অনেক সাধনার পরে পর্ব ৪০

অনেক সাধনার পরে পর্ব ৪০
অরনিশা সাথী

মাগরিবের নামায শেষ করে আদিরা কিচেনে যায় স্ন্যাকস তৈরি করতে। সাথে রুজবা’ও আছে। দুজনে মিলে ফ্রোজেন সমুচা, চিকেন রোল ভেজে নেয় একে একে। সাথে বেগুনি আর কাবাব’ও বানায়। বড় ফ্ল্যাক্সে দুধ চা ঢেলে নেয়। আদিরা বড় একটা ট্রেতে সব ধরনের ভাজাভুজি তুলে নেয়৷ সাথে একটা প্লেটে তিনজনের পরিমান সব স্ন্যাকস নিয়ে দুই কাপ দুধ চা ঢালে কাপে। ট্রে-তে স্ন্যাকস এর প্লেট এবং চা’য়ের কাপ তুলে রুজবাকে বলে,

–“এগুলো বাবা-মায়ের ঘরে দিয়ে এসো। মা’কে বলবে নির্ঝর’কে সাথে রাখতে।”
রুজবা পেছন থেকে আদিরা’কে জড়িয়ে ধরে বলে,
–“ও ভাবী, আমরা তো প্রায় বছর ছ’য়েক ধরে পরিচিত। আমি আপনার ছোট বোনের মতো না? আমাকে তুমি না বলে তুই করে বলুন না, শুনতে ভালো লাগবে আমার।”
আদিরা মুচকি হেসে রুজবার গালে হাত রেখে বলে,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

–“আচ্ছা বলবো। তবে সেম কথা গুলো আমি’ও বললাম। আমাকে আপনি না বলে তুমি করে’ও তো বলতে পারিস।”
–“আচ্ছা আচ্ছা, আমিও তুমি করেই বলছি। এবার দাও তো ট্রে-টা আমি দিয়ে আসি। ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে না?”
–“হ্যাঁ নে, পারবি তো?”
–“আমি বাচ্চা না ভাবী।”
আদিরা মুচকি হাসলো। রুজবা ট্রে নিয়ে বেরিয়ে যায় সাথে সাথে। শ্বশুর শাশুড়ী’র ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে নিচু স্বরে বলে,

–“মা আসবো?”
তৎক্ষনাৎ ভেতর থেকে আওয়াজ আসে,
–“আয়, অনুমতি নেওয়ার কি আছে?”
রুজবা গুটিগুটি পায়ে ভেতরে যায়। টি-টেবলের উপর ট্রে রেখে সোজা হয়ে দাঁড়ায়। শাহানা বেগম জায়নামাজে বসে তসবিহ পড়ছেন। আর নোমান সাহেব সোফায় বসে ব্যাবসার হিসাবের খাতা নাড়াচাড়া করছেন। তার মাথায় টুপি। ক্ষানিক আগেই মসজিদ থেকে নামায পড়ে বাড়ি ফিরেছেন উনি। নোমান সাহেব হিসাবের খাতা পাশে রেখে বললো,

–“দাঁড়িয়ে আছো কেন মা? বসো।”
রুজবা চুপচাপ বসে৷ শাহানা বেগম তসবিহ শেষ করে জায়নামাজ গুছিয়ে রেখে বসে রুজবার পাশে। নোমান সাহেব ফের বলে,
–“এ বাড়িতে তোমার কোনো সমস্যা হচ্ছে না তো?”
রুজবা ধীর স্বরে জবাব দেয়,
–“না বাবা।”

রুজবা চা’য়ের কাপ তুলে দেন নোমান সাহেবের হাতে। পরপর শাহানা বেগমের হাতে’ও তুলে দেন চা’য়ের কাপ। শাহানা বেগম চা’য়ে চুমুক দিয়ে বললেন,
–“নুহাশ ফিরেনি এখনো?”
–“নাহ।”
–“ফোন করেছিলো?”
রুজবা মাথা নাড়ায়৷ নোমান সাহেব চা শেষ করে কাপ’টা ট্রে-তে রেখে বলে,

–“হতচ্ছাড়া’টা আগেও রাত করে বাড়ি ফিরতো এখন যে ঘরে বউ আছে তারপর’ও রাত করে বাড়ি ফিরে। বাচ্চা’কাল থেকে এটায় আমাকে হাড়ে হাড়ে জ্বালিয়ে দিলো একেবারে। এক্ষুনি ফোন করে বাইরে বাইরে ঘোরা বার করছি আমি।”
বলেই নোমান সাহেব ফোন হাতে নিলেন। রুজবা দ্রুত কন্ঠে বললো,

