নয়নে লাগিল নেশা পর্ব ৪৭

নয়নে লাগিল নেশা পর্ব ৪৭
Mousumi Akter

দীর্ঘদিন পর প্রিয়তার ফিরে আসায় বাড়িটা আবার ও আমেজময় হয়ে উঠেছে।এত জার্নি,এত ক্লান্তি ভুলে সবার মাঝে বসে অন্ত আর প্রিয়তা হাসি মুখে গল্প করছে।তারা কোথায় কোথায় ঘুরেছে সেই ছবি গুলা দেখাচ্ছে।অন্ত খেয়াল করল গাড়িতে যে বিষন্ন মুখ ছিল প্রিয়তার সেটা এখন আর নেই।

প্রিয়তার হাসি মুখটা অন্তকে যেমন প্রশান্তি দিল তেমন প্রশান্তি দিল প্রান্তিক আর রজনিকে।ঘন্টা দু’য়েক তারা বসে বসে গল্প করছে।বাড়ির সবার জন্য শপিং করে নিয়ে এসছে।সেগুলা সবাইকে দেখাচ্ছে।প্রিয়তা রজনির হাতে একটা সাদা শাড়ি আর সাদা ব্লেজার দিয়ে বলল, ” তুই আর ভাইয়া এই কাপল ড্রেস পরে ঘুরতে যাবি একদিন। তোকে একদম হোয়াইট এঞ্জেল লাগবে।আমার ভাইয়া আরো বেশী ফিদা হয়ে যাবে।”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

প্রিয়তার প্রাণবন্ত মুখটা দেখে প্রান্তিকের মনে সত্যি প্রশান্তি লাগছে।কিন্তু তার বোন হঠাৎ এতটা অস্বাভাবিক থেকে স্বাভাবিক হল কীভাবে? কিছুতো একটা হয়েছে? কিন্তু কি হয়েছে।রজনি খেয়াল করল প্রান্তিক থুতনিতে আঙুল ঠেকিয়ে কিছু একটা ভাবছে।কিন্তু কি ভাবছে।রজনি সবার মাঝ থেকে উঠে গেল।প্রান্তিকের কাছে গিয়ে বলল,
“কি হয়েছে? কি ভাবছেন? এতবড় খুশির দিনে আপনি চিন্তিত কেনো?”
“একটু রুমে চলোতো দরকার আছে।”

প্রান্তিক আর রজনি রুমে গেল।রজনি শাড়ি আর ব্লেজার টা বিছানায় রেখে প্রান্তিকের গলা জড়িয়ে ধরে বলল,
” বলুন না কি হয়েছে আপনার? আপনাকে চিন্তিত দেখালে আমার যেন কেমন অস্থির অস্থির লাগে।”
রজনি সহযে এভাবে এসে প্রান্তিকের কাছে কখনো ধরা দেয়না।প্রান্তিক সেই সুযোগ টা নিয়ে বলল,
“আগে একটা কিস করো বলছি।”

রজনি কোনো বাহানা ছাড়াই প্রান্তিকের ফর্সা খোঁচা খোঁচা দাঁড়িওয়ালা গালে নিজের ওষ্ট ডুবিয়ে বলল,
” এইবার বলুন।”
প্রান্তিক ওষ্ট এগিয়ে বলল, ” এখানে দাও।ইউ নো রজনিগন্ধ্যা আই লাইক ইট।”
রজনি লজ্জা পেল।ভীষণ লজ্জা পেল।গাল দু’টো লাল হয়ে গেল।লজ্জা পাওয়ার মত অস্বস্তিকর ব্যাপার দুনিয়াতে আর নেই।প্রান্তিক রজনিকে দেখে আবার ও মুগ্ধ হল।তার বউ কি লজ্জা পেলে একটু বেশীই সুন্দর লাগে।প্রান্তিক দুষ্টুমি করে বলল, ” দেরি করছো কেনো? তুমি কিস না করলে আমার চিন্তার কারণ টা বলতে পারছিনা।”

রজনি প্রান্তিকের ওষ্টে ওষ্ট মিলিয়ে গভীর অনুভূতিতে মগ্ন হল।কিছুক্ষণ পরে তারা দু’জন স্বাভাবিক হল।প্রান্তিক ডিভানে গিয়ে বসল।রজনিকে তার কোলের উপর বসিয়ে বলল, ” প্রিয়তার এই স্বাভাবিক হওয়ার কারণ বুঝতে পারছিনা।ও কি সত্যি স্বাভাবিক নাকি অভিনয় করছে।”

