তোলপাড় পর্ব ৪৪+৪৫+৪৬

তোলপাড় পর্ব ৪৪+৪৫+৪৬
শান্তনা আক্তার

আহসান আর রাতে আর আসলো না। রিমি আর রিমলি অপেক্ষা করতে না পেরে ঘুমিয়ে যায়। রিমি তো প্রচন্ড রাগ নিয়ে ঘুমায়। কত আশা করেছিল আজ ওর আপুর সাথে আহসানের দেখা করাবে, কিন্তু সব কিছুই ভেস্তে গেল। আজ রিমি কলেজ থেকে ছুটি নিয়েছে। সকালে ঘুম থেকে উঠে রিমি রিমলিকে নিয়ে হসপিটালে যায় checkup করাবে বলে। বেশ লম্বা লাইন। মানুষের ভীড়। পাবলিক হসপিটাল গুলোর কার্যকালাপ কারোরই অজানা নয়। প্রতিদিন লাইনের পর লাইন শয়ে শয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। কেউ কেউ দুপুরের খাবার নিয়ে আসে। কারণ দেখা যায় কেউ সকাল ৭ টা থেকে লাইন ধরেও যোহরের আযান দিয়ে দিলেও তাদের বসে থাকতে হয়। রিমিরাই বসে আছে প্রায় ২ ঘন্টা যাবৎ। বিরক্তির ছাপ স্পষ্ট রিমি ও রিমলির মুখে ভেসে আছে।

-তোর আহসান নাকি ডক্টর! আর ওদের নাকি হসপিটাল আছে নিজস্ব। তাহলে তুই আমাকে সেখানে কেন নিয়ে গেলি না?
রিমলির কথায় রিমি তেলে বেগুনে জ্বলে ওঠে।
-আমি কি সেধে নিজের গর্দান দিতে যাব নাকি?
-কেন? গর্দানের কথা কোথ থেকে আসলো শুনি?
-আমার যে শ্বশুর মশাই, সে তো কোনো জল্লাদের থেকে কম না। আমাকে দেখলে কি অবস্থা হবে আমি তো ভাবতেও চাইনা। কারণ না ভেবেই শরীর কাটা দিয়ে উঠছে আমার।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

-হুম বুঝলাম, তবে আহসানকে বলতি নাহয়। ও ঠিক কোনো না কোনো ভাবে ম্যানেজ করে নিতো।
-কচু করতো! ওনার সাথে কোনো কথাই বলবো না আমি। বলার ইচ্ছেও নেই। মিথ্যুক লোক একটা।
-মিথ্যুক! হুম বুঝেছি।
-কি বুঝেছিস?
-এটাই যে গতকাল বরের অপেক্ষায় প্রহর কেটেছে। তবুও দেখা মিলেনি। এইজন্যই রিমি বেবির এতো রাগ জমে আছে।
-সেরকম কিছু না। তবে উনি কেন বলেছিলেন রাতে আসবে? না বললে তো তোকে নিয়ে অপেক্ষা করতাম না।
-কথা ঠিক। কিন্তু এভাবে না জেনে কাউকে দোষারোপ করা যায়না। হয়তো কোন জরুরি কাজ ছিলো।
-উনার যদি সেরকম জরুরি কোনো কাজ ছিলো, তাহলে একটা ম্যাসেজ অথবা ফোন করে জানিয়ে দিলেও তো পারতেন? সেটাও করলেন না। এইজন্য আমার বেশি রাগ হচ্ছে।

-কুল ডাউন। এখন দেখ কতক্ষণ লাগে আমাদের লাইন আসতে। আমি বোর হয়ে যাচ্ছি।
-হুম এখনো অনেক পিছিয়ে আমরা। তুই বসে থাক। আমি কিছু নিয়ে আসি তোর জন্য। কিছু খেয়ে আসিসনি বাসা থেকে আর আমাকেও খেতে দিসনি। লাইন ধরবি বলে।
-খেয়ে আসলে এখন আমাদের অবস্থান কোথায়
থাকতো ভেবেছিস তুই?
-আমি আর কিছুই ভাবতে পারছি না। এই বলে পেছনে ফিরতেই একজন মহিলার সাথে ধাক্কা খেল রিমি। মহিলার হাতের প্রেসক্রিপশন টাইপ একটা কাগজ ছিল সেটা রিমির পায়ের কাছে পড়ে।
-সরি আমি আসলে দেখতে পারিনি এই বলে মহিলাটি রিমিকে না দেখেই কাগজটা তুলে নিল। রিমি কয়েক সেকেন্ড থমকে গেল মহিলাটির কন্ঠস্বর শুনে। রিমির দু সেকেন্ডও সময় লাগেনি নীল বোরখা পরিহিত মহিলাটির কন্ঠস্বর চিনতে। রিমি অস্ফুট স্বরে বলল,

