অনেক সাধনার পরে পর্ব ৪১

অনেক সাধনার পরে পর্ব ৪১
অরনিশা সাথী

ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে ঘন ঘন শ্বাস নিচ্ছে রুজবা। এই মূহুর্তে ওর দম বন্ধ হয়ে যাওয়ার মতো লাগছে। ইশ্! এভাবে কেউ পেছনে লাগে? লজ্জা লাগে তো ওর। নুহাশের কথা’ও বলিহারি, ওর কি দরকার ছিলো সবার সামনে ওর দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে ওই গানটা করার? একা একাই লজ্জা পেয়ে আবার দুহাতে মুখ ঢেকে নেয় ও। সেসময়ে কাঁধে সেই চিরচেনা স্পর্শ পায়৷ অমনি বুকটা আবার পুরো দমে দ্রিমদ্রিম শব্দে লাফিয়ে উঠছে। রুজবা নিজেকে সামলে নিয়ে নুহাশের দিকে ঘুরে দাঁড়ায়। ওর ঠোঁটজোড়া থরথর করে কাঁপছে। কি করবে কি বলবে ভেবে না পেয়ে যা মনে আসলো তাই বলে দিলো চট করে।

–“খাবেন কিছু? এনে দেই?”
কথাটা বলে রুজবা দরজার দিকে যেতে গেলেই নুহাশ ওর হাত ধরে আটকে দেয়। রুজবা চোখ বন্ধ করে ফেলে তৎক্ষনাৎ। নুহাশ একটানে রুজবাকে নিজের কাছে নিয়ে আসে। দুহাতে রুজবার দুই গাল আঁকড়ে ধরতেই রুজবা চট করে চোখ মেলে তাকায়। রুজবা পরপর চোখের পলক ফেলে। থরথর করে কাঁপে রুজবার অধর যুগল। নুহাশ কম্পনরত সেই ঠোঁটের দিকে তাকিয়ে শুকনো ঢোক গিলে। পরপর নেশা জড়ানো কন্ঠে বলে,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

–“হ্যাঁ, তোমাকে।”
আর কিছু বলে উঠার সুযোগ পায় না রুজবা। তার আগেই নুহাশের ঠোঁটের গভীর স্পর্শ পায় নিজের ঠোঁটে। একহাতে নুহাশের গলার কাছে টি-শার্ট আর অন্যহাতে পেছন দিকে দিয়ে নুহাশের ঘাড়ের উপরের চুল খামচে ধরে অনুভব করতে থাকে নুহাশের স্পর্শ।
দরজায় টোকা পড়তেই রুজবা ধাক্কা দিয়ে নুহাশকে নিজের থেকে সরিয়ে দেয়। বুকে হাত দিয়ে ঘন ঘন শ্বাস নেয় কিছু সময়। নুহাশ বা হাতের উলটো পিঠ দিয়ে ঠোঁট মুছে বলে,

–“কি হলো?”
রুজবা চোখ রাঙিয়ে তাকায় ক্ষানিক সময়। এই ছেলে কি শুনতে পাচ্ছে না কেউ অনবরত দরজায় টোকা মারছে? কান কি তবে একদম গেলো? রুজবা একবার আয়নায় নিজেকে দেখলো। নাহ সব ঠিকঠাক আছে। রুজবা দাঁড়িয়ে না থেকে দ্রুত গিয়ে দরজা খুলে দেয়। নির্ঝর হেসে বলে,

–“ঘুমায় গেছিলা তোমরা? আম্মু খেতে ডাকছে।”
নুহাশ এসে নির্ঝর’কে কোলে তুলে নিয়ে বলে,
–“না বাবা ঘুমাই নি, তবে ঘুমাবো। চলো আগে খেয়ে আসি।”
নুহাশ নির্ঝরকে নিয়ে চলে যেতে নিয়েও আবার রুজবার দিকে তাকিয়ে বাঁকা হেসে রুজবার কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলে,

–“পেট ভরেনি নিশ্চয়ই? আমার তো ওইটুকুতে হয়নি, আপাতত ডিনার সেরে আসি তারপর আবার আধখাওয়া তোমাকে পুরোপুরি খাবো।”
রুজবা অবাক হয় এই ছেলের কথা শুনে। চোখ কোটর থেকে বেরিয়ে আসার উপক্রম। নুহাশের দিকে চোখ রাঙিয়ে তাকাতেই ও সোজা হয়ে দাঁড়ায়৷ তারপর স্বাভাবিক গলায় বলে,

–“ওরকম ভাবে তাকিয়ে না থেকে খেতে আসো দ্রুত।”
চলে যায় নুহাশ। রুজবা তখনো ড্যাবড্যাবে চোখে নুহাশের চলে যাওয়া দেখলো। ওর কানের কাছে এখনো নুহাশের বলা কথাটাই ঘুরপাক খাচ্ছে৷ ছিহঃ! এই লোক এতটা অসভ্য, নির্লজ্জ, লাগামহীন?

