নয়নে লাগিল নেশা পর্ব ৩৮

নয়নে লাগিল নেশা পর্ব ৩৮
Mousumi Akter

ট্রাকের সাথে ধাক্কা লেগে খানিক টা দূরে গিয়ে পড়ে।গাড়ির সমস্ত গ্লাস ভেঙে গুড়ো হয়ে যায়। গাড়ির ভেতর থেকে একবার সবার চিৎকার শোনা যায়।প্রান্তিক পেছনে তাকিয়ে দেখে তাদের প্রিয়তা র*ক্তা*ক্ত অবস্থায় অচেতন হয়ে পড়ে আছে গাড়ির সিটের সাথে।মুখে একটা কাচ ঢুকে গিয়েছে।অন্তর খুব একটা আঘাত লাগেনি তবে চোখ মুখ র*ক্তা*ক্ত। রজনির ও কপাল কেটে র*ক্ত বের হচ্ছে।প্রান্তিকের নিজের ও কপাল কে-টে গিয়েছে।অন্ত ব্যাথায় কাতর তবুও প্রিয়তা কে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাদছে আর বলছে, ” ভাই এম্বুলেন্স, এম্বুলেন্স ডাকেন।ওকে বাঁচাতে হবে। ওর অবস্থা ভাল না। ”

প্রান্তিক তাকিয়ে দেখে একমাত্র বোন জীবিত নাকি মৃত বোঝা যাচ্ছেনা। নিঃশ্বাস বইছে কীনা সেটাও বোঝা যাচ্ছেনা।পাশেই তার স্ত্রী রজনি জ্ঞান হারিয়ে পড়ে আছে। কপাল দিয়ে একভাবে র*ক্ত পড়ছে।প্রান্তিক একবার বোন একবার রজনি দু’জনের দিকে তাকাচ্ছে।কি করবে বুঝতে পারছে না।একবার প্রিয়তার দিকে তাকিয়ে বলছে, ” তোর কিচ্ছু হবেনা বোন।” আরেকবার রজনির দিকে তাকিয়ে বলছে, “আমি তোমাকে কিছু হতে দিবনা।”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

দিশেহারা হয়ে পড়েছে প্রান্তিক।রজনি সিট থেকে গড়িয়ে পড়ে যাচ্ছে দেখেই প্রান্তিক রজনিকে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে বলল, ” রজনিগন্ধ্যা তুমি ঠিক আছো? আমার জন্য যদি তোমাদের কিছু হয়; আমি শেষ করে দিবো নিজেকে।” প্রান্তিক খুব বেশী উত্তেজিত হয়ে কথাগুলো বলছে।অন্ত তাকিয়ে দেখে প্রান্তিকের অবস্থা ও খুব একটা ভাল নয়।অন্ত কাকে রেখে কাকে দেখবে কিছুই বুঝতে পারছেনা।রজনিকে বুকে নিয়েই প্রান্তিক সেন্স হারিয়ে যায়।

আশ পাশের লোকজনে ভরে গিয়েছে। সবাই গাড়ির দরজা খুলে ওদের চারজন কে বের করল।চারজন ই আহত। সবাত মাঝে প্রিয়তার অবস্থা বেশী খারাপ।প্রিয়তার মেহেদী রাঙা হাতে লেখা আছে ” শ্রাবণের বউ।”
মানুষ বলাবলি করছে মনে হয় নতুন বউ।এর বরের নাম মনে হয় শ্রাবণ।দেখো ছেলেটা বউটারে কত ভালবাসে।নিজেও আঘাত পাইছে কিন্তু বউটারে জড়ায় ধরে রাখছে।

দেখতে দেখতে এম্বুলেন্স চলে এল।ইমারজেন্সি ওয়ার্ডে ওদের ট্রিটমেন্ট করে প্রিয়তাকে আইসিইউ তে ভর্তি করল।ওদের মাঝে শুধু অন্তর জ্ঞান আছে।প্রিয়তাকে আইসিইউতে ভর্তি করলে অন্ত আইসিইউ রুমের সামনে বসে কাদছে আর বলছে, ” আল্লাহর কাছে এই প্রথমবার কিছু চাইছি আমি।সে হল তোমার আয়ু। প্রয়োজনে আমার আয়ু নিয়ে নিক তবুও তোমায় সুস্থ করে দিন।”

