তোলপাড় সিজন ২ গল্পের লিংক || শান্তনা আক্তার

তোলপাড় সিজন ২ পর্ব ১+২
শান্তনা আক্তার

‘একদিন এই মস্ত বাড়ির বউ হবে এই রিমি। জানো মা! এই বাড়িতে একটা গোলুমোলু ছেলে আছে। সবসময় গাড়ি চড়ে বেড়ায়। একদিন দেখেছিলাম গাড়ির জানালা খুলে আমাকে দেখে হেসে দিয়েছিল। তখনই ভেবে নিয়েছি একেই বিয়ে করবো আমি। দেখো মা, তোমার মেয়ে রাজরানী হয়ে পায়ের উপর পা রেখে হুকুম চালাবে।’
মাত্র এগারো বছর বয়সী মেয়ের মুখে বিয়ের কথা শুনে হতভম্ব হয়ে যায় আম্বিয়া খাতুন। সে জানে মেয়ে তার পাকাবুড়ি। তবে এতোটা! তা জানা ছিল না।

‘পাকা মেয়ে কোথাকার। সবসময় পাকামি। স্কুলের জন্য দেড়ি হয়ে যাচ্ছে।’
‘একটু দাঁড়াও না কিছুক্ষণ পর ছেলেটার গাড়ি বের হবে গেট দিয়ে।’
‘না প্রতিদিন তুমি একই কাজ করো। দেখো বাড়ির দারোয়ান আমাদের দিকে কিভাবে তাকিয়ে আছে! রোজ রোজ তুমি এখানে দাঁড়িয়ে থাকো। এটা ভালো বিষয় নয়। কোন একদিন ওই দারোয়ান চাচা দৌঁড়ানি দিবে আমাদের মা মেয়েকে।’
‘বললেই হলো? উনি জানে না আমি এই বাড়ির হবু বউ? চলো গিয়ে জানিয়ে দিয়ে আসি, তাহলে আর আমাদের দৌঁড়ানি খেতে হবে না।’
‘রিমিইইই।’ আম্বিয়া চোখ রাঙিয়ে তাকালেন রিমির দিকে। রিমি যতই চঞ্চল প্রকৃতির হোকনা কেন, মাকে যমের মতো ভয় পায়। তাই চুপ হয়ে মায়ের সাথে স্কুলের পথে পা বাড়ায়।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

°°°°°১২ বছর পর°°°°°
‘আজ পুরো ১২ বছর পর আমরা আবারও একসাথে হলাম। আমি যে কতটা এক্সাইটেড তোদের দেখে তা বলে বোঝাতে পারবো না।’
‘তো এই খুশিতে তোমার গলায় একটা গান হয়ে যাক আহসান ভাইয়া!’
‘কি যে বলিস না জিসান! আমি তো সবসময় গিটারই বাজিয়ে গেলাম। এখন একটু আড্ডা দেই নাহয়।’
‘ভাইয়া, জিসান ভাইয়া তো ঠিকই বলেছে। গান গা না একটা। একটা রোমান্টিক গান গা তুই। যাতে মনটা ফ্রেশ হয়ে যায়।’
‘আমাদের জান্নাত সবসময় রোমান্টিক মুডে থাকে তাই ওর মাথায় রোমান্টিক গানই ঘুরপাক খায়। সারাদিন রোমান্টিক মুভি দেখলে তো এমন হাল হবেই।’

‘তোমার সাথে কেউ কথা বলছে না ওকে? আমি আমার ভাইয়াকে বলেছি। তুমি আমার কথার মাঝে পা ঠ্যাং জাগাবে না।’
‘এই ঠ্যাং কিরে? কানাডা থেকে এসব শিখে এসেছিস নাকি?’ দেখতে তো পেত্নী ফেল।আবার আসছে রোমান্টিক গান শুনতে!’
‘স্রুতি আপু! তোমার ভাইকে থামাও বলছি।’
‘জিসান তুই কিন্তু মার খাবি বলে দিলাম। সবসময় জান্নাতের পেছনে লাগবি না। কতদিন পর আসলো মেয়েটা আর তুই কিনা পেছনে লেগে গেলি?’
‘তুই কে যে তোর কথা শুনবো?’
‘কে মানে? আমি তোর বড় বোন। কিছু বলি না বলে মাথায় চড়ে যাচ্ছিস।’
‘তো?’
‘তো মানে?’

