তোমার নেশায় আসক্ত সিজন ৩ পর্ব ১১ || Suraiya Aayat

তোমার নেশায় আসক্ত সিজন ৩ পর্ব ১১
Suraiya Aayat

প্রায় 5 মিনিট হল আরিশ বসে আছে ইলমাজের বাড়িতে, এখনও আরিশের ইলমাজের দেখা মেলেনি, বাড়ির কাজের লোকটা ওকে বলল সোফাতে বসতে, উনি ইলমাজকে ডেকে দিচ্ছেন , উনি সেই কখন ইলমাজকে ডাকতে গেছেন তবে এখনও এল না সে আর না এলো ইলমাজ , কারোর দেখা মিলল না ৷ এতক্ষণ ধরে বসে বসে খানিকটা বিরক্ত হচ্ছে আরিশ , জীবনে কখনো কারো জন্য এক মিনিটও অপেক্ষা করেনি আরিশ, যদিও আরু নামক মানুষটা তার জীবনে ব্যাতিক্রমি একটা ঘটনা ৷

এখান বাধ্য হয়েই ইলমাজের জন্য পাঁচ পাঁচটা মিনিট একই জায়গায় নীরবে বসে আছে যদিও বা বারবার বিরক্ত হওয়ার সাথে সাথে ওর মধ্যে তীব্র অনুশোচনাটাও কাজ করছে গুরুতরভাবে ৷ বাড়ি থেকে মনের মাঝে একরাশ চঞ্চলতা নিয়ে বেরিয়ে এসেছে কোনরকমে , আরু যে খুব জোরে ব্যথা পেয়েছে সেটা আর বুঝতে বাকি নেই আরিশের তবুও আরুর ব্যথাটাকে উপেক্ষা করে তাড়াতাড়ি করে বেরিয়ে এসেছে কারণটা ইলমাজ, সিঁড়ি দিয়ে ওঠার সময় ফোনে হঠাৎ করে একটা কল আসে ৷
আরিশ খানিকটা দ্রুতপায়েই সিঁড়ি দিয়ে উঠছে হঠাৎ ফোনের রিংটোন এর আওয়াজ টা বাজতেই পা জোড়া থেমে গেল , প্যান্টের পকেট থেকে ফোনটা বার করে বিরক্তিভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখল ফোনে বড় বড় অক্ষরে লেখা ভাসছে ইলমাজ নামের শব্দ টা তা দেখার সাথে সাথেই আরিশের বুকের ভিতর একটা ধাক্কা দিয়ে গেল এর পরে কি হতে যাচ্ছে ও জানেনা আর কি বলার জন্যই ইলমাজ ওকে ফোন করেছে সেটা হয়তো কলটা না ধরলে ও জানতে পারবে না ৷
আরিশ ফোনটা ধরে বলল

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

‘ কেমন আছো?’
কথাটা বলতেই আরিশকে থামিয়ে দিয়ে ইলমাজ বলে উঠলো
‘ দেখা করতে আসতে পারবে একটু আমার বাসায়?’
আরিশ খানিকটা শুকনো গলায় বলল
‘ হ্যাঁ কেন না , অবশ্যই আসবো ৷ কখন আসতে হবে বল !’
‘ আধঘণ্টার মধ্যে আসলেই ভালো হয় আমি একটু ব্যস্ত ছিলাম আরকি ৷’
আরিশ মনে মনে সব হিসাব-নিকাশ করে নিল যে এই মুহূর্তে আরুর সাথে গিয়ে জেনে নেবে যে ওর সানা আর আহানের বিয়েতে মতামত আছে কি নেই, যদি আরু বলে যে ওর বিয়েতে মত আছে তাহলে তো কোন সমস্যাই রইল না আর যদি বল এই বিয়েতে ওর মত নেই তাহলে আরিশ এই মুহুর্তে আর কোন কথা না বাড়িয়ে রাতে এসে ওর সাথে এ ব্যাপার নিয়ে আলোচনা করবে , তার মানে আরুর সাথে পাঁচ মিনিটের মধ্যে দেখা সাক্ষাত করে তারপর ও ইলমাজদের বাড়িতে যাবে ৷ এই ভাবনা চিন্তা গুলো নিজের মনে মনে করে নিয়ে আরিশ বললো

