দোলনচাঁপার সুবাস পর্ব ২৭

দোলনচাঁপার সুবাস পর্ব ২৭
তাসফিয়া হাসান তুরফা

নিশীথের বাপ-দাদা বাড়ি ফিরতে ফিরতে রাত ১০টার মতোন বেজে গেলো। আসমা বেগম খাবার না খেয়ে উনাদের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। এমনকি নিশীথকেও না খাইয়ে রেখেছিলেন সবাই একসাথে খাওয়ার জন্য! তো, আয়মান তালুকদার তথা নিশীথের বাবা ফ্রেশ হয়ে বেরোতেই আসমা বেগম স্বামীর নিকট গিয়ে বললেন,

-বলছিলাম, খাবার টেবিলে দেবো? রাত তো অনেক হয়ে গেছে!
-আমরা খেয়ে এসেছি বাহিরে থেকে।
আয়মান সাহেব জবাব দিলেন। আসমা কিছুটা অবাক হলেন। বাহিরে থেকে খেয়ে এসেছে তবে তাকে জানালোনা কেন? উনি বিস্ময় না ঢেকেই প্রশ্ন করলেন,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

-আপনারা খেয়ে আসবেন আমায় ফোন দিয়ে জানালেন না কেন? আমি তো আপনাদের জন্য অপেক্ষা করছিলাম!
-ওহ প্লিজ, আসমা। বাবা ডায়াবেটিস এর পেশেন্ট, ইনসুলিন করেই সময়মতো তাকে খেতে হয়। এটা কি তুমি জানোনা? ওখানে যখন দেখছিলাম আমাদের আসতে টাইম লাগবে তখনি ডিনার সেড়ে ফেলেছি। এটা আবার ফোন দিয়ে বলার কি আছে? এটা তো কমনসেন্সের ব্যাপার!
বিরক্তির সহিত জবাব দিলেন আয়মান সাহেব। উনার কথা শুনে আসমা বেগমের মুখটা ছোট হয়ে এলো। যার জন্য করলেন চুরি, সে-ই বললো চোর!

অতএব, আর কথা না বাড়িয়ে নিশীথকে খে’তে ডাকার উদ্দেশ্যে তিনি রুম ত্যাগ করছিলেন৷ এমন সময় পেছন থেকে আয়মান সাহেব বললেন,
-তোমার ছেলে কখন বাড়ি ফিরেছে? মা একা ছিলো বাসায়, আজকে অন্তত জলদি ফেরার কথা যদি আমি ভুল না হই!

-৮ টার দিকে এসেছে।
ছোট্ট করে জবাব দিলেন আসমা। আয়মান সাহেব তাচ্ছিল্যের সাথে কথা শুনালেন,
-মায়ের জন্য ঠিকই ৮টায় ফেরা যায়। অথচ বাপ বাসায় থাকলে তো ঘুমোনোর আগে ছাড়া বাড়ির ত্রিসীমানায় পাওয়া যায়না লাটসাহেবকে!

বরাবরের ন্যায় এ কথাটাও আসমা হজম করে নিলেন। নিশীথকে ডাকার পর সে আসতে বেশিক্ষণ লাগালোনা। সে পারতপক্ষে অন্য ধান্ধায় আছে, তাই জলদি ডিনার সেড়ে একবারে রুমে চলে যাবে। তাই ও মিনিট পাঁচেকের মাঝেই ডাইনিং টেবিলে আসে। মা-কে একা বসে থাকতে দেখে জিজ্ঞেস করে,
-তুমি একা বসে আছো কেন, মা? বাকিরা কই? দাদু খেয়েছে?

-আব্বার খাওয়ার টাইম পার হয়ে যাচ্ছিলো তাই উনারা বাইরে থেকে খেয়ে এসেছেন।
-সেকি? তাহলে আমরা এতক্ষণ ওয়েট করলাম কেন? আমি আরও ভাবলাম খেতে বসে দাদুর খোজখবর নিবো এখন দেখছি এই কাহিনি। ওরা তোমায় একটা ফোন দিয়ে জানালেই তো পারতো। আজব!
-বাদ দে! তুই খেয়ে নে চুপচাপ।
-তুমি খাবেনা?

-ক্ষিধে নেই। তোকে খেতে বললাম না? খাওয়ার সময় এত কথা বলছিস কেন?
ছেলেকে ধমকে উঠেন আসমা বেগম। নিশীথ কিছু বলতে গিয়েও বলেনা, নিরবে বুঝে যায় মায়ের অভিমান। বাবা-মায়ের মধ্যে চলা মনমালিন্য নিঃসন্দেহে একজন সন্তানের জন্য ভীষণ কষ্টের। নিশীথের ক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম হলোনা।

বরং, অন্তরে পুষে রাখা জন্মদাতার প্রতি চাপা ক্ষো’ভ আরও খানিকটা বৃদ্ধি পেলো। ও চুপচাপ মায়ের মুখের কাছে খাবারের নলা ধরলো উনি খাবেন সে আশায়, কিন্তু আজ বোধহয় আসমা বেগমের অভিমান একটু বেশিই। তাকে কঠোর হতে দেখা গেলো। ছেলের বাড়িয়ে দেওয়া হাত ওর নিকটই ফিরিয়ে দিলেন। হতাশাময় এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিশীথ কোনোমতে খাওয়া শেষ করলো। নিজ রুমে যাওয়ার আগে দাদুর কাছে গিয়ে উনার খোজখবর নিতে ভুললোনা!