” আমি প্রিয়তার বেষ্ট ফ্রেন্ড। আমি ওকে সব চেয়ে ভাল বুঝি। ও আমার ননদ। আমিই ওকে শ্রাবণের ব্যাপারে সব সত্য জানিয়েছি। শ্রাবনের এ বাড়িতে আসার কারণ, ওকে ভালবাসার কারণ, শ্রাবণের উদ্দেশ্য সব জানিয়েছি। সেই সাথে শ্রাবণ কেনো এসব করেছে সেসব ও জানিয়েছি। ও যেদিন থেকে সব প্রমাণ সহ জানল শ্রাবণ সত্যি অভিনয় করতে এসেছিল আপনা-আপনি কেমন বদলে যেতে শুরু করল।

আমি হাজার বার শ্রাবণের ব্যাপারে পজিটিভ সাইড বুঝিয়েছি কিন্তু ও সে ব্যাপারে একটা উত্তর ও দেয় নি। শুধু বলেছে আমার বিশ্বাসের প্রতি আমি লজ্জিত, কোন চোখে অভিনয় ছিল আর কোন চোখে ভালবাসা ছিল আমি বুঝতে পারিনি। আমার চোখের সামনে দু’জোড়া চোখ ছিল।এক জোড়া চোখ শ্রাবণের দেখতে ভয়ংকর সুন্দর। ওই চোখের মায়ায় আমি আটকে গিয়েছিলাম।

কিন্তু ওই চোখ সারাক্ষণ আমার ক্ষতি আমার ফ্যামিলির করতে চেয়েছে।ওই চোখে আমার জন্য ভালবাসা ছিলনা।অথচ যে চোখ জোড়ার দিকে আমি কোনদিন তাকিয়ে দেখিনি সেই চোখ জোড়া আমাকে পবিত্র চোখে দেখেছে।এত কিছুর পরেও আমাকে আগলে রেখেছে।তারপর ও অন্তকে ভালবাসতে পারিনি।এত কিছুর পরেও শ্রাবণের জন্য মায়া হয়। তবে সেই মায়া থেকে কিছু অংশ কীভাবে যেন অন্তর দিকে চলে গিয়েছে। সেটা কি আমাকে আগলে রাখছে সেজন্য নাকি অন্য কারণ আমি বুঝতে পারছিনা।”

প্রান্তিক রজনিকে জড়িয়ে ধরে বলল, “তুমি আমায় খানিকটা নিশ্চিন্ত করলে।”
“আচ্ছা আপনি চাইলেই তো পারতেন শ্রাবণ আর প্রিয়তাকে এক করে দিতে। কেনো করলেন না। আপনি নিজেই তো শ্রাবণ কে ভীষণ ভালবাসেন।শ্রাবণ তো অসহায়।ওর ও তো কিছুই করার ছিলনা।ছেলেটা যে ভীষণ কষ্ট পাচ্ছে। এত কষ্ট কেনো দিচ্ছেন বলুন।”

“তাহলে কি করতে বলছো? অন্তর কাছ থেকে এনে শ্রাবনের হাতে তুলে দিব?”
” তা কি আর সম্ভব। আসমান জমিন সৃষ্টির ও আগে সৃষ্টিকর্তা প্রত্যেক মানুষের জীবনসঙ্গী ঠিক করে রেখেছেন।তিনি উত্তম পরিকল্পনাকারী।পবিত্র সম্পর্কের জোর বেশী।”
“আমি জানতাম তুমি ভুল কিছু ভাববে না।বা বলবেও না।”
” কিন্তু আগে তো পারতেন।তখন কেনো করলেন না?”

“শ্রাবণ ওর ভুল কখন বুঝতে পেরেছে বলো।আমি শুধু দেখছিলাম ও কখন ওর ভুল শুধরাতে পারে। আমি যে ওর ব্যাপারে জেনেছি ওকে কোনদিন জানানোর ইচ্ছা ছিলনা।আমি চেয়েছিলাম ও যেন নিজে থেকে ওর ভুল বুঝতে পারে।কিন্তু না ও সব সীমা লঙ্ঘন করল।তুমি যেদিন বললে কেউ তোমার শাড়ির কুচি খুলে ফেলেছে আর ওখানে শ্রাবণ অন্ত ছিল আমি তখন ই বুঝেছিলাম।

