তোলপাড় পর্ব ৪৭+৪৮+৪৯

তোলপাড় পর্ব ৪৭+৪৮+৪৯
শান্তনা আক্তার

খোলা আকাশের নিচে বড় একটা লাভ সেপের ছাতা। রংধনুর সাতটা রঙ সেই ছাতায়। সাধারনত লাভ তো লাল রঙের হয় তবে এটা সাতরঙা কেন? ঠিক এই প্রশ্ন টাই রিমি মনে মনে আওড়ে যাচ্ছে। প্রশ্নের ভাবনা কাটিয়ে রিমির নজর কাড়ে ছাতাটার নিচে থাকা টেবিলটি। টেবিলের এক পাশের চেয়ারে একজন বয়স্ক মতো লোক বসে আছে। হুজুরের বেশ তার। কি যেন পড়ছে সে। হাতে তার কাগজ মতো কিছু হবে। রিমি কিছু বুঝে উঠতে পারছে না আহসান ওকে এখানে কেন এনেছে। লাভ ছাতার নিচে একজন হুজুর! এটা যেন ওর কাছে আরও ভাবান্তর। রিমি বিস্মিত হয়ে বলল, আপনি আমাকে এখানে কেন এনেছেন বলবেন? আমি কিছুই বুঝতেছি না। আহসান মুচকি হাসি দিয়ে বলল,

-চলো গিয়ে বসি।
আহসান রিমির হাত টেনে হুজুরের সামনের দুটো চেয়ারে রিমিকে নিয়ে বসে পড়ে। আহসানকে দেখে হুজুর সালাম দিলেন।
– আসসালামু আলাইকুম,ওয়ারহমাতুল্লাহ। আহসান বাবু।
আহসান জবাব দিল,
-ওয়ালাইকুমুস সালাম, ওয়ারহমাতুল্লাহি ওয়াবারাকাতুহ। আপনার কোন প্রবলেম হয়নি তো আসতে?
হুজুর সাহেব প্রাণখোলা একটা হাসি দিয়ে বললেন, না কোন সমস্যা হয়নি। আপনারা তৈরি তো?

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

-জ্বি আপনি শুরু করেন কাজী সাহেব।
কাজী সাহেব নামটা শুনে রিমির চোখ বেরিয়ে আসার উপক্রম। রিমি ওর নাক মুখ ঘুচিয়ে জিজ্ঞেস করল, আপনি কি কাইন্ডলি বলবেন আমরা এখানে কেন এসেছি? কাজী সাহেবকে কেন ডেকেছেন? এখানে কার বিয়েতে এসেছি আমরা? আমরা তিনজন ছাড়া একটা কাক ওতো নেই এখানে।তো কার বিয়ে হবে?
আহসান খুব ইজিলি বলল, আমাদের।

-আমাদের? আমাদের আবার কিসের বিয়ে? আমরা তো অলরেডি স্বামী স্ত্রী।
-হুম তবে আমি চাই আবার আমাদের বিয়ে হোক। প্রথমবার আমি বিয়ের জন্য প্রিপেইড ছিলাম না। আর তুমিও না। আর এখন আমি তোমাকে খুব করে চাই। তাই নতুন ভাবে নিজের করে নিতে চাই। শুরুটা ভালবাসা দিয়ে ভরিয়ে দিতে চাই। যাহাতে আপনাকে শেষ নিঃশ্বাসটাতেও আপন করে পাই।

-আপনি যে কি? আমি,,,,
আহসান ধমকের সুরে বলল,একদম চুপ। কাজী সাহেবের আরও কাজ আছে। আমাদের জন্য বেশ খানিক সময় নষ্ট হয়েছে ওনার। তাই কথা না বলে উনি যা বলে তাই শোনো।
রিমি আর কোন কথা বাড়ালো না। কাজী সাহেব যা বললেন সব অক্ষরে অক্ষরে পালন করল দুজন। বিয়ে পড়িয়ে কাজী সাহেব চলে যান। কাজী সাহেব চলে গেলে আহসান সবুজ ঘাসে হাটু মুড়ে বসে। তারপর বলে, প্রেয়সী! ভালবাসার আরেক নাম জানতাম না ঠিক।