দোলা ব্যাপক সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছে। কারণ, মা সত্যি সত্যি নিশীথের সাথে দেখা করতে চাইছে। দোলা প্রথমে ভেবেছিলো উনি সৌজন্যতার জন্য এমনটা বললেন বোধহয়। কিন্তু পারভীন বেগম সাফ জানিয়ে দিয়েছেন,
-এসব বিষয়ে আমি ইয়ার্কি-ঠাট্টা করিনা। প্রত্যেকটা মানুষের উচিত উপকারির প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা। সেখানে একি এলাকায় থেকেও যদি ছেলেটার সাথে একদিন কথা না বলি, বিষয়টা কত বাজে দেখায়! আর তোর তো কোনো আক্কেলই নাই দেখছি৷ কেন রে? একটাবার অন্তত মুখের কথা বলতে পারলিনা ওকে বাসায় আসার জন্য?
খানিকটা থেমে কিছু একটা ভেবে বললেন,

-আচ্ছা, বাজার আছেই বাসায়। শিমুল অনেকদিন ধরে পোলাও খাওয়ার বায়না করছিলো, কালকে তো রান্না করবোই। নিশীথকে কাল দুপুরেই ডাকিস। এক রান্নায় মিটে যাবে!
মায়ের এত পরিকল্পনা দেখে দোলা রোবটের ন্যায় চেয়ে থাকে। বিড়বিড়িয়ে বলে,
-তুমি যদি জানতে তুমি কাকে বাসায় ডেকে আনতে চাইছো, তবে নিজেও এ কথা মুখে আনতেনা, মা!
পারভীন বেগম শুনতে না পেয়ে শুধালেন,

-কি বলছিস?
-ক,কই? কিছুই না!
-আচ্ছা, তাহলে ঘুমাতে যা! রাত হয়ে গেছে!
ব্যস! এরপর থেকেই নিজের রুমে এসে দোলা নিজের সাথে মনে মনে তর্ক করছে, কিভাবে নিশীথকে বাসায় আসতে বলবে এ বিষয়ে? দোলার মনে ভয় হচ্ছে। নিশীথ তো ঠোঁট’কাটা, স্ট্রেইটকাট কথা বলতে ভালোবাসে। বাসায় এসে যদি সুযোগবুঝে ও মা-কে প্রস্তাব দেয়? তবে কতটা লজ্জাজনক ব্যাপার হবে!

নিশীথের সাথে বিয়ের কথা ভাবতেই দোলার গাল গরম হতে লাগলো। তবে মেয়েটা বুঝলোনা আজ নিশীথের কথা মনে হতেই ও এত লজ্জা পাচ্ছে কেন? ভ্রুযুগল কুচকে দোলা কাপাকাপা হাতে ফোন হাতে নিলো। বিকালে নিশীথের মেসেজের কোনো রিপ্লাই এখনো দেওয়া হয়নি।

এখন রাত ১০.৩০ এর মতো বাজে! এ সময় মেসেজ দেওয়াটা ভালো দেখাবে কি? পরক্ষণেই ভাবলো, মেসেজ দেওয়া উচিত। সরাসরি না বল্লেও অন্তত ফোনে ধন্যবাদ জানানো উচিত ছেলেটাকে। মা ঠিকই বলেছে, ওর মধ্যে কৃতজ্ঞতাবোধ কম। তাই নিজের দ্বিধাদ্বন্দ্ব পাশে রেখে একবুক সাহস সঞ্চার করে দোলা টাইপ করলো। দুরুদুরু বুকে মেসেজ সেন্ড করে নিশীথের রিপ্লাইয়ের অপেক্ষা করতে লাগলো!

দাদুর সাথে কথাবার্তা শেষে ভালো মেজাজে নিশীথ রুমে ফিরলো। দরজা লাগিয়ে আয়েশ করে বিছানায় শুয়ে বালিশের পাশ হতে ফোনটা হাতে নিতেই ওর অক্ষিদ্বয় বড় হয়ে এলো! মিনিট দশেক হবে দোলা মেসেজ দিয়েছে। ছোট্ট একটা বার্তায় “থ্যাংক ইউ আজকের জন্য” লিখে পাঠিয়েছে মেয়েটা। নিশীথ ইষত হাসলো। যাক! ওর দোলনচাঁপার একটু একটু করে উন্নতি হচ্ছে তবে! অতঃপর, মেসেজের জবাব হিসেবে আর কিছু লিখে না পাঠিয়ে ও সরাসরি কল দিলো।

