নীলপদ্ম গেঁথে রেখেছি তোর নামে পর্ব ৩২

নীলপদ্ম গেঁথে রেখেছি তোর নামে পর্ব ৩২
ইফা আমহৃদ

“তোমরা এই পূর্ণিমাতে নদীতে কী করছ? পূর্ণিমার আলোয় সবকিছু উজ্জ্বল দেখা গেলেও খরস্রোতা ঢেউ তোমাদের ভাসিয়ে নিয়ে যাবে। পানির ধারা বৃদ্ধি পাওয়ার আগে এখান থেকে চলে যাও তোমরা।” নৌকা নিয়ে অগ্রসর হওয়ার সময় এক মাঝি সাবধান করে দেয় অপূর্বদের। বৈঠা নিয়ে ঠেলে সামনে যাওয়ার প্রয়াস করতেই অপূর্ব একটা জ্বলন্ত আলোর পথের সন্ধান পেল। দাঁড়িয়ে অপূর্ব বলে, আমি অপূর্ব। আপনাদের চেয়ারম্যান সাহেবের ছেলে। আপনারা আমাকে একটু সাহায্য করুন।”

“আপনি চেয়ারম্যান ভাইয়ের ছেলে? আগে বলবেন তো বাবা। তা আমাদের কাছে আপনাদের কী সাহায্য লাগবে? আমরা সব করব।”
“আপনারা একটু নদীতে নেমে আরুকে এনে দিবেন। কিছুক্ষণ আগে ঐ পাড়ার ব/খা/টে ছেলে কালাচাঁন আমাদের বাড়ির মেয়ে নিয়ে জোর করে নদীতে ঝাঁপ দিয়েছে। আপনারা একটু দেখুন না?” অপূর্বর ভাঙা গলায় এক মাঝি ও দুই জেলে বিচলিত হয়ে উঠল। একজন জেলে অন্য জেলেকে উদ্দেশ্য করে বলে, “এখনো বসে আছিস কেন? চেয়ারম্যান বাড়ির মেয়ে। যেভাবে হোক আমাদের খুঁজে বের করতেই হবে।”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

জেলেদের কাছে এক ধরনের টর্চ লাইট থাকে। যা বিদেশ থেকে শুভাকাঙ্ক্ষিদের মাধ্যমে দেশে আনা হয়। যা দিয়ে নদীর অনেক গভীরে যাওয়া যায়। দুটো জেলে লাইট দুটো নিয়ে ঝাঁপ দিল জ্বলে। নিভু নিভু আলোয় তখন জ্বলছে হারিকেন। তুর ছুটে গিয়ে খবর পৌঁছে দিয়েছে ‘সাত ভাই চম্পা’ নিবাসে। সবাই ছুটে এসেছে নদীর পাড়ে। জেলেরা কিছুক্ষণ তল্লাশি করে ভেসে উঠে পানিতে, পায় না আরুর সন্ধান। হাঁপাতে হাঁপাতে বলে, “মনে হয় ভেসে গেছে স্রোতে। পানির নিচে কেউ নেই।”

পারুল হাউমাউ করে কেঁদে উঠল। নদীতে নামার জন্য ব্যস্ত হয়ে গেল। মোতাহার আহসান পারুলকে একহাতে আগলে নিয়ে জেলেকে বলে, “তোমাদের পরিচিত কেউ নেই? খবর দিয়ে সবাই একসাথে খুঁজতে থাকো।”
“চেয়ারম্যান সাহেব, এত সময় নেই। আমরা নিজেদের মতো চেষ্টা করছি।” বলেই অনেকটা এগিয়ে আবার ডুব দিল জেলে। এক মুহুর্তের আগেই ভেসে সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলে, “পেয়েছি। এইখানে আছে‌। তবে মেয়েটার গলায় একটা কলস বাঁধা। আবার একটা ছেলে হাত ধরে আছে শক্ত করে। কতটা পানি খেয়েছ, জানা নেই। আপনারা একটা কাঁচা ডালের ব্যবস্থা করে দিল। কলস ভেঙে উদ্ধার করে নিয়ে আসি।”

