নীলপদ্ম গেঁথে রেখেছি তোর নামে পর্ব ৩৩

নীলপদ্ম গেঁথে রেখেছি তোর নামে পর্ব ৩৩
ইফা আমহৃদ

রাতে হঠাৎ করেই তাপমাত্রা নেমে গেল। আর্দ্র হয়ে গেল গ্রামের পরিবেশ। কুয়াশায় দূরের কিছু সুব্যক্ত নেই। মশারা বৈরী আবহাওয়ায় আশ্রয় গ্রহণ করল গোয়াল ঘরে। মশার তাণ্ডবে গরুরা মাঝরাতে হাম্বা হাম্বা ডেকে উঠে। সেই গোয়ালে ফেলে রাখা হয়েছে কালাচাঁনকে। পাঁচ গরুর ছোটাছুটিতে একের পর এক পাদাঘাত পড়ল কালাচাঁনের দেহে। বেদনাক্রান্ত দেহ নিয়ে পল্লব উন্মুক্ত করতেই কালাচাঁন উঠে বসে।

মৃত্যু থেকে করব পর্যন্ত দেহ থাকে ব্যথাহীন। কিন্তু কালাচাঁন তেমন কিছু অনুভব না করে হাত দিয়ে স্পর্শ করে দেহ। গোয়ালঘরের দরজা দিয়ে ফকফকা পূর্ণিমার আলো দেখে তার উপলব্ধি হলো কিছুটা। সে যে চেয়ারম্যান বাড়িতে তালাবদ্ধ আছে। দরজা ধরে ধাক্কা দিয়ে চ্যাঁচিয়ে বলে, “কে কোথা আছো? দরজা খুলে দাও। শুনতে পারছ, দরজা খোলো। গোলাপী, কোথায় তুমি?”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

আহসান বাড়ির সদস্যরা নির্ঘুম রাত্রিযাপন করছে। কালাচাঁনের শব্দটা কানে পৌঁছালেও প্রতিক্রিয়া দেখায় না। সেই তীক্ষ্ণ কণ্ঠটা আরুর কানে লাগে। ইমদাদ হোসেন মৃধার ঘুমে চোখ লেগে আসলেও মেয়ের দিকে চেয়ে আছে পারুল। আচমকা আরু তন্দ্রার মাঝে কেঁপে ওঠে। শুণ্য গলা থেকে অযথা কলসের দড়ি খোলার চেষ্টা করতে করতে ব্যক্ত করে বাক্য, “আমি ম/র/ব না। আমি বাঁচতে চাই কালাচাঁন। পৃথিবীতে সাতজন মানুষ দেখতে একরকমের। তোমার ভালোবাসার জোরে তাদের একজনকে তুমি খুঁজে নাও। তোমার ভালোবাসার তুলনা হয় না। কিন্তু তোমার ভালোবাসার ছলে আমার এই জীবনটা কেড়ে নিও না। আমাকে বাঁচতে দাও।”

পারুল গভীর আলিঙ্গনে জড়িয়ে রাখলেন আরুকে। আরুর বন্ধ চোখ থেকে পানি ঝরছে। তাপমাত্রা বোধহয় ১০৪° এ পৌঁছেছে।‌ মেয়ের গোঙানির শব্দ শুনে ইমদাদ হোসেন উঠে আলো জ্বালিয়ে দিলেন। আরুর মাথায় হাত বুলিয়ে বলতে থাকে, “আরু মা, চোখ মেলে তাকা। তোকে কেউ মারবে না।”

আরু ধীরে ধীরে চোখ মেলে তাকাল বাবা মায়ের দিকে। তবে মনের ভেতরে দানা বাঁধা ভয় থেকে মুক্তি মিলে না। উদ্বিগ্ন হয়ে বলে, “ঐ দেখো কালাচাঁন। আমাকে নিয়ে ঝাঁপ দিল জলে। আমাকে বাঁচাও।”
আরুর এই কণ্ঠ যথেষ্ট ছিল সবাইকে ঘর থেকে নিয়ে আসতে। অপূর্ব ছুটে এসেছে সবার প্রথমে। আরুকে উত্তেজিত হতে দেখে ছুড়ে দেয় প্রশ্ন, ” ফুফু-ফুফা, আরুর কী হয়েছ? এমন করছে কেন?”
“জানি না, হঠাৎ করে কেমন ভয় পেয়ে চলেছে।”

