
তারপর ধীর পায়ে ঘরে চলে যায় নজরাত। অত্যন্ত বিতৃষ্ণার সঙ্গে রাদ মুখশ্রী ঢেকে বসে থাকে বেঞ্চে। বার কয়েক দীর্ঘশ্বাস ফেলে শুভ্র নীলাভ আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে।

রাতে খাবার টেবিলে রাহার ফোনে কল আসলে সে কল রিসিভ করে বলে,
–” খাবার খাচ্ছি রে তাই সালামের জবাব দিলাম না। তো বল কি খবর তোর?

তিন মিনিট পর রাহা কল কেটে খাবার খেতে মনোযোগী হলে সাজ্জাদ হোসেন বললেন,
–” বৌমা একটা কথা ভুল বললে তুমি।
রাহা একটু ঘাবড়ে গেল! উদ্বিগ্ন গলায় বলল,
–” কি বাবা? যদি একটু বলে দিতেন?
সাজ্জাদ হোসেন মুখে সৌজন্য মূলক হাঁসি ফুটিয়ে বললেন,

–” নামাজ, রোজা, হজ, জাকাত, পরিবার, সমাজসহ জীবনঘনিষ্ঠ ইসলামবিষয়ক প্রশ্নোত্তর অনুষ্ঠান ‘আপনার জিজ্ঞাসা’। জয়নুল আবেদীন আজাদের উপস্থাপনায় এনটিভির জনপ্রিয় এ অনুষ্ঠানে দ‍র্শকের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন বিশিষ্ট আলেম ড.মুহাম্মদ সাইফুল্লাহ। তো একজন প্রশ্ন করেন আমাদের সমাজে প্রচলন আছে, খাওয়ার সময় সালাম দিতে হয় না। এটা কি ঠিক?

তিনি উত্তরে বলেন : না, এ কাজটি শুদ্ধ নয়। খাওয়ার সময় সালাম দেওয়া জায়েজ, আবার সালামের জবাব দেওয়াও জায়েজ। কারণ, খাওয়ার সময় অন্য সব কথা বলা হচ্ছে। সব কথা বলা জায়েজ রয়েছে, তাহলে সালাম দেওয়া কেন নিষেধ থাকবে। কে বা কারা নিষেধ করেছে সালাম দিতে?

যদি সালামকৃত ব্যক্তির মুখে লুকমা হয়। এমতাবস্থায় তার জন্য সালামের উত্তর দেয়া কষ্টকর হয়, তাহলে খানারত ব্যক্তিকে সালাম দেয়া মাকরূহ। কিন্তু যদি মুখে লুকমা না হয়, বা উত্তর দিতে কোন কষ্ট না হয়, তাহলে খানারত ব্যক্তিকে সালাম দিতে কোন সমস্যা নেই। [ফাতাওয়া উসমানী-৪/৪৩৫]

বলা হয়, আপনি খাওয়া-দাওয়া করছেন, তাই সালাম দিতে পারলাম না। এ ক্ষেত্রে কথা কিন্তু বলা হয়েই গেল। এটি আমাদের একটি ভুল কাজ এবং ভুল ধারণা। বুঝলে মা?
রাহা মাথা দুলিয়ে হেসে বলল,

–” জ্বি বাবা বুঝতে পেরেছি। আসলে এভাবে কখনো ভেবে দেখিনি। তবে একটা বইয়ে এরকম পড়েছিলাম। যাই হোক জেনে উপকৃত হলাম। জাযাকাল্লাহু খাইরান বাবা।
বিনিময়ে সাজ্জাদ হোসেন বললেন,

–” ওয়া আনতুম ফা জাযাকিল্লাহু খাইরান বৌমা।
শ্বশুর আর বৌমার মধ্যে এতো সুন্দর সম্পর্ক দেখে আনন্দের সঞ্চালন ঘটে রূপক এর। ভীষণ ভালো লাগে তার। আপনজন বা প্রিয় মানুষ গুলো যখন এভাবে মিলেমিশে আনন্দে থাকে তখন ই জীবনের আসল স্বার্থকতা।

সপ্তাহ খানেক পার হলো।
রাহা রূপক কে অভিযোগের গলায় বলল,
–” তুমি এখন আর আমাকে ঐ ভাষাটা বলো না কেন?
রূপক সকৌতুকে প্রশ্ন করে,

–” কোন ভাষার কথা বলছো বলো তো?
–” ঐ যে ইতালিয়ান ভাষা।
রূপক প্রাণ ভরে হাসে। ক্ষীণ স্বরে বলে,
–” তোমার হাতটা বাড়াও দেখি?
রাহা ভ্রকুটি করে বসে থাকলে রূপক নিজেই তার বাম হাতটা টেনে নিয়ে এলো। রাহা নির্বিকার মুখে চেয়ে থাকে চুপটি করে। দেখা যাক কি করে রূপক।

