তোর নামের বৃষ্টি পর্ব ১৩

তোর নামের বৃষ্টি পর্ব ১৩
জাবিন মাছুরা

আমি চোখ বন্ধ করে ভাইয়ার দিকে হাত এগিয়ে। হাত পা থরথর করে কাঁপছে।
ভয় পাচ্ছি ঠিকি কিন্তু চোখ বন্ধ করতেই ভেসে উঠছে রাতের কথা।মনে পড়ছে তার মুখের ‘বউ’ ডাকটা।সবকিছু যেন ছবির মতো ভেসে উঠছে।ভাইয়া কোনদিনও আমাকে মারতে পারবে না।আত্মবিশ্বাস নিয়ে চোখ বুজে আছি।
কিন্তু ভাইয়া আমাকে ভূল প্রমাণ করে দিল।আমার ডান হাতে স্কেল দিয়ে জোরে করে বারি মারলেন। আমি দাঁত চেপে ব্যথা সহ্য করতে লাগলাম।

মেঘাকে বারি দিয়ে ত্বকি চেয়ার থেকে উঠে বসল।রাগে তার সারা শরীর কাঁপছে।মাথার চুল টেনে রাগ কন্ট্রোল করার চেষ্টা করল।রাগ কন্ট্রোল করতে না পেরে ত্বকি রুম থেকে বেরিয়ে গেল।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

ভাইয়া বেরিয়ে যাওয়ার পরে আমি হাতের দিকে লক্ষ্য করলাম।আমার হাত লাল হয়ে গিয়েছে।পুরো হাতটা জ্বলা করছে।হাতটার দিকে তাকিয়ে নিরবে চোখের পানি ফেলতে লাগলাম।

তিথি নিজের কৌশরের আবেকের মানুষটার দিকে কিছুক্ষণ পলকহীন নয়নে তাকিয়ে রইল।আবেক বললে ভুল হবে।লোকটার প্রতি তার আবেক ছিল না, ছিল প্রথম ভালোবাসা।
স্তব্ধ হয়ে গিয়েছে চারপাশ।ফ্যানের হাওয়া গায়ে লাগছে না তার।ঠান্ডা পরিবেশ থাকা সত্ত্বেও তিথি ঘেমে একাকার হয়ে গিয়েছে।তার গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গিয়েছে।মূহুর্তেই মাথা ঘুরে উঠলো তিথির।ক্লাসের সবার সামনে গা এলিয়ে পড়ে গেল সে।

ক্লাসের সবার দৃষ্টি তিথির উপর গিয়ে পড়ল।তিথির প্রিয় মানুষ সাদের ক্ষেত্রের ব্যতিক্রম ঘটল না।তিথি পিছনে বসার জন্য এতক্ষণ চোখের পরে নি সাদের।ধীর পায়ে এগিয়ে গেল সে তিথির কাছে।
তিথির মায়াভরা মুখ দেখে চিনতে দেরি হলো না সাদের।পাঁচ বছর আগে মেয়েটি যেমন ছিল এখন তেমন নেই।চোখে মুখে যৌবনের সৌন্দর্য খেলা করছে।হাসিমাখা মুখটিতে আজ গম্ভীরতা ফুটে উঠেছে।
সাদ চিন্তিত হয়ে গেল।কি করবে সে বুঝতে পারল না।পিপাসিত নয়নে দেখতে লাগলো তিথি।বেহায়া চোখ দুটোর তৃষ্ণা যেন মিটতে চাইছে না।সাদ এক ধ্যানে তাকিয়ে রইল তিথির সৌন্দর্য ভরা মুখের উপর।

তিথির বান্ধবী তিথির মুখে পানি ছিটে দিতে লাগল।চোখে মুখে পানির ছিটে পেয়ে পিটপিট করে নয়ন মেলা চাইল তিথি।সামনে তাকিয়ে সাদকে দেখে তার অস্থিরতা আরো বেড়ে গেল।নিজেকে শক্ত রেখে চোখ দুটো বন্ধ করে তার বান্ধবী উপমা বলে উঠলো,
-আমাকে বাসায় নিয়ে চল উপমা।আমি আর এখানে থাকতে পারছি নি।(তিথি)