‘ হ্যাঁ আমি আসছি ৷’
‘ ওকে ৷’
কথাটা বলে দিলে ইলমাজ ফোনটা কেটে দিলো,
হঠাৎ করে মুখের উপরে ফোনটা কেটে দেওয়ায় আরিশ খানিকটা অপমান বোধ করল কিন্তু হয়তো ওর আগের ব্যবহারের দরুন ইলমাজ ওর সাথে এমন ব্যবহার করছে , ইলমাজের সাথে যা করেছে সেটা তার থেকেও খারাপ তাই আরিশ কথাগুলোকে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে , কদিন পরে তো আর মানিয়ে নেওয়ার প্রয়োজন হবে না কথাটা ভাবতেই একটা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে আরিশ রুমের দিকে চলে গেল তারপরে দেখল আরু খুশিতে ডান্স করছে তারপর বিছানা থেকে পড়ে গেল তবুও আরুর বেশি কাছে যাইনি, আরিশের হাতে বেশী সময় ছিল না যে ও আরুকে জিজ্ঞাসা করবে

‘ খুব কি ব্যাথা পেয়েছো ? কোথায় চোট পেয়েছো !’
যদিও ও জানে আরু এসবের কথা ভেবেও দেখে না ৷ ইলমাজের উপস্থিতির জন্য আজ আরুর থেকে আরিশের এই দূরে সরে যাওয়া ৷

কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই হাতঘড়ি টার দিকে একবার তাকিয়ে দেখল ঘড়ির কাঁটা টিকটিক করে সরতে সরতে আরো এক মিনিট পার হয়ে গেল,এখনো ইলমাজের দেখা নেই , সামান্য হতাশ হয়ে উপরের দিকে মুখ তুলে তাকাতেই দেখলো হুইলচেয়ারের চাকাটা নিজ হাত দিয়ে ঠেলে ঠেলে ওর দিকে এগিয়ে আসছে ইলমাজ, গায়ে একটা শালের চাদর জড়ানো, চোখে থাকা কালে গভীর চশমাটা যেন ওর ব্যক্তিত্ব টাকে এক গাম্ভীর্য রূপ দিয়েছে , কিন্ত অবাক করা বিষয় হলো কয়েক বছর আগে এই মানুষটার মাঝখানে এতো গাম্ভীরয ছিল না , তাহলে কি সময়ের সাথে সাথে ইলমাজের মাঝে এই পরিবর্তন এসেছে , হয়তোবা তাই, এই কথাগুলো ভাবতে ভাবতে আরিশের নিজের মনের মাঝখানে খানিকটা অনুশোচনা কাজ হল ,আজ আরিসের একটা কাজের কারন একটা মানুষের জীবনটা কে কত ভাবে প্রভাবিত করতে পারে সেটা ইলমাজকে না দেখলে আরিশ হয়তো বুঝতেই পারতো না, সব সময় নিজের মাঝে গড়ে তোলা অদ্ভুত এক চরিত্রের মধ্যে নিজেকে নিমজ্জিত রাখে বলা হত অন্যের ব্যাবহারের প্রতি ততটাও গভীরভাবে দৃষ্টিপাত করা হয় না সেজন্য হয়তো এ সমস্ত ব্যাপার নিয়ে খানিকটা ভাবলেশহীন আরিশ ৷

ইলমাজ আরশের কাছাকাছি এসে মুচকি হেসে বলল
‘ কফি নাকি চা ?’
আরিশ ইলমাজের কথার পরিবর্তে মুচকি হেসে বলল ‘ ‘ এসবের কোন দরকার নেই ৷ বাই দা ওয়ে সবাই বলে প্রথমে চা তারপর কফি, কিন্ত তুমিই আজ প্রথম বললে যে কফি নাকি চা ৷ ভালো লাগলো ৷ বাট আমার কিছুই লাগবে না তোমার কথাটা শুনেই চলে যাবো ৷’
ইলমাজ তার চোখের চশমাটা খানিকটা নাকের ডগার সাথে মিলিয়ে দিয়ে বলল
‘ তিক্ততার পরও মিষ্টতা আনা যাই ৷’
‘ তা ঠিক ৷’ কিছু বলবে হয়তো তুমি ?’
‘ বলার তো অনেক কিছুই আছে শুধু সেগুলো আপনার শোনার অপেক্ষায় , তা সেরকম মনোবৃত্তি নিয়ে এসেছেন তো?’
কথাটা শুনে আরিশের মনটা খচখচ করছে, এর আগের দিনও এতটা জটিল ওর ইলমাজকে মনে হয়নি যেদিন ও ইলমাজের কাছে ক্ষমা চাওয়ার জন্য গিয়েছিলো,তারপর ইলমাজ ওকে চিঠিতে তার নতুন ঠিকানার কথা জানাই ৷ আরিশ একটু ঘাবড়ে গিয়ে বলল