নৌকাতে জীবন বাঁচাতে বড় বড় দা রাখা হয়। দা বের করে এগিয়ে দিতেই অপূর্ব একটা ছোটো গাছের ডাল একবারে কেটে নিয়ে এলো। মাঝিসহ মোট তিনজনে পানির নিচে চলে গেল। আরু চেতনাহীন। ওর বুকের উপরে কলসখানা। আরুর একহাত কালাচাঁন শক্ত করে ধরে আছে। আরু অন্যহাত দিয়ে কালাচাঁনের হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করেছে, দেখে বোঝা যাচ্ছে। ডাল দিয়ে কলস চূর্ণ বিচূর্ণ করে তিনজনে দুজনকে আলাদা করে উপরে তুলে দিয়ে এলো।

আরুর শাড়িটা বোধহয় জলের বেগে এলোমেলো হয়ে গেছে। গলার সাথে এখনো বাধা কলসের অংশ ও দড়ি। আরুকে উপরে তুলতে বিলম্ব হলেও আরুর উপর ঝাপিয়ে পড়তে কারো বিলম্ব হলো না। আরুকে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে পারুল বলে, “আরু, কথা বল মা। আমি আর কখনো তোর সাথে খারাপ ব্যবহার করব না। তুই একবার চোখ মেলে তাকা।”

অপূর্ব তার ভেজা পোশাকটা জড়িয়ে দিল আরুর দেহে। আরুর কোনো শ্বাস পড়ছে না। অপূর্ব পেটের উপর প্রেষ করতে করতে বলে, “তোমরা দাঁড়িয়ে না থেকে আরুর হাত পায়ের তালু ম্যাসাজ করে দাও।”

অপূর্বর অদম্য কাজে আরুর মুখ থেকে গরগর করে পানি পড়তে থাকে। অন্যদিকে জেলেরা তখন কালাচাঁনকে বাঁচাতে ব্যস্ত। মুখের উপর মৃদু চপল দিতে থাকে, কিন্তু এতেও আরুর শ্বাস পড়ে না। অপূর্ব বুঝে গেছে, একটাই উপায় আছে। কেবল সেভাবেই জ্ঞান ফেরানো সম্ভব।

অপূর্ব শার্ট নিয়ে নিজেকে যথেষ্ট আড়াল করে নিয়ে ঝুঁকে গেল আরুর মুখের উপর। আশেপাশের সবাই তখন অন্যদিকে তাকাল। কিছুক্ষণ পর অপূর্ব সরে শার্টটা জড়িয়ে দিল আরুর গায়ে। তিন সেকেন্ড পর আরু ফোঁস করে দীর্ঘ শ্বাস গ্ৰহণ করে। মাটি থেকে পিঠটা একটু উপরে উঠে গেল। সবাই তখন আরুকে ঘিরে ধরল। অপূর্ব বারণ করে, “একটু ফাঁক করে দাঁড়াও। অক্সিজেন নিতে দাও।”

আরু শ্বাস নিলেও জ্ঞান ফিরল না। ওর শরীরে যে ধুম জ্বর ও মাথা ভার ছিল। এভাবে দীর্ঘক্ষন ফেলে রাখলে আরুর অবস্থা অস্বাভাবিক হয়ে উঠবে। অপূর্ব অতি যত্নে আরুর গলা থেকে ভাঙা কলসের অংশসহ দড়ি খুলে ফেলল। অতঃপর অপূর্ব আরুকে কোলে তুলে হাঁটার প্রয়াস করে, কিন্তু তার মচকে যাওয়া পা ও অসাড় শরীর নিয়ে হাঁটতে পারছে না। তখন ইমদাদ হোসেন ছুটে আসে। মেয়েকে কোলে নিয়ে নৌকার মাঝিকে উদ্দেশ্য করে বলে, “আমাদের একটু ওপার ছেড়ে দাও ভাই। এতটা পথ হেঁটে যাওয়া ঠিক হবে না।”

“তা কি বলতে হয়? কে কে যাবেন, আসুন।” মাঝি বলতেই পারুল এগিয়ে যায়। মোতাহার আহসান দুইহাত পেছনে রেখে বলে, “কোথায় নিয়ে যাচ্ছিস ওকে? আরু আমার বাড়ি থেকে হারিয়ে গেছে। আমি ওকে ফিরিয়ে দিতে পারলেও, ও একটুও সুস্থ নয়।‌ ওকে সুস্থ করে তবেই তোরা বাড়িতে যাবি। তাছাড়া কাল সবাই দেখবে চেয়ারম্যান মোতাহার আহসানের ভাগ্নেকে মা/রার জন্য একে কেমন শা/স্তি দেই? দেখবে‌ নি/ষ্ঠু/র আমিকে। বাড়ির দিকে চল।”