তবে তুমি এসে চেনালে সঠিক বেঠিক। কঠিন, পাথরের ন্যায় হৃদয়ে আনলে প্রেমের জোয়ার, সেই জোয়ারে ভেসে আমি হয়েছি দিওয়ানা তোমার। যখনি হেসেছো তুমি, আহসান থেমে গিয়ে আবার বলল, যখনি হেসেছো তুমি, শুরু হয়েছে #তোলপাড়। আশায় আছে এই রাজকুমার, তোমারি মতো এক রাজকন্যার। তুমি যে মিলনসুধা, রূপের পদ্ম ফুল। তোমাকে পাওয়ার নেশায়, আজ মনটা বড়ই আকুল। আর দিওনা ফিরিয়ে আমায়, এটাই শেষ সুযোগ। পাঠকমন্ডলী সবাই চায়, দেখতে আমাদের মিলন হোক।
রিমি পলকহীন চোখে চেয়ে বলল, আপনি আমাকে এতো ভালবাসেন?

-হুম খুব। আমার দু চোখ জুড়ে শুধু তুমি আর তুমি থাকো।
-দু চোখ? ভালবাসার মানুষটি তো হৃদয়ে থাকে।
-হুম, তবে সেটা তো অনুভবে। আমি তো চোখ দিয়ে দেখতে চাই আমার রিমিকে। সারাক্ষণ।অনন্তকাল।
-তাই?
-হুম তাই। হাতটা দাও।
-কেন?

-তুমি কি কিছুই বোঝো না রিমি? আমি চাইছি কারণ এটা প্রপোজ চলছে।আহ! কোন কথা নয়, দাও তো।
রিমি ডান হাতটা বাড়িয়ে দিল। আহসান আলতো করে রিমির হাত ধরে নিয়ে প্রথম ভালবাসার ছোঁয়া এঁকে দিল রিমির হাতে। আহসানের ঠোঁটের স্পর্শে রিমির বুকের ভেতর কম্পন শুরু হয়ে গেল। চট করে হাতটা টেনে নিয়ে আসলো। তাই দেখে আহসান বলল, কি হয়েছে?
রিমি কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, বাসায় যাব আমি।

-উহু, যেতে দেব না আজ আমি।
-আপনার কাজ নেই হসপিটালে?
-না, আজ নেই আর। তাইতো আজ পুরো দিন তোমার সাথে কাটানোর প্লান বানালাম। আজ তুমি আর আমি। আমার দিনটা আজ তুমিময় করে রাখতে চাই। আর তোমার দিনটা হবে সম্পূর্ণ আমিময়।
-কি করবেন আপনি?
-আপাতত একটা গিফট এনেছি সেটা পড়িয়ে দেই তারপর পরের ধাপে যাব। এই বলে টেবিলের উপর থাকা অনেকগুলো বক্সের মধ্যে একটা গয়নার বক্স হাতে নিল। তা দেখে রিমির চোখের ভয়টা নিমিষেই রাগে পরিনত হয়ে গেল। ও বলল, খবরদার কোন হিরে অথবা সোনার নেকলেস টেকলেস পড়াবেন বলে দিলাম।

আহসান বাকা হাসলো। তারপর বলল, এটা ওইসব সোনা, হিরের চেয়েও দামি। বলে রজনীগন্ধ্যার গাজরা বের করলো গয়নার বক্স টা থেকে। রিমি তব্দা খেয়ে গেল তা দেখে। আহসান গিয়ে রিমির চুলের খোপায় যত্ন করে গাজরা পড়িয়ে দিল। তারপর আস্তে আস্তে সমস্ত গয়নার বক্স থেকে একে একে সকল ফুলের তৈরি হাড়, কানের দুল, টিকলি ইত্যাদি রিমিকে পড়িয়ে দিতে লাগলো। রিমি হা করে সবটা দেখছে। এতোটায় বিস্মিত যে বলার ভাষা হারিয়ে ফেলেছে রিমি।

