নয়নে লাগিল নেশা পর্ব ২৯

নয়নে লাগিল নেশা পর্ব ২৯
Mousumi Akter

প্রিয়তার তীব্র মন খারাপ। আকাশে জমা গুমোট মেঘের মত তার মনেও মন খারাপের মেঘ বাসা বেঁধেছে। সকাল থেকে কিচ্ছুই খায়নি সে। সারাদিন কাঁন্নাকাটি করে চোখ ফুলিয়ে ফেলেছে। রক্তজবার মত চোখ লাল হয়ে গিয়েছে। পৃথিবীর কিছুই ভাল লাগছে না।চারদিকে বিষন্নতা। বিছানায় উপুড় হয়ে কেদেই যাচ্ছে। প্রিয় মানুষ হারানোর সিগন্যাল পেয়ে গিয়েছে আজ।

আজ সকালেই তার বাবা আর ভাই একজন ইঞ্জিনিয়ারের সাথে বিয়ে ঠিক করেছে। ছেলে বিদেশে সেটেল। বিয়ে করে প্রিয়তাকে বিদেশ নিয়ে যাবে। সুখ আর প্রাচুর্যের অভাব না সেখানে। কিন্তু প্রিয়তা সুখ বলতে শ্রাবণ কে বোঝে। প্রিয় মানুষ কে পাশে পাবার চেয়ে বড় সুখ পৃথিবীতে নেই।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

প্রিয় মানুষের থেকে বড় সম্পদ মূল্যবান জিনিস ও এই পৃথিবীতে নেই। সকাল গড়িয়ে দুপুর, দুপুর গড়িয়ে বিকাল অতিক্রম হয়ে গিয়েছে। রজনী বিকালে খাবার নিয়ে প্রিয়তার রুমে প্রবেশ করল। প্রিয়তার রুমে ঢুকে দরজা লক করে দিল। টি-টেবিলের উপর খাবার রেখে প্রিয়তার কাধে হাত রাখল। প্রিয়তা অশ্রুসিক্ত চোখে রজনীর দিকে ফিরে তাকাল। রজনিকে দেখে তার আরো কাঁন্না পাচ্ছে। রজনীর দিকে তাকিয়ে জোরে কেদে দিল।রজনী প্রিয়তার হাত ধরে টেনে বলল,

” ওঠ আগে। এইভাবে কেউ কাদে। দেখতে এসছিল শুধু,বিয়েতো হয়ে যায়নি। এইভাবে কেউ ভেঙে পড়ে।”
প্রিয়তা উঠেই রজনিকে জড়িয়ে ধরে বলল, ” পৃথিবীর কেউ বুঝবে না আমার ভেতরের যন্ত্রণা। সবাই শুধু সান্ত্বনা দিবে, কেউ শান্তি দিয়ে দুঃখ মুছে দিবে না। আমার পরিস্থিতি কেউ বুঝবে না।”

“আমরা কেউ অন্যোর পরিস্থিতির ভাগ নিতে পারি না প্রিয়তা। কেবল উপলব্ধি করতে পারি মাত্র।”
“আমি শ্রাবন কে ছাড়া বাঁচবনা রজনী। আমার র*ক্তে*র সাথে যেন ও মিশে গিয়েছে। আমার সাথে হাজার ও স্মৃতি শ্রাবণের। তুই প্লিজ ভাইয়াকে বল। একমাত্র তুই আছিস যে পারবে ভাইয়া কে রাজি বানাতে।”
” তার আগে খাবার খেতে হবে, খাবার খেয়ে বাইরে যেতে হবে। আমি একদম তোকে হাসি খুশি দেখতে চাই।”
” তুই ভাইয়া কে বলবি তো!”

“তোর ভাইয়া একজন বিচক্ষণ মানুষ। নিজের বোনের জন্য এই পৃথিবীর সব থেকে সেরা জিনিস টাই দিবে।”
“ভাইয়ার ধারণা ওই ইঞ্জিনিয়ার ই উত্তম পাত্র। কিন্তু ভাইয়া তো জানেনা সব সময় ফ্যামিলির পছন্দ সঠিক হয়না। শ্রাবণ ই আমার জন্য সঠিক পাত্র।”

“দেখ প্রিয়তা আমি তোর ভাইয়াকে দেখতে পারতাম না। এই পৃথিবীর সব থেকে খারাপ মানুষ বলে জানতাম। কিন্তু এখন আমার চোখে ওই মানুষ টা এই পৃথিবীর সব চেয়ে ভাল মানুষ। শুধু নিজের উপর রাগ হয় কেনো মানুষ টাকে আমি অপমান করেছিলাম। কেনো খারাপ ভেবেছিলাম। আমার বাবা-মায়ের সিদ্ধান্ত সঠিক ছিল সেটা এখন বুঝতে পারি। আসলে আমরা যখন কাউকে দেখতে পারিনা তার হাজার টা ভাল কাজ ও চোখে পড়েনা।

