দোলনচাঁপার সুবাস পর্ব ৩৪

দোলনচাঁপার সুবাস পর্ব ৩৪
তাসফিয়া হাসান তুরফা

নিশীথের মুখশ্রী উদাসীনতায় জরাজীর্ণ, চোখের চাহনি অস্থির। ল্যাম্পপোস্টের আলোয় দাঁড়িয়ে থাকা লম্বাচওড়া ছেলেটাকে দেখে কেন যেন দোলার ভীষণ মায়া হলো। ওর ভেতরকার মায়া কণ্ঠের মাঝে প্রকাশ পেলো। নিশীথের উদ্দেশ্যে শুধালো,

—এত রাতে বাসার নিচে শুধুই আমায় দেখতে এসেছেন?
দোলার বোকা প্রশ্নে নিশীথ কিঞ্চিৎ হাসলো। সহজভাবে বললো,
—তোমার কি আমাকে বিশ্বাস হচ্ছেনা, দোলনচাঁপা?
—হ,হচ্ছে!
দোলা সৎভাবে উত্তর দিলো। নিশীথ এবার জিজ্ঞেস করলো,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

—তবে কেন ঐ প্রশ্ন করলে?
—না মানে বলছিলাম যে এ সময় কেউ আসে?
—নিশীথ আসে!
দোলা ঠোঁট টিপে হাসলো। জীবনে প্রথম ওর মনে এক অদ্ভুত উত্তেজনা চলছে, কেমন যেন প্রেম প্রেম অনুভূতি হচ্ছে! মিনিট পাঁচেক সেভাবেই অতিক্রম হলো। নিশীথ বলে বসলো,

—একটু নিচে আসবে?
—এখন?
দোলা চমকে উঠে খানিকটা চিল্লায়। পরে নিজেই নিজের জিভ কামড়ে ধরে গলার স্বর নামায়। চুপিসারে জবাব দেয়,
—এখন কিভাবে যাবো নিচে? কেউ যদি দেখে ফেলে? আমার ভয় করে।
—তুমি আর তোমার ভয়! আমায় প্রেমটাও করতে দিবানা মনমতো!

দোলা কাচুমাচু মুখে তাকায় নিচে দাঁড়ানো নিশীথের দিকে। ও কিভাবে নিশীথকে বলবে, ওর মন চাইছে একছুটে নিশীথের কাছে যেতে। ওর হাতে হাত রেখে রাতের আধারে একটু হেটে বেড়াতে। কিন্তু, সব ইচ্ছে তো আর পূরণ হয়না! দোলার মন খারাপ হয়। নিশীথকে বলে,

—আমার দিকটাও একটু বুঝুন প্লিজ। আমি কিভাবে এ সময় বের হবো?
—আমার উপর যদি বিশ্বাস রাখো, ঠিকই বের হতে পারবে বাসা থেকে। বাকিটা তোমার ইচ্ছে!
—কিন্তু…

দোলার কথায় নিশীথ মলিন চোখে তাকায়। ফোনের ওপাশে বড় করে এক দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। যে দীর্ঘশ্বাস মিশে ছিল হতাশা, মিশে ছিল পেয়েও না পাওয়ার আক্ষেপ। দোলার বুক ভারি হয়। নিশীথ ফোন কেটে বাড়ির দিকে হাটা দেয়। এমন সময় হাতে ধরে রাখা ওর ফোন ভাইব্রেশনে বেজে উঠে। দোলা ফোন দিয়েছে। নিশীথ পেছনে না তাকিয়েই ফোন কানে নেয়। ও কোনো জবাব না দেওয়ায় কিছুক্ষণ পর দোলা নিজেই বলে,