–“থাক বাবা, আপনার ফোন করতে হবে না। যাওয়ার আগে বলে গেছেন দ্রুত ফিরবে।”
নোমান সাহেব হতাশ শ্বাস ফেলে ফোন পাশে রেখে দিলেন৷ রুজবা মিনমিন কন্ঠে বলে,
–“মা, ভাবী নির্ঝর’কে আপনার কাছে রাখতে বলেছিলো।”
–“হ্যাঁ ডেকে নিচ্ছি আমি, তোমরা তো আবার ছাদে যাবে। নির্ঝর তো শুধু ছোটাছুটি করে ওর ছাদে যাওয়ার দরকার নেই।”
রুজবা দাঁড়িয়ে বললো,
–“আমি পাঠিয়ে দিচ্ছি ওকে।”

শ্বশুর শাশুড়ী’র ঘর থেকে বেরিয়ে সোজা নিজেদের ঘরে এসেছে রুজবা৷ আদিরা, ফারিন, জান্নাত আর রিয়ান ততক্ষণে ছাদে চলে গিয়েছে শীতল পাটি আর স্ন্যাকস এবং চা’য়ের কাপ, ফ্ল্যাক্স সহ। যাওয়ার আগে রুজবা’কে বলে গিয়েছে দ্রুত যাওয়ার জন্য। নিবির শো-রুমে গিয়েছে ফিরতে ফিরতে রাত হবে।

এদিকে কিয়ান আর নুহাশ বেরিয়েছে সেই বিকালে এখনো আসার নাম নেই৷ রুজবা ফোন হাতে নিয়ে বসে আছে নুহাশ’কে ফোন করার জন্য৷ ফোন করবে কি করবে না দোটানায় আছে ও। কিছু আনার কথা বলবে নুহাশ’কে। কিন্তু কিভাবে বলবে কথাটা সেটাই ভাবছে ও। অবশেষে নুহাশের নাম্বারে ডায়াল করলো রুজবা। তিনবার রিং হতেই ওপাশ থেকে রিসিভ হলো। রুজবা সালাম দিয়ে ধীরে স্বরে প্রশ্ন করে,

–“কোথায় আছেন?”
–“মিস করছো বুঝি?”
রুজবা লজ্জা পেলো ক্ষানিকটা। এভাবে বললে লজ্জা পাবে না? রুজবা কথা কাটিয়ে বললো,
–“আছেন কোথায় সেটা বলুন, বাজারে?”
আচমকা’ই রুজবা নিজের কোমড়ে শক্ত ঠান্ডা পুরুষালি হাতের স্পর্শ পায়৷ হাত-জোড়া’র মালিক যে নুহাশ এটা বুঝতে অসুবিধা হয়নি আর তার। কান থেকে ফোন নামিয়ে নেয় রুজবা। নুহাশ পেছন থেকে রুজবার কোমড় টেনে ধরে নিজের কাছে নিয়ে আসলো। দুহাতে রুজবার পেট পেচিয়ে ধরে কাঁধে থুতনি রেখে বলে,

–“কিছু প্রয়োজন?”
–“ছিলো।”
–“কি লাগবে বলো, নিয়ে আসি আমি।”
–“থাক___”
–“বাজার তো কাছেই।”
–“আর যেতে হবে না। আমি ভাবী বা ফারিনের থেকে নিয়ে নিবো।”
–“পারসোনাল কিছু?”
রুজবা মাথা নাড়ায়৷ নুহাশ প্রশ্ন ছুঁড়ে,

–“ন্যাপকিন?”
–“নাহ।”
নুহাশ ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন করে,
–“তাহলে আর কি?”
রুজবার শরীর মৃদু কাঁপছে। বুকটা দ্রিমদ্রিম করছে। লোকটা’কে বললে কি ভাববে সে? নুহাশ আবার’ও প্রশ্ন করে। রুজবা নিচু কন্ঠে বলে,

–“পিল___”
নুহাশ তৎক্ষনাৎ রুজবা’কে নিজের দিকে ঘুরিয়ে বলে,
–“পিল কেন?”
রুজবা আমতা আমতা করে বলে,
–“প্রোটেকশনের___”
–“প্রোটেকশন লাগবে কেন?”
রুজবা পরবর্তীতে কি বলবে ভেবে পেলো না। নুহাশ রুজবা’র দু গাল ধরে বললো,
–“বাচ্চা চাও না?”
রুজবা প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করে,

