নয়নে লাগিল নেশা পর্ব ১৩

নয়নে লাগিল নেশা পর্ব ১৩
Mousumi Akter

প্রান্তিকের দেওয়া প্রস্তাবে আয়েশা বেগম ভীষণ খুশি। এত খুশি বোধহয় সে জীবনে আর কখনোই হয়নি। ঘন ঘন রাস্তার দিকে তাকাচ্ছে– কখন মুনসুর আলী বাড়িতে আসবে আর সে এই খুশির প্রস্তাবটা দেবে। খুশিতে মন বড্ড অস্থির আয়েশা বেগমের। মুনসুর আলীর আসতে দেরি দেখে আয়েশা বেগম রজনীর ঘর ঝাড়ু দিচ্ছে আর রজনীকে বলছে, “তোর বাপের কী এত কাম পড়ছে রে মা আইজ? আইজকাই যেন দিন দুনিয়ার সব কাম করতেছে!”

রজনী খাটে বসে আছে দু-পা মেলে দিয়ে।রাগী চোখে নিজের মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল, “আম্মা, তুমিই বা আজ এত বাবার খোঁজ নিচ্ছ কেন বুঝলাম না। জীবনে তো দেখি না বাবার জন্য এত উতলা হতে।”
“অন্যদিন আর আইজ এক দিন না। আইজকা বিশেষ কারণ আছে।”
আয়েশা বেগমের চোখ-মুখে আনন্দের ঝলকানি।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“আম্মা, ওই ছেলে বিয়ের প্রস্তাব দেওয়ার পর থেকে তুমি যেন খুশিতে মাটিতে পা ফেলছ না। কিন্তু কেন?”
“কারণ– আমার স্বপনেতেও আছিল না যে এমন একখান পোলা আমার মাইয়্যার জন্য বিয়ের প্রস্তাব দিবো।”
“কেমন পোলা আম্মা? একটা গু’ ন্ডা, মা’ স্তান,বে ‘য়াদব, ছেলের বিয়ের প্রস্তাবে এইভাবে খুশি হওয়ার কী আছে?”

“ প্রান্তিক খারাপ পোলা, তোমারে এইসব আজেবাজে কথা কে কইছে মা? তোমার বাজান কোনোদিন মানুষ চিনতে ভুল করে নাই। তুমি তো জানোই তোমার বাজান যেইডা বলে ওইডাই আমি মনে-প্রাণে বিশ্বাস করি খুব। তোমার বাজান হলো আমার প্রথম চক্ষু। সে দেখার পর যেইডা ভালো বলে আমিও সেইডাই বিশ্বাস করি মন-প্রাণ দিয়ে। আর এই বিশ্বাসে আমি ঠকি নাই।তোমার বাজান যেদিন বলছে– প্রান্তিক ভালো পোলা, সেইদিন থেইকাই আমার খুব পছন্দ। আমি তাহাজ্জুদ পইড়া আল্লাহরে ডাইকা কইছি, আল্লাহ আমার মাইয়্যার লাইগা ভালো একখান পোলার সন্ধান দাও। নামাজের মাঝে আমার প্রান্তিকের কথাও মনে উঠছে।”

“আমি আল্লাহকে ডাকি যেন, এই ছেলে আমার থেকে ৭০ হাত দূরে থাকে। আর তুমি আল্লাহকে ডাকো যে, এই ছেলের সাথে আমার বিয়ে হয়? বড়োলোক ছেলে দেখে কি মাথা একবারেই গেছে আম্মা? আমি সোজা বলে দিচ্ছি– এই ছেলের সাথে আমার বিয়ে দিলে আমি বাড়ি ছেড়ে চলে যাব।”
“তোমার বাজান যা ভালো বুঝব তাই হবে।তুমি এমন বিয়া নিয়া মুরব্বির লগে তর্ক করছ ক্যান? আমার মাইয়্যা তো এমন আছিল না।”