—পাঁচ মিনিট অপেক্ষা করুন। আমি আসছি!
নিশীথ মনে মনে খুশি হয়। এবার সে পেছন ফিরে তাকায়। কিন্তু দোলা ততক্ষণে ফুরুৎ! জীবনে এই প্রথম, এত বড় দুঃসাহসিক কাজ করতে দোলার বুক দুরুদুরু কাপে। বাড়ির সবাই ঘুমে কাদা, বিষয়টা নিশ্চিত করে অতি সাবধানতা অবলম্বন করে ও পা টিপে টিপে বের হয় বাসা থেকে। যতটুকু সম্ভব শব্দ না করে বের হওয়া যায় দোলা করেছে। বাসা থেকে বের হওয়ার পরেও দোলার বুক কাপা বন্ধ হয়নি! ওর মনে হচ্ছে এই বুঝি, মা এসে যাবে। ওকে দেখে প্রশ্ন করবে “এত রাতে চোরের মতো কোথায় যাচ্ছিস, দোলন?” তখন ও কি উত্তর দেবে?

নানান প্রশ্নের মেলা বসে দোলার মন-মস্তিষ্ক জুড়ে। তবু বের যখন হয়েছে, তখন তো নিচে যেতেই হবে!
যেমন ভাবনা তেমন কাজ। ভয়ে ভয়ে দ্রুতপায়ে সিড়ি বেয়ে দোলা নেমে পড়ে দোতলায় ওদের বাসা থেকে। এ বাসায় দাড়োয়ান না থাকলেও দোলা ভাবছিলো দরজার কাছে কাউকে দেখতে পেলে কি হবে? ঠিক এমন সময় আশ্চর্যজনকভাবে দোলা লক্ষ্য করে গেটের কাছে কেউ দাঁড়িয়ে আছে। ভয় পেয়ে দোলা উল্টোপথে তড়িঘড়ি করে ফিরতে যাবে এমন সময় সেই ব্যক্তিটি ধীরস্বরে ওর নাম ধরে ডাকে। বিস্ময়ের সাথে দোলা অনুধাবন করে লোকটা আর কেউ নয়, বরং তূর্য! ছেলেটা ওকে বললো,

—আরে ভাবি দাঁড়ান। সেই ১২টা থেকে ভাই আমাকে এখানে দাড় করিয়ে রেখেছে আপনার জন্য। মাত্র এলেন। আমি তো ভেবেছিলাম আসবেন না। অথচ ভাই শিওর ছিলো আসবেন। এজ ইউজুয়াল, ভাইয়ের কথাই ঠিক হলো!
তূর্যর কথায় দোলা লজ্জিত হলো। তার মানে নিশীথ এখানে আসার সময় থেকে এতক্ষণ ছেলেটাকে গেটের কাছে দাড় করিয়ে রেখেছে? অথচ ওকে একবারো বলেওনি এ ব্যাপারে!
কি লজ্জার ব্যাপার। ছিঃ!

তূর্য কোনোরকম শব্দ ছাড়া গেট খুলে দিতেই দোলা তাড়াতাড়ি করে বেরিয়ে এলো বাসার বাহিরে। নিশীথ দাঁড়িয়ে ছিলো বাসার সামনেই। দোলার অপেক্ষা করছিলো চুপচাপ। ওকে বেরিয়ে আসতে দেখে আর কথা না বাড়িয়ে দোলার হাত ধরে টেনে নিয়ে গেলো। দোলা কিছু বুঝে উঠার আগেই দুজনে চলে এলো ওদের বাড়ির সাইডের আবছা অন্ধকার জায়গায়! এদিকটায় ল্যাম্পপোস্টর আলো পড়েনা ঠিকমতো। অর্থাৎ, কেউ দেখতেও পারবেনা ওদের এখানে। নিশীথ তা ভেবেই দোলাকে এখানে এনেছে।

দোলা মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে চুপচাপ। এতক্ষণ বাসা থেকে বেরোনোর আগে ওর মনে প্রচন্ড ভয় ছিলো, পাছে কেউ দেখে ফেলবে কিনা এ ভয়! অথচ, এখন এই নিশুতি রাতে বাসার নিচে নিশীথ এর সাথে একা একা লুকিয়ে দেখা করছে বিষয়টা উপলব্ধি করতেই ওর তনে-মনে ভয়ের পরিবর্তে উল্টো লাজের আবরণ ছেয়ে যাচ্ছে। এক অদ্ভুত লজ্জায় ঘিরে ধরেছে মেয়েটাকে! সারাজীবন প্রেম না করা মেয়েটা যৌবনের সূচনায় প্রেমিক পুরুষের সাথে এমন লুকোচুরি সাক্ষাৎ এর মুহুর্তে কেমন রিয়েকশন দেওয়া উচিত দোলা জানেনা।