-স্রুতি!
নিজের নাম শুনে হচকচিয়ে ওঠে মহিলাটি। তারপর মাথা উঁচু করে রিমিকে দেখে খুবই গুরুতর ভাবে চমকে ওঠে।
-রিমি তুই! এখানে?
রাতে খুব বড় একটা অপারেশন করেছে আহসান। আচমকাই ইমার্জেন্সির একটা রোগী এসে পড়ায় আহসান হসপিটালেই আটকে যায়।এসবের মাঝে আহসান রিমির কথা ভুলেই যায়।
রাত ২টোর সময় চোখ লেগে যায় ওর। হসপিটালে নিজের ক্যাবিনেই ঘুমিয়ে যায়। একজন নার্সের ডাকে ঘুম ভাঙে ওর।
-স্যার কাল রাতের পেসেন্টটার জ্ঞান ফিরেছে।
আহসান ঘুম ঘুম চোখে বলল, ওনার বাড়ির লোকজনকে বলো ওনাকে কিছু খাইয়ে দিতে। আর যেসব মেডিসিন দিয়েছি সেগুলো চেক করে খাইয়ে দিন তাকে খাবার খাওয়ানোর পর।

-ওকে স্যার বলে চলে যায় নার্স।
আহসান উঠে ফ্রেশ হয়ে নেয়৷ তারপর ফোনটা হাতে নিয়ে বলল, ওহ শিট! আমি তো রিমির কথা ভুলেই গিয়েছিলাম এতো টেনশনের মাঝে। নিশ্চয়ই গতকাল আমার পথ চেয়ে বসে ছিল মেয়েটা। একটা কল দেওয়ারও সময় ছিলো না আমার। সেরকম পরিস্থিতি থাকলে অবশ্যই জানাতাম। যাই হোক, রিমিকে বুঝিয়ে বললে বুঝবে। আজ রাতে যদি জরুরি কাজ না থাকে, তাহলে রিমির কাছে যাওয়ার চেষ্টা করবো। আর তখনই সব বুঝিয়ে বলবো। আহসান তারপর ক্যান্টিন থেকে ব্রেকফাস্ট অর্ডার দিয়ে কাগজপত্রে চোখ বুলাতে লাগলো।
আচমকা আহসান মেয়েলি কন্ঠের আভাস পেল।

-হাই আহসান!
আহসান দেখলো ওর সামনে একটা মর্ডান মেয়ে দাঁড়িয়ে। পরনে মর্ডান কাপড়-চোপড়। চুল ছোট। আহসানের কাছে অচেনা সে। চিনতে না পেরে আহসান মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করল, কে আপনি? কোনো পেসেন্ট হলে রুলস মেইনটেইন করে আমার ক্যাবিনে আসুন। এভাবে হুট করে কিভাবে ঢুকে গেলেন আমার পারমিশন ছাড়া?
মেয়েটি কিছু না বলে চেয়ারে গিয়ে বসে পড়ে। তাই দেখে আহসানের মেজাজ পুরোই বিগড়ে গেল।
-আপনাকে আমি কিছু একটা জিজ্ঞেস করেছি। বের হন আমার ক্যাবিন থেকে।

-হাই আই এম নাদিয়া। আমার পরিচয়,,,,,
নাদিয়াকে পুরো কথা শেষ করতে না দিয়ে আহসান বলে ওঠে, থাক আমার জানতে হবে না। আপনি বেরিয়ে যান ইমিডিয়েটলি।
-তুমি শোনো তারপর নাহয়,
– স্ট্রেঞ্জ! আপনি আমাকে তুমি করে বলার সাহস কোথা থেকে পেলেন?
-তোমার বাবার থেকে।
-বাবার থেকে মানে?
-মানেটা হলো তোমার বাবা মানে আঙ্কেলই আমাকে তোমার ক্যাবিনে পাঠিয়েছে। পরিচিত হওয়ার জন্য।
-ডোন্ট টক রাবিশ। কি যা তা বলছেন?
-ঠিকই বলছি। বিশ্বাস না হলে রঞ্জিত আঙ্কেলকে জিজ্ঞেস করো।