‘ ঠিক বুঝলাম না ৷’
ইলমাজ মুচকি হেসে বলল
‘ সত্যিই কি কিছু বুঝতে পারছেন না! আচ্ছা সে যাই হোক আপনি কিন্তু বললেন না যে কফি নাকি চা ৷’
‘ সামান্য এক গ্লাস জল হলেই হবে, আর কিছু লাগবে না ৷’
‘ আচ্ছা ৷’
কথাটা বলে মৃন্ময়ী বলে ডেকে উঠল ইলমাজ খানিকটা নরম সুরেই ৷
কথাটা বলার সাথে সাথে একটা সুদর্শন রমণী আরিসের সামনে এলো, তার ব্যাস্ততা দেখে আরিশের মনে হলো যে সে হয়তো এই ডাকটার অপেক্ষাতেই ছিলো, কখন সে ডাকবে তাই তিনিও ছুটে আসবেন ৷
মেয়েটার রূপ দেখে বোঝা যায় যে নেহাতই অল্প বয়সী , মেয়েটাকে দেখে আরিশ খানিকটা ঘাবড়ে গেল ৷ মেয়েটাকে অল্প বয়সী, আর এমন একটা যুবতী মেয়ে এই বাড়িতেই বা কেন ? এরকম হাজারো প্রশ্ন আসছে আরিশের মনের মাঝে ৷ আরিসের প্রশ্নের ছটা ভেঙে এক নিমেষেই ইলমাজ বলে উঠলো

‘ ও আমার দেখাশোনা করে প্রায় দেড় বছর ধরে , ও খুবই দক্ষ একজন আর বিশ্বাসযোগ্য আর আমার খুব কাছের একজন মানুষ হয়ে উঠেছে এই এক বছরে ৷’
‘ইলমাজের কথার রহস্য আরিশ খানিকটা হলেও আঁচ করতে পারলো তবুও অবাক হলো ৷
মৃন্ময়ী ইলমাজের দিকে তাকিয়ে বলল
‘ ডাকলেন যে কোন কিছু দরকার বুঝি?’
‘আমার দরকার নেই, দরকার টা উনার ৷ উনার জন্য এক গ্লাস জল এনে দাও আর আমার ওষুধ টাও রেডি রেখো, গিয়ে খেতে হবে ৷’

‘হমম ‘ বলে মৃন্ময়ী মাথা নাড়িয়ে চলে গেল ৷ হয়তো ইলমাজের দেওয়া কর্তব্যটাই এখন বিচক্ষনভাবে পালন করবে সে ৷
ইলমাজ আর মেয়েটার কথোপকথন আর দৃষ্টির চাহনি দেখে আরিশের মনে খানিকটা সন্দেহ জাগলো তার সাথে যেন কোন এই বিদঘুটে প্রবল বৃষ্টির দিনে একমুঠো রোদের ছোঁয়া দেখতে পেলো ৷ হয়তো এতোদিনে আরুশির প্রতি আবেগটাকে কাটিয়ে উঠতে পেরেছে ইলমাজ,এই কথগুলোই ভাবছে ভীষনভাবে ৷ মনে মনে বারবার আল্লাহকে স্মরণ করছে আর একটা ভালো কিছুর অপেক্ষায় আছে আরিশ ৷

হঠাৎ ওর ভাবনার ব্যাঘাত ঘটিয়ে ইলমাজ বলে উঠলো
‘ আরুশিকে কবে আমার কাছে ফিরিয়ে দেবেন?’
কথাটা শুনেই আরিশের বুকের ভিতর ধক করে উঠলো, হয়তো এতক্ষনের হাজারো কল্পনা জল্পনার পর ও এই কথাটা শোনার জন্য জন্য মোটেই প্রস্তুত ছিল না ৷

খানিকক্ষণ ইলমাজের দিকে তাকিয়ে আছে আরিশ তবুও কিছু বলছে না দেখে ইলমাজ একটু মুচকি হেসেই বললো
‘ আমার সেই প্রেয়শীকে কবে ফিরিয়ে দেবেন আমার কাছে ! তাকে যে আমি বড্ড ভালোবাসি , দু’বছর ধরে তার অপেক্ষা করেছি হয়তো সে ফিরবে সেই অপেক্ষায় ৷ আর যখন আজ সে নিজেই আমাকে ফিরে পেতে চায় তখন আমি আর অপেক্ষা করে থাকতে পারি বলুন ! তাকে নিজের করে পাওয়ার আকাঙ্খাটা আকাশছোঁয়া ৷’
‘ সত্তিই কি ও আপনার কাছে এখনো ফিরতে চাই ইলমাজ ? আমার জন্য কি মনের এক কোনে এক টুকরো অনুভুতির ও কি সন্চার হয়নি ? ‘(আরিশ মনে মনে)

