অনেক সাধনার পরে পর্ব ৩৯

অনেক সাধনার পরে পর্ব ৩৯
অরনিশা সাথী

শাহানা বেগম দুপুরের রান্না বসিয়েছে৷ রাশেদা বেগম অনেক বার বারণ করেছিলো রান্না করতে কিন্তু শাহানা বেগম শুনেননি। উনার একই কথা,

–“আমার নুহাশের বউ এই প্রথম এসেছে এ বাড়িতে। আমি নিজে রেঁধে/বেড়ে খাওয়াবো না তা কি হয় নাকি?”
শাহানা বেগমের কথায় হার মেনে নেন রাশেদা বেগম। শাহানা বেগম চুলোয় গরুর গোশত রান্নার জন্য মশলা কষাচ্ছেন। পাশেই আদিরা অন্যসব রান্নার জোগাড় করছে।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

বাড়িতে শাহানা বেগমই রান্না করেন। আদিরা চাইলেও রান্নায় হাত লাগাতে দেয় না। পাশ থেকে শুধু রান্নার সবকিছু জোগাড় করে দেয়। শাহানা বেগমের এক কথা, যতদিন উনি সুস্থ ভাবে বেঁচে আছেন ততদিন উনি নিজেই স্বামী সন্তান আর ছেলের বউদের রান্না করে খাওয়াবেন। পড়ে যখন বয়স বাড়বে, উনি পারবেন না তখন না হয় ছেলের বউরা রান্নাবান্না করবেন। তাছাড়া মাঝেসাঝে দুই একটা নিজেদের পছন্দের কিছু রান্না করলে সেটা আলাদা হিসাব।

ঘড়ির কাটায় সাড়ে এগারোটা। রুজবার এখন আর মাথা যন্ত্রণা নেই। বিছানা ছেড়ে উঠে গুটিগুটি পায়ে রান্নাঘরের দিকে এগোয় ও। দেখতে পায় শাহানা বেগম রাঁধছেন আর আদিরা হাতে হাতে সাহায্য করছে। রুজবা আদিরার পাশে গিয়ে দাঁড়াতেই আদিরা বলে,

–“কি ব্যাপার? বিছানা ছেড়ে উঠেছো কেন? মাথা যন্ত্রণা করছে না? একটু ঘুমাও গিয়ে দেখবে কমে যাবে ব্যথা।”
–“সকাল থেকে তো বিছানার সাথেই লেগে ছিলাম। এখন ব্যাথা নেই ভাবী। কি করতে হবে? সরুন, আমি করে দিচ্ছি।”

–“তোমার এখানে কোনো কাজ নেই। তুমি ঘরে যাও।”
রুজবা মিনমিন করে বললো,
–“ঘরে একা একা ভালো লাগছে না, তাই তো এখানে এলাম।”
আদিরা আলতো হেসে বললো,

–“এই নুহাশ’টাও না, বেরিয়েছে দুই ঘন্টা পেরিয়েছে। ঘরে নতুন বউ রেখে কেউ এত বাইরে বাইরে থাকে?”
রুজবা নতুন বউ? কথাটা আবার মাথাচাড়া দিতেই একরাশ লজ্জা এসে ঘিরে ধরলো ওকে। মাথা নিচু করে নিলো মূহুর্তেই। আদিরা বুঝতে পেরে মৃদু হাসলো। রুজবা আদিরার পাশ থেকে সরে শাহানা বেগমের পাশে দাঁড়িয়ে বললো,

–“আন্টি আপনি ঘরে যান, আমি রান্না করি আজ?”
শাহানা বেগম খুন্তি রেখে আচঁলে হাত মুছে রুজবার দিকে ঘুরে। রুজবার গালে হাত রেখে বলে,
–“রান্না করার সময় অনেক আছে। এখন কিচ্ছু করতে হবে না তোমার। তুমি ওই চেয়ারটাতে বসো। আর আমি তো তোমার মায়ের মতোই, আদিরা মা ডাকে আমাকে। তুমিও তাই ডেকো, তাহল খুশি হবো৷”
রুজবা মুচকি হেসে সম্মতি জানিয়ে বলে,

–“ভাবীকে তো তুই বলেন তাহলে আমাকে তুমি কেন? আমি কি আপনার মেয়ে না ভাবীর মতো?”
শাহানা বেগম আর আদিরা হাসে। শাহানা বেগম রুজবার গাল টেনে দিয়ে বলে,
–“তুই তো আমার আরেকটা মেয়ে।”
–“তাহলে আপনি বসুন, আমি রান্না___”
রুজবা পুরো কথা শেষ করার আগেই আদিরা বলে,

–“তোমার তো বিয়ে হলো আট/দশদিন হবে৷ আর কালই এই বাড়িতে নতুন এসেছো। আমি এই বাড়িতে বউ হয়ে এসেছি আট বছর, মা আমাকেই রান্না করতে দেয় না আর তুমি তো নতুন।”
শাহানা বেগম মুচকি হেসে বলে,