ওদের ঝগড়া ঝাটি আহসান মোটেও সহ্য করতে পারছে না। খুব ঠান্ডা প্রকৃতির ছেলে আহসান। ঝায়-ঝামেলা মোটেও পছন্দ করে না।
‘তোরা সবাই চুপ কর গাইস। আর নইলে বল আমি চলে যাই।’
‘এই না, তুই চলে গেলে কিভাবে হয় বল? আচ্ছা আমরা নাহয় আড্ডা দেই বা কোনো গেম খেলি। আহসান পছন্দ করছে না যখন, ওর কথাই শুনি আমরা।’
‘ওকে স্রুতি আপু। আমরা নাহয় গেমই খেলি৷ যেহেতু আমরা চারজন আছি চলো লুডু,চেস অথবা ক্যারাম খেলি। আমি আর তুমি পার্টনার। আহসান ভাইয়া আর জিসান ভাইয়া পার্টনার।

‘আমি আর তুমি পার্টনার। আহসান ভাইয়া আর জিসান ভাইয়া পার্টনার।’ জিসান কথাটা ব্যঙ্গ করে বলল।
‘ভ্যাঙালে ব্যাঙ পায়, মরা গরুর ঠ্যাং খায়। তুমি আমার যেকোনো কথায় নাক না গলালে পেটে ব্যথা করে তাইনা?'(কোমড়ে হাত গুজে নাক কান ঘুচিয়ে বলল জান্নাত।)
‘তুই যা বলিস তা আমার মোটেও পছন্দ হয়না। একদম ডিজগাস্টিং লাগে। খেলতে পারেনা কিছুই। হেরে ভুত হওয়ার জন্য লুডু,দাবা,ক্যারাম খেলতে আসছে! তাও আবার এই চ্যাম্পিয়ন জিসানের সাথে।’

‘এতো এটিটিউড দেখাবা না ওকে? ছোট বেলায় পারতাম না বলে হেরে যেতাম। এখন আমি পুরো পাঁকা খেলারি।
‘হয়েছে, আমি জানি তুই কত পাঁকা খেলারি। ক্যারামের স্টিকে টোকা দিতে গিয়ে হাতে ব্যথা পাস আর তুই নাকি পাঁকা খেলারি!’
‘উফ কি যে মহাবিপদ! তোদের কাউকে কিছুই বলতে হবে না। আমিই বলছি কিছু একটা।’
‘একদম ঠিক বলেছিস স্রুতি। এই জিসান গাঁধা আর জান্নাত গাঁধীকে দিয়ে কিছুই হবে না। তার থেকে বরং তুই বল।’ আহসান বেশ বিরক্ত হয়ে কথাটা বলল।

‘হুম। তো আমরা ট্রুথ অর ডেয়ার খেলি? এটাই বেস্ট হবে। কি বলিস তোরা?’
আহসান বলল, ‘ওকে তাহলে শুরু করা যাক। জান্নাত তুই গিয়ে একটা খালি বটাল নিয়ে আয়।’
‘ওকে ভাইয়া।’
জান্নাত বোতল নিয়ে আসলে ওরা খেলা শুরু করে। প্রথমেই স্রুতির পালা আসে। জান্নাত বলল, ‘আপু বলো ট্রুথ অর ডেয়ার?’
‘উমম, ট্রুথ।’

‘গাইস তোমরা কেউ কি আপুকে টাস্ক দিতে চাও?’ আহসান ও জিসান উভয়ই বলল না তুই দে।
‘ওকে তাহলে আপু তুমি বলো তোমার প্রথম ক্রাশ কে?’
স্রুতি সোজাসাপটা বলল, ‘তোর ভাই। ওই প্রথম ক্রাশ। ওর পরে আর খাইনি।’
আহসান হচকচিয়ে ওঠে স্রুতির কথা শুনে। আহসান বলল,’ফান কম করবি। আর তুই কিন্তু ট্রুথ নিয়েছিস, তাই মিথ্যে কেন বলছিস?’