কোনো অনুভূতি কাজ করেনা। আর যখন কাউকে ভালবাসি তার প্রতিটা খারাপ কাজ কেই পজিটিভ ভাবে নিই। কারণ সেই মানুষটার প্রতি আমাদের অনুভূতি পজিটিভ থাকে। তার কোনো ভুল আমাদের চোখে পড়েনা,চোখ থাকতেও অন্ধ হয়ে যায় আমরা। কিছু সময় পরিবারের সিদ্ধান্ত সঠিক হয় আবার ভুল ও হয়।আবার কিছু সময় নিজের সিদ্ধান্ত সঠিক হয় আবার ভুল ও হয়। আসলে কি বলতো সব ভাগ্য। ভাগ্য বলে কিছু আছে প্রিয়তা।”

“আমার শ্রাবণ কি আমার জন্য সঠিক নয় প্রিয়তা? যদি সঠিক নাও হয় আমি ওই ভুলেভরা মানুষের সাথে জীবন কাটানোর জন্য প্রস্তুত। আমি প্রমান করে দিব আমি সঠিক মানুষ কে বেছে নিয়েছিলাম জীবনে। আমি ছাড়া শ্রাবণের আর কেউ নেই। এই পৃথিবীতে ও এতিম,অনাথ। কেউ নেই ওর। কেউ ওকে ভালবাসেনি কখনো। একমাত্র আমি আছি যে ওকে ভালবাসে।”
“তুই এত সিরিয়াস শ্রাবণ কে নিয়ে?”

“আমি বাঁচলে শ্রাবণের সাথে বাঁচব। নইলে ম’রে যাবো। এখন আমার ডিসিশন তারা কি করবে। তুই ও ভেবে দেখ ভাইয়াকে বলবি কীনা!”
“বলব না মানে। আমার কানে সানাই এর সুর ভেষে আসছে ননদিনি। শ্রাবণ আর প্রিয়তার বিয়েতে রজনী উরাধুরা নাচ করবে।”

প্রিয়তা কিছুটা নিশ্চিন্ত হল। খাবার খেয়ে রজনীর সাথে বাইরে বের হল।পড়ন্ত বিকাল। প্রান্তিকের ফুল বাগানে প্রিয়তা পায়চারী করছে।হেলে যাওয়া সূর্যের কীরণ প্রিয়তার মুখে পড়েছে। মুখশ্রীতে লাল আভায় দারুণ লাগছে। দূর থেকে একজোড়া চক্ষু প্রিয়তার লালচে মুখের সৌন্দর্যে বুদ হয়ে তাকিয়ে আছে। এই চোখ জোড়া প্রায় সময় প্রিয়তাকে দেখে। খুব ভাল ভাবে দেখে। একদম মুগ্ধ নয়নে দেখে। এই চোখ জোড়ার মালিক অন্ত।

অন্তর ভেতরে যে প্রিয়তার জন্য গভীর ভালবাসা রয়েছে সেটা অপ্রকাশিত।প্রিয়তা শ্রাবণের কথা ভেবে হাসছে। নিশ্চয়ই ভাইয়া এলে রজনী শ্রাবণের কথা বলবে আর ভাইয়া সব মেনে নিবে। এসব ভাবতে ভাবতে প্রিয়তার পায়ে একটা গোলাপের কাটা ফুটল।প্রিয়তা আহ শব্দ তুলে। চোখ মুখে ব্যাথার স্পষ্ট ছাপ। অন্ত দূর থেকে ছুটে এল। ছুটে এসেই প্রিয়তার সামনে বসে পড়ল।প্রিয়তার পা হাত দিয়ে ধরে ফেলল। প্রিয়তা অন্তকে দেখে বেশ অবাক হয়ে বলল,

“আপনি?”
“প্রিয়তমার পায়ে কাঁটা প্রিয়তম কি ছুটে আসবে না?”
“পা ছাড়ুন আমার প্রিয়তম ঠিক ই চলে আসবে।আমি ফোন দিচ্ছি শ্রাবণ কে।”
“তোমার ফোন পেয়ে আসতে আসতে পায়ে জখম হয়ে যাবে প্রিয়তমা। কেমন হিরো শ্রাবণ আমার আগে আসতে পারল না।”