“এখনো ও সেই মুহুর্তটা থেকে বের হয়ে আসতে পারছে না। তাই এমন করছে।” বলেই অপূর্ব আরুর মাথায় হাত রাখে। আরু উন্মাদের মতো ইমদাদ হোসেনকে আঁকড়ে ধরে রেখেছে। অনিতা অপূর্বর শুষ্ক মুখমণ্ডলের পানে চেয়ে অনুভব করল, ছেলের কষ্ট। দ্বিধা নিয়ে পারুলকে উদ্দেশ্য করে বলে, “অপূর্ব ডাক্তার মানুষ, ও আরুকে পারবে ঐ অবস্থা থেকে বের করে আনতে।”

অপূর্ব মুগ্ধ হয়ে মায়ের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করতেই তিনি আশ্বস্ত করলেন অপূর্বকে। অপূর্ব বিছানায় বসে আরুর মাথায় হাত রাখতেই পদ্মবতী খুঁজে নিল তার জলকে। দুহাত অপূর্বর চিবুকে‌ রেখে বলে, “অপূর্ব ভাই, আপনি এসেছেন? কালাচাঁন আমাকে নিয়ে নদীতে ঝাঁপ দিয়ে তার ভালোবাসাকে ইতিহাস করে রাখতে চেয়েছে। কিন্তু আমি তো ওকে ভালোবাসি না। আপনি আমাকে বাঁচান।”

“পারুল, আরু দুদিন কিছু খেয়েছে কিনা জানি না। এসো, ওরজন্য হালকা কিছু তৈরি করে নিয়ে আসি।” পারুলকে উদ্দেশ্য করে কথাটা বলে অনিতা রান্নাঘরে গেল। পারুলসহ বাকি তিন বউও গেল রান্নাঘরে। ইমদাদ হোসেন লজ্জায় উঠে গেলেন মোতাহার হোসেনের সাথে কথা বলতে‌। শেফালী কড়া ডোজের ওষুধ খেয়ে ঘুমিয়েছে। তিস্তা সুজনের দিকে তাকিয়ে চোখ রাঙিয়ে বলে, “সবাই ওদের স্পেস দিতে চলে গেছে, তুমি হা করে তাকিয়ে কী দেখছ? বউকে আদর করে দু খানা কথা বিয়ের পর তোমার মুখ থেকে আমি শুনিছি। বিয়ের আগে ভালোবাসা উতলে পড়ছিল। বড় ভাইকে দেখে শেখো। (বিরতি দিয়ে) দাঁড়িয়ে আছো কেন? ঘরে চলো।”

“তুমিই তো বললে, দেখতে।”
“তুর তুই ঘরে যায়। তোর ভাইয়ের নাকে দড়ি বেঁধে আমিও ঘরে যাচ্ছি।” তিস্তা থামার পূর্বেই সুজন ছুটে গেল ঘরে। তুরও ফিরল শেফালীর কাছে। দরজাটা ভিড়িয়ে নবদম্পতি তাদের নতুন ঘরে ফিরে গেল। দৃষ্টির অগোচরে চেনা মানুষগুলো চলে যেতেই অপূর্ব আরুকে টেনে নিল হৃদমাঝারে। আরু বিড়ালছানার মতো লেপ্টে করে গেল কালাচাঁনের নামে তার অভিযোগ।

অপূর্ব আদুরে গলায় আরুকে বলে, “পদ্মবতী, তুমি অপূর্বর হৃদমাঝারে আছো! এই দেহে যতক্ষণ প্রাণ নামক অদৃশ্য বস্তুটা অর্পিত থাকবে, ততক্ষণে তুমি এরচেয়ে বেশি নিরাপদ কোথাও থাকবে না। আমার চোখে নিজের চোখ রেখে একবার দেখো, এই চোখের গভীরতা। তুমি নদীর জলে নয়, তোমাকে হারানোর ভরে জমিয়ে রাখা চোখের জলে তুমি ডুবে যাবে। এই ডোবা মানে, আমার প্রেমে নিজেকে হারিয়ে ভুলে যাবে সব উন্মাদনা। তাকাবে কি আরুপাখি?”

আরু তাকালো সেই চোখে। হারালো সেই মায়াডোরে। ভয়ের মাত্রা হুরহুর করে নামল শুণ্যে। চোখ বন্ধ করলেই গড়াল জমিয়ে রাখা পদ্মবতীর অশ্রু। অপূর্ব অতি আদরে নিজের ললাট ঠেকিয়ে দিল আরুর ললাটে। জমিয়ে রাখা দুঃখের সময়টাকে গাঢ় নিঃশ্বাসের সাথে ফেলে দিল। অপূর্ব খুব শীঘ্রই আরুকে ঘরণী করে তুলবে! খুব শ্রীঘ্রই!
আরুর খবর পৌঁছে গেছে ময়নার কাছে। ছানাদের ঘুম পাড়িয়ে রেখে উড়ে এসে থেমেছে আরুর ঘরের জানালায়। পুনরাবৃত্তি করল একটি বর্ণ, “আরুপাখি! আরুপাখি! আরুপাখি!”