‘আমি সত্যিই বলেছি ওকে? তুই আমার ক্রাশ।’
‘আচ্ছা ভাইয়া এন্ড আপু, তোরা এটা নিয়ে বারগেনিং করিস না। এভাবে চললে রাত হয়ে যাবে। আর আমার চান্সই আসবে না।’ বলে জান্নাত বোতল ঘোরালো। এবার পালা আসলো জিসানের। জিসানের পর জান্নাত। ওরাও ট্রুথ নিয়েছে। সেম ওদেরও স্রুতির মতো প্রশ্ন জিজ্ঞেস করা হয়েছে। জান্নাত বলল ওর ক্রাশ বিখ্যাত নায়ক ঋত্বিক রশান। আর জিসান বলল ওর ক্রাশ বিখ্যাত সিঙ্গার লিজা। তারপর শেষে পালা আসলো আহসানের।

‘এইতো আমার ভাইয়ার পালা চলে এসেছে। ভাইয়া তুই কি নিবি?’
‘আমার কোনো ক্রাশ নেই। আর তোরা যা ডেঞ্জারাস! ট্রুথ নিলে তোরা যেসব কুয়েশ্চনস করবি তার একটারও আন্সার আমি দিতে পারবো না৷ কারণ আমার আন্সার দেওয়ার মতো কিছু নেই। শুধুমাত্র না ওয়ার্ডটা ছাড়া। তাই আমি ডেয়ার নিলাম। তবে গান বাদে সব করবো। এটা আমার কন্ডিশন।’

‘তাহলে আর কি করতে বলবো তোকে? নাচবি নাকি কবিতা বলবি?’ জিসান শ্রুতিকে থামিয়ে বলল,
‘আরে না আপু। আমি ভাইয়াকে একটা টাস্ক দেই খুব ইন্টারেস্টিং আর ইউনিক।’
‘আচ্ছা দে দেখি কি ইউনিক টাস্ক দিস তুই।’
‘তো ভাইয়া তোমার ডেয়ার হচ্ছে, তুমি মনে কর আজ তুমি একটা সিম্পল মানুষ। মানে মধ্যবিত্ত এক ফ্যামিলির ছেলে। ডাক্তার নও।’
‘হুম মনে করলাম। এবার আমার টাস্ক কি শেষ?’
‘আরে না, তুমি আজ একটা সাধারণ পরিবারের ছেলের মতো রাস্তায় ঘুরে বেড়াবে। মানে মানুষ যেন ভাবে তুমি রঞ্জিত তালুকদারের ছেলে আহসান তালুকদার না। তুমি সাধারণ কেউ।’

‘মানে কি বলছিস তুই? আমি মধ্যবিত্ত সেজে রাস্তায় ঘুরে বেড়াবো আর এটাই আমার ডেয়ার?’
‘হুম এটাই। এখন বের হবে আর বিকেলে ফিরে আসবে। কি কি অভিজ্ঞতা অর্জন করবে সব রাতে শেয়ার করবে।’
‘বাট আই কান্ট ডু দিস। বাপি জানতে পারলে খুব রিয়েক্ট করবে। বাপির একটা রেপুটেশন আছে এখানে।’
‘আরে কেউ তো তোকে দেখেনি। তাই টেনশন ফ্রি থাক। মামুর দোহাও না দিয়ে তুই পারবি না তাই বল। তুই মামুকে ইস্যু করছিস, যাতে পাড় পেয়ে যাস।’

‘আহ জিসান! আহসান পারবে না প্লিজ অন্য কিছু দে।’
‘না আপু। জিসান ভাইয়ার কথা বা কাজ যতই আমার পছন্দ না হোক। এই ডেয়ারটা কিন্তু আমার খুব পছন্দ হয়েছে। গান গাইবে না। এটাই ওর আসল শাস্তি।’
‘ওকে গাইস আমি নাহয় দু তিন লাইন গান গেয়ে দিলাম। তাও আমাকে এসব ভয়াবহ ডেয়ার থেকে মাফ কর। আগে জানতে পারলে গানই গাইতাম।’
‘একদম না। তোমাকে এই ডেয়ারটাই নিতে হবে।নইলে ভাববো তুমি ভীতু।’
‘জিসান, ভাই তুই অন্য কোন ডেয়ার দে।’