“তোমার মেয়ে এখন বড়ো হয়েছে আম্মা।একটু হলেও নিজের ভালো বোঝে।”
“বাপ-মাইর থেইকা সন্তান কোনোদিন নিজের ভালো বেশি বুঝে না, মা।”
রজনীর কখনো মা’ রামারি করা, গু’ ন্ডা টাইপ ছেলে পছন্দ নয়। তাছাড়া প্রান্তিকের অনেক মেয়ের সাথেই মেলামেশা আছে। মাত্র দুই-তিনবার সাক্ষাতেই দুইটা মেয়ে কল দিয়ে কীসব বিশ্রী কথা বলেছে। হঠাৎ এমন চরিত্রের একটা ছেলের সাথে বিয়ের কথা শুনে রজনীর শরীরের মাঝে বাজে এক শিহরণ বয়ে গেল।

চোখ বন্ধ করে কল্পনা করল– প্রান্তিকের বিছানায় রোজ রোজ ভিন্ন ভিন্ন নারী। সে তার জীবনসঙ্গী হিসাবে এমন ছেলেকে ভাবতেই পারে না। তার উপর মা’ রামারি তো আছেই। ভালোর জন্য হোক আর খারাপের জন্য হোক মারামারি করবে কেন? মানুষের গায়ে হাত দিতে যার হাত কাঁপে না তার হৃদয়ে মায়া-দয়া কীভাবে সম্ভব? প্রান্তিকের চামচা যে সত্য কথা বলেছে তার-ই বা প্রমাণ কী? প্রান্তিক নিঁখুত অভিনয়ের ছেলে। এমনভাবে এসে বিয়ের প্রস্তাব দিল যেন, সে সত্যি ভীষণ ভালোবেসে ফেলেছে।

অথচ এর জীবনে একাধিক নারী আর নারী। বড়োলোকের ছেলে এইভাবে কয়টা বিয়ে করবে তার ঠিক নেই। যেভাবে নিঁখুত অভিনয় করতে পারে যে-কোনো মেয়ে গলে গিয়ে বিশ্বাস করবে তার ভালোবাসা সত্য। লাস্ট দিন কলেজে একটা মেয়ের পাশে বসেছিল রজনী। মেয়েটাকে দেখে মডেলের মতো দেখায়। হঠাৎ করে প্রান্তিকের আলোচনা তুলেছিল পাশে বসে থাকা মেয়েটার সাথে। রজনী উঁকি মেরে দেখেছে প্রান্তিকের ছবি দেখাদেখি করছে আর বলছে, অনেকদিন ধরে আমার পেছনে ঘুরছে, বাট পাত্তা দিচ্ছি না। আর একটু ঘুরিয়ে নিই তারপর রাজি হব। সেখান থেকে রজনীর মেজাজ আরও খারাপ। প্রান্তিককে আরও সহ্য করতে পারছে না। মা-মেয়ের এক প্রকার ঝগড়া শুরু হলো এই বিয়ে নিয়ে। রজনী বলে উঠল,

“আমি কিন্তু বাড়ি ছেড়ে চলে যাব আম্মা, তুমি যদি বাবাকে এই ছেলের প্রস্তাবের কথা কিছু বলো।”
এর মাঝে প্রিয়তার আগমন। প্রিয়তা রজনীদের বারান্দায় উঠতে উঠতে বলল, “বাড়ি ছেড়ে চলে যাবি বুঝতে পেরে আমি নিতে এসেছি।”
অচেনা এক মেয়েকে দেখে আয়েশা বেগম বেশ কৌতুহল হয়ে জিজ্ঞেস করল, “তুমি কেডা মা? আসলে চিনি নাই। আগে তো দেহি নাই।”

রজনী কঠিন কণ্ঠে জবাব দিল, “আমার বেস্ট ফ্রেন্ড। যার কথা বলি তোমাদের। ওর নাম প্রিয়তা।”
প্রিয়তার পোশাক দেখে আয়েশা বেগম বুঝতে পারল– অত্যন্ত ধনী পরিবারের মেয়ে। যদিও প্রিয়তার ব্যাপারে আগেই রজনীর মুখে অনেক শুনেছে। আয়েশা বেগম অমায়িক হাসি দিয়ে বলল, “আসো মা, বসো। গরিবের বাড়িতে আইছ।”
“ছি! ছি! এসব কী বলছেন আন্টি? এটা আমার নিজেরই বাড়ি। গরিব-বড়োলোকের কোনো ব্যাপার নেই।”
“তোমার বান্ধবী রাগ করছে একটু বুঝাও না, মা।”
“কী নিয়ে আন্টি?”