-আমার কাউকে কিছু জিজ্ঞেস করার ইচ্ছে নেই। গেট আউট। গেট আউট ফ্রম মাই ক্যাবিন।
বেশ চিল্লিয়ে বলে আহসান। আহসানের চিৎকারে নাদিয়া ভয় পেয়ে যায়। কিন্তু তাও ঘাপটি মেরে বসে থাকে। তাই দেখে আহসান নিজেকে আর কন্ট্রোল করতে পারেনা। টেবিলের উপর বারি মেরে হুংকার দিয়ে বলল, বিন্দুমাত্র লজ্জা নেই আপনার? কথা কি কানে যাচ্ছে না আপনার? আপনাকে কি দারোয়ান ডেকে বের করতে হবে, নাকি কোন মহিলা সার্ভেন্টকে ডেকে গলা ধাক্কা দিয়ে বের করবো? কোনটা বলুন?
নাদিয়া আর কিছু না বলে কাঁদতে কাঁদতে বেরিয়ে যায় আহসানের ক্যাবিন থেকে।

-স্রুতি তুই! এখানে কিভাবে?(রিমি বেশ উত্তেজিত হয়ে বলল)
-বলছি আমি তবে এখান থেকে বেরোনোর পর।
-ঠিক আছে।
বেশ কিছুক্ষন পর,,,
-এবার বল। এতোদিন কোথায় ছিলি তুই? অনিক কোথায়? তুই কেমন আছিস সেটা আমাকে একটাবার জানালি না কেন?এমন অনেক প্রশ্ন ছুড়ে দিল স্রুতির দিকে।
স্রুতি বলল, তুই এতো হাইপার হোসনা। আমি খুব ভালো আছি। আর অনিক এখানেই ছিল। আমাকে বলেছিল বেরিয়ে এসে এখানে দাঁড়িয়ে থাকতে। তুই দাঁড়া আমি অনিককে ফোন দিচ্ছি।
-হুম দে। স্রুতি অনিককে ফোন দিয়ে চলে আসতে বলে দেয়।

-বলে দিয়েছি অনিক চলে আসবে।
-বুঝলাম কিন্তু তুই কেমন রে? আমাকে নাকি নিজের বেস্ট ফ্রেন্ড ভাবিস! এই তার নমুনা? আমাকে ফাঁসিয়ে চলে গেলি। তারপর আমার কি হলো না হলো এটা একবার জানার প্রয়োজনবোধ করিসনি তুই?
-সরি রে। আমি তোর ভালোর জন্যই বলিনি কিছু।
-বাহ! ভালোর জন্য?

-হুম ভালোর জন্য। আমি যদি তোকে ফোন দিতাম তাহলে সবাই তোকে আরও ভুল বুঝতো। এই ভেবে আমি তোর সাথে কন্টাক্ট করার চেষ্টা করিনি। আমি চাইনি তুই আরও সমস্যায় পড়িস। আমি জানতে পারি আমি পালিয়ে যাওয়ায় মামু তোর সাথে আহসানের বিয়ে দিয়েছেন। আর তুই যেহেতু আহসানদের বাড়িতেই, সেহেতু তোর সাথে কন্টাক্ট করা মানে তোর বিপদ বাড়ানো।
– হুম বুঝলাম। কিন্তু তুই আমার সাথে অন্য যোগাযোগ মাধ্যম থেকেও যোগাযোগ করতে পারতিস। আসল কথা হচ্ছে তুই আমাকে তো ভুলেই গিয়েছিস। ভাগ্যক্রমে আজ দেখা হলো বলে তোর খোঁজ পেলাম। নইলে এটাও হতো না।
-কে বলেছে আমি তোকে ভুলে গিয়েছি? তোকে বার্থডে ম্যাসেজ দিয়েছিলাম তো।