‘না আহসান ভাইয়া ভীতু মানে ভীতু।’ জিসান আর জান্নাত মিলে আহসানের কানের মাথা খেয়ে ফেলেছে ভীতু ভীতু বলে। আহসান নিজের ইনসাল্ট সহ্য করতে না পেরে রাজি হয়ে গেল। এরপর জিসান আর জান্নাত মিলে আহসানকে মধ্যবিত্ত পরিবারের সাজে সাজিয়ে দিল। ইন ছাড়া শার্ট, সাধারণ স্লিপার পড়িয়ে বাড়ির সবার আড়ালে আহসানকে বাহিরে বের হতে সাহায্য করলো। আর দারোয়ানকে বলে দিল আহসানের ব্যাপারে কাউকে কিছু না বলতে। আহসান সাত পাঁচ না ভেবে সামনের রাস্তা ধরলো।
(পরিচয়ঃ আহসান ও জান্নাত রঞ্জিত তালুকদার ও অপা তালুকদারের একমাত্র ছেলে মেয়ে।

আহসানের বয়স যখন ১৪ আর জান্নাতের বয়স যখন ৬ তখন রঞ্জিত পরিবারের সকলকে নিয়ে কানাডায় শিফট করে। এখন বাংলাদেশে ফিরে আসার মূল কারণ রঞ্জিতের মা মুনতাহা তালুকদার। রঞ্জিতের বাবা এরশাদ তালুকদার মারা যাওয়ার পর রঞ্জিত তার মাকে রাজি করিয়ে বিদেশ নিয়ে যায় ছেলে মেয়েকে মানুষ করার জন্য। তবে আহসানের পড়াশোনা শেষ হলেও জান্নাতের শেষ হয়নি। তার আগেই মুনতাহা বায়না ধরেছে জীবনের শেষ নিশ্বাস নিজের দেশের মাটিতেই ত্যাগ করতে চান।

আর জান্নাত বাংলাদেশে গিয়েই পড়াশোনা শেষ করুক। মায়ের ইচ্ছেটা পূরণ না করে থাকতে পারলেন না রঞ্জিত। রঞ্জিত তার বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান নয়। রঞ্জিতের ছোট বোন হাফসা রহমান ও তার হাসবেন্ড নিলয় রহমানের সন্তান স্রুতি ও জিসান। স্রুতি আহসান প্রায় সমবয়সী। জিসান স্রুতির দেড় বছরের ছোট। তবে জান্নাত ওদের তুলনায় বেশ ছোট। বাকিটা ধিরে ধিরে জানতে পারবেন।)

‘উফ আজ কি ভালো একটা দিন। শুনলাম আমার প্রিন্স আহসান এসেছে কানাডা থেকে। এতো ভালো মুডটার বারোটা বাজিয়ে দিল এই কুকুরগুলো। এতো সুন্দর মুডটা নষ্ট করার কি খুব দরকার ছিল তোদের? আল্লাহ,আল্লাহ করে রাস্তাটা পাড় করতে পারলেই বাঁচি। আমার মা আমার সাথে আসে না বলে কুকুরগুলো বড্ড সাহস পেয়ে গেছিস তোরা। আমি যে কি করবো এগুলো কে নিয়ে? জন্মশত্রু তোরা।’

রিমি বকবক করতে করতে রাস্তা দিয়ে হেঁটে চলেছে। আচমকাই একটা কুকুর দৌঁড়ে আসছিল ওর দিকে। রিমি তা দেখে নাক কান খিচে দিল ভোঁ দৌড়। একেবারে গিয়ে ধাক্কা খেল ফুটপাতের ঝালমুড়ির ছোট খাটো একটা গাড়ির সাথে। সাথে সাথে গাড়িটা উলটে পরে৷ ঝালমুড়ি ওয়ালা পাশেই একটা দোকানে চা খাচ্ছিলো, এসব দেখে দৌঁড়ে আসে। এসেই বলে,
‘হায়রে, আমার কি সর্বনাশ করলো রে! আমার সব ঝালমুড়ির জিনিস মাটিতে ফালায় দিল!’
রিমি ভয় ভয় কন্ঠে বলল,