নিশীথ এতক্ষণ একধ্যানে প্রেয়সীর মুখশ্রী লক্ষ্য করছিলো। মাথা নিচু করে লাজুক ভংগিতে চেয়ে থাকা এ মেয়েটাকে দেখলে কে বলবে এই মেয়ে ওর প্রেমিকা নয়? ওদের দুজনকে একসাথে এ সময় দেখলে কে বলবে ওদের মাঝে আর দুটো কপোত-কপোতীর মতো কোনোরকম প্রেম-বিনিময় ঘটেনি? বরং, ওদের দেখলে যে-কেউ বলবে ওদের মাঝে নির্ঘাত মাখো মাখো প্রেমের সম্পর্ক আছে! নয়তো কেউ এভাবে প্রেমিকের এক ডাকে এ সময় বাড়ি ছেড়ে এভাবে চলে আসে? আসেনা!

দোলার দিক চেয়েই নিশীথের অন্তর অনেকটা প্রশান্ত হয়। আলতোভাবে মেয়েটার থুতনিতে হাত রেখে ওর মুখ তুলতেই দোলনচাঁপা লজ্জায় মিইয়ে যায়। এক ঝটকায় নিশীথের থেকে দূরে সরে দাঁড়ায়। কাচুমাচু মুখে এদিক-সেদিক চায়। নিশীথ আড়ালে হাসে। দোলাকে এমন চুপ থাকতে দেখে বলে,
—আমার সাথে দেখা করতে নিচে কেন এলে, দোলনচাঁপা?
দোলা ভ্যাবাচেকা খায়। নিজেই ডাকলো দেখা করার জন্য আবার নিজেই এমন প্রশ্ন করছে? লোকটা অদ্ভুত। দোলা নিচু স্বরে বললো,

—আপনিই তো নিচে নামতে বল্লেন!
—আমি বললেই তুমি নিচে নামবে?
নিশীথ পাল্টা প্রশ্ন করে। দোলা বিস্মিত চাহনি দিয়ে শুধায়,
—মানে? কি বলছেন?

—বলছিলাম, একটা ছেলে রাত ১২.৩০টায় তোমায় বাড়ির নিচে ডাকলো দেখা করার জন্য আর তুমিও কিনা আসার জন্য রাজি হয়ে গেলে? একবারো কি নিজের জন্য চিন্তা হলোনা?
দোলা কিছুক্ষণ বিস্ময় চাহনি নিয়ে চেয়ে রয় নিশীথের দিকে। যেন বুঝার চেস্টা করছে ও কি বলছে। খানিক বাদে বোকা বোকা কণ্ঠে প্রশ্ন করে,

—আমার জন্য চিন্তা হবে কেন?
নিশীথ মাথা চাপড়ায়। এ মেয়ে আর সময় চতুরতা দেখালেও ওর কাছে এসে কেমন বোকা হয়ে যায়! কয়েক কদম দোলার দিকে এগিয়ে আসে। দোলা সরতে চাইলেও হাত দিয়ে ওর বাহু চেপে ধরে নড়াচড়ায় বাধা দেয় নিশীথ। এবার দোলার অন্তরে ভয় জাগে। শ্বাসপ্রশ্বাস দ্রুত হয়। চোখদুটো বুজে আসে। এরই মাঝে নিশীথ ওর কানের কাছে মুখটা এলিয়ে ফিসফিসিয়ে বলে,

—আমার বোকা দোলনচাঁপা! আমি যদি এখন তোমার সাথে কিছু করি? তুমি কি ভয় পাচ্ছোনা?
দোলা বুজে থাকা চোখ খোলে তাকায় নিশীথের দিকে। ততক্ষণে নিশীথের মুখ ওর মুখের সামনে। ওই আবছা আধারেও দুজনের চোখাচোখি হয় কিছুক্ষণ! চোখে চোখে না বলা কথা বিনিময় হয়। দোলা যেন নিশীথের ওই চোখের ভাষা পড়তে পারে! ও সহজভাবে জবাব দেয়,
—আমি জানি আপনি কিচ্ছু করবেন না!