আহসান বাড়িতে মানুষ ধরে না, তবুও এসেছে বিচার দেখতে। সচরাচর বাড়িতে বিচার কাজ সম্পন্ন না করলেও এই প্রথম সেই কাজটি করতে রাজি মোতাহার আহসান। আরুকে একটা চাদর প্যাঁচিয়ে নিয়ে এসেছে বিচারে। এলোমেলো চুলগুলো হাত‌খোঁপা করে আঁচল তুলে দিয়েছে মাথায়‌। ফ্যাকাসে মুখ জানান দিচ্ছে জ্বরের তীব্রতা। মোতাহার আহসান আরুর অবস্থা দেখে বলেন, “বোন, একটা চেয়ার এনে বসা মেয়েকে।”

“না ভাইজান, বিচারের সময় সবাই দাঁড়িয়ে থাকে। আমি চাইনা আরুর তা অমান্য করুক।” আরুকে ধরে বলে পারুল। তবুও অনিতা ছোটো একটু টুল এনে দেয় বসতে। মোতাহার আহসানের আদেশে এবার তা খেয়ানত করার স্পর্ধা খুঁজে পায় না পারুল। বিচারকার্য পরিচালনার সিংহাসনে বলে বলেন, “ঐ শু/য়ো/রের বাচ্চাটাকে এখানে নিয়ে আসুন। ওর মাকে এনেছেন?”

“জি, চাচা।” প্রহরীরা বলেই চলে গেল গোয়ালঘরের উদ্দেশ্য। গোয়ালঘর থেকে বিষ্ঠাতে‌ লেপা কালাচাঁনকে নিয়ে হাজির হয় বিচারসভায়। নিমগাছের সাথে বেঁধে ফেলে তারপরে। কালাচাঁনকে দেখে ভয়ে জড়সড়ো হয়ে যায় আরু। মোতাহার আহসান উপস্থিত গ্ৰামের সামনে নিজের মতামতের রাখে, “আমার ভাগ্নির বিচার এখানে হচ্ছে না, এখানে বিচার হচ্ছে একটি মেয়ের। যাকে এই কালাচাঁন অ/পহ/র/ণ করে নিয়ে গেছে। তারপরের দিন গলায় দড়ি বেঁ/ধে মেয়েটিকে নিয়ে নদীতে ঝাঁপ দেয়। তাই আমি গতকাল রাতে ভেবে সিদ্ধান্ত নিয়েছি, এই কালাচাঁনকে একশো একটা বে/তের বাড়ি দিয়ে জুতার মালা গলায় পরিয়ে আপনারা গ্ৰাম থেকে বের করে‌ দিবেন। এই সুন্দরনগর গ্ৰামে এই ছেলের ছায়াও যাতে না পড়ে।”

তখনই সেখানে হাজির হয় সুন্দরী। একমাত্র ছেলে তার। ছেলের হয়ে হাতজোড় করে ক্ষমা চেয়ে মিনতি করে, “আমার ছেলে ভুল করেছে সাহেব। ও অনেক বড় অন্যায় করেছে। ওকে এই শাস্তি দিবেন না। ক্ষমা করে দিন।(বিরতি টেনে) আমি আরুকে আমার বাড়ির বউ করে নিয়ে যাবো প্রয়োজনে।”

নীলপদ্ম গেঁথে রেখেছি তোর নামে পর্ব ৩২

অনিতা এবার স্বামীর পক্ষ নিয়ে সুন্দরীকে বলে, “ছেলেকে আপনি মানুষ করতে পারেননি। একজনকে ভালো লাগতেই পারে। ঘটকের মাধ্যমে বিয়ে প্রস্তাব পাঠাবেন, পছন্দ হলে বিয়ে নয়তো সেখানেই শেষ। রাজি নয় বলে জোর করে নদীতে ঝাঁপ দেওয়া কেমন রীতি? একটু হলে..
বলতে গিয়ে কেঁপে উঠলেন অনিতা। কেঁপে উঠে উপস্থিত সবাই।

নীলপদ্ম গেঁথে রেখেছি তোর নামে পর্ব ৩৪