পরিশেষে আহসান বলল, পারফেক্ট। একদম ফুলবাগ লাগছে আমার রিমিকে। রিমির চোখ বেয়ে নোনা পানি গড়িয়ে পড়লো। আহসান যে এমন কিছু করবে তা রিমির ভাবনার ও অনেক বাহিরে ছিল। ও গাঢ় গলায় বলল, আপনি কেমন মানুষ বলুন তো?
আহসান রিমির চোখের পানি হাত দিয়ে মুছে দিয়ে বলল, আমি মানুষ না তো। আমি হচ্ছি আমার বউয়ের চোখে আস্ত এক ভ্যাম্পায়ার।

-আপনি কিভাবে জানলেন? কথাটা বলে জিভে কামড় বসায় রিমি।
-বউয়ের মনের কথা পড়তে না পারি, কিন্তু মুখের কথা শুনতে তো পারি। তুমি আমাকে কথায় কথায় ভ্যাম্পায়ার বলতে সেটা খুব স্পষ্ট শুনতে পেতাম। বুঝলে?
-আমি,ইয়ে মানে, হয়েছে কি…

-থাক কি হয়েছে না হয়েছে, আমতা-আমতি, আর শুনছি না। মেইন পয়েন্টে আসি এবার। Do you love me?
রিমির কলিজা ধক করে বারি খায়। চোখ বড় হয়ে আসে।
-এভাবে অক্ষিগোলক দুটোকে কষ্ট না দিয়ে বলে ফেল জলদি। ভালবাসো না আমায়? রিমি তাও কিছু বলছে না।
আহসান এবার বিরক্ত হয়ে বলে,আচ্ছা যাও বলতে হবে না। আমি চলে গেলাম। বলে পিছ ফিলে হাঁটা দিল আহসান। কিছুদূর যেতেই আহসান থমকে গেল রিমির কথায়।

– I love you Ahsan! I really love you…
রিমির মুখ থেকে প্রত্যাশিত কথাটি শুনে আহসান ওইভাবেই দাঁড়িয়ে রইলো। তারপর ঘুরে দাঁড়িয়ে বলিউড ফেমাস শাহরুখ খানের মতো দুহাত দুদিকে মেলে দিল। রিমিও মাধুরীর মতো ছুটে গিয়ে আহসানের বুকে গিয়ে পড়ে। আর বলে, কোথায় যাবেন আপনি? একটুও বোঝেন না আমাকে। তাইতো সহজেই বলে দিলেন বউয়ের মন পড়তে পারেন না। বলি চলেই যদি যাবেন, তাহলে এভাবে নতুন করে বিয়ে করার মানে কি?

কিছক্ষণ আগে তো মুখে খই ফুটছিল আর এখন,,,,,, রিমি ওর কথাটা শেষ করতে পারলো না। তার আগেই আহসান রিমির চুলের মধ্যে হাত ডুবিয়ে রিমির মাথাটা তুলে একে বারে ওর ঠোঁটে হামলা বসালো। রিমি চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইলো। আহসান এমন অদ্ভুত কাজ করবে তা রিমি ভাবতেই পারেনি। বেশ কিছুক্ষণ পর আহসানের থেকে ছাড়া পেয়ে রিমি হাপ ছেড়ে বাঁচলো। রিমি কিছু বলবে কি আবারও একই কাজ করলো আহসান। এবার যেন ছাড়ার নাম গন্ধই নিচ্ছে না। রিমির দম যায় যায় অবস্থা। আহসানের শার্ট খামছে ধরলো এবার। তাই দেখে আহসান রিমিকে ছেড়ে দিয়ে একটা দুষ্টু হাসি দিয়ে বলল, এখন থেকে অভ্যাস করবে বুঝলে? নইলে অন্য কাউকে খুঁজতে হবে। রিমির শরীরের সমস্ত রক্ত এবার মাথায় চড়ে গেল। রিমি আহসানের কলার চেপে ধরে বলল, একদম খুন করে ফেলবো যদি এই কথাটা আর শুনি তাহলে।