বলাবাহুল্য, দোলার এত সহজ স্বীকারোক্তিতে নিশীথ খানিকটা অবাকই হয় বটে। তার মানে, দোলা সত্যিই ওর সাথে সেইফ ফিল করে! নিশীথ এর ভালোবাসা, ওর নিয়ত সবটাই মেয়েটা ভালো করে বুঝে! নিশীথের ঠোঁটের কোণে প্রসন্ন হাসি ফুটে। ও ডান হাতে দোলার গালে আলতোভাবে হাত ছোয়ায়। যে স্পর্শে দোলা খানিকটা কেপে উঠে। কিন্তু নিশীথের হাত সরিয়ে দেয়না এবার। বরং, সাহস করে নিশীথের চোখের দিক চেয়ে থাকে! এমন অবস্থায় নিশীথ প্রশ্ন করে,

—আমায় পছন্দ করো, দোলনচাঁপা?
দোলা চমকায়। নিশীথের চোখের দিকে তাকিয়ে থাকা চোখ দ্রুতবেগে নামিয়ে নেয়! এদিক-ওদিক তাকিয়ে বলে,
—আ,আমি অনেকক্ষণ ধরেই তো আছি। আমার এখন বাসায় যাওয়া উচিত। মা মাঝেমধ্যে উঠে যায়!
দোলা যেতে নিলে নিশীথ পেছন থেকে ওর হাত চেপে ধরে। শান্তভাবে বলে,
—উত্তর না দিলে আজ তোমায় যেতে দিচ্ছিনা।

দোলা পেছন ফিরে তাকায়। দু’চোখে আকুতি মিশিয়ে অসহায়ভাবে বলে,
—প্লিজ? হাতটা ছেড়ে দিন!
—দোলনচাঁপা!
নিশীথ চাপাস্বরে ধমক দেয়। যেন সে আজ দোলার মুখে শুনেই ছাড়বে সে ওকে নিয়ে কি ভাবে। অথচ ওই সময় দোলনচাঁপা এক অদ্ভুত কাণ্ড করে বসে! বেশ চাপা অথচ কোমল স্বরে বলে,
—আমায় যেতে দিন, নিশীথ!

নিশীথ কিছুক্ষণের জন্য থমকে যায়। ধরে রাখা হাতটাও নিজ হতেই শিথিল হয়ে আসে। এ প্রথম দোলার মুখে “ভাই” ছাড়া নিজের নাম শুনতে বড্ড মধুর লাগলো ওর কাছে! হাত ছাড়া পেতেই দোলা এক ছুটে পালিয়ে যায়। নিশীথ একনজরে সেদিকে চেয়ে রয়। বাসার গেটে ঢুকার আগে কি মনে করে দোলনচাঁপা পেছন ফিরে আড়চোখে নিশীথের দিকে তাকায়। নিশীথকে ওর দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে মিষ্টি হেসে চোখ নামিয়ে নেয়।

দোলনচাঁপার সুবাস পর্ব ৩৩

বাসার নিচে গেটের ধারে লাইটের আলোয় ঝলমলে প্রেয়সীর এমন হাস্যোজ্জ্বল মুখ দেখে নিশীথ যেন একটা হার্টবিট মিস করে! ওর ঠোঁটের কোণে ভেসে উঠে সূক্ষ্ম হাসির রেখা। হঠাৎ করেই নিশীথ অনুভব করে, গত দু’রাত ধরে অশান্ত বিক্ষিপ্ত থাকা ওর মনটা এখন নিজ থেকেই প্রফুল্ল হয়ে গেছে!

দোলনচাঁপার সুবাস পর্ব ৩৪(২)