‘আমি ইচ্ছে কিছুই করিনি চাচা। আসলে একটা কুকুর আমার পেছনে,,,
‘আরে চুপ করো মাইয়া। আমার ক্ষতি কইরা এহন কইতাছো ইচ্ছা কইরা করো নাই। আমি কিছুই জানি না। আমি গরীব মানুষ। এহন আমার ক্ষতিপূরণ দিতে হইবো। কি কন ভাইসব?’ সেখানে থাকা প্রতিটি লোক সায় দিল ঝালমুড়িওয়ালার সাথে।
‘আচ্ছা ক্ষতিপূরণ আমি দেব। বলুন কত দিতে হবে?’
‘বেশি না ১৫ হাজার টাকা দিলেই হইবো।’

‘কিহ! ১৫ হাজার টাকা? এখানে ভালো করে ২ হাজার টাকারও জিনিস নেই। আপনি ১৫ হাজার টাকা কোন হিসেবে চাইলেন?’
‘আমি কিছুই জানিনা। আমারে ১৫ হাজার টাকাই দিতে হইবো।’
‘আজব তো!’
আহসান ভীড় দেখে একজন লোককে ডাক দিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘ভাইয়া ওখানে এতো ভীড় কেন?’
লোকটি বলল, ‘ আর বলবেব না ভাই। একটা মেয়ে একজন ঝালমুড়িওয়ালার গাড়িসহ উল্টিয়ে ফেলে দিয়েছে। সেই নিয়েই ঝামেলা।’

আহসান ভীড়ের মধ্যে ঢুকে গিয়ে বলল, ‘আচ্ছা এখানে এতো হট্টগোল কেন করছেন আপনারা?’
রিমি আহসানের সামনে গিয়ে বলল, আমি বলছি। এই লোকটার গাড়ি টা আমি ইচ্ছে করে ফেলিনি। আমি ক্ষতিপূরণ ও দিতে চেয়েছি। কিন্তু উনি বলছেন ১৫ হাজার টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। এই জিনিসপত্র দেখে কি মনে হচ্ছে এখানে ১৫ হাজার টাকার জিনিস আছে?

আহসান পুরো তব্দা খেয়ে গেল কপাল ভাজ করে বকবক করা মেয়েটিকে দেখে। রিমি আঙুল উঁচিয়ে একটার পর একটা কথা বলে যাচ্ছে ঠোঁট নাড়িয়ে। আর আহসান চোখের পলক না ফেলে এক ধ্যানে দেখে যাচ্ছে রিমির ভাব ভঙ্গি। আহসানের ধ্যান ভাঙে ঝালমুড়িওয়ালার বিচ্ছিরি গালাগাল শুনে। আহসান পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করে ১৫ হাজার টাকা দিয়ে বিদায় জানালো ঝালমুড়িওয়ালাকে। আস্তে আস্তে ভীড় কমে যায়। আর এদিকে রিমি চোখ রাঙিয়ে চেয়ে থাকে আহসানের দিকে।
‘আমার হয়ে টাকা কে দিতে বলেছে তোমাকে?’

‘থাক আমার কোনো সমস্যা নেই। আসলে ঝামেলা আমি পছন্দ করি না।’
‘তো? সেটা কি আমার দায়? এখন আমি তোমাকে কিভাবে শোধ করবো টাকাটা?’
‘করতে হবে না। আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন।’
‘একদমই না। আমি কারো ঋণ রাখি না। আমার কাছে এখন ওতো টাকা নেই। চিনি না জানি না,তুমি আগ বাড়িয়ে আমার হয়ে টাকাটা কেন দিলে?’