তিথির অবস্থা দেখে সাদ আড়াল হয়ে পড়ল।উপমা তিথিকে বাড়িতে নিয়ে এলো।
তিথি মানা করা সত্ত্বেও উপমা তিথির মাকে বলে দিল যে তিথি মাথা ঘুরে পড়ে গিয়েছিল।তিথির মা শুনে ইচ্ছে মতো বকা দিল তিথিকে।বকা দেওয়া শেষ করে কান্না করে দিলেন।কান্না করতে করতে মেঘাকে ডাকতে লাগলেন।
ভাইয়া চলে গিয়েছে এখনো ফিরে নি।আমি কাঁদাছিলাম আর পড়ছিলাম।হঠাৎ আম্মুর কন্ঠে পেয়ে আমি বই বন্ধ করে আম্মুর কাছে চলে এলাম।

ছোফার উপর তিথি আপুকে দেখে আমি অবাক হয়ে গেলাম।আজকে এত তাড়াতাড়ি আপু চলে এসেছে কেন।আপুর দিকে ভালো করে তাকিয়ে দেখলাম তার মুখটা কেমন যেন শুকিয়ে গিয়েছে।সারা মুখে ক্লান্ততা স্পষ্ট ফুটে উঠেছে।আমি আপুর পাশে গিয়ে বসলাম।পাশে থাকা মেয়েটির দিকে তাকালাম।মনে হয় আপুর সাথে পড়ে।মেয়েটার দিকে তাকিয়ে দেখলাম, আমার দিকে গম্ভীর মুখ করে তাকিয়ে আছে।মেয়েটার সাথে কোন কথা বললাম না।

আজকে সাদ ক্লাস না নিয়েই বাসায় চলে এসেছে।দীর্ঘ পাঁচ বছর পর তিথিকে দেখে কোন কাজে সে মনোযোগ দিতে পারছে।অতীত তার পিছু পড়ে রয়েছে।
ভার্সিটি থেকে এসে সাদ একটা রুমে বদ্ধ করে রেখেছে।ফ্লোরে হাটু ভেঙে বসে আছে সে। চোখ দুটো তার বন্ধ।ঘনঘন নিশ্বাস নিচ্ছে সে।তাকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে খুব কষ্ট হচ্ছে তার।অতীতের স্মৃতি গুলো চোখের সামনে ভেসে উঠছে।

পাঁচ বছর আগে তিথির গৃহ শিক্ষক ছিল সাদ।তখন তিথি সবে মাএ ক্লাসে নাইনে পড়ত।অন্তত চঞ্চল স্বভাবের মেয়ে ছিল তিথি।পড়াশোনাতে বেশ ভালোই ছিল।কিন্তু আবেগ মেয়েটাকে নষ্ট করে ফেলে।জীবনের প্রথম সে সাদের প্রেমে পড়েছিল। ইশারা ইঙ্গিতে সে সাদকে বোঝাতে চাইতো যে, সে সাদকে ভালোবাসে।সাদ ব্যপারটা বুঝতে পেরেও না বোঝার ভান করে থাকত।
সবকিছু ঠিকঠাক মতো চলছিল।সাদ সবসময় তিথিকে দূরে ঠেলে রাখত।কিন্তু তিথি নিজের আবেগের বশে হঠাৎ একদিন সাদকে প্রোপস করে বসে।

মনে মনে সাদ তিথিকে একটু হলেও পছন্দ করত।কিন্তু সাদ সবসময় ক্যারিয়ার নিয়ে সচেতনত ছিল।তখন সাদ অনার্স ফাইনাল ইয়ারে পড়ত। তার লক্ষ্য ছিল ইউনিভার্সিটিতে শিক্ষকতা করা। সেদিন সাদ তিথির প্রোপস পেয়ে, নিজেকে কন্ট্রোল করে রাখতে পারে নি।বিচার দিয়েছিল তিথির বাবার কাছে।শুধু বিচার নয়, সাদ সেদিন তিথিকে অপমান করে, বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছিল।