ফজরের আজান কানে আসতেই ঘুম ভেঙে যায় রুজবার। চোখ পিটপিট করে তাকায়। নিজেকে নুহাশের উম্মুক্ত বুকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে থাকতে দেখে মুচকি হাসে। লোকটা রাতে ওকে নিয়ে যেভাবে শুয়েছিলো এখনও ঠিক সেভাবেই আছে৷ আলগোছে রুজবা নুহাশের থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে উঠে দাঁড়ালো। কাবার্ড থেক কালো রঙের একসেট কামিজ নিয়ে ওয়াশরুমে চলে যায় শাওয়ার নিতে। শাওয়ার শেষে একেবারে ওজু করে বের হয় ও। নুহাশ তখন কোলবালিশ জড়িয়ে ঘুমাচ্ছিলো। রুজবা নুহাশের বাহুতে হাত রেখে ডাকে। দু’বার ডাকতেই নুহাশ নড়েচড়ে ঘুম জড়ানো কন্ঠে বলে,

–“উমমম বলো, ডাকছো কেন এত সকালে?”
–“ফজরের আজান দিয়েছে, উঠে ফ্রেশ হন নামাজ পড়বো।”
নামাজের কথা শুনে সঙ্গে সঙ্গেই চোখ মেলে তাকায় নুহাশ। ফোনের পাওয়ার বাটন চেপে সময় দেখে বলে,
–“ফ্রেশ হয়ে যেতে মসজিদের জামাত ছুটে যাবে।”

–“কাল থেকে এলার্ম দিয়ে রাখবেন। এখন শাওয়ার নিয়ে ওজু করে আসেন, একসাথে নামাজ আদায় করবো।”
নুহাশ মুচকি হেসে উঠে যায় চট করে। রুজবার কপালে আলতো করে চুমু খেয়ে টাওয়াল গলায় ঝুলিয়ে চলে যায় শাওয়ার নিতে। রুজবা আগে থেকেই নুহাশের জামা-কাপড় রেখে দিয়েছিলো ওয়াশরুমে। অতঃপর দুজনে একসাথে ফজরের নামাজ আদায় করে। নুহাশ সকাল সকাল হাঁটতে বের হয় নামাজ শেষে আর রুজবা কিচেনে যায় সকালের নাস্তা বানাতে সাহায্য করার জন্য।

চুপচাপ নিজের ঘরে বসে আছে ফারিন। এ বাড়িতে ও রানীর মতো থাকছে। কেউ কিচ্ছু করতে দেয় না। যে জান্নাতের সাথে ওর তেমন ভালো/ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিলো না কোনোকালে সে জান্নাত’ও ফারিনকে কোনো কাজে হাত লাগাতে দেয় না। নিজের বাবার বাড়ি হলে ফারিন এতক্ষণে মায়ের হাতে হাতে প্রায় সব কাজ করে দিতো। মাঝে মাঝে তো তিন বেলার রান্নার কাজটা ফারিনই করতো। ওর রান্নার হাত বেশ ভালো। ফারিনের বড্ড মন কেমন করছে বাবা মা আর বোনের জন্য। আচ্ছা, ও যেমন ওদের মিস করছে ওরা’ও কি মিস করছে ফারিনকে? ভাবে ফারিন। কিয়ান বাইরে থেকে এসে ফারিনকে মন খারাপ করে বসে থাকতে দেখে ওর কাছে যায়৷ ফারিনের পাশে বসে ওর হাতদুটো নিজের হাতে নিতেই ফারিনের হুশ ফিরে। হাসার চেষ্টা করে বলে,

–“কখন এসেছো তুমি?”
–“এইতো কিছুক্ষণ।”
–“নাস্তা করবে না? চলো___”
বলে ফারিন উঠতে গেলেই কিয়ান ওকে টেনে নিজের কাছ ঘেঁষে বসায়৷ ফারিনকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে বলে,
–“মন খারাপ তোমার?”
ফারিন ছোট্ট করে হাসে। বলে,

–“না তো__”
–“আমাকে মিথ্যে বলছো?”
ফারিন চুপ হয়ে যায়। কি বলবে? কিয়ানের থেকে কিছু লুকাতে পারে না যে ও। মূহুর্তেই যে কিয়ান ফারিনের মনের কথা ধরে ফেলে৷ কিয়ান ফারিনের দুই গালে হাত রেখে বলে,
–“বাড়ির জন্য মন কেমন করছে?”