“আমি জানি ভিলেন রা আগে আসে অন্ত ভাই। আর হিরোর এন্ট্রি পরে হয়।আর আপনি আমাকে আজ হঠাৎ প্রিয়তমা বলে ডাকছেন কাহিনী কী?”
অন্ত পায়ের কাঁটা তুলে বলল, “আমি একটু মজা করলাম। শ্রাবণ কে চেতিয়ে দিতে ভাল লাগে। তোমাকেও চেতিয়ে দিতে ভাল লাগে। তুমি শ্রাবণের প্রিয়তমা আমার নও।”

এতক্ষণে প্রিয়তা শ্রাবণ কে মেসেজ করে দিয়েছে। শ্রাবণ মাত্রই প্রান্তিকের সাথে বাইরে থেকে এল। প্রান্তিক নিজের রুমে গিয়েছে। শ্রাবণ ফুল বাগানে প্রবেশ করল।মুখটা কেমন শুকনো দেখাচ্ছে। সারাদিনে নিশ্চয়ই কিছু খাওয়া হয়নি।শ্রাবণ কে দেখেই অন্ত বলে উঠল,

“শ্রাবণ শালা তোর হয়ে আমি প্রক্সি দিচ্ছিলাম।”
শ্রাবণ ক্লান্ত চোখ মুখে প্রিয়তার দিকে তাকাল। আজ আর অন্তর কথার কোনো উত্তর দিলনা। অন্ত বুঝতে পারল শ্রাবণের মন ভাল নেই। তাই আর কথা না বাড়িয়ে সরে গেল।শ্রাবনের চোখ অশ্রুসিক্ত। একটা ছেলের চোখের পানি অতি সহযে বের হয়না।প্রিয়তা শ্রাবনের চোখে পানি দেখে বলল,

“সারাদিন কোথায় ছিলে তুমি শ্রাবন।?”
“ভাই এর সাথে।”
“কিছু খেয়েছো?”
“হুম।”

“মিথ্যা বলছো ক্যানো? আর আজ তুমি কাদছো ক্যানো? তুমি কি একটা মেয়ে। আমি তোমাকে বহুবার বলেছি আমাদের ব্যাপার টা ভাইয়াকে জানাও। অথচ তুমি আজ না কাল, কাল না পরশু এভাবে করে ভাইয়াকে আজ ও জানালে না।”
শ্রাবণ একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল, “ভাই আমাকে ভরসা করে প্রিয়তা। আমি কোন মুখে বলব, আমি আপনার বোনকে বিয়ে করতে চাই। হাজারবার চেষ্টা করেও পারিনি। আমি নিজেও জানিনা কীভাবে বলব।”

“তাহলে আমার বিয়ে দেখতে চাও তুমি?”
“আমার কপালটা এত খারাপ কেনো প্রিয়তা।
পৃথিবীর সব থেকে বাজে অনুভূতি নিজের ভালবাসার মানুষ কে অন্য কারো পাশে দেখা। সেই অনুভূতি আমাকে আজ হজম করতে হল। ওই ইঞ্জিনিয়ার কে খু- ন ক র তে চাই আমি। ”
“কতজন কে খু*ন ক র বে তুমি? মানুষ খু* ন করার চেয়ে সহজ কাজ ভাইয়াকে গিয়ে বলা সেটা পারবে না। আমি নিজে ভাইয়াকে বলব।”

“আমিই বলব আজ। হয় ভাই আমাকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দিবে নইলে খু* ন করবে। নইলে তোমাকে আমার হাতে তুলে দিবে। ”
“ভাইয়া তোমাকে ভালবাসে শ্রাবণ। ভাইয়া সব মেনে নিবে।”
শ্রাবন প্রিয়তার দুই গালে হাত রেখে বলল, ” আমার প্রাণপাখি, তুমি ছাড়া বুকের খাঁচা শূণ্য। যদি কখনো তুমি আমার না হও জেনে রেখো আমার মৃত্যু হয়েছে। ”

“তুমি ভুলেও এসব বলবে না। আমি সৃষ্টিকর্তাকে বলব, আমার আয়ু তোমার করে দিতে। ”
“দেখি পায়ে কোথায় কাটা ফুটেছে।”
“অন্ত ভাইয়া কাটা তুলে দিয়েছে।”
“এই অন্তটা ইদানিং তোমার দিকে তাকিয়ে থাকে।”
“কখন?”