আহসান রিমির দিকে ঝুকে বলল, তাহলে আমাকে আদর দিতে হবে যাতে আমি তোমাতেই বিভোর থাকি। অন্য কোনো মেয়ের দিকে তাকানোর সুযোগই দেবে না।
-আপনি আসলেই একটা অসভ্য লোক।
-তাই নাকি! বলে রিমির কোমড় জড়িয়ে নিল।
-ছাড়ুন আমাকে।

-না, কেন ছাড়বো? আমি তো অসভ্য। তাই অসভ্যতামী করছি।
-আপনি,,,রিমির ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে ওঠে। আবারও আহসানের বুকে মাথা ঠেকিয়ে নেয়।
এরই মাঝে একজন ওয়েটার আসে। এসেই বলে,
-স্যার আপনাদের লাঞ্চ রেডি। ওয়েটারকে দেখে রিমি আহসানের থেকে দূরে সরে আসলো।
-আসার সময় পেলেন না আপনি? দেখছেন সদ্য বিয়ে করা হাসবেন্ড ওয়াইফ রোমান্স করছে তাও আবার ফার্স্ট টাইম। সেখানে কিভাবে ঢুকে পড়লেন!

-থাক না আপনি রাগ করবেন না। উনি বুঝতে পারেনি। প্লিজ আমার জন্য রাগটা কন্ট্রোল করুন। রিমির রিকুয়েষ্ট এ আহসান আর রাগ দেখালো না। ওয়েটারকে খাবার সার্ভ করতে বলে রিমিকে নিয়ে চেয়ারে গিয়ে বসলো। আজ দুজন দুজনাকে খুব ভালবাসা দিয়ে খাইয়ে দিল আহসান রিমি। খাওয়া শেষে আহসান ওর হাতের ভাজে রিমির হাত বন্দী করে নিল। আহসানের চোখে মুখে খুশির ঝলক। সাথে রিমিরও। থাকবে নাই বা কেন? কত বাধা বিপত্তি পেড়িয়ে অবশেষে আজ তারা কাছে পেল ভালবাসার মানুষটিকে। রিমি আহসানের কাধে মাথা রেখে বলল, আপনি আমার সাথে আছেন এটা যদি আপনার বাবা জানতে পারে তাহলে কি হবে ভেবেছেন?

-বাপিকে বলেই এসেছি। আমি আর বাড়ি যাব না। বাড়ি ত্যাগ করেই এসেছি। তোমার হাত ধরবো বলে। সেদিনই আমার এই কাজটা করা উচিত ছিল। বিশ্বাস করো আমি তোমাকে একা বাড়ি থেকে বের দেব ভাবিনি। আমিও ওই মুহুর্তে ভেবে নিয়েছিলাম বাপিকে কটা কথা বলে তোমার সাথেই বেরোবো। কিন্তু বাপির সাডেনলি হার্ট অ্যাটাক হয়। ফলে আমি আর যেতে পারি নি।
-হার্ট অ্যাটাক হয়েছে আপনার বাপির? আর আপনি আমাকে জানালেন না?
-সরি আসলে তুমি এমনিতেই আমাকে তোমার কাছে ঘেঁষতে দিচ্ছিলে না আর এটা বললে আরও ইগনোর করতে। ভাবতে তোমার জন্য সব হয়েছে। তাই বলিনি।