হসপিটালের মানুষ খুব অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। কেউ কোনো সান্ত্বনা দিচ্ছেনা।কিছু সময়ে মানুষকে সান্ত্বনা দেওয়া যায়না।অন্তর হাহাকার আর কাঁন্না দেখে অন্তকে ঘিরে চারদিকে থাকা মানুষ জনের চোখে পানি পড়ছে।
অপরপাশে রজনির স্যালাইন চলছে। প্রান্তিক ও সেন্সলেস হয়ে আছে।প্রান্তিকের ও স্যালাইন চলছে। ওদের ঘিরেও মানুষজন দাঁড়িয়ে আছে। সবাই ওদের সুস্থ হওয়ার জন্য প্রার্থনা করছে।

রজনির মুখের দিকে তাকিয়ে সবাই বলছে এত সুন্দর মেয়ে আগে দেখিনি।গোলাপের মত দেখতে।প্রান্তিক আর রজনি পাশাপাশি বেডেই আছে।ঘন্টা খানিক পরে রজনির জ্ঞান ফিরল।জ্ঞান ফিরতেই তাকিয়ে দেখল সে হসপিটালে।সাথে সাথে মনে পড়ল পথের এক্সিডেন্ট এর কথা।সে হসপিটালে বাকিরা কোথায়?আশে পাশে তাকাল।ডান দিকে তাকাতেই বুকের মাঝে বাড়ি মেরে উঠল।তার প্রাণপ্রিয় মানুষটার মাথায় ব্যান্ডেজ, যা র*ক্তে ভেজা।চোখ বুজে পড়ে আছে। রজনি ওঠার চেষ্টা করল কিন্তু মাথার ব্যাথায় উঠতে পারল না। রজনির জ্ঞান ফিরতেই সাইড থেকে কেউ একজন অন্তকে ডেকে বলল, ‘ আপনাদের লোকের জ্ঞান ফিরেছে।’

অন্ত দ্রুত ছুটে এল।এসে দেখে রজনির জ্ঞান ফিরেছে।অন্ত রজনিকে দেখেই বলে, ‘ ভাবি আপনার জ্ঞান ফিরেছে।’
রজনি কাঁন্নাভেজা কন্ঠে বলল, ‘ তোমার ভাই ওভাবে সুয়ে আছে কেনো? ওর কি হয়েছে?’
‘ শান্ত হন ভাবি। ভাই সুস্থ হয়ে যাবে।’
‘প্রিয়তা কোথায়?’
‘আইসি ইউ তে ভাবি।’

‘ আই সি ইউতে ক্যানো? ওর কি হয়েছে?’
‘ওর অবস্থা ভাল না ভাবি।’
‘সব খারাপ ক্যানো ওর সাথেই হচ্ছে অন্ত।’
‘ভাল মানুষের সাথে খারাপ ই হয় ভাবি।’
‘তোমার ভাইয়ার কি হয়েছে।ওকে উঠতে বলো প্লিজ!’
‘ভাইয়া উঠবে ভাবি।চিন্তা করবেন না।’
‘ আমাকে ওর আরেকটু কাছে নিয়ে যাও।আমি ওকে ছুঁয়ে দেখতে চাই।প্লিজ অন্ত।’
‘ভাবি আপনি নিজেও অসুস্থ। ‘

এরই মাঝে নার্স এসে বলল, ‘ প্লিজ আপনি অসুস্থ। কথা বলবেন না।এতে আপনার ক্ষতি হবে।উনি ভাল আছেন ঘুমের মেডিসিন দেওয়া ঘুমোচ্ছে।’
নার্স রজনিকে একটা মেডিসিন দিল।মেডিসিন খেয়ে রজনি ঘুমিয়ে গেল।

রাত দুইটা বাজে। হসপিটালে উপস্থিত হল মাহবুব,আঞ্জুমান সহ অন্তর মা -বাবা। আঞ্জুমান আর মাহবুব এর পরিবারের সবার এই ক্রিটিক্যাল কন্ডিশনে আঞ্জুমান আর মাহবুব ভীষণ ভাবে ভেঙে পড়েছে। বিশেষ করে প্রিয়তার জন্য। প্রিয়তার সাথেই ক্যানো সব খারাপ হচ্ছে। আঞ্জুমান আর মাহবুব দুজনেই কাঁন্নাকাটি করছে অন্তর মা-বাবা তাদের বুঝিয়ে যাচ্ছে। শেষ রাতের দিকে প্রান্তুকের জ্ঞান ফিরল। জ্ঞান ফিরতেই সে রজনির নাম ধরে ডাকল।রজনি ঘুমিয়ে আছে। আঞ্জুমান ছেলের জ্ঞান ফিরতে দেখে মুখে কাপড় গুজে কাদছে। প্রান্তিক মায়ের হাত ধরে বলল, ‘ আমাকে ক্ষমা করে দাও আম্মু। আমার জন্য আজ সবার এত বড় ক্ষতি হল।’