-ওহহ! তার মানে ওটা তোর নাম্বার ছিলো?
-হুম।
-তাহলে বলিসনি কেন?
-তোকে এমনিতেই বিপদের মুখে ফেলে দিয়ে চলে এসেছিলাম। তাই আর,,, স্রুতিকে পুরো কথাটা শেষ করতে দিলো না।
-থাক আর কথা বাড়াতে হবে না। কোনো কথা বলবি না আমার সাথে। চল আপু আমরা বাসায় যাই।
-এমন করিস না লক্ষীটি। আপু তুমি তোমার এই অভিমানী বোনটাকে বোঝাও না প্লিজ। (রিমলির হাত ধরে রিকুয়েষ্ট করে বলল)
-তুই কিরে রিমি? মেয়েটা ক্ষমা চাচ্ছে সেই কখন থেকে আর তুই কিনা ভাব দেখাচ্ছিস?
-আমি ভাব দেখাচ্ছি? আচ্ছা তাই ভালো। তোমরা যদি মনে করো আমি ভাব দেখাচ্ছি। তবে তাই। আমি ভাবই দেখাচ্ছি। তুই আমার বোন না। তুই থাক আমি একাই গেলাম।

এরই মাঝে অনিক চলে আসে। এসেই বলে,
-ওয়াও! রিমিকে কোথায় পেলে স্রুতি?
-রিমলি আপুকে ডক্টর দেখাতে এনেছিল। সেখান থেকেই পেলাম। তুমি কোথায় গিয়েছিলে?
-পাশেই ছিলাম। এখানে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে বোর হয়ে গিয়েছিলাম তাই হাঁটছিলাম। যাই হোক, কেমন আছো রিমি?
রিমি অন্যদিক ফিরে উত্তর দিল, যেমনই থাকি তাতে আপনাদের কি? নিজেদের কার্যসিদ্ধি হয়ে গেছে এটাই অনেক আপনাদের জন্য। আমাকে মনে না রাখলেও চলবে। এমনিতেও ভুলেই গেছেন। মনে করা না করার প্রশ্নই আসছে না।
রিমি একনাগাড়ে বলে ফেলল।

-হুম আমি সরি। এতে আমার কোনো দোষ নেই। সব দোষ তোমার এই বান্ধবীর। আমি কতো বলেছি রিমিকে জানানো উচিত। ইভেন আমরা যেদিন বিয়ে করি ওইদিনই তোমাকে জানাতে চেয়েছিলাম যে আমরা ভালো আছি। কিন্তু তোমার বেস্ট ফ্রেন্ডই মানা করেছে।
-তোমরা সবাই আমাকে কেন দোষ দিচ্ছো? আমি কি ইচ্ছে করে কিছু করেছি নাকি? স্রুতি না পেরে কেঁদেই দিল। তা দেখে রিমলি বলল,

-মাফ করে না রিমি। দেখনা মেয়েটা কান্না করছে।
স্রুতি তোর ভালোর জন্যই জানায়নি। প্লিজ আর রাগ করে থাকিস না।
-আচ্ছা আমি স্রুতিকে মাফ করে দেব। কিন্তু আমার একটা শর্তে আছে। সেটা যদি স্রুতি আর অনিক মেনে নেয়, তাহলেই আমি ওদের মাফ করে দেব।
অনিক আর স্রুতি দুজনেই একসাথে বলল, কি সেটা?
-তুমি আজই স্রুতিকে নিয়ে স্রুতিদের বাড়ি যাবে। স্রুতির জন্য কাকু/কাকিমা অনেক কষ্ট পেয়েছে৷ স্রুতির জন্য কত রাত তারা নির্ঘুমে কাটিয়েছে, কত চোখের পানি ফেলেছে, তা কেবল তারাই জানে।

-কিন্ত বাবা মাকি আমাকে আর অনিককে মেনে নেবে? যদি আমাকে রেখে দেয়? অনিকের কাছে যদি যেতে না দেয়?
-সেরকম কিছুই হবে না। কারণ তুই এখন প্রেগন্যান্ট। তোর বেবির জন্য হলেও কাকু/কাকিমা তোদের মেনে নেবেন। ভয় পাসনা। আমার বিশ্বাস তারা তোদের ফিরিয়ে দেবেন না, বরং ভালবেসে কাছে টেনে নেবেন।
-তুই সত্যি বলছিস তো রিমি?
-হুম সত্যি বলছি। এটাই হবে ইনশাআল্লাহ। ভরসা রাখ।

