দোলনচাঁপার সুবাস পর্ব ১৬

দোলনচাঁপার সুবাস পর্ব ১৬
তাসফিয়া হাসান তুরফা

কক্ষজুড়ে আলো-আঁধারির মিলনমেলা। নীল রঙের ড্রিম লাইটটাও যেন খুব একটা দৃশ্যমান পরিবেশ সৃষ্টি করেনি রুমের মধ্যে। এর মাঝে দোলা চোখ মেলে তাকায়। নিজের দিকে বর্ধিষ্ণু পুরুষালি ছায়া দেখে অন্তর আত্মা সবটাই যেন কেপে উঠে ওর! আসন্ন কোনো বিপদের আশংকায় ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য তাড়নায় শোয়া থেকে হুট করে উঠে বসে চিৎকার দিতে যাবে এমন সময় ঝড়ের বেগে সেই পুরুষালি অবয়ব দ্রুত গতিতে রুম থেকে বেরিয়ে যায় ও কিছু বুঝে উঠার আগেই। প্রচণ্ড ভয়ে দোলা বুকে হাত দিয়ে জোরে জোরে শ্বাস নেয়! হৃদপিণ্ডটা অত্যন্ত দ্রুতগতিতে উঠানামা করছে। চিন্তায় চিন্তায় নিউরনে শিহরণ হচ্ছে। এই মাত্র কি হতে চলেছিলো ওর সাথে? ওর ঘুমটা সঠিক সময় না ভাঙলে কি হতো?

কিন্তু দোলা ভেবে পায়না ওটা কে হতে পারে এবং কেন-ই বা এত রাতে তার রুমে আসবে? উপরন্তু, সে তো নিজের বাড়িতেও নেই আজ। রাতের বেলা ডিনার শেষে মামার জোরাজুরিতে ওরা আর বাড়ি ফিরে যেতে পারেনি গতকাল, তাই মামাবাড়িতেই রাত কাটাচ্ছে ওরা। তার মধ্যে এই রুমে শুধু দোলা একাই নয় বরং কামিনি-ও তো ঘুমোচ্ছিলো ওর পাশে। ভাবতে ভাবতেই বিছানার অপরপাশে তাকায় মেয়েটা। কামিনি নেই। কোথায় গেছে সে? দোলার ভাবনার কিছুক্ষণের মাঝেই বাথরুম থেকে বেরিয়ে আসে কামিনি। বিছানায় পুনরায় শুতে নিতেই বোনের উদ্দেশ্যে দোলা বলে,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

—কতক্ষণ বাথরুমে ছিলি তুই?
স্বাভাবিকভাবেই মধ্যরাতে বোনের এহেন প্রশ্নে কিছুটা বিরক্ত হলো কামিনি। নিভু নিভু চোখে একবার দোলার দিক তাকিয়ে বিরক্তিসহিত বললো,
—মিনিট দশেক হবে। কেন বলোতো, আপু?

দোলা কিছু বলতে যেয়েও বললোনা। কামিনিকে কে যদি এ মুহুর্তে সে সবটা বলেও ফেলে তবু সে আদৌ ওর কথা বিশ্বাস করবে কিনা তার কোনো গ্যারান্টি নাই। উপরন্তু ওর কথাকে ঘুমের ঘোরে দেখা কোনো হ্যালুসিনেশন বলে চালিয়ে দিতে পারে! তাই কোনো প্রমাণ না থাকায় দোলা আপাতত চুপ থাকাটাই শ্রেয় মনে করলো। কামিনি ততক্ষণে চোখ বুজে ফেলেছে। বোনের গায়ে কাথা টেনে দিয়ে বললো,

—কিছু না। এমনিতেই জিজ্ঞেস করছিলাম। ঘুমা!
অতঃপর নিজেও আবার শুয়ে পড়লো ওর জায়গায়। কিন্তু একবার মাথায় ব্যাপারটা ঢুকে যাওয়ায় আর ঘুম আপাতত আসছেনা এবং এখন এত সহজে আর আসবেও না এটা দোলা খুব ভালো করেই জানে! তাই কিছুক্ষণ এদিক-সেদিক করে উঠে বাথরুম থেকে মুখ ধুয়ে এলো।

যেহেতু ঘুম আসছেনা আর আচমকা ঘুম ভেঙে যাওয়ায় মাথাও ধরেছে, নিজের বাসা হলে এই মাঝরাতেও সে চা বানিয়ে খেতো। কিন্তু মানুষের বাসায় তো আর সেটা করতে পারবেনা! তাই আপাতত পানি খাওয়াকেই সে শ্রেয় মনে করলো। রুমের দরজা ইষত খোলাই ছিলো, যা ওর মনের সন্দেহকে আরও খানিকটা তীব্র করে তুলে। সন্দেহের রেশ ধরে ধীরপায়ে সামনে এগোতেই ডাইনিং টেবিলের সামনে কাউকে দেখতে পায়। পেছন দিক দাঁড়িয়ে থেকে গ্লাসে পানি ঢালছে কেউ।