মোতাহার আহসান মুখের উপর কেউ কোনো বাক্য করতে পারে না। এগিয়ে যায় বাড়ির দিকে। অপূর্ব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে যায় পেছনে পেছনে। মোতাহার আহসান নৌকার তিনজনকে উদ্দেশ্য করে বলে, “আপনাদের কাছে আমার কৃতজ্ঞতার অন্ত নেই। যেভাবে আমার ভাগ্নিকে আমাদের হাতে তুলে দিলেন। বলুন, আপনাদের কী চাই? আমার বোনের কলিজাকে ওর হাতে তুলে দেওয়ার জন্য, প্রয়োজনে আমি আমার কলিজা আপনাদের হাতে তুলে দিবো।”
“আমার মতো দরদি চেয়ারম্যান এই সুন্দরনগরে পেয়ে আমরা ধন্য। আপনার কলিজা আমাদের চাই না। আপনি এভাবেই আমাদের পাশে থাকুন। বিদায় দিন, আজ আমরা আসি।”

“আসুন। (প্রহরীদের উদ্দেশ্য করে) এখনো এখানে দাঁড়িয়ে কী দেখছেন আপনারা? ঐ শু/য়ো/রটাকে নিয়ে গোয়াল ঘরে ফেলে রাখুন। আগামীকাল সকালে পুরো গ্ৰামকে আমার বাড়িতে হাজির থাকতে বলবেন। কালকে ওর শা/স্তি হবে।” বলেই মোতাহার আহসান বাড়ির দিকে গেল। পেছনে পেছনে গেল তার তিন ভাই ও বাবা।

আরুর চেতনা ফিরেনি। আরুর অসুস্থ শরীর নিয়ে কয়েক মুহূর্ত পানির ভেতরে ছিল বলে হাত পা সাদা হয়ে গেছে। দড়ি থাকার কারণে গলায় একটা কালচে দাগ দেখা যাচ্ছে। অপূর্ব ডাক্তারি সরজ্ঞাম নিয়ে আরুর চিকিৎসা করল প্রাথমিকভাবে। ইনজেকশন পুশ করে হাতটা ধরে কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ ফেলল। অনুভব করে পালস রেট। এই হাতটা দিয়ে রক্ত চলাচল করছে। অপূর্বর এক মুহুর্তের জন্য মনে হয়েছিল, এই হাতটা জীবিত অবস্থায় সে দেখতে পারবে না। আরুর জীবিত থাকলেও ততক্ষণ অপূর্বর স্বপ্ন মনে হবে, যতক্ষণ আরু ডাকবে না অপূর্ব ভাই বলে।

অপূর্বর বড্ড ইচ্ছে করল, আরুকে বুকে নিয়ে তার হৃৎপিণ্ডের রক্ত চলাচলের শব্দ শুনতে। কিন্তু আশেপাশের মানুষগুলোর কারণে সেটা অসম্ভব। বিয়ের আগেই আরুকে অক্সিজেন দেওয়ার ব্যাপারটা তাকে বেশ ভাবাচ্ছে। আজ রাতে আরুর পাশে তার বাবা মা থাকবে। নিজের কাঙ্ক্ষিত স্পৃহাকে বুকে চাপা দিয়ে উঠে দাঁড়ায় অপূর্ব। আরুর ফ্যাকাসে মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে বলে, “রাতে আরুর জ্ঞান ফিরতে পারে।

দুধ ছাড়া গরম কিছু খাওয়ালে ভালো হতো। এমনিতেই গায়ে ধুম জ্বর। দুধ খাওয়ালে টাইফয়েড হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। আর রাতে যতই জ্বর বাড়ুক আমাকে বলবেন। অনেকক্ষণ পানির ভেতরে ছিল। তাই পানি দিলে ঠান্ডায় জ্বর বেড়ে যেতেই পারে। উঠি!”

নীলপদ্ম গেঁথে রেখেছি তোর নামে পর্ব ৩১

আচ্ছা ঘরের ভেতরে কি, কোনো অদৃশ্য গাছের শিকড় প্রবেশ করেছে? তাহলে অপূর্বর পা কেন আটকে যাচ্ছে। কেন আরুর বিপরীত দিকে পা চলছে না?

নীলপদ্ম গেঁথে রেখেছি তোর নামে পর্ব ৩৩