-ড্যাড, আমি আর ওই বদরাগী, অহংকারী আহসানের কাছে যাব না। তুমি অন্য কাউকে দিয়ে কাজ করাও।
-নো মাই ডটার, তোমাকেই করতে হবে। তুমি ছাড়া সম্ভব না।
-আমি তো ম্যারিড ড্যাড! কেউ যদি রঞ্জিত আঙ্কেল কে বলে দেয় আমার বিয়ের ব্যাপার টা?
-কেউ কিছুই বলবে না। ভয় কেন পাচ্ছো? তোমার বিয়ের ব্যাপার টা এখনো আমরা ভাইরাল করিনি। আমাদের কিছু রিলেটিভ ছাড়া কেউ জানে না এটা। সো ডোন্ট ওয়ারি।
-কিন্ত ড্যাড এই আহসান তো খুবই রাগী। আমাকে ছেলেরা একবার দেখলেই ক্রাশ খেয়ে ফেলে, আর ওই আহসান কিনা এতোটা রুডলি বিহেভ করলো আমার সাথে?

-হুম এর শোধ তোমাকে নিতে হবে। আজ কিন্তু তুমি খুব অপমানিত হয়েছো নাদিয়া। এই অপমানের বদলা নেওয়ার জন্য হলেও আমার প্ল্যান মোতাবেক কাজ করতে হবে তোমাকে।
-ওকে তাই হবে ড্যাড। সত্যিই ওই আহসান আজ আমার সাথে যা করলো তার জন্য আমি ওকে কখনোই মাফ করবো না। আজ থেকে এটা শুধু তোমার মিশন নয়, আমারও। তুমি আমি মিলে ওই বাপ ছেলের এমন হাল করবো যে ওদের রুহু অবধি কেঁপে উঠবে। এন্ড দ্যাটস মাই চ্যালেঞ্জ।
-That’s like my daughter..
-এর পরের স্টেপ কি ড্যাড?

-তুমি এতোটা খারাপ ব্যবহার কিভাবে করলে নাদিয়ার সাথে? টেবিলের উপর ঠাস করে বারি মেরে বলল রঞ্জিত।
-ওনার কাজ আমার পছন্দ হয়নি তাই আমি খারাপ ব্যবহার করতে বাধ্য হয়েছি বাপি। একদমই ম্যানারলেস মহিলা সে।
-জাস্ট শাট আপ আহসান। নাদিয়া তারেকের মেয়ে। তুমি কি জানো না তারেকের সাথে আমার সম্পর্ক কেমন?
-যেমনই হোক আমার তাতে কিছু আসে যায়না। আমি তারেক আঙ্কেলকে রেসপেক্ট করি। কিন্তু তাই বলে তার মেয়ের বেয়াদবিকে টলার করতে পারবো না।

-তোমাকে টলার করতে হবে। কারণ আমি চাই নাদিয়ার সাথে তোমার বিয়ে দিতে।
-হোয়াট! বাপি তুমি কি ভুলে গেছো আমি বিবাহিত? আমার স্ত্রী আছে।
-সো ওয়াট? ডিভোর্স দিয়ে দাও তাকে। ওর থেকে নাদিয়া শত গুনে স্মার্ট, মডার্ন।
-স্মার্টনেস পোষাকে প্রকাশ পায়না বাপি। কথা বার্তা, আচার আচরণ ঠিক না থাকলে কেউ স্মার্ট কেন? সার্কাসের জোকার হওয়ারও যোগ্যতা রাখেনা। রইলো কথা মডার্নের। আমি মনে করি নাদিয়া মডার্ন নয়, একজন নিম্নমানের মহিলা। এসব মহিলাদের আমি ঘৃণা করি। এরা উন্নত সমাজের জন্য বোঝাস্বরুপ।