ডাইনিং এর লাইট ঝলমলে হওয়ায় এবার ব্যক্তিটার অবয়ব স্পষ্ট বুঝা যায়। দোলার কাছে মনে হলো, কিছুক্ষণ আগে ওদের রুমে অন্ধকারের মাঝে যে আবছা অবয়ব সে দেখেছিলো এ ব্যক্তিটির শারীরিক গঠন অনেকটাই ওইরকম। ঘটনার পরিক্রমায় দোলার ভ্রু কুচকে যায়। কেননা, ছেলেটা আর কেউ না ওর মামাতো ভাই, রাকিব। বিষয়তা মাথায় আসতেই সব জল ঘোলা হয়ে যায়। এবার আর ঘটনা বুঝতে দেরি হয়না দোলার! রাকিব পেছন ফেরার আগেই নিঃশব্দে রুমে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দেয় সে। ওর যা বুঝার, বুঝা হয়ে গেছে।

দোলার বড়মামা ও মামি ভীষণ ভালো মানুষ হলেও তাদের বাড়িতে দোলা খুব একটা আসতে চায়না। এর অন্যতম প্রধান কারণ তাদের এই ছেলেটা। বয়সের দিক দিয়ে গুণে গুণে দোলার চেয়ে বছর দুয়েক বড় হবে রাকিব। তবু ওর আচরণে এর ছিটেফোঁটাও নেই যেন। এমন প্রাপ্তবয়স্ক একটা ছেলের অপর একটি প্রাপ্তবয়স্ক মেয়ের সাথে কিরুপ আচরণ করা উচিত তার কান্ডজ্ঞান-ই যেন রাকিবের মাঝে অবিদ্যমান।

শুরু শুরুতে সে খুব একটা পাত্তা দিতোনা, ভাবতো বয়সের দোষ। সময়ের সাথে চলে যাবে। কিন্তু যত সময় বেড়েছে দোলা লক্ষ্য করেছে, রাকিবের আচরণ দিন দিন উচ্ছন্নে যাচ্ছে। এইতো কালকেরই ঘটনা! দোলারা যখন মামার বাসায় এলো, সকলের সাথে ড্রয়িংরুমে বসে হাসিঠাট্টার মাঝেই দোলার চোখ বারবার রাকিবের দিকে যাচ্ছিলো। কেননা, ছেলেটা পুরোটা সময় এক অদ্ভুত দৃষ্টিতে দোলাকে দেখে যাচ্ছিলো। যার দরুণ ওখানে বসে থাকতেও মেয়েটার অস্বস্তি লাগছিলো।

মেয়েদের মাঝে সৃষ্টিকর্তা এক আলাদা ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য ক্ষমতা দিয়েছেন যার ফলে কোন পুরুষ তাদের দিকে কোন নজরে তাকাচ্ছে, এটা তারা ঠিকই উপলব্ধি করতে পারে। ফলস্বরূপ, আর দশটা মেয়ের মতো দোলাও বুঝেছে রাকিব ওর দিক কোন নজরে তাকিয়েছে। তাইতো ওর কুনজরে ওর পুরো গা ঘিনঘিন করছিলো সারাটা সময়। কিন্তু মামা-মামির চেহারার দিক তাকিয়ে এ কথা সে কাউকে বলেনি, বলতে পারেনি।

কিন্তু সে ঘুণাক্ষরেও ভাবেনি রাকিব কোনোদিন এতটা নিচে নামবে যে এভাবে ওর রুমে ঢুকে…ছি! দোলা ভাবতেও পারেনা আর বিষয়টা! আর এত রাতে কামিনি ওকে রুমে দেখলেও কতটা বাজে হতো! সবমিলিয়ে ঘৃণায় গা ঘিনঘিন করে দোলার। সে ভাবে, একবার মা-কে বলবে কিনা! এসব ভেবে ভেবে যখন মন-মস্তিষ্ক একাকার, তখন হঠাৎ ওর ফোন বেজে উঠে।

এত রাতে ফোন বাজায় চমকে উঠে দোলা ফোন হাতে নিয়ে সাইলেন্ট করে দেয়, স্ক্রিনে সময় দেখে নেয়। এখন ৪.২০ বাজে। কিছুক্ষণ পরেই ভোর হয়ে যাবে। এ অসময়ে আবার কোন আননোউন নাম্বার ওকে কল করছে? কেন-ই বা করছে? দোলার চোখ সরু হয়ে আসে। সাধারণত, সে অচেনা নাম্বারের ফোন খুব একটা ধরেনা, আর এমন সময়ে তো একদমই নয়। তবু যেহেতু ঘুম ধরছেনা, সে বসেই আছে তাই টাইমপাস এর জন্য ফোন রিসিভ করলো। কিন্তু হ্যালো বলার সাথে সাথেই ওপাশ থেকে যে আওয়াজ এলো তা শুনার জন্য সে মোটেও প্রস্তুত ছিলোনা!