আমি এই পৃথিবীর সব ক্ষমা করতে পারি কিন্তু তোমার দিকে কারো কু-দৃষ্টি আমি মেনে নিবনা।অন্য কেউ হলে তো খু*ন ই করে ফেলতাম। শুধু শ্রাবণ বলে আমি ভালবাসার টানে কিছুই করতে পারিনি।ভাবলেই কেমন চমকে উঠি আমি আমার ফুলের মত বোনকে মে*রে রিভেঞ্জ নিতে চেয়েছিল।পৃথিবীতে সব অন্যায়ের ক্ষমা নেই রজনিগন্ধ্যা।তাছাড়া ও হাজারো মেয়ের সাথে রাত কাটিয়েছে ড্রাগ এডিকটেড হয়ে। আমি ভাবতেও পারিনা আমার বোনের পাশে এমন কাউকে নেভার এভার।তবুও ওই পা*গ*ল টারে আমি ভালবাসি।”

“মন খারাপ করবেন না একদম আপনি।”
প্রান্তিকের ভীষণ মন খারাপ হল।তার সারাদিন মন খারাপ থাকে রজনি কে বুঝতে দেয়না।তার কিছু হলে এই মেয়েটাকে কে দেখবে।শ্রাবণের মত কত শত্রু আছে তার।তারা যদি ঝাপিয়ে পড়ে।তার এই পবিত্র ফুলের ক্ষতি যদি কেউ করে।অন্তত এই জন্য হলেও সে রজনির হাত ধরে বৃদ্ধ হতে চায়।তার কিছু হলে রজনি পা-গ- ল হয়ে যাবে।সে ছাড়া এই পৃথিবীর কেউ সামলাতে পারেনা রজনিকে

মনে মনে বলল, ” তোমাকে পাওয়ার জন্য কত আন্দোলন,কত সংগ্রাম করে পেয়েছি তা শুধু আমি জানি।তোমার ঘৃণা ভরা দৃষ্টিতে ভালবাসা দেখার জন্য ছটফট করেছি।আমি জিতেছি।প্রান্তিক চৌধুরীকে কেউ হারাতে পারেনি কিন্তু ভাগ্যর কাছে হয়ত হেরে যাবো।”

রাতে সবার খাওয়া শেষে গল্প শেষ করে রাত প্রায় শেষের দিকে। এ বাড়িতে আজ প্রথমবার অন্ত প্রিয়তার রুমে ঘুমোবে। সবার মাঝে অন্ত বেশ হাসি খুশি থাকলেও রুমে এসে বেশ চুপচাপ। একটা বালিশ নিয়ে ফ্লোরে সুয়ে পড়ল।প্রিয়তা ওয়াশ রুম থেকে এসে দেখল অন্ত ফ্লোরে। কিছু না বলে সে চুপচাপ নিজের বালিশ টা নিয়ে ফ্লোরে অন্তর পাশে গিয়ে সুয়ে পড়ল। প্রিয়তাকে ফ্লোরে দেখেই অন্ত ধড়ফড়িয়ে উঠ বসে বলল, ” এ কি তুমি! তুমি এখানে কেন?”

প্রিয়তা কৌতুহলী দৃষ্টিতে অন্তর দিকে তাকিয়ে আছে।অন্ত এমন চমকে গেল কেন? প্রিয়তা বাঁকা সুরে বলল,
” যেভাবে ধড়ফড়িয়ে উঠেছেন যেন আপনার ইজ্জত মা’ র’ তে এসছি আমি।”
” নাউজুবিল্লাহ ছিঃ”
“নাউজুবিল্লাহ বলছেন কেন? আপনার আচরণে তো তাই বুঝাচ্ছে।আমি অমন কিছুই করতে এসছি।”

“তুমি অসুস্থ মানুষ তো। নিচে সোয়া যাবেনা তাই বলেছি।”
” আপনার বাড়িতে আপনি ফ্লোরে ঘুমোবেন, বাইরের দেশে গেলে সারারাত টুলে বসে ঝিমিয়ে ঝিমিয়ে কাটাবেন,আমার বাড়িতেও ফ্লোরে ঘুমোবেন এত অবিচার তো করতে পারিনা।আমি অতটা নির্দয় পাষাণ মেয়ে না।”
“তাহলে কি বলতে চাইছো?”
“আপনি দুইদিন ফ্লোরে আমি দুইদিন ফ্লোরে।”
“আজিবন জেগে থাকলেও তোমাকে ফ্লোরে ঘুমোতে দিবনা আমি।সো চুপচাপ খাটে গিয়ে সুয়ে পড়ো।”