-সত্যি তো এটাই। আমার জন্যই এসব হয়েছে। আমি আপনার জীবনে না আসলে আজ আপনাদের বাবা ছেলের সম্পর্কে ফাটল ধরতো না। সব দোষ আমার।
-না রিমি। সব দোষ ভাগ্যের। আজ আমি স্রুতিকে মন থেকে থ্যাংকস জানাচ্ছি। ও যদি না পালাতো তাহলে আমি এতো সুন্দর একটা নারীকে আমার জীবনে পেতাম না।
-আপনি বলুন এখন আপনার বাপি কেমন আছে? আমার খুব খারাপ লাগলো শুনে। সাংঘাতিক একটা ঘটনা ঘটেছে তাহলে। আপনি আপনার বাপির খেয়াল রাখবেন বুঝলেন?

-আলহামদুলিল্লাহ এখন ভালোই আছে। তবে বাপির খেয়াল রাখার দায়িত্ব তার বউ নতুবা ছেলের বউয়ের। আমি তো কাজেই থাকবো।
-আমি! মাথা কি গেছে? উনি আমাকে দেখলে আরও অসুস্থ হয়ে যাবেন।
-আরে না। তুমি এসব নিয়ে ভেবো না। আমি এখন থেকে তোমার সাথেই থাকবো। অনলাইনে চাকরি খোঁজা শুরু করবো আজ। বাড়ি আর যাব না।

-এটা করবেন না। কারণ আপনার বাপি যেকোনো সময় অসুস্থ হয়ে যেতে পারে। আপনি বাসায় না থাকলে যেকোন সময় ভয়ংকর কিছু হয়ে যেতে পারে। উনি আপনার বাবা। বাবার চেয়ে আমি বড় নই। বাবা হারালে কাঁদলেও ফিরে পাবেন না। যাদের বাবা নেই তারাই বোঝে বাবার কদর কতখানি। আপনার বাপি আপনাকে খুব ভালবাসে। প্লিজ এটা করবেন না।
-তুমি ঠিক বলেছো কিন্তু আমাকে বাপি ভালবাসলে আমার ভালবাসাকে কেন মেনে নিতে পারছে না?
-মেনে নেবে। আপনি একটু সবুর করুন।

-তুমি জানো না তাই এমন বলছো। বাপি আমাকে আবার বি,,
-থেমে গেলেন যে? বি মানে?
-বি মানে কিছু না। তুমি আমাকে দুটো দিন তোমার সাথে থাকতে দাও আমি আজকের মধ্যেই জব জোগাড় করে ফেলবো।
-একদম ই না। আপনার বাপি খুব রেগে যাবেন। ফলে আবারও,,, থাক নাই বললাম কথাটা। আপনি কিন্তু এমন কিছুই করবেন না বলে দিলাম। নইলে আর কথা বলবো না আপনার সাথে।
-এটা করো না। আচ্ছা তাই হবে। এবার এই বিষয় টা বাদ দাও রোমান্টিক কিছু বলো। গান বা কবিতা,কাব্য।
-আমি সেসব পারি না আপনার মতো। আমার একটা প্রশ্ন আছে।
-বলে ফেল।

-এই যে ছাতাওয়ালা লাভটা সাতরঙা কেন? লাল কেন নয়?
-আমি এভাবেই বানাতে বলেছি।
-কিন্ত কেন?
-কারণ আমি চেয়েছি আমাদের পথ চলাটা রংধনুর সাতটা রঙ দিয়ে শুরু হোক। যাতে এভাবেই আমাদের সামনের পথ গুলো রঙিন, জমকালো হয়ে থাকে।

-বাহ! ভালো তো। কিন্তু আমরা এক হয়ে থাকতে পারবো তো চিরকাল?
-হুম পারবো। আমরা যতদিন বাঁচবো, একে অপরের জন্য বাঁচবো। বলে রিমির কপালে ঠোঁট ছোঁয়ায়।
-বিকেল হয়ে এসেছে আমাকে বাড়িতে দিয়ে আসুন। নইলে বাবা মা চিন্তা করবে। আর আপনিও বাড়ি যান। নইলে আপনার বাপি কোনো একটা হেস্তনেস্ত করে ছাড়বে।
-এতো কুইক?
-প্লিজ।