সেদিন ত্বকি তিথিকে ইচ্ছে মতো মেরেছিল।যার ফলে তিথি ত্বকির সাথে কথা বলা বন্ধ করে দে।ভাইয়া বোনের সম্পর্কে ফাঁটল ধরে।প্রায় এক বছর সে সাদের মায়াতে পড়ে থাকে।খাওয়া দাওয়া বন্ধ করে দেয়।তিথির এ অবস্থা দেখে ত্বকির মা স্টোক করে।মাকে কষ্ট থাকতে দেখে,একটা সময় সে নিজে থেকেই সাদকে ভুলে থাকলেও রাতের অন্ধকারে সাদ নামক যন্ত্রণা তাকে আক্রমণ করে।সে ইচ্ছে মতো কাঁদে সাদ নামক ব্যক্তিটার জন্য।আজও তিথি সাদ নামক রোগে আক্রান্ত।

সাদ চোখ বন্ধ করে তিথির সেই পাগলমি চিন্তা করছে।মেয়েটা সে খুব কষ্ট দিয়ে ফেলেছে।হয়তো আজ সে তিথির অপরাধী।সেদিন যদি সে তিথিকে ভালো ভাবে বোঝালেও পারত।তিথির কথা ভেবেই ত্বকি বুকে তীব্র ব্যথা অনুভব হচ্ছে।সাদ তখন বুঝতে না পারলেও তিথির থেকে দূরে গেলে তার মূল্য বুঝতে পারে।সেও যে একটা সময় তিনি নামক রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়ে।

তিথির চিন্তায় মত্ত ছিল সাদ।হঠাৎ ঘরির দিকে তাকাতে সে দেখে বিকেল হয়ে গিয়েছে।সাদ আর দেরি না করে উঠে পড়ে।তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে বেরিয়ে পড়ে।

তোর নামের বৃষ্টি পর্ব ১২

বিকেল হয়ে গিয়েছে, আমি এখনো বই পড়ছি।ভাইয়া রাগ করে আর রুমে আসে নি।তিথি আপু আর তার ফ্রেন্ড উপমা আপু গাড়ি নিয়ে ঘুরতে গিয়েছে।যাতে তিথি আপুর মন শরীর মন মানসিকতা ভালো থাকে।
হঠাৎ ভাইয়া রুমে প্রবেশ করে।তাকে দেখে আমার মনটা খারপ হয়ে যায়।নিজে থেকেই চোখ হাতের উপর চলে আসে।হাতটা একদম ফেঁটে গিয়েছে।এখনো প্রচুর ব্যথা।ভাইয়া গম্ভীর মুখ নিয়ে আমার পাশে এসে বসল।কিছুক্ষণ নিরব থেকে আচমকা আমার ডান হাত টান দিয়ে তার হাতের মাঝে নেয়।আমি তো ভয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলি।ভাইয়া আমার হাত স্লাইড করতে করতে বলে উঠে,
-সরি।(ত্বকি)

তিথি গাড়ি থেকে নেমে অরিনকে নিয়ে নদীর পাড়ে বসে আছে।চারপাশে ঠান্ডা বাতাস বয়ে যাচ্ছে।যা ফলে তার অবাধ্য চুল গুলো বাতাসের সাথে খেলা করছে।আহ্, কি মিষ্টি বাতাস একদম প্রেমে পড়ে যাবার মতো।প্রকৃতির মধু ময় সৌন্দর্য দেখে তিথি মুগ্ধ।তার মন চাইছে মাতাল হাওয়াতে দোলে দোলে নীল আকাশটাতে ছুঁয়ে আসতে।তিথি মন ভরে পলকহীন দৃষ্টিতে প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগ করছে।উপমা অনেকেটা দূরে গিয়ে কারো সাথে কথা বলছে।

হঠাৎ তিথির কোলে একটি চার বছরের বাচ্চা মেয়ে এসে বসল।মেয়েটা দেখতে যেমন মিষ্টি ঠিক তেমনি মেয়েটির পাকা পাকা কথা।মুহূর্তে মেয়েটা তিথির সাথে মিশে গেল।বাচ্চাটার সাথে কথা বলে তিথির মনটা অনেক হাল্কা হয়ে গেল।হঠাৎ মেয়েটি ‘বাবা’ বলে ডেকে উঠলো।
তিথি মেয়েটির কন্ঠ অনুসরণ করে পিছনে তাকাল।নিজের প্রিয় মানুষটিকে দেখে তিথি থমকে গেল।বুকের ভেতরে বেদম প্রহর শুরু হয়ে গেল।

তোর নামের বৃষ্টি পর্ব ১৪