-আহসান! ভালো ভাবে কথা বলো বলে দিলাম।
-ধমক দিলে সত্যিটা পালটে যায়না বাপি। আমি আমার স্ত্রীকে ভালবাসি। আর তাকে ছাড়া অন্য নারীর প্রতি আমার বিন্দুমাত্র কোনো অ্যাট্রাকশন নেই। আমি এটা নিয়ে আর একটা কথাও বলতে চাইনা বাপি। আর রিমিকে আমি ডিভোর্স দিতে পারবো না। তুমি চাইলে রিমির মতো আমাকেও বাড়ি থেকে বের করে দিতে পারো। আর এই হসপিটাল থেকেও। আমি অন্য কোনো হসপিটালে জব করবো দরকার পড়লে। তাও আমি রিমিকে ছাড়ছি না বলে রঞ্জিতের চোখের সামনের থেকে সরে আসে আহসান।

-ধন্যবাদ বলতে হবে না। খুব খুশি হলাম জেনে। সব ঠিক হয়ে গেছে এটাই অনেক। আচ্ছা পরে কথা হবে বলে ফোন কেটে দিল রিমি। তারপর পিছনে ফিরতেই ওর বোন রিমলিকে দেখতে পায়। দুজনের চোখাচোখি হতেই রিমলি প্রশ্ন করল, কার সাথে কথা বলছিলি? নিশ্চয়ই আহসান! তাইতো বলি হাসিতে গদগদ করছে কেন।
-দেখ আপু, বেশি বুঝে উল্টো পালটা বলবি না বলে দিলাম। আমি আহসানের সাথে নয়, স্রুতির সাথে কথা বলছিলাম।
-স্রুতির সাথে! কি বলেছে? ওদের মেনে নিয়েছে তো?

-তুই সুযোগ পেলে একগাদা প্রশ্ন করিস ক্যান বলতো? এতো কথা বলতে ভালো লাগে তোর?
-আমি কিছু বললে তুই গরম কড়াইয়ে তেল দেওয়ার মতো ফুটে পড়িস। যাই হোক, স্রুতির পয়েন্টে আয়। কি বলেছে?
– বলেছে কাকু-কাকিমা ওকে আর অনিককে মেনে নিয়েছে। সাথে খুব খুশিও হয়েছে।
-বাহ! বেশ ভালো খবরতো। মন ভালো হয়ে গেল। আগে মেনে নিলে এতটা কষ্ট পেতেন না তারা।
-কথা ঠিক তবে তখন না মেনে নেওয়ার সম্ভাবনা বেশি ছিলো। এখন মেয়ের জন্য চিন্তা করতে করতে তারা নিজেরাই বিরক্ত। মেনে না নিয়ে উপায় কি বল?

-হুম রাইট। ওদের কথার মাঝে রিমির ফোন বেজে ওঠে। কে ফোন দিলরে রিমি? স্রুতি কি? দে আমার কাছে কথা বলি।
-উফ আপু! স্রুতি নয় আহসান।
-তাই নাকি। কথা বল তাহলে।
-না আমি ওনার ফোন রিসিভ করবো না। কোনোমতেই না।
-কেন? গতকাল আসেনি বলে?
রিমি দাঁত কিরমির করে বলল, না তা না। আমি কথা বলবো না এটাই শেষ কথা।
-হয়তো ব্যস্ত ছিলো। এমন করিস না। দেখ কি বলে।
কয়েকবার রিং বাজা বন্ধ হয়ে গেল।

-যাক ভালো হয়েছে কেটে গেছে।
-তুই ব্যাক কর।
-না করবো না।
-টেনে মারবো এক চড় তারপর ছোট বেলায় যেভাবে মাটিতে গড়াগড়ি করে কান্না করতি, সেই সিনটার পুনরাবৃত্তি ঘটবে।
-আমি কল ব্যাক করছি না বলতে না বলতেই আবার আহসানের কল বেজে ওঠে। রিং বাজা মাত্র রিমলি খপ করে রিমির হাত থেকে ফোনটা কেড়ে রিসিভ করে কানে ফেলল। সাথে স্পিকার অন করে দিল।