কিয়ান প্রশ্নটা করতেই ফারিন হুঁ হুঁ করে কেঁদে উঠে। কিয়ান খুব যত্নে আগলে নেয় ফারিনকে নিজের বুকে৷ ফারিন হেঁচকি তুলে কাঁদছে। কিয়ান ফারিনের মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,
–“কেঁদো না৷ খুব শীঘ্রই উনারা মেনে নিবে দেখো। তোমাকে নিয়ে একদিন ও বাড়ি যাবো, তারপর আমিও দেখি আমাদের দেখেও উনারা কিভাবে মুখ ফিরিয়ে থাকে।”

ফারিন এবার শব্দ করে কেঁদে দেয়৷ কাঁদতে কাঁদতে বলে,
–“আমি তো বাবাকে কষ্ট দিতে চাইনি কিয়ান। আমি চেয়েছিলাম বাবাকে মানিয়ে তোমার হতে। কিন্তু অনেক চেষ্টার পরেও তো মানাতে পারলাম না। আমার, আমার আর কিছু করার ছিলো না কিয়ান। আমি বাবাকে অনেক কষ্ট দিয়ে ফেললাম। কিভাবে দাঁড়াবো আমি বাবার সামনে?”
কিয়ান ফারিনকে শান্ত করার চেষ্টা করে বললো,

–“আংকেল যখন দেখবে তুমি আমার কাছে ভালো আছো। সুখে আছি আমরা, তখন উনি আর রাগ করতে পারবে না। তোমাকে সুখে দেখলে উনার আর কষ্ট’ও থাকবে না।”
বহু কষ্টে এটা সেটা বলে কিয়ান ফারিনকে শান্ত করে৷ যেভাবে কাঁদতে শুরু করেছিলো আর একটু হলে বাসার সবাই ছুটে এসে ওকে অপরাধী বানিয়ে দিতো। বলতো ও মেয়েটাকে ইচ্ছে করে কাঁদিয়েছে।

একসাথে নাস্তা করতে বসেছে সকলে। নোমান সাহেব খাবার টেবিলে বসে তেমন একটা কথা বলা পছন্দ করে না৷ তবে কথাটা যদি খুব জরুরী হয় তাতে কোনো আপত্তি নেই। নোমান সাহেব খাওয়ার মাঝে বললো,
–“নুহাশ?”
–“জ্বি বাবা।”
–“তোমার শ্বশুর ফোন করেছিলো। রুজবা মায়ের নানু এসেছে। তোমাদের বিয়ের সময় উনি অসুস্থ ছিলেন বলে আসতে পারেনি। রুজবা আর তোমাকে যাওয়ার কথা বলেছে। উনি নাতজামাই’কে দেখতে চেয়েছে। গিয়ে দেখা করে আসো।”
নুহাশ খেতে খেতেই বললো,

–“রুজবা’কে আবার সাথে করে নিয়ে আসবো না?”
রুজবা আর নোমান সাহেব দুজনেই একসাথে কেঁশে উঠে। নিবির আর আদিরা ঠোঁট চেপে হাসে। নোমান সাহেব স্পষ্ট বুঝে গেলেন উনার এই ছেলে একটু না, অনেক বেশিই বউ পাগলা। যতটা উনি ভেবেছিলেন তার থেকেও বেশি। ওদিকে লজ্জায় রুজবার টেবিলের নিচে ঢুকে বসে থাকতে ইচ্ছে করছে। এই লোকটার জন্য সবার সামনে ওর লজ্জায় মাথা কাটা যাচ্ছে। ওদিকে উনাকে দেখো দিব্যি খেয়ে যাচ্ছেন উনি৷ যেন সে কিছুই বলেনি। নোমান সাহেব দাঁতে দাঁত চেপে বলে,

–“বউকে একদিন রাখার কথা বলে দুদিন রেখেছো। এরপর আবার আজ নিয়ে গিয়ে আবার সাথে করে নিয়ে আসলে কথার খেলাপ হবে না?”
নুহাশ ভ্রু কুঁচকে বলে,
–“আমার বউ আমার কাছে নিয়ে আসবো এতে কথা ভাঙার কি হলো বাবা?”
–“বেয়াই বিয়ের আগেই জানিয়ে দিয়েছিলো এখন বিয়ে পড়িয়ে রাখবে কিন্তু উনি মেয়ে তুলে দিবে দুই বছর বাদে।”