—এত রাতে জেগে আছো কেন?
ভরাট পুরুষালি হিমশীতল করে দেওয়া কণ্ঠ শুনে দোলা এক মুহুর্তের জন্য থমকে যায়! মানুষটার কণ্ঠ সে চিনে। বরং, এ ক’দিনে বেশ ভালো করেই চিনে গেছে। নিশীথ ওকে ফোন দিয়েছে! এই মাঝরাতে? একটু পরেই ভোর হবে এমন সময়! কিন্তু কেন?
হকচকিয়ে দোলা বিরক্তি না দমিয়ে কোনোমতে বলে,

—এত রাতে ফোন দিয়েছেন কেন?
ওপাশ থেকে সামান্য হাসির আওয়াজ পাওয়া যায়। নিশীথ খানিকটা হাসলো বোধহয়! প্রশ্ন করলো,
—প্রথমবার ফোনে কথা তবু গলা চিনতে পেরেছো দেখি? কিভাবে, হু?
ওর এভাবে বলায় দোলা খানিকটা লজ্জা পায়। কিছু বলবে তার আগে কামিনিকে নড়াচড়া করতে দেখে আলগোছে বারান্দায় চলে যায়। দরজা টেনে নিশীথকে বলে,

—ওসব বাদ দিন। আপনাকে কিছু জিজ্ঞেস করেছি সেটার জবাব দিন আগে। আপনি আমার নাম্বার কোথায় পেলেন আর আমায় এত রাতে ফোন-ই বা দিয়েছেন কেন?
দোলার কণ্ঠে উপচে পড়া ক্ষোভ। কিন্তু নিশীথের কোনো যায় আসলোনা তাতে। সে সদার ন্যায় নির্বিকারভাবেই বললো,

—ঘুম তো হারাম করেই দিয়েছো আজকের। আমি চেয়েও ঠিকমতো ঘুমাতে পারছিনা, দোলনচাঁপা। তাই ভাবলাম নিজে যখন ঘুমোতে পারছিনা তখন তোমায় কিভাবে শান্তিতে ঘুমাতে দিই, বলো? এছাড়াও এটা আমার ফোন, আমার ইচ্ছা, তুমিও আমার। তাই আমি যখন মন চাবে তখনই ফোন দিবো। তোমার কোনো সমস্যা?
দোলা তাজ্জব বনে গেলো। সে বিশ্বাস করতে পারছেনা এই মাঝরাতে নিশীথ এসব খেজুরে আলাপ করার জন্য ওকে ফোন দিয়েছে! এই লোকের মাথা ঠিক আছে তো? নাকি কালকে দুপুরের কথাবার্তার পর সে হুশবুদ্ধি হারিয়ে ফেলেছে? দোলা ভাবতে পারছেনা! কিছুক্ষণ পর চোখমুখ শক্ত করে শীতল কণ্ঠে সে বলতে ধরে,

—দেখুন,
—কিভাবে দেখবো? তুমি তো ফোনের ওপারে! ভিডিও কল দিলে না হয় দেখতাম।
নিশীথ ইচ্ছে করে ফাজলামো করে। বিরক্তিতে দোলার চোয়াল শক্ত হয়। দাত কটমট করে বলে,
—এই মাঝরাতে নিজের সাথে আমার ঘুম নষ্ট করে আপনার কি লাভ হচ্ছে, নিশীথ ভাই? এমনিতেই আমি খুব পেরেশানিতে আছি তার মধ্যে আপনি…

কথার মাঝে হুট করে থেমে যায় দোলা। সে উপলব্ধি করে এই মাত্র কাকে কি বলতে ধরছিলো। কথার তালে তালে আর একটু হলেই নিশীথকে সবকিছু বলে দিতো সে! ভাগ্যিস সময় থাকতেই নিজেকে সামলে নিয়েছে। মনে মনে এক স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে দোলা আবারো বলে,
—বলছিলাম আমার ভীষণ ঘুম পাচ্ছে। আপনি আমায় আর ফোন দিবেন না প্লিজ। কাল দুপুরের কথাবার্তার পর অন্তত আপনার বুঝা উচিত আমার দিক থেকে। অনুরোধ করছি, আর যোগাযোগ করেন না আমার সাথে! ফোন রাখছি এখন।