‘আচ্ছা আপনি পরে নাহয় দিয়ে দিয়েন আমার টাকাটা। আর এভাবে মেয়েদের ঝগড়া করা মানায় না রাস্তার মাঝে।’
‘আমি কি ইচ্ছে করে কিছু করেছি নাকি? যাজ্ঞে, আমার দিনটাই আজ খারাপ হয়ে গেল। যেতে চেয়েছিলাম কোথায়, আর হয়ে গেল কি! এখন আর সময় নেই কলেজের জন্য দেড়ি হয়ে যাচ্ছি।’
‘জ্বি, আপনি কোথায় যেতে যাচ্ছিলেন?’
‘এইতো তালুকদার বাড়িতে। শুনেছি তারা নাকি কানাডা থেকে এসেছে। তাই আমার প্রিন্সকে দেখতে যাচ্ছিলাম।’
আহসান ভ্রু জোড়া হালকা কোঁচকালো।তারপর বলল,
‘আপনার প্রিন্স মানে? কে সে?’
‘আহসান।’

নিজের নামটা শুনে আহসানের হিচকি উঠে গেল।
‘কি হয়েছে? পানি খাবে?’ বলে ব্যাগ থেকে বোতল বের করে দিল।
‘না থাক লাগবেনা। কিন্তু আপনি আহসান মানে আপনার প্রিন্সকে চেনেন তো? তাকে দেখেননি?’
‘হুম ছোট বেলায় দেখেছিলাম। গোলুমোলু লাল টমেটোর মতো দেখতে সে।’
গোলুমোলু লাল টমেটোর মতো শুনে আহসান ওর মুখে চোখে হাত দিয়ে দেখতে লাগলো। তা দেখে রিমি বলল, ‘কি হয়েছে? তুমি এরকম করছো কেন?’

‘কিছু না। আপনি একটা কথা বলুন, ছোট বেলায় কি দেখেছেন না দেখেছেন সেই জের ধরে এখনো আপনার প্রিন্সের ফেসের বর্ণনা পোষণ করে রাখবেন নাকি? প্রেজেন্ট সে দেখতে কেমন সেটা বলুন।’
‘আরে মশাই আমি কি তাকে প্রেজেন্ট দেখেছি নাকি যে বলবো? তবে আই হোপ ভালোই হবে দেখতে। আমার প্রিন্স বলে কথা। আর তুমি রাগ করো না আমি তুমি করে বলছি বলে। আসলে আমি এমনই। টিন এজারের ছেলে মেয়েকে আমি তুমি করেই বলি। সো ডোন্ট মাইন্ড।’

‘ইট’স ওকে। তবে আমাকে দেখে বোঝা না গেলেও আমার বয়স ২৬ বছর।
‘ওহ! বোঝাই যাচ্ছে না দেখছি। আচ্ছা তুমি তোমার নাম্বারটা আমাকে দিয়ে রাখো। আমি যেদিন পারবো ফোন দিয়ে বলবো টাকা নিয়ে যেয়ো।’
‘ওকে, তবে আপনি কি খুব তাড়াহুড়োর মধ্যে আছেন?’
‘হ্যাঁ, আমাকে কলেজে যেতে হবে বলে চলে যেতে নেয় রিমি। কিন্তু কি যেন ভেবে আবারও আগের জায়গায় গিয়ে দাঁড়ালো। তারপর বলল, তুমি এতোগুলা টাকা কোথায় পেলে বলোতো? গেটাপ দেখে তো মনে হয়না ভালো ফ্যামিলির ছেলে।’
‘হোয়াট ডু ইউ মিন মিস?’
‘থুক্কু, ভালো ফ্যামিলি বলতে আমি স্বচ্ছল পরিবারের কথা বললাম। তোমাকে দেখে তো মনে হচ্ছে না। ব্যাপার কি হুম? চুরি টুরি করো নাকি?’

‘ছি ছি, আমি আসলে ওই একরকম কাজ করি আরকি।’
‘ওই একরকম আবার কেমন কাজ? কাজের নাম নেই কি?’
‘আছে তো। ওয়েট করুন ভেবে নেই।’
‘মানে! ভেবে বলবে মানে?’
‘মানে ওই কাজকে কি বলে আমি তো তা জানি না তাই বললাম ভেবে বলি।’
‘কি এমন করো তুমি?’
‘আমি হচ্ছি গিয়ে, ওইতো সেলসম্যান! আমি একজন সেলসম্যান।’
‘তো এটা বলতে এতো সময় লাগলো কেন?’