পড়ন্ত বিকেলে রাজধানীর বাহিরে নদীর পাশ ঘেঁষে সবুজ ঘাসের প্রকৃতিতে বেড়াতে বের হয় রূপক তার প্রিয়তমা স্ত্রীকে নিয়ে। মানুষের কোলাহল বিহীন নির্জন নিহারিকা এই স্থানটি ভীষণ প্রিয় রূপক এর। যখন খুব বেশি মন খারাপ হতো, আবার খুব বেশি আনন্দ হতো তখনি এখানে এসে একাকী সময় অতিবাহিত করতো রূপক।

সবুজ ঘাস মোড়িয়ে ব্রেসলেট বানিয়ে রাহার হাতে পড়িয়ে দেয় রূপক। ফর্সা গোলগাল হাতে বেশ মানিয়েছে সবুজ ঘাসের ব্রেসলেট টা। রাহা মনমুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে র‌ইলে তাকে অবাক করে দিয়ে রূপক তার হাতে কিসি দিয়ে দেয়! যার ফলে লজ্জায় বরফের মতো জমে যায় রাহা। লাজুক হেসে নদীর টলমলে পানির দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে। পাশে তাকালেই যেন দম বন্ধ হয়ে যাবে এমন অনুভূতিরা ঘিরে ধরে তাকে।
এর মধ্যে আবার রূপক তার কোলে মাথা রেখে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ল। রাহার হাত দুটো নিয়ে খেলা করতে করতে বলল,

–” ভালোবাসি প্রিয়।
উত্তরে রাহা বলে,
–” আমিও।

রাদ ইদানিং বড্ড বেশি ব্যস্ত সময় পার করছে। অফিসে যেমন কাজ তেমনি বাসায় ফিরেও ল্যাপটপ সামনে নিয়ে বসে থাকে। এতে প্রচুর বিরক্ত নজরাত। কিছুক্ষণ বেলকনিতে দাঁড়িয়ে থাকে আবার হাঁটাহাঁটি করে কাহিল হয়ে পড়ে ঘুমিয়ে থাকে। এমনি করে সময় অতিবাহিত হচ্ছে তার।

আজকে দূর আকাশের চাঁদটা তুলনায় অনেকটা বড় এবং গোলাকার আকৃতি। হয়ত পূর্ণিমা রাত। পূর্ণিমা রাত সম্পর্কে অবগত নয় নজরাত। তাই অত কিছু না ভেবে অনিমেষ চাহনিতে চেয়ে থাকে চাঁদের দিকে। কি অদ্ভুত সুন্দর লাগছে চাঁদটা “সুবহান আল্লাহ”। ইচ্ছে করছে একটা গজল গাইতে। কতোদিন হলো নজরাত গজল গায় না। হয়তো ভুলে বসেছে।
তাই মুহূর্তটার সাথে মিলিয়ে গাইল,

” তোমার দুনিয়াতে আমি যে দিকে তাকাই,
অথ‌ই নিয়ামতে ডুবে আছি সবাই”
নজরাত এর মনটা বিষন্নতার চাদর ছেড়ে একটু ফুরফুরে হলো। খোলে যা‌ওয়া চুল গুলো হাতখোপা করে বেলকনি থেকে রুমে এসে দেখলো তখনো রাদ ল্যাপটপ মুখে নিয়ে বসে আছে। নজরাত বিরক্ত হয়ে ঠাস করে ল্যাপটপ বন্ধ করে দেয়। রাদ বিষ্ময় নিয়ে তাকালে, তাকে অবাক করে দিয়ে তার কোলে বসে পড়ল নজরাত। রাদ মুখে বিরক্তিকর ছাপ ফুটিয়ে বলল,

–” আমার অনেক কাজ আছে। প্রিজ কাজ গুলো করতে দাও?
–” একটা কবিতা শুনবে?
–” কি কবিতা?
“বিষাদ ছুঁয়েছে মনে,
তাই তো মুখশ্রী জুড়ে
কেমন পাংশুটে ভাব”।
রাদ মুচকি হেসে বলে,

তোমার নিরব অভিমানীনি পর্ব ২৩

–” এতটুকুই?
নজরাত অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে,
–” আমার মাথায় কবিতা আসে না। কি করবো?
এ কথা শুনে হেসে ফেলল রাদ।

তোমার নিরব অভিমানীনি পর্ব ২৫