-আচ্ছা তবে রাতে কিন্তু আমার শ্বশুরবাড়ি যাব বলে দিলাম।
-আচ্ছা এসেন। তবে আপনার বাপি যেন কিছু বুঝতে না পারে। সাবধানে।
-ওকে, এবার আমাকে হামি দাও তারপর বাসায় দিয়ে আসবো। রিমি আর কোনো উপায় না পেয়ে আহসানের আবদার গুলো পূরণ করলো। কারণ রিমি ভালো করেই জানে আহসান নাছোড়বান্দা। ছাড়ার পাত্র নয়।

-ওয়াও! সো রোমান্টিক। আমার রিফাতটা যদি তোর আহসানের মতো হতো তাহলে কি যে ভালো হতো রে বোন।
-রিফাত ভাইয়াও খুব ভালো। সবাই যদি একইরকম হতো তাহলে দুনিয়ায় এতো ভ্যারাইটি থাকতো না বুঝলি?
-ঠিক। কিন্তু রিমি, আহসানের সাথে তো আমার আর দেখাই হলো না। কাল তো চলেই যাচ্ছি।
-রাতে আসবে বলেছে।

-রাত তো হয়ে গেছে অলরেডি। সেদিনের মতো আজও দেখ আসবে না হয়তো।
-আজ না আসলে তেরোটা বাজাবো ওনার।
-জানিস আমি আব্বু আম্মুকে তোর আর আহসানের কথাটা বলে দিয়েছি।
-কেন বললি? এইজন্যই আব্বু আম্মু আমাকে দেখে হাসছিল। মিষ্টি করে কথাও বলছিল।
-তা তো বলবেই। বাবা মার সবচেয়ে বড় পাওয়া হচ্ছে তার ছেলে মেয়ের সুখ। তারা সবসময় চায় তাদের ছেলে মেয়ে সুখে শান্তিতে ঘর করুক।

-আপনি তো সবই জানেন। জ্ঞানের পন্ডিতমশাই। রিমি রিমলি এটা ওটা নিয়ে তর্কাতর্কি করছে। এরই মাঝে রিমির ফোনে আহসানের ম্যাসেজ আসে। রিমি ম্যাসেজটা ওপেন করেই দরজা খুলতে চলে যায়। আহসান দাঁড়িয়ে ছিলো হাতে আইসক্রিম এর বক্স নিয়ে। রিমি আহসানকে দেখা মাত্রই লজ্জায় চোখ নামিয়ে রাখলো। রিমি এই প্রথম আহসানকে দেখে রাগ না করে লজ্জা পাচ্ছে। আহসানের কাছেও ব্যাপারটা ভালো লেগেছে। একেবারে রোমান্টিক টাইপ। যেমনটা সে চাইতো।

-এভাবে দাঁড়িয়ে লজ্জা পাবে নাকি ভেতরে যেতে দেবে?
রিমি এবার হচকচিয়ে যায় আহসানের কথায়। তারপর সাইডে চেপে আহসানকে ভেতরে আসার সুযোগ করে দেয়। আহসান রিমির হাতে আইসক্রিমের বক্সটা ধরিয়ে দিয়ে রিমির রুমে যেতেই রিমলি বলে ওঠে আসসালামু আলাইকুম ছোট ভাই। আহসান রিমলিকে দেখে কিছুটা আন্দাজ করতে পারে যে ও নিশ্চয়ই রিমির বড় বোন হবে। তাই বলে, ওয়ালাইকুমুস সালাম। আপনি নিশ্চয়ই রিমির বড় আপু?