“খুবই সুন্দর একখান বিবাহের প্রস্তাব আইছে। কিন্তু সে রাজি না।”
“আচ্ছা আন্টি, আজ আমার জন্মদিন। ওকে আমার সাথে আমার বাড়ি নিয়ে যাই। আজ কিন্তু ও থাকবে আমার সাথে। আমি রাতে ভালোভাবে বুঝাব।”
“নিয়া যাও; কিন্তু রাইত থাকার দরকার নাই।ওর বাজান অনেক চিন্তা করব। একটা মাইয়্যা তো।”
“আপনি চিন্তা করবেন না আন্টি। আমি অক্ষত অবস্থায় আপনার মেয়েকে ফিরিয়ে দিয়ে যাব।”
“বুঝছি মা, কিন্তু ওর বাপ না আইলে আমি অনুমতি দিই কেমনে মা?”

“আঙ্কেলের ফোন নাম্বারটা দিন, আন্টি। আমি ফোন দিচ্ছি। আমার বাড়ি এই গ্রামেই।কিন্তু এখন শহরে থাকি আমরা। আমার বাবার কথা শুনলে আঙ্কেল কিছুই বলবে না।”
“আইচ্ছা ঠিক আছে। কিন্তু আমি রান্না করব তুমি খেয়ে দেয়ে একবারে ওকে নিয়ে যাবা।”
“আজ না আন্টি দেরি হয়ে যবে। ওকে রাখতে আসব। সেদিন খাব।”

আয়েশা বেগম রজনীকে বলল, ” যাও মা।সাবধানে থাইকো কিন্তু। গিয়ে তোমার বাবার নাম্বারে ফোন দিয়ো।”
রজনী রেডি হচ্ছে। একটা থ্রী-পিস পরল আর সঙ্গে একটা শাড়ি নিল। অনুষ্ঠানের সময় পরবে বলে। প্রিয়তার হাতে একটা ফটোফ্রেম দিয়ে বলল, “তোদের বিয়ের পর এটায় তোর আর ভাইয়ার কাপল ছবি রাখবি। আমার তরফ থেকে সামান্য উপহার।”

প্রিয়তা ফটোফ্রেমটা হাতে নিয়ে সেখানে তার আর শ্রাবণের ছবি কল্পনা করে খুশিতে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরল। তারপর রজনীকে জড়িয়ে ধরে বলল, “ইশ! তোকে যদি আমার ভাইয়ার সাথে বিয়ে দিতে পারতাম না! তোকে দিয়ে আমার আর ওর বিয়ের জন্য ভাইয়াকে পটিয়ে ফেলতাম।”
“যাচ্ছি তো তোদের বাড়ি। আর আসব না।তোর ভাইয়ের বউ হিসাবে থেকে যাব।”
“ইয়া আল্লাহ, এই দোয়া তুমি কবুল করো প্লিজ। ভাইয়ার মন থেকে সেই মেয়েকে তুলে নাও।”
“কোন মেয়ে?”

“ভাইয়া যেন কার প্রেমে পড়ে আধা পা* গ * ল হয়ে গিয়েছে। এখন সেই মেয়েই লাগবে।”
“যাক, অগ্রিম একটা ছ্যাঁকা খেলাম। তোর মুখে তোর ভাইয়ার প্রশংসা শুনে শুনে আমি বেশ ক্রাশড কিন্তু। আফসোস প্রকৃতি শূন্যস্থান রাখে না কখনো। অন্য কেউ জায়গা দখল করে নিয়েছে।”

“থাক, দুঃখ পাস না। নসিবে থাকলে হবেই।”
“তবে তোর ভাইয়াকে দিয়ে একজনকে টাইট দেওয়াব, বুঝলি? প্রয়োজনে ঘুস লাগলে দেব।”
“ঘুস না, আমার ভাইয়াকে একটা সিগারেট গিফট করলেই সে হ্যাপি হবে।”
আবার প্রান্তিকের কথা মনে পড়ল রজনীর।পৃথিবীর সব মা রা মা রি করা ছেলেরই কি সিগারেট প্রিয়?
রজনী মজা করে বলল, “প্রিয়তা, তাহলে তোর ভাইয়াকে আমি সিগারেট গিফট দিই।”

“আরে! দারুণ আইডিয়া। শোন, একটা সিগারেট নিয়ে সুন্দর করে গিফট পেপার দিয়ে মুড়িয়ে নিয়ে যাব। তুই আমার ভাইয়াকে দিয়ে বলবি– ভাইয়া, আপনার জন্য গিফট এনেছি।”
“আমাকে যদি কিছু বলে? আমি এসব পারব না।”
“আরে, কিছুই বলবে না। দারুণ মজা হবে।”
এরই মাঝে বাড়িতে শিস দিতে দিতে প্রবেশ করল রজনীর ভাই। আজ ক’দিন বাদে ফিরল তার ঠিক নেই। বাড়িতে ঢুকেই ডাকল, “আম্মা, ও আম্মা?”