‘আপনি কি আমার শিক্ষিকা যে পরাপর প্রশ্ন করেই যাচ্ছেন! আমি আমার টিচারের প্রশ্নেও এতটা নার্ভাস হইনি যতটা এখন হচ্ছি।’
‘সরি, আচ্ছা তুমি সেলসম্যান হয়ে এতোগুলু টাকা কিভাবে একজনকে দিয়ে দিলে? কষ্ট লাগলো না?’
‘আজ মাইনে পেয়েছিলাম। আর কষ্ট পাইনি কারণ টাকার জন্য ‘আমার জীবন তো আর চলে যাচ্ছে না।’
‘অন্য একদিন কথা হবে। আজ আমার হাতে একটুও সময় নেই। আমি তাহলে গেলাম।’
‘আপনি তাহলে কলেজ ছাত্রী?’

‘না, আমি এবার অনার্স ফাইনাল ইয়ারে।’
‘তাহলে কলেজে কি কারণে যাচ্ছেন?’
‘আমার বোনের জন্য এপ্লাই করতে যাচ্ছি। ফরম জমা দেব।’
‘ও বুঝলাম।’
‘ওকে বায়, ও হ্যাঁ তাড়াতাড়ি নাম্বারটা দাও।’
‘আপনি কিছু মনে না করলে আমি কি আপনার সাথে যেতে পারি?’

কথাটা শুনে রিমি যেন আকাশ থেকে পড়লো। অচেনা একজন লোক ওর সাথে যেতে চাইছে। ব্যাপার টা তো আজবই।
‘লোকটা নিশ্চয়ই আমাকে বিশ্বাস করতে পারছে না। তাইতো আমার সাথে যেতে চাইছে। আমার কি হুম? আমি তো বলেছি টাকা দিয়ে দেব। তাহলে ভয় কিসের?’ -মনে মনে।
‘আপনি কি কিছু ভাবছেন? আচ্ছা আমাকে বিশ্বাস না করলে থাক। আমি চলে যাচ্ছি।’
‘আরে না, কথাটা বিশ্বাস অবিশ্বাসের নয়। কথাটা হচ্ছে তুমি আমার সাথে কেন যাবে? কাজ নেই?’
‘না আজ ছুটি। আর আমার ইচ্ছে হচ্ছে আপনার সাথে যেতে তাই আরকি।’
‘ইচ্ছে হচ্ছে নাকি আমি পালিয়ে যাব টাকা না দিয়ে সেই ভয়? মনে মনে। আচ্ছা চলুন তাহলে। আমি কিন্তু বাস দিয়ে যাব।’

‘তো?’
‘তো আর কি চলো।’
আহসান বড় করে হাসি দিয়ে বলল, ‘থ্যাঙ্কিউ।’
বাসে উঠেছে দুজন। লোকাল বাস সিট পাওয়া ভাগ্যের বিষয়। তারপরও দুজন পাশাপাশি দুটো সিট পেয়ে গেল। এদিক দিয়ে বাসও ছেড়ে দিল। আহসান রিমির দিকে চেয়ে বলল, ‘আপনি বসুন আমি দাঁড়িয়ে থাকি।’

‘আজব পাবলিক তো! দেখছো দুটো সিট তাও দাঁড়িয়ে কেন যাবে? বসো এখানে।’ বলে রিমি জানালা সাইডে গিয়ে বসল। আহসান ভেবেছিল রিমি দ্বিধাবোধ করবে তাই দাঁড়িয়ে যাওয়ার কথাটা বলেছিল। যখন শুনলো রিমি কিছু মনে করছে না তখন আর সংশয় না করে বসে পড়ে রিমির পাশের সিটে। আহসান অনেকক্ষণ ধরে কিছু বলবে বলবে ভেবেও বলে উঠতে পারছে না। কিছুক্ষণ পর রিমিই বলল, ‘তুমি এই মাসে চলবে কিভাবে? টাকা তো সবই দিয়ে দিলে।’
‘সমস্যা নেই, গ্রামে আমার বাবা মা থাকে তাদের থেকেই নেওয়া যাবে।’