– হ্যালো রিমি, তুমি রেগে আছো আমি জানি। কিন্ত বিশ্বাস করো কাল আমি অপারেশন থিয়েটারে ছিলাম। খুবই সিরিয়াস অপারেশন করেছি। ঘটনাটি অকস্মাৎ। আমি তোমার কাছে আসতামই কিন্তু আটকে গেলাম। ওই সিচুয়েশনে আমার অন্য কিছু মাথায় ছিলো না। হ্যালো রিমি! তুমি কি শুনতে পাচ্ছো না? কথা বলছো না কেন? আহসান হ্যালো হ্যালো করে যাচ্ছে। আর এদিকে রিমির পুষে রাখা অগ্নিমূর্তির চাহনি নিমিষেই অনুতপ্তের আভায় পরিনত হয়ে গেল। এবার রিমি নয় রিমলি সেই অগ্নিমূর্তির চাহনি ধারণ করলো। রিমলির রক্তচক্ষু রিমির দিকে তাক করেছে তো করেই রেখেছে। রিমি রিমলির চাহনি দেখে কান ধরে নিঃশব্দে ঠোঁট নাড়িয়ে বলল, সরি। রিমলি কিছু না বলে রিমির হাতে ফোন ধরিয়ে দিল। ইশারা করলো কথা বলার জন্য।

রিমি আমতা আমতা করে বলল, জ, জ, জ্বি বলুন আমি শুনছি।
আহসান রিমির গলা শুনে জীবন ফিরে পেলে৷ বড় একটা শ্বাস ছেড়ে দিয়ে বলল, কথা বলোনি কেন?
-এমনি আসলে আপনি একটার পর একটা কথা বলে যাচ্ছিলেন বলে আমি কি বলবো না বলবো ভেবে পাচ্ছিলাম না।
-ওকে তুমি নিচে নেমে এসো আমি তোমাকে নিয়ে একটা জায়গায় যেতে চাই।
-মানে! এই বিকেলে কোথায় যাব?

-বিকেলে যাবেনা তোকি গভীর রাতে যাবে?
-আমি কি তাই বলেছি? আমি আপনার সাথে কেন যাব?
-বেশি কথা না বলে চুপচাপ নিচে আসো। আমি গাড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি। সময় মাত্র পাঁচ মিনিট৷ যা পড়ে আছো তাতেই চলে আসো।
-কিন্ত,,, আহসান রিমির পুরো কথা শোনার আগেই ফোন কেটে দেয়। যাহ, ফোন কেটে দিলো? রিমলি গিয়ে রিমির মাথায় একটা চাটা মেরে বলল, তোর সমস্যা কিরে ভাই? অতিরিক্ত রাগ অভিমান স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। ছেলেটা যখন বলেছে তোকে নিয়ে কোথাও যাবে, তাহলে এতো ঢং করার কি আছে?

-আপু আমি কি করবো বুঝতে পারছি না।
-বুঝতে হবে না। তুই যা নইলে এক লাথি দেব ডিরেক্ট বারান্দা ভেদ করে নিচে গিয়ে পড়বি।
-আচ্ছা বাবা যাচ্ছি আমি। তুই আমাকে ছাড়া গোটা দুনিয়ার সাপোর্টার। কিন্তু আমি এই অবস্থাতেই যাবো কি করে?
-হুম গেলে কি হয়েছে? থ্রি পিসটা সুন্দর তো। আর তোকে ওতো সাজগোছ করতে হবে না। আমার ছোট বোনটা এমনিতেই খুব সুন্দর। একদম আমার মতোই।
-তাও ওনার সাথে যাচ্ছি। এভাবে যাই কিভাবে?
-ওরে বাবারে! এতোক্ষণ যাব না, যাব না করছিল। আর এখন এভাবে কি করে যাই? তোর পেটে পেটে এক রুপ, আর দেখাস অন্য রুপ? আজ তুই যদি আহসানকে মনের কথা না বলে বাসায় আসিস না, তাহলে আমি আব্বু আম্মুকে বলে দেব তুই আহসানকে ফিরিয়ে দিচ্ছিস অকারণে।

-এই তুই এটা করিস না। এমনিতেই আম্মু রেগে আছে। যদি এটা শোনে, তাহলে নির্ঘাত গর্দান যাবে।
-তাহলে আমি যা বলছি তাই কর গিয়ে।
-আচ্ছা যাচ্ছি।
-মনে রাখিস আমার কথা। আজ আহসানকে আই লাভ ইউ বলতে ভুলিস না যেন।
-তুইও চল আমাদের সাথে। পরিচিত হবি আহসানের সাথে।
-নো মিস ঢঙি। আমি কারো রোমান্স এ বাঁ পা দিতে চাইনা। তোকে যখন দিতে আসবে তখন আলাপ হয়ে যাবে। এবার যাতো।
রিমি গুটিগুটি পায়ে নিচে নেমে আসলো। আহসান রিমিকে দেখেই বললো, গুড সময়ের মধ্যে চলে এসেছো।
-আমাকে নিয়ে কোথায় যাবেন?