–“তখন শ্বশুর মশাইয়ের কথায় রাজি না হলে উনি মেয়ে বিয়ে দিতেন না তাই রাজি হয়েছি। এখন যেহেতু বিয়ে হয়েই গেছে এখন ওকে নিজের কাছেই রাখবো।”
–“সে বলেছিলো প্রয়োজনে তুমি যাবে আসবে। এতে কোনো সমস্যা নেই।”
নুহাশ নির্বিকার কন্ঠে বলে,

–“আমার প্রয়োজন তো সবসময়, তাই বলে এখন প্রতিদিন তো আর শ্বশুর বাড়ি গিয়ে বসে থাকতে পারবো না বাবা। প্রতিদিন গেলে আমার সম্মানে বাঁধবে না বলো?”
–“শ্বশুড়কে মানিয়ে বউ আনতে পারলে নিয়ে আসো আমাদের কারো আপত্তি নেই। কিন্তু খবরদার বলছি এর মাঝে আমাকে টানবা না। তোমার হয়ে এ বিষয়ে আমি উকালতি করতে যেতে পারবো না।”
–“ঠিক আছে। মা, ভাবী তোমরা দুজনেই ব্যাগ গুছাও।”
নিবির ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন ছুঁড়ে,

–“ওরা ব্যাগ গুছাবে কেন?”
–“দুজনকেই দুজনের বাবার বাড়ি দিয়ে আসবো। আমার বউ থাকবে না, তাহলে তোমাদের বউ সহ্য করবো ক্যান আমি? যেদিন আমার বউ আসবে সেদিন তোমাদের বউ’ও আসবে। প্রয়োজন হলে তোমরা’ও আমার মতো শ্বশুর বাড়ি যাবে আসবে। এখন থেকে আমরা বাপ বেটা তিনজনে ব্যাচেলর ভাবে থাকবো এ বাসায়।”

নুহাশের কথা শুনে রুজবা বড়বড় চোখ করে তাকায়। বড় ভাই ভাবী’র কথা না হয় বাদ দিলাম, কিন্তু নিজের বাবা মায়ের সাথেও এ বিষয়ে ফাজলামো করতে বাদ রাখছে না অসভ্যটা। শাহানা বেগম মুখ টিপে হাসে ছেলের কথায়। ওদিকে আদিরা তো ফিক করে হেসে দেয়। নিবির রাগান্বিত চোখে তাকায়৷ আর নোমান সাহেব চিবিয়ে চিবিয়ে বলে,
–“হতচ্ছাড়া’টার কথা শুনেছো? আমার সাথে মশকরা করছে ও? লজ্জা শরম কিচ্ছু নেই। আর আমরা বাবা মায়ের সামনে লজ্জায় বউয়ের সাথে তেমন ভাবে কথাও বলতাম না। যা বলার চার দেয়ালের ভেতরে। আর এই হতচ্ছাড়া বাবা মা’কে দুই, দুই বার নিজের বিয়ের কথা বলে। আজ আবার বউ কাছে রাখার আবদার জানাচ্ছে।”

–“যুগ আর জেনারেশন দুটোই পাল্টেছে বাবা। রুজবা রেডি হও গিয়ে।”
কথাটা বলে নুহাশ উঠে যায়৷ যাওয়ার আগে আরো একবার মা আর ভাবীকে উদ্দেশ্য করে বলে,
–“তোমরা দুজনে ব্যাগ গুছিয়ে রেখো। আপাতত আমার বউ রেখে আসছি। বিকেলে ভাই আর বাবার বউ রেখে আসবো।”
শাহানা বেগম হাত উচিয়ে বলে,

অনেক সাধনার পরে পর্ব ৪০

–“মার খাবি কিন্তু বেয়াদব।”
নুহাশ নিবির আর নোমান সাহেবের মুখের দিকে তাকিয়ে বলে,
–“রেডি হও, বউ থাকতেও আমার মতো সিঙ্গেল হয়ে থাকার জন্য।”
কথাটা বলে মানে মানে কেটে পড়ে নুহাশ। নোমান সাহেব ফোঁস করে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে শাহানা বেগমকে বলে,
–“শুনলে তোমার ছেলের কথা? কি বলে গেলো হতচ্ছাড়া’টা।”

অনেক সাধনার পরে পর্ব ৪২