‘বাবা মার বয়স হয়েছে। যোয়ান মদ্দ ছেলে হয়ে তাদের থেকে টাকা চাইতে লজ্জা করবে না?’ রিমি বেশ রেগে বলল কথাটা।
‘না মানে, আপনি চিন্তা করবেন না। আমি ম্যানেজ করে নেব কোনো এক ভাবে। আর এ নিয়ে কথা না বাড়ানোই ভালো। কারণ যা হয়ে গেছে তা আর ফিরে আসবে না।’
‘হুম তাও ঠিক। আচ্ছা বলো তোমার ফ্যামিলিতে কয়জন মেম্বার্স?’
‘পাঁচজন। আমি বাপি-মম, দাদিয়া আর ছোট বোন।’
‘তুমি বাবা মাকে বাপি-মম বলো নাকি?’
‘না আমি কি তাই বলেছি নাকি? আমি বলেছি বাবা মা।’
‘আমি স্পষ্ট শুনলাম।’

‘ভুল শুনতে পারেন।’
‘ওহ, কি জানি? সকালের শুরুটাই খারাপ ঘটনা দিয়ে হলো। চিল্লাচিল্লি করতে গিয়ে মনে হচ্ছ আমার কানটাই গেছে।’
‘আপনি কিছু মনে না করলে একটা কথা বলি?’
‘জ্বি।’
‘আপনি আপনার প্রিন্স মানে আহসানকে কিভাবে চিনলেন? মানে ছোটবেলায় কিভাবে চিনলেন বা দেখলেন?’
‘এটা খুব লম্বা ঘটনা। আমি শর্ট করে বলছি। স্কুল থেকে আসা যাওয়ার পথে আমার চোখ আটকে যায় এক বিশাল বাড়ির দিকে। খুব পছন্দ হয়েছিল বাড়িটা আমার। ভেতরে ঢোকার খুব ইচ্ছে ছিল কিন্তু দারোয়ান থাকতো বলে কখনোই সেই সাহস দেখাইনি।’
আহসান খুব কৌতুহল দেখিয়ে বলল, ‘তারপর?’

‘তারপর আমি রোজ দাঁড়িয়ে থাকতাম আহসানদের বাড়ির রাস্তায়। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর একটা গাড়ি বের হতো সেই গাড়িতেই আমি আহসানকে দেখেছিলাম।’
‘ওহ ভেরি ইন্টারেস্টিং। তো তার সম্পর্কে সব জানেন তাহলে?’
‘ মানুষের মুখে যা শুনেছি সেটুকুই জানি। বেশি জানতে হলে আমার প্রিন্সকে আমার সামনে আসতে হবে।’
আহসান আনমনে বলল,’সামনেই তো আছি।’

‘কি বললে?’
‘না মানে সামনে আসলে কি করবেন?’
‘ডিরেক্ট প্রপোজ করবো। বলবো আমি তার জন্য অনেকগুলো বছর ওয়েট করে ছিলাম। এবার আমাকে বিয়ে করে তাকে অপেক্ষার অবসান ঘটাতে হবে। আমি আর কিছুই জানি না।’
‘মানে সে কেমন দেখতে শুনতে সেটা বিচার বিবেচনা না করেই ডিরেক্ট প্রপোজ!’
‘হুম, দেখতে শুনতে ভালোই হবে। এখন নিশ্চয়ই আর মোটু নেই। ধরো তোমার মতো তারখাম্বা, উজ্জ্বল শ্যামলা আর গুড লুকিং হলেই হলো। এতটা তো হবেই।’

‘তারখাম্বা মানে?’
‘মানে তারখাম্বার মতো লম্বা।’
‘এই মেয়ে কি রে ভাই? পুরোই পাগলী তার প্রিন্স আহসানের জন্য। পাগলী মেয়ে এখনো জানে না তার সাথেই আহসান বসে আছে।’ বিরবির করে।
‘ওই তুমি কি বলছো? আস্তে আস্তে কেন বলছো? জোড়ে বলো।’
‘কিছু না ভাবছি আপনার ইচ্ছেটা খুব জটিল আর ইউনিক। দোয়া করি আপনার ইচ্ছেটা যেন খুব শীঘ্রই পূরণ হোক।’
‘এই কথাটায় তোমাকে একটা স্পেশাল ফুচকা খাওয়াবো। আগে কাজটা হয়ে যাক তারপর।’

তোলপাড় সিজন ২ পর্ব ৩+৪