‘ যদি তোমার কিছু হত আমি কি নিয়ে বাঁচতাম।’
‘ প্রিয়তা কই আম্মু।’
‘ আইসিইউতে।’
প্রান্তিক কোনো কথা বলতে পারলনা। কষ্টে বুক ভেঙে চুরে যাচ্ছে।পাশের সিটে রজনি সুয়ে আছে।প্রান্তিক খুব কষ্টে রজনির দিকে হাত বাড়াল।রজনির কপালে হাত রাখল।আঞ্জুমান রজনির গায়ে হাত রেখে বলল,

‘ মা রজনি।’
আঞ্জুমানের ডাকে রজনির চোখ মেলে তাকাল।চোখ মেলে তাকাতেই দেখল প্রান্তিকের হাত তার কপালে। রজনি প্রান্তিকের হাত টা শক্ত করে চেপে ধরল। চোখ দিয়ে পানি পড়ছে তার।নিজের জন্য কাদছেনা। প্রান্তিক যে আঘাত পেয়েছে সেই ব্যাথা অনুভব করেই রজনি কষ্ট পাচ্ছে।

দশদিন পরে রজনি আর প্রান্তিক বাড়ি ফিরলেও প্রিয়তা বাড়ি ফিরতে পারেনি। প্রিয়তার অবস্থার কোনো পরিবর্তন হয়নি। বাড়িতে এসেই প্রান্তিকের মেজাজ ক্রমশ খারাপ হচ্ছে। সব কিছুর জন্য যেন শ্রাবণ দায়ী। শ্রাবণ এত কিছু না করলে তার বোনের এ অবস্থা হতনা।প্রান্তিক একটার পর একটা সিগারেট টানছে আর পায়চারী করছে।কোনভাবেই নিজের রাগ সামলাতে পারছেনা।

সিগারেট ফেলে রুমে এসে প্রচুর ভাঙচুর করছে। চিৎকার করছে। রজনি রুমে এসে প্রান্তিকের এমন ভয়ংকর রাগের কারণ বুঝতে পারছেনা।প্রান্তিক এর আচরণ কেমন সাইকোদের মত লাগছে। রজনি র হঠাত মনে হল প্রান্তিক তাকে বলেছিল, ‘ পৃথিবীর সমস্ত রাগের উর্দ্ধে তুমি।একবার কাছে এলেই আমি নদীর মত শান্ত হয়ে যায়।’
রজনি কিছু না বলে আচমকা প্রান্তিক কে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘ প্লিজ শান্ত হন। কি হয়েছে আপনার?’
প্রান্তিক রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বলল, ‘ ওকে বাঁচিয়ে রাখব ভেবেছিলাম কিন্তু না।ওর জন্য আমার বোনের এই অবস্থা। আমি ওকে বাঁচাব না।’

‘কাকে?’
‘শ্রাবণ।’
রজনি তখন ভীষণ অবাক হল।তাহলে কি প্রান্তিক জানে শ্রাবণ কোথায় আছে। রজনি এই বিষয়ে কোনো কথা বাড়াল না। সে প্রান্তিক কে শক্তভাবে জড়িয়ে ধরে বলল,
‘ আই লাভ ইউ। ‘
প্রান্তিক আচমকা শীতল হাওয়া অনুভব করল।রজনিকে আলিঙ্গন করে ক্লান্তি দূর করল।

নয়নে লাগিল নেশা পর্ব ৩৭

মধ্যরাতে প্রান্তিক রুম ছেড়ে বাইরে এল। অপেক্ষা করছিল রজনির ঘুমের জন্য। রজনিও অপেক্ষা করছিল কখন প্রান্তিক বাইরে বের হয়।প্রান্তিক নিজের পিস্তল নিয়ে ফুল বাগানের দিকে এগিয়ে গেল।বাগানের শেষের দিকে ওদের ব্যবসায়ের জন্য গুদাম ঘর করা।সেই গুদাম ঘরে প্রবেশ করল প্রান্তিক।

নয়নে লাগিল নেশা পর্ব ৩৯