তাড়াহুড়োয় কথাগুলো বলে দোলা ফোন কাটতে যাবে এমন সময় নিশীথ বেশ শান্তস্বরে শুধায়,
—কি হয়েছে তোমার? কোন সমস্যায় আছো তুমি?
নিশীথের কথায় দোলা মাথা চাপড়ায়, আনমনেই জিব কাটে। লোকটা শুনে ফেলেছে তবে, এখন নিশ্চয়ই অনেক জেরা করবে। তবু থমথমে কণ্ঠে বললো,

—কোনো সমস্যায় নেই আমি। আপাতত আমার একটাই সমস্যা আর তা হচ্ছে আপনি এই রাতে ফোন দেওয়া। মানুষের বাসায় এসেছি, সকালে উঠতে হবে। তাই দয়া করে এখন ফোন রাখুন এবং আমায় উদ্ধার করুন।
দোলার কণ্ঠে ক্রোধ শুনেও নিশীথ থামলোনা। এর মাঝে খুট করে ফোন কেটে যায়। অর্থাৎ দোলা ফোন কেটে দিয়েছে। নিশীথ বিস্মিত হয়।

এ মেয়েটার সাহস দেখে সে ভালোই অবাক হচ্ছে কাল থেকে! ওকে যতটা ভীতু ভেবেছিলো প্রথমে ততটাও নয়। বরং যথেষ্ট সাহসী ও স্পষ্টবাদী মেয়ে ওর দোলনচাঁপা। এ নিয়ে নিশীথের আপত্তি নেই। তবু, এ সময় ওর জানতেই হবে দোলা কোন অসুবিধায় আছে। যেহেতু বলছে বাসায় নেই, তার মানে যেখানে আছে সেখানে ওর সাথে কোনো বিপদ হলোনা তো?
নিশীথের চোয়াল শক্ত হয়। ত্রস্ত হাতে আবার ফোন দেয় দোলাকে। প্রথমবারে না ধরলেও পরেরবার সে ফোন ধরে অতীষ্ঠ কণ্ঠে বলে,

—আবার কেন ফোন দিচ্ছেন, নিশীথ ভাই? আপনি বুঝেন না কেন?
—ছেলেটা কে, দোলনচাঁপা?
নিশীথের তীক্ষ্ণ কণ্ঠ ভেসে আসে অপরপাশ হতে। দোলা ভড়কে যায়। আমতা আমতা করে বলে,

—ক,কোন ছেলে?
—কোন ছেলের কথা বলছি তুমি ভালো করেই জানো। আমি জানিনা তুমি কোথায় আছো এবং কোন ধরনের সমস্যায় আছো। কিন্তু আমি যেমনটা আন্দাজ করছি ওরকম কিছু যদি সঠিক হয় তবে নিজেকে সাবধানে রাখবে। মাইন্ড ইট, তোমার যেন কোনো ক্ষতি না হয়। নয়তো বিষয়টা মোটেও ভালো হবেনা, দোলনচাঁপা।
তীব্র ভাবে দোলার প্রতি ওয়ার্নিং ছুড়ে নিশীথ। অতঃপর ফোন কাটার আগে ফিসফিসিয়ে বলে,

—এরপর থেকে এভাবে আমার ফোন কাটার সাহস করবেনা বলে দিলাম। সব হিসাব জমা রাখছি, সুযোগমতো শোধ করে দেবো।
দোলা কিছুক্ষণ কানে ফোন নিয়েই বোকার মতো দাঁড়িয়ে থাকলো। এখন তো চাইলেও আর ঘুমোতে পারবেনা। একটুপর ফজরের আজান দিবে। রাকিবের ঝামেলাটা কি কম ছিলো যে হঠাৎ করে এই নিশীথটা ফোন দিয়ে এসব বললো?

দোলনচাঁপার সুবাস পর্ব ১৫

দোলার মাথা কাজ করছেনা একদম। শুধু সে জানে, আজকের রাতটা ওর জন্য অদ্ভুত এক রাত ছিলো। সেভাবেই কিছুক্ষণ দূর আকাশের দিক সে চেয়ে রইলো। যে আকাশে এখনো অন্ধকার বিদ্যমান, এখনো আলোর রেখা ফুটতে আরম্ভ করেনি। যেন সবকিছুই কেমন ধোয়াশাময়, সবকিছুই কত আবছা। ঠিক যেন ওর অনাগত ভবিষ্যতের মতো!

দোলনচাঁপার সুবাস পর্ব ১৭