-হ্যাঁ, ঠিক ধরেছো। তবে তুমি কিভাবে জানলে?
-একটু একটু মিল আছে রিমির সাথে। তাছাড়া আমি শুনেছি রিমির বড় বোন আছে।
-ও, খুব ভালো। তবে শ্বশুর বাড়ি এসেছো খালি হাতে? মিষ্টি নিয়ে আসবে তো! (মজা করে বলল)
-কথাটা ঠিক বলেছেন আপু। আসলে আমার খেয়াল ছিলো না। যদি জানতাম আপনি এসেছেন তাহলে মিষ্টির দোকান নিয়ে আসতাম। তবে আমি আইসক্রিম নিয়ে এসেছি। ওয়েট করুন আমি মিষ্টি অর্ডার দিচ্ছি। এখনি চলে আসবে।

-আরে ভাই আমি মজা করেছি। তুমি যে বলেছো এটাই অনেক। আমি মিষ্টি লাইক করি না। তবে খাবারের তালিকার মধ্যে আইসক্রিম আমার খুব পছন্দের। আমি তাহলে তোমার আইসক্রিম খেতে গেলাম তুমি বসো। এই বলে বেরিয়ে আসলো রিমলি। কিছুক্ষণ পর রিমি একটা ট্রেতে আইসক্রিম সাজিয়ে নিয়ে আসলো। আহসান রিমিকে দেখেই বলল, কি করছিলে তুমি? এতোক্ষণ লাগে নাকি?
-একটু সময় তো লাগে নাকি? আচ্ছা সরি। আপনি যে এখানে এসেছেন, সেটা আপনার বাপি বুঝতে পারেনি তো? আর মাও তো চিন্তা করতে পারে আপনার জন্য!

– বাপি বুঝলেও আমার কিছু করার নেই। আর আমি মমকে বলেই আসি সবসময়। যদি কোনো প্রবলেম হয়, তাহলে মম আমাকে জানিয়ে দেবে। তাছাড়া আমার মম আমাকে খুব সাপোর্ট করে। আমার হয়ে অনেকবার বাপিকে বুঝিয়েছে।
-কথা ঠিক। আপনার মা খুব ভালো একজন মা। আমার কাছে মনে হয় উনি আমার নিজের মাই। খুব ভালবাসে আমাকে। ওনাকে দেখলে মনটাই ভালো হয়ে যায়।

-আমি শুনেছি মেয়েরা তার শ্বাশুড়িকে টোটালি সহ্য করতে পারেনা। আর তোমার নাকি শ্বাশুড়িকে দেখলে মন ভালো হয়ে যায়!
-হুম কারণ আমার ক্ষেত্রে উল্টোটা ঘটেছে। শ্বশুর আমার যেমন তেমন, শ্বাশুড়ি আমার মনের মতন। বুঝলেন?
-আমার বাপিও খুব ভালো। তুমি তার উপরের আত্মাকে দেখেছো, ভেতরের না।
-হুম জানি আমি। কিন্তু আপনার বাবা টাকার মোহে ছোটকে ছোট করেই দেখে। ওনার মনটাই বিলাসবহুল।
-ঠিক তবে আমি বুঝে উঠতে পারি না বাপি আমাকে আর মমকে এতো ভালবাসে। নিজের কাজকে সম্মান করে। এমন অনেক গরীব রুগী আছে তারা টাকার অভাবে চিকিৎসা করাতে পারেনা। বাপি তাদেরও ফ্রি চিকিৎসা করে। এতো ভালো একটা মানুষ তোমার ক্ষেত্রে এতো নির্বিচার কেন?

-তা তো জানি না। এখন আইসক্রিম টা খান নইলে সব গলে যাবে। অনেকটা গলে গিয়েছেও।
-তোমার আপু আসুক তারপর।
-আপু আসবেনা বলেছে৷ ও বললো আমাদের মধ্যে আসতে চায়না তাই অন্যরুমে চলে যায়। এখন আপনি নিন তো।
আহসান রিমির হাত থেকে আইসক্রিমের বাটিটা নিয়ে নেয়৷ তারপর বলে, এভাবে আইসক্রিম খাওয়ার মজা নেই জানো।
-তাহলে কিভাবে মজা আছে?