নিজের ভালোবাসার মানুষের নামে ভালোবাসায় অবেগমাখা মতো মধুর ধ্বনি অন্যের মুখে শুনতেই আরিশের মনের মধ্যে যেন কয়েকদফা দমকা বাতাস বইছে , যা মনের মাঝে চুরমার করে দেওয়ার জন্যই যথেষ্ট ৷
আরিশ এবার মুখে একটা মিথ্যা হাসি ফোটানোর চেষ্টা করে বলতে লাগলো, যদিও বা মুখের মিথ্যা হাসিটাও যেন আজকে ওর সঙগ দিচ্ছেনা, তবুও কোনরকম মুখের হাসিটাকে প্রসারিত করে বলতে লাগলো
‘ হ্যাঁ আপনার প্রেয়শীকে নিশ্চয় আপনার কাছে ফিরিয়ে দেব, আর কিছুদিন অপেক্ষা করুন ৷’
‘ আর কতো ?’

‘ এতদিন তো অপেক্ষা করলেন আর কিছুদিন না হয় ! আপনার সত্যিই কি তাকে পাওয়ার জন্য তাড়া টা বড্ড বেশি ?’
খানিকটা ভাঙ্গা ভাঙ্গা কণ্ঠে বলল আরিশ ৷
ইলমাজ খানিকটা রসিকতা করেই বললো
‘ এত বছর যখন তার জন্য অপেক্ষা করতে পেরেছি তখন আপনার কথা অনুযায়ী কিছুদিন অপেক্ষা করতেই পারি তাতে আমার কোন সমস্যা হবে না আশা করি, কিন্তু মানুষটাকে তো পাবো আমি, ফিরে পাবো নিজের পুরনো ভালোবাসাকে ৷’
‘পুরোনো ভালোবাসা’ কথটা শুনে আরিশের একটু কেমন অদ্ভুত অনুভূতি হলো তবুও আরিশ আর কিছু শোনার মতো বা ভাবার মতো শক্তি পাচ্ছেনা ৷

তোমার নেশায় আসক্ত সিজন ৩ পর্ব ১০

‘ ধন্যবাদ !’
‘ ধন্যবাদ ! কিসের জন্য? ধন্যবাদ শব্দটি তো আমার আপনাকে বলা উচিত বলে আমি মনে করি ৷’
‘ ওইই যে আর কিছুদিন সময় দেওয়ার জন্য ৷’
‘ কিন্তু আর কিছুদিন সময় নিয়ে আপনার লাভটা কি? অযথা মায়া বড়িয়ে মায়া কাটানোটা কষ্টকর ৷’
‘ সেটা না হয় আপনার কাছে অজানাই থাকলো ! আমিও চাইনা কিছু কিছু প্রশ্নের মুখোমুখি হতে ৷ আর ভালোবাসায় মায়া না থাকলে সেটা ভালোবাসা না তাহলে সেটা ভালোলাগা ৷’

কথাটা বলে আরিশ উঠে দাঁড়িয়ে বলল
‘ বেশিদিন আপনাকে আর অপেক্ষা করাবো না ,হাতে গোনা কয়েক দিন ৷ আজ আসি কেমন আর সুবিধা-অসুবিধায় আমাকে ফোন করবেন অবশ্যই ৷’
কথটা বলে আরিশ চলে যেতে নিলেই ইলমাজ বলে উঠলো
‘ আপনার কণ্ঠস্বর টা বড্ড শুকনো শোনাচ্ছে, জলটুকু খেয়ে যাবেন না?’
আরিশ পিছন ঘুরে তাকিয়ে একটা বৃথা হাসি দিয়ে বলল
‘ অন্য কোন একদিন না হয় আসি ৷’
আরিশ চলে যেতেই কি ইলমাজ হুইলচেয়ারে মাথাটাটা ঠেকিয়ে চোখটা বন্ধ করে বললো
‘ ভালোবাসা নামক জিনিসটা বড্ড কঠিন, যে সয় সে রয় ৷’

তোমার নেশায় আসক্ত সিজন ৩ পর্ব ১২