–“আপনি চান?”
–“চাইবো না কেন?”
–“বিয়ের অনুষ্ঠান দু’বছর বাদে হবে। এখনই বাচ্চা___”
–“এজন্যই তো আরো বেশি করে বাচ্চা চাই। দু’বছর কে অপেক্ষা করবে বলো? যত তাড়াতাড়ি তুমি কনসিভ করবে তত তাড়াতাড়িই তোমাকে এ বাড়িতে নিয়ে আসতে পারবো আমি।”
রুজবা ভ্রু কুঁচকে তাকালো। নুহাশ ফের বলে,

–“কোনো প্রোটেকশন ফোটেকশনের দরকার নেই। যেভাবে চলছে সেভাবেই চলুক। আই নিড অ্যা বেবি।”
কথাটা বলতে বলতেই নুহাশ ফ্রেশ হতে ওয়াশরুমে চলে যায়। রুজবা “হা” করে নুহাশের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে। এই লোকটা তো মহা ধুরন্ধর। হোয়াট অ্যা প্ল্যান। বউকে দ্রুত নিজের কাছে নিয়ে আসার কত তাড়া মানুষটার।

ছাদে বসে আড্ডা জমিয়েছে ফারদিন বাড়ির ছেলে-বউরা। নিবির বাদে বাকী সবাই আছে৷ আড্ডার টপিক না বলা’ই ভালো। কিয়ান যেখানে আছে সেখানে তো বাঁদরামি পুরো দমে চলে। আজকাল নুহাশ’ও কম যায় না। নুহাশের এমন রুপ জান্নাত আদিরার আগে থেকেই দেখা৷ তবে ফারিন আর রুজবা জানতো না। বিয়ের পর থেকেই জানতে পারছে ওরা। আড্ডার এক পর্যায়ে কিয়ান নুহাশের দিকে গিটার এগিয়ে দিয়ে বলে,

–“গান ধর।”
–“মুড নেই।”
ওমনি কিয়ান পরপর কয়েকটা কিল থা/প্প/ড় বসায় নুহাশের পিঠে। দাঁতে দাঁত চেপে বলে,
–“আমরা বললেই মুড নেই না? এখন রুজবা বললে তো ঠিকই সুরসুর করে গান ধরতি শা*লা।”
নুহাশ বাঁকা হেসে রুজবার দিকে তাকিয়ে বলে,

–“তাহলে তাকেই বল, আমায় বলতে।”
জান্নাত আর আদিরা মুখ চেপে হাসলো। সাথে ফারিন’ও। কিয়ান তাড়া দিয়ে বললো,
–“মুখে বলতে হবে না, ভাবী’জির মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে সে গান শুনতে ইচ্ছুক। ঝটপট গান ধর তো নুহাশ।”
নুহাশ দুদিকে মাথা নাড়িয়ে বলে,
–“মনে মনে ইচ্ছে পোষণ করলে তো হবে না। মুখে বলতে হবে সবকিছু। ইচ এন্ড এভ্রিথিং, তবেই না বুঝবো আমি।”
রিয়ান বললো,

–“শালী সাহেবা, ইচ এন্ড এভ্রিথিং না হয় পড়ে মুখে বলে বুঝাবা। আগে গান ধরতে বলো ওকে।”
রুজবা লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে বসে রয়৷ রিয়ান ফের বলে,
–“আপনি বললেই আপনার বর গান গাইবে এর আগে না। আপনি বরং বলুন তাকে গান ধরতে।”
রুজবা পড়েছে মহা বিপাকে। সবার সামনে ও কিভাবে বলবে নুহাশ’কে গান ধরতে? আর এই লোকটা’ও না ইচ্ছে করে লজ্জায় ফেলে ওকে। সবার রিকুয়েষ্টে লজ্জা ভেঙে আমতা আমতা করে বলে,

–“সবাই যখন এত করে বলছে তাহলে একটা গান শোনান সবাইকে।”
–“শুধু সবাই বলছে বলে? তুমি চাও না?”
রুজবার কান গরম হয়ে এলো। বেশ সময় নিয়ে ধীর স্বরে বলে,
–“আ্ আমিও চাই।”

রুজবা’র কথায় সবাই ফিক করে হেসে দেয়। কিয়ান এগিয়ে দেয় গিটার। নুহাশ গিটার হাতে নিয়ে টুংটাং আওয়াজ তুলে। রুজবা’র দিকে তাকিয়েই গান ধরে,
❝অনেক সাধনার পরে আমি
পেলাম তোমার মন
পেলাম খুঁজে এই ভুবনে
আমার আপন জন
তুমি বুকে টেনে
নাও না প্রিয় আমাকে
আমি ভালোবাসি, ভালোবাসি
ভালোবাসি তোমাকে❞