আহসান ঠোঁটে দুষ্টু হাসির রেখা টেনে আইসক্রিম নিয়ে রিমির গালে ঠোঁটে লাগিয়ে দেয়। তারপর আহসান রিমির গাল ঠোঁট থেকে আইসক্রিম খেতে থাকে। রিমি চোখ বন্ধ করে কাপড় খামছে থাকে। ইতোমধ্যে রিমির কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। আহসান যেন তার কাজে ব্যস্ত। থামার নাম গন্ধই নেই। এদিকে রিমির শরীর অসাড় হয়ে এসেছে। হিমশীতল করা অনুভূতি গ্রাস করে নিয়েছে রিমিকে। আহসান রিমির গলায় ছোট ছোট ভালবাসার স্পর্শ দিতেই রিমির হৃদ স্পন্দন থেমে যায়। আস্তে আস্তে আহসান এক ঘোরের মধ্যে চলে যায়।

তোলপাড় পর্ব ৪৪+৪৫+৪৬

হারিয়ে যায় তার প্রেয়সীর মায়াজালে। পূর্ণতা দেয় জমে থাকা অনুভূতিগুলোকে। সকালে আহসানের ঘুম ভাঙে ফোনের শব্দে। ফোনটা হাতে নেবে কি রিমি আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরে আহসানকে। আহসান রিমিকে সামলে কোনমতে ফোনের নাগাল পেল। তার মধ্যে কল কেটে যায়। আহসান ফোনের স্কিরে তাকাতেই বড়সড় একটা শক খেল। এখন অবধি ১০০ টার মতো মিসড কল ভেসে আছে রঞ্জিতের নাম্বার থেকে। আহসান রিমির থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে রিমিকে না জানিয়েই চলে গেল। এই ভেবে যে পরে রিমিকে জানিয়ে দেবে। রিমিকে ডাকলো না কারণ রিমি গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন ছিল। বাড়িতে এসেই আহসান রঞ্জিতের মুখোমুখি হলো। রঞ্জিতের চোখ লাল। আগ্নেয়গিরির অগ্নুৎপাতের মতো।

-কোথায় ছিলে রাতে?
-রিমির সাথে ছিলাম বাপি। আহসান যে এতো সহজে এভাবে মুখের উপর উত্তর দেবে তা রঞ্জিত কল্পনাও করতে পারেনি।
-তুমি কি তোমার উপর হাত তুলতে বাধ্য করবে আহসান? কখনো তো মার খাওনি আমার হাতে।
-তুমি আমার বাপি। চাইলেই আমাকে মারতে পারো।
-মুখে মুখে কথা বলাটা তোমার স্বভাব হয়ে গিয়েছে। সব ওই রিমির থেকে শিখেছো। আমার থেকে কি রিমি বেশি আপন হয়ে গেল নাকি?

-কখনোই না৷ নিঃসন্দেহে আমি তোমাকে রিমির থেকেও অনেক বেশি ভালবাসি। কিন্তু সবাই সবার জায়গায় আমার কাছে প্রিয়। আমি যেমন তোমার আর মমের জায়গায় কাউকে বসাতে পারবো না, ঠিক সেভাবে রিমির জায়গায় ও অন্য কোনো মেয়েকে বসাতে পারবো না। আমি এক কথায় রিমিকে ছাড়া অন্য কাউকে মেনে নিতে পারবো না৷ তাই কোনো নাদিয়াকে আমার জীবনে জড়ানোর দুঃসাহস দেখিও না। কথাটা বলেই আহসান সিড়ি বেয়ে উপরে চলে যায়। রঞ্জিত মুষ্টিবদ্ধ করে দাঁড়িয়ে থাকে। রাগে ফুসছে সে। চোখ যেন তার আগুন ছুড়ছে আনাচে কানাচে।

তোলপাড় শেষ পর্ব