-সেটা গেলেই দেখতে পারবে। কথা না বাড়িয়ে গাড়িতে গিয়ে বসো। তুমি ভালো করেই জানো আমি সারপ্রাইজ শেয়ার করি না।
-আবার সারপ্রাইজ? কথাটা বলেই রিমি ওর মুখটা কালো করে ফেলল। মন খারাপ হয়ে গেল। আহসান সেটা বেশ ভালো করে বুঝতে পারলো। কিন্তু তবুও কোন কিছু না বলে ড্রাইভিং সিটে গিয়ে বসল। গেট খুলে দিয়ে রিমিকে গাড়িতে ওঠার জন্য ইশারা করলো। রিমি আহসানের পাশের সিটে বসতেই আহসান গাড়ি স্টার্ট দিল।

তোলপাড় পর্ব ৪১+৪২+৪৩

গাড়ির ব্রেক কষলো বড় একটা পার্কের কাছে গিয়ে। পার্কের বাহিরে সাইনবোর্ডে লেখা ‘লাভার্স পয়েন্ট’ দুপাশে দুটো লাভ সেপও দেওয়া। রিমি লেখাগুলোয় চোখ বুলাতেই অজানা অনুভূতি এসে ওকে ঘিরে ধরলো। রিমি বুঝতে পারলো আহসান আবার ওকে বড়সড় কোন সারপ্রাইজ দিতে চলেছে। কিন্তু সেটা কি তা রিমির জানা নেই। ইতোমধ্যে রিমির বুকে ধুকপুকানির তাল শুরু গিয়েছে। রিমির ভাবনার সুতো কাটে আহসানের কথায়। আহসান বাহিরে নেমে গাড়ির দরজা খুলে রিমিকে বের হতে বলছে। রিমি বের হবে কি আহসান ওর হাত রিমির দিকে বাড়িয়ে দেয়। রিমি ওর কাঁপা কাঁপা হাতটি বাড়িয়ে আহসানের হাতের মধ্যে গুজে দেয়। ওরা পার্কের মধ্যে প্রবেশ করে। কিন্তু পার্কের মধ্যে কোন একটা মানুষ জন নেই। পুরোই নিস্তব্ধ৷ বিন্দু পরিমাণ কোলাহল নেই। পুরো পার্ক আর খোলা আকাশ। রিমি চারপাশের শান্ত পরিবেশ দেখে বিস্মিত হয়ে গেল। রিমি আশ্চর্যান্বিত হয়ে জিজ্ঞেস করলো, এখানে জনমানবশূন্য কেন? এসব জায়গায় তো মানুষের অভাব থাকার কথা না?

-তার মানে তুমি এখানে এসেছো আরও আগে।
-না, একদমই না। আমি কথার কথা বললাম। যেহেতু এটা লাভার্স পয়েন্ট। সেহেতু এখানে লাভার্সদের আনাগোনা থাকবে এটাইতো স্বাভাবিক। এই সামান্য সেন্সটা যেকারোই আছে। একটা ক্লাস সিক্স পড়ুয়া বাচ্চাও জানে। কিন্তু আপনি আমাকে এখানে কেন আনলেন?

-তুমি তো খুব সুন্দর করে বললে এখানে লাভার্সদের আনাগোনা লেগে থাকে। এখানে সকল লাভার্সরা আসে। তাহলে এই অহেতুক প্রশ্নটা করার মানে কি? আশা করি তুমি কিছুটা হলেও আচ করতে পারছো। এনিওয়েস, চলো যাওয়া যাক বলে আহসান সামনের দিকে পা বাড়ালো। রিমিও ভয় ভয় কদম ফেলে আহসানের পিছনে গেল।

তোলপাড় পর্ব ৪৭+৪৮+৪৯