“তাহলে আপনিও খাটে আসুন।সমস্যা নেইতো। আমি বিলিভ করি আপনাকে।দূর দেশে থেকেও যে আমার একটা পশম স্পর্শ করেনি সে আমার বাড়িতে আর কি করবে।”
অন্তর হৃদয় আত্মা কেঁপে উঠল।বুক ধড় ফড় করছে।হাত -পা কাঁপছে। সেই ভয়ংকর রাতের কথা মনে পড়ে গেল।অন্তর মাথায় কাজ করছেনা।সে প্রিয়তার বিশ্বাস এর যোগ্যনা।সে প্রিয়তার বিশ্বাস রাখতে পারেনি।এই সরল মেয়েটা আর কত ঠকবে।কারো অনুমতি ছাড়া তার পশম স্পর্শ করাও পাপ।এই পাপের যাতনায় অন্ত শেষ হয়ে যাচ্ছে।

প্রিয়তা কোনদিন জানলে কি উত্তর দিনে সে।প্রিয়তা কি আবার অস্বাভাবিক হয়ে যাবে।তাছাড়া প্রিয়তা শ্রাবণের সম্পত্তি।সে শ্রাবণ কে ভালবাসে।অন্তর বিবেক বলছে এত বড় অন্যায় আর করা যাবেনা।শ্রাবণ যথেষ্ট শাস্তি পেয়েছে।এখানে সে একা কষ্ট পাবে প্রিয়তাকে হারিয়ে।ওদিকে শ্রাবণ -প্রিয়তা দুজনেই কষ্ট পাচ্ছে।দুজন ভাল বাসার মানুষ কে এক করে দেওয়া কম আনন্দের নয়।প্রিয়তা তার একান্ত নিজস্ব অনুভূতি।

যে অনুভূতি কাছে থাক বা দূরে থাক একান্তই তার।দিনশেষে প্রিয়তার হাসি মুখ ই তাকে প্রশান্তি দেয়।প্রিয়তার কাছাকাছি আর কখনো যাওয়া যাবেনা।খুব সাবধানে থাকতে হবে।প্রিয়তা ঘুমিয়ে পড়লে আবার সরে আসতে হবে।প্রিয়তা তার শখের নারী।আর শখের নারী কাছে টানলে দূরে যাওয়ার ক্ষমতা কোনো পুরুষের ই নেই।অন্ত চুপচাপ বালিশ নিয়ে খাটে গিয়ে সুয়ে পড়ল।প্রিয়তা আসলে মনে মনে এটাই চাইছিল।অন্ত তার পাশেই ঘুমোক।দু’জন দু’দিকে মুখ করে সুয়ে আছে।হঠাৎ প্রিয়তা ডাকল,

” অন্ত।”
“হুম।”
“ধন্যবাদ।”
“কেনো?”
“কেউ না হয়েও আমার একাকিত্ব জীবনের সঙ্গী হওয়ার জন্য।”
“আমি কেউ না?”
“যেখানে আপণ মানুষ বুকে -পিঠে ছু-রি দিয়ে চলে গিয়েছে সেখানে আপনাকে তো কিছুই ভাবতাম না।”
“ওসব না ভাবলে হয়না।”
“জানেন অন্ত ভালবাসা মানে আমি কি বুঝতাম?”

“কি?”
“এক জোড়া বিশ্বস্ত হাত। যে আমাকে আগলে রাখবে। আমার মানসিক শান্তির কারণ হবে।জীবনে টাকার প্রতি কোন মোহ ছিলনা।ভালবাসার মোহ ছিল।কিন্তু দেখুন আমার জীবন টা কেমন হল।যে যা চায় সে তা কখনোই পায়না এটাই চরম সত্য।”

নয়নে লাগিল নেশা পর্ব ৪৬

“আমি ভালবাসা বলতে বুঝি জীবনে এমন কেউ আসুক যে সৎ,বিশ্বাসী, সরল,প্রিয় বলতে আমাকেই বুঝবে।দেরি আসুক সমস্যা নেই তবে এমন কেউ ই আসুক।”
অন্তর এই চমৎকার কথা যেন প্রিয়তার মনে আরো এক ধাপ দোলা দিল।প্রিয়তার কষ্ট আরো খানিক টা কমে গেল।

নয়নে লাগিল নেশা পর্ব ৪৮