সম্পূর্ণ গান’টা নুহাশ রুজবার দিকে তাকিয়েই শেষ করেছে৷ রুজবা লজ্জায় মাথা তুলে তাকায়নি আর। বাকী সবাই মিটিমিটি হেসেছে। গান শেষ হতেই সকলে কড়তালি দিয়ে উঠে। কিয়ান প্রশ্ন করে,
–“অ্যাট লাস্ট রুজবার মন পেলি?”
নুহাশ মুচকি হাসলো শুধু৷ আদিরা প্রশ্ন করে,
–“তা ভালোবাসি বলেছে মুখে?”

–“ভালোবাসে কিনা বোঝার জন্য মুখে বলার প্রয়োজন নেই৷ আমি তার মন পড়তে জানি। তবে হ্যাঁ অপেক্ষায় আছি ভালোবাসি কথাটা শোনার, আই হোপ খুব শীঘ্রই শুনতে পাবো।”
সবাই একসাথে “ওহহোওওওও” বলে চিল্লিয়ে উঠে। ফারিন রুজবা’কে কাঁধ দিয়ে মৃদু ধাক্কা দিয়ে বলে,
–“নুহাশ ভাই তো জানেই তোর মনের খবর, তাহলে ভালোবাসি বলেই দে। পাঁচটা বছর অপেক্ষা করেছে তোকে পাওয়ার জন্য, ফাইনালি সে পেয়েছে তোকে। আর অপেক্ষা করাস না ইয়ার।”
আদিরা ঠোঁট টিপে হেসে বলে,

–“এখন তো নুহাশের বউ তুই। বউ হয়েও আমার দেবর’টাকে অপেক্ষা করাচ্ছিস? দিস ইজ নো ফেয়ার রুজবা।”
–“হ্যাঁ হ্যাঁ, বলেই দে রুজবা। দেখ নুহাশ চাতক পাখির মতো অপেক্ষা করছে তোর মুখ থেকে ভালোবাসি কথা শোনার জন্য।”
জান্নাতের কথায় কিয়ান ফাজলামো করে বলে,

–“ভাবী, শালী আর বেয়াইন সাহেবা দয়া করে আর আপনার বর মশাইকে অপেক্ষা করাবেন না। গত পাঁচটা বছর সে আপনার ভালোবাসার অনলে জ্বলে পুড়ে খাটি সোনা হয়েছে তাই আপনি নিঃসন্দেহে তার সাথে নিজের মনের আদান-প্রদান করতে পারেন। নিশ্চিন্ত মনে ভালোবাসতে পারেন। সে আপনার, এবং শুধুমাত্র আপনারই।”
কিয়ানের কথায় আরেক দফা হাসির রোল পড়ে আড্ডা মহলে। এবার রিয়ান একই সুর তুলে বলে,

–“হ্যাঁ শালী সাহেবা, ভালোবাসি বলেই দাও।”
এদের সকলের এরকম কথাবার্তায় রুজবা’র বেশ লজ্জা লাগছে৷ আর বসে থাকতে পারছে না। রুজবা উঠে ছুট লাগায় নিচে। সকলে রুজবার পানে তাকিয়ে উচ্চস্বরে হাসে। নুহাশ সেদিকে তাকিয়ে বলে,
–“সবাই হঠাৎ করে আমার বউয়ের পেছনে পড়লা কেন? লজ্জার ডোজ’টা বেশি হয়ে গেলো না?”
কিয়ান ভ্রু কুঁচকে বলে,

অনেক সাধনার পরে পর্ব ৩৯

–“বাহ! যার জন্য করি চুরি সেই বলে চোর। এজন্যই তো কারো ভালো করতে নেই।”
–“ও যেদিন স্বেচ্ছায় ভালোবাসি বলবে সেদিনই শুনবো আমি। ভালোবাসি শোনার এত তাড়া নেই আমার। কারণ জানি সে শুধু আমার। তার মনে যে আমি অল্প অল্প করে জায়গা করে নিচ্ছি এটাও হান্ড্রেড পার্সেন্ট সিয়র আমি।”
নুহাশের কথায় সকলে মৃদু হাসে। নুহাশের ভালোবাসা ওদের দেখতেও ভালো লাগে৷ নুহাশ গিটার’টা কিয়ানের হাতে দিয়ে সে নিজে’ও নেমে যায় ছাদ থেকে।

অনেক সাধনার পরে পর্ব ৪১