“তুমি বুঝবে না ওসব। আমি জানি এবং খেয়াল করি কে তোমাকে দেখছে কে কতবার তাকাচ্ছে।”
“এত্ত কেয়ারিং তুমি আমার প্রতি।”
“ঠিক কতটা ভালবাসি বুঝিয়ে বলা সম্ভব নয়। কিছু জিনিস অসম্ভব বুঝিয়ে বলা।”
শ্রাবণ নিচে বসে প্রিয়তার কাঁটা ফোঁটা পায়ে হাত বোলাল।হাত বোলাতে বোলাতে বলল, ” এত সুন্দর পায়ে কাঁটা৷ ফুটল। খুব ব্যাথা পেয়েছো।”

প্রিয়তা আদুরে গলায় বলল, “খুউউউব।”
“ইশ! অপেক্ষা করো একটু। এই আদর বিয়ের পরে হবে। ”
“শুধু বাজে কথা।”

প্রান্তিক বসে বসে সিগারেট টানছে। রজনী রুম ভরে পায়চারী করছে। প্রিয়তার ব্যাপারে কথা বলবে। কিন্তু শুরু করার সাহস পাচ্ছেনা। প্রান্তিকের বিচক্ষন চোখ রজনীর অস্থিরতা দেখেও কিছু বলছেনা। রজনী কতক্ষণ পায়চারী করতে পারে সেই অপেক্ষায় আছে। এরই মাঝে প্রান্তিকের ফোনে কয়েকটা ছবি পাঠাল কেউ। ছবিগুলো দেখে প্রান্তিক অবাক হয়ে ছবিগুলো জুম করল। শ্রাবণ আর প্রিয়তার কিছু ছবি। প্রান্তিক ফোনটা বিছানার উপর ছুড়ে ফেলে সিগারেট দ্রুত টানছে। প্রান্তিকের ভেতরে কি চলছে তা বোঝার ক্ষমতা কারো নেই।

রজনী পায়চারী করতে করতে হাঁপিয়ে উঠে বলল,
“মানুষ জন বিয়ে করে কি জন্য?”
প্রান্তিক ভ্রু উঁচিয়ে রজনীর দিকে তাকিয়ে বলল,
“হোয়াট ডু ইউ মিন রজনীগন্ধ্যা?”
“মানুষ বিয়ে করে কি জন্য সেটা জানতে চাইছি।”

“এতদিনে বুঝতে পারোনি। নাকি আবার ও বুঝাবো।”
“কথা নেগেটিভ দিকে নিবেন না মোটেও। আপনার মনে কি আছে সত্য করে বলুন।”
“তুমি আছো আর কি থাকবে?”
“যে হৃদয়ে সিগারেট এর পোড়া গন্ধ সে হৃদয়ে আমি নেই। আপনার হৃদয়ে আছে শুধু সিগারেট সেখানে ফুল থাকবে কীভাবে?”

“এত রেগে আছো ক্যানো? আমি কি সিগারেট খেয়ে কখনো তোমাকে কিস করেছি। ব্রাশ করে তবেই তো কিস করি।”
“আজ থেকে আপনি সিগারেট খেলে আমিও খাবো।আমিও রাস্তাঘাটে সিগারেট খাবো আর ধোঁয়া উড়াব।”
“শুধু সিগারেট? বিয়ার খাবেনা?”
“সে আবার কি?”
“মদ। ”
“আপনি ওসব ও খান!”

“হু, তুমি খাবেনা?”
“নিশ্চয়ই খাবো। আপনি যা খাবেন আমিও তাই খাবো।”
“তাই?”
“হ্যাঁ। ”
প্রান্তিক রজনীর দিকে সিগারেট এগিয়ে দিয়ে বলল,”নাও টান দাও।”

রজনী প্রান্তিকের হাত থেকে সিগারেট নেওয়ার জন্য হাত বাড়াতেই প্রান্তিক রজনীর হাত ধরে টান দিয়ে কোলের উপর বসাল।হাতের সিগারেট ফেলে দিলে রজনীর ওষ্টে গম্ভীর চুম্বন দিয়ে বলল,
“সিগারেট খেতে চাইছো তাই খাওয়ালাম।সিগারেট খেলেও যে ফ্লেবার পেতে সেই ফ্লেবার এর চুমু দিলাম রজনীগন্ধ্যা। এখন থেকে এভাবে রোজ সিগারেট খাওয়াবো তোমায়।রাস্তায় দাঁড়িয়ে খাবেনা? গো।”

“আপনি এত জঘন্য।সব সময় এসব করে জিতে যান।”
“প্রান্তিক চৌধুরীকে যদি কেউ ভেবে থাকে হারিয়ে দিচ্ছে উল্টো দিকে সে হেরে বসে থাকবে।টের ও পাবেনা।রেজাল্ট এর পরেই বুঝবে কি বোকাটা ছিল।”

নয়নে লাগিল নেশা পর্ব ২৮

“আপনার এত কঠিন কথা বুঝিনা আমি।কিছু বলতে চাইছি আর আপনি শুনতেই চাইছেন না।”
“কি বলবে তুমি? শ্রাবণ আর প্রিয়তার কথা।”
প্রান্তিকের মুখে এ কথা শুনে রজনী থমকে গেল।

নয়নে লাগিল নেশা পর্ব ৩০