আঞ্জুমান চৌধুরী অগ্নিমুডে এসে দাঁড়িয়ে বললেন, “কেডা তোমার আম্মা?”
“রাগ করেছ নাকি আম্মা?”
“তোমার মতো পোলা পেটে ধরেছি আমার তো খুশিতে গদগদ থাকার কথা। এ কদিন কোথায় ছিলে?”
“বন্ধুদের সাথে একটু ঘুরতে গেছিলাম আম্মা। রফিকরে দিয়ে তো খবর দেওয়ায়ছিলাম। খবর পাওনি?”
“তোমার আব্বা অনেক রেগে আছে কিন্তু।
রেগে থাকুক আর যা-ই করুক আমার কিছু টাকা লাগবে তুমি চেয়ে দিয়ো।”
“টাকার নাম নিলে ঝা–ড়ু–র বা– ড়ি– র অভাব হবে না।”

এরই মাঝে প্রিয়তা আর রজনী ঘর থেকে বের হলো। রজনীর ভাইয়ের নাম বাবু।
বাবু বলল, আম্মা কে?”
“রজনীর বন্ধু, রজনীকে নিতে এসেছে।
প্রিয়তা উঠানে নামতেই বাবু প্রিয়তার আপাদমস্তক তাকিয়ে দেখল। রজনী ভাইকে দেখেই বলল, “তোমার বাড়ির কথা মনে পড়েছে?”

প্রিয়তা বলল, “ইনি কে রজনী?”
“আমার ভাইয়া।”
প্রিয়তা হাসি মুখে বলল, “ভাইয়া, ভালো আছেন?”
“হ্যাঁ, তুমি কেমন আছ?”
বাবুর চাহনি খুব বাজে। খুব বাজে চোখে প্রিয়তাকে দেখছে। প্রিয়তার খুব একটা সুবিধার লাগল না বাবুর দৃষ্টি। প্রিয়তা জানেই না প্রিয়তাকে ডিস্টার্ব করার জন্য বাবুকে প্রান্তিক কীভাবে মেরেছিল। কিন্তু বাবু ঠিকই চিনেছে। মনে মনে আরও একবার টার্গেট করে নিল প্রিয়তাকে।

বিকালের দিকে প্রিয়তা রজনীকে নিয়ে তাদের বাড়িতে প্রবেশ করল। এতবড়ো বিলাসবহুল বাড়ি রজনী আগে দেখেনি।চারদিক কত সুন্দর আর চকচকে। আঞ্জুমান চৌধুরী প্রিয়তার সাথে রজনীকে দেখেই বুঝতে পারল– প্রিয়তার বান্ধবী। হাসিমুখে রজনীর কাছে এসে রজনীর মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, “কেমন আছ মা?”
“জি, আলহামদুলিল্লাহ আন্টি। আপনি কেমন আছেন?”
“ভালো আছি মা। যাও রেস্ট নাও।”

প্রিয়তা রজনীকে তার রুমে নিয়ে গেল। ফ্যান ছেড়ে দিয়ে খাটের উপর বসল।রজনীকে খুব অস্থির দেখাচ্ছে। সে প্রিয়তাকে বলল, “তোর ভাইয়া কই? আমি সেই বেয়াদবের কথা শেয়ার না করলে শান্তি পাচ্ছি না।”
“আচ্ছা, চল ভাইয়ার রুমে নিয়ে যাচ্ছি আর গিফট বক্সটাও দিবি কিন্তু।”

নয়নে লাগিল নেশা পর্ব ১২

“ছি! আমি পারব না।”
“না দিলে আমার ভাইয়া কাজ করে দিবে না কিন্তু।”
“আচ্ছা দিব।”

নয়নে লাগিল নেশা পর্ব ১৪