দোলা মাত্রই ফোন রেখে শুয়ে পড়েছিলো। চোখ বুঝার সেকেন্ড খানেকের মাঝেই আচমকা ফোন বেজে উঠায় চমকে উঠে ও। এ সময় কে কল করছে ভাবতেই চোখে পড়লো নিশীথের নাম। ধরবে কিনা ভাবতে ভাবতে দোলা শেষমেশ ধরেই ফেললো কল। সাথে সাথেই ওপাশ থেকে প্রশ্ন এলো,
-কিসের জন্য থ্যাংকস দিলে?
-ওইতো আজকে হেল্প করলেন যে, সেজন্য।

-তোমার আমাকে কখনোই ধন্যবাদ দিতে হবেনা, দোলনচাঁপা। তোমার দিকে আসা সমস্ত বিপদ যেন আমায় আগে অতিক্রম করুক, এটাই আমি দোয়া করি সবসময়।
নিশীথের সোজাসাপটা স্বীকারোক্তি দোলাকে বিমোহিত করে, ওর অন্তরে নাড়া দেয়। মেয়েটা খেয়াল করে, ওর গাল আবারো গরম হতে শুরু করেছে। দোলার মনে পড়ে ছোটবেলায় বাবা বলতেন, “তোর উপর আসা সব বিপদকে আগে আমাকে অতিক্রম করতে হবে, দোলনচাঁপা”

বাবার এ কথা শুনে প্রতিবার দোলার চোখ জ্বলজ্বল করতো আর বাবাকে নিজের সুপারহিরো মনে হতো। সেই মানুষটা নেই আজ অনেক বছর হতে চললো। প্রতিদিন বাবার কথা মনে পড়লেও সচারচর কারও মাধ্যমে ওর বাবার কথা মনে পড়েনা। কিন্তু নিশীথের ক্ষেত্রে যেন এ নিয়ম প্রযোজ্য নয়।

দোলা অস্বীকার করতে পারেনা এ ছেলেটার কথায়, ওর প্রতি নিশীথের আচরণে কিছু একটা আছে যা দোলাকে ওর বাবার কথা মনে করিয়ে দেয়। যেটা খুব কম মানুষই পেরেছে। বাবার মতো পরিপূর্ণভাবে ওকে “দোলনচাঁপা” ডাকাই হোক, কিংবা ওর প্রতি নিশীথের সুস্পষ্ট রক্ষণশীলতাই হোক না কেন। নিশীথের ব্যক্তিত্বে কিছু একটা তো আছে, যেটা দোলা চাইলেও হাজার চেষ্টা করে উপেক্ষা করতে পারেনা!

নিজ ভাবনায় বিভোর দোলা সম্ভ্রম ফিরে পায় ফোনের ওপাশ থেকে বেশ অনেকবার “হ্যালো, হ্যালো” শব্দ আসায়। সাড়া না পেয়ে নিশীথ ওকে ডেকেই চলেছে নিজের মতোন। দোলা ঠোঁট টিপে হাসে। প্রসঙ্গ পাল্টে সিরিয়াস ভাবে বলে,

-আপনাকে একটা দরকারি কথা বলার ছিলো
-শুনছি, বলো
-উম, মা আপনাকে বাসায় ডাকছে। কাল দুপুরে আসতে পারবেন ক..
-তুমি আন্টিকে আমার কথা বলে দিয়েছো? ওহ মাই গড! শাশুড়ী মা কি রাজি? কাল আমাদের বিয়ের কথা বলার জন্য…

-আল্লাহ! থামুন আপনি! কিসব ভাবছেন একা একাই?
নিশীথের কথায় লাগাম টেনে দোলা থামিয়ে দেয়। এই ছেলে দিবাস্বপ্ন দেখতে পটু। মিনিট খানেকের মাঝে কত কি না ভেবে নিলো একা একাই?

-এমন কিছুই নয়। মা এসব কিছুই জানেন না। ওনি স্রেফ আপনাকে বাসায় দাওয়াত দিয়েছে। আর আমায় বলেছে আপনাকে জানাতে। যদি সময় হয়, কাল দুপুরে আমাদের বাসায় আসবেন। মা খুশি হবেন।
-আর তুমি? তুমি খুশি হবেনা, দোলনচাঁপা?
দোলা জবাব দিলোনা এবারো। নিশীথ জোরে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো, যা ফোনের এপাশ থেকে কর্ণগোচর হলো দোলার। ও হঠাৎ বললো,

-আপনার কাছে একটা রিকোয়েস্ট ছিলো…
-তোমার মা-কে আমাদের ব্যাপারে কিছু না বলতে, তাই তো?
-জি। ঠিক বুঝেছেন। আশা করছি আমার অনুরোধের মান রাখবেন।

দোলনচাঁপার সুবাস পর্ব ২৬

এবার নিশীথ জবাব দিলোনা। উলটো, খুট করে ফোন কেটে দিলো দোলার মুখের উপর! ও চমকালো, ছেলেটা কি খুব বেশি রেগে গেলো নাকি? কপাল কুচকে দোলা ভাবলো, এত রাগ কেন নিশীথের? কিন্তু ও আর ফিরতি কল করলোনা। মনে মনে ভাবলো, কাল আসুক আগে। তখন যা হবার দেখা যাবে!

দোলনচাঁপার সুবাস পর্ব ২৭ (২)