–“আমার মেয়ে নেই, আমার মেয়ে থাকলে কি আমি তাকে দিয়ে রান্না করাতাম? নিশ্চয়ই না। তাহলে তোদের দিয়ে রান্না করাবো কেন? আর তোরা তো আমার ছেলের বউ না, আমার মেয়েই।”
আদিরা রুজবা দুজনেই মুচকি হাসলো। মনে মনে দুজনেই নিজেদের বেশ ভাগ্যবতী মনে করলো এরকম শ্বাশুড়ি পেয়ে।

রুজবার ভীষণ অস্থির অস্থির লাগছে কাল সকাল থেকে সমানে শাড়ি পড়ে থাকায়৷ ফজরে শাওয়ার নিয়ে আবার শাড়ি পড়ায় তো রুজবার রীতিমতো শরীর চুলকাচ্ছিলো তাই সে সময়ে শাড়ি খুলে নুহাশের টি-শার্ট আর টাউজার পড়েছিলো। কিন্তু সকাল হতেই আবার শাড়ি গায়ে জড়াতে হয়েছে ওর। থাকার প্ল্যান তো ছিলো না তাই এক্সট্রা জামা/কাপড়ও আনেনি ও। এখন গোসল করে কি পড়বে ও? আদিরাকে কি বলবে? আদিরার জামা রুজবার গায়ে লাগবে৷ একটু লুজ হবে তবে সেটা ব্যাপার না। রুজবা দোটানায় আছে, আদিরাকে বলবে কি বলবে না? দ্বিধাদ্বন্দ ঝেড়ে ফেলে রুজবা আমতা আমতা করে বলে,

–“ভাবী, আপনার এক সেট জামা দিবেন আমাকে? টানা এত সময় শাড়িতে থাকিনি তো, শরীর চুলকাচ্ছে আমার৷ এক্সট্রা জামা আনিনি আমি সাথে___”
আদিরা দাঁত দিয়ে জ্বীব কেটে বলে,
–“হায় আল্লাহ! দেখছো আমি কাল রাতেই একবার তোমাকে এ কথা জিজ্ঞেস করবো ভেবেছিলাম, কিন্তু একদম ভুলে গেছি। ইশ্! আ’ম স্যরি আসলে আমার মাথায় রাখা উচিত ছিলো।”

–“না না, স্যরি বলবেন না। আসলে কাল যে আমার থাকা হবে এ বাড়িতে এরকমটা তো জানা ছিলো না নয়তো এক্সট্রা নিয়ে আসতাম আমি।”
শাহানা বেগম দাঁত কিড়মিড়িয়ে বললো,
–“আদিরা? নুহাশ কই ফোন করে জিজ্ঞেস কর তো। ওর বউয়ের কি লাগবে না লাগবে সেটা লক্ষ্য রাখবে না ও? মেয়েটা কাল থেকে এক কাপড়ে আছে। ইশ্! এই নাকি উনি রুজবাকে ভালোবাসে পাগলের মতো। বউয়ের কখন কি প্রয়োজন সাহেবের সেটাই মাথায় থাকে না। আজকে আসুক ও___”

–“এসে গেছি মা, আমাকে নিয়েই কথা হচ্ছিলো বুঝি?”
শাহানা বেগম দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
–“হ্যাঁ, আপনি আমার গুণধর পুত্র না? আপনার কথাই হচ্ছিলো এখানে।”
নুহাশ আদিরার পাশ ঘেঁষে দাঁড়ায়। আদিরার দিকে ক্ষানিকটা ঝুঁকে বলে,
–“কি ব্যাপার, বলো তো ভাবী? মা জননি এত চটে আছে কেন?”
–“শুধু মা একা না, আমিও চটে আছি নুহাশ।”

নুহাশ দ্রুত সরে গেলো আদিরার পাশ থেকে। ভ্রু কুঁচকে বললো,
–“বাড়ির দুই গিন্নি ক্ষেপে আছে আমার উপর? কিন্তু কেন?”
নুহাশ রুজবার দিকে তাকিয়ে ভ্রু নাচিয়ে ফের বললো,
–“তৃতীয় গিন্নিও কি ক্ষেপে আছে?”
শাহানা বেগম চটে গিয়ে বলে,

–“একদম ফাজলামি করবি না নুহাশ। কাল থেকে মেয়েটা এক কাপড়ে আছে। বউয়ের দিকে কি একটুও ধ্যান বা নজর নেই তোর? আমরা ভুলে গিয়েছিলাম কিন্তু তুই কি করে ভুলে গেলি? তোর বউ তো ও৷”
নুহাশ রুজবার দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে বললো,
–“আমার ধ্যান তো সবসময় ওর দিকেই থাকে। সেটা যদি তোমরা একবার ওর পুরো শরীরে ভালো করে চোখ বুলাতে তাহলে অবশ্যই বুঝতে পারতে৷”

নুহাশের কথায় রুজবা কেশে উঠে। আদিরা আলতো ভাবে থা/প্প/ড় মারে নুহাশের বাহুতে। নুহাশ চোখমুখ কুঁচকে বলে,
–“কি হলো? মারলে কেন?”
–“লজ্জা শরমের মাথা খেয়েছো? মা দাঁড়িয়ে___”
–“তো?”
–“তুমি নির্লজ্জ হতে পারো কিন্তু রুজবা তো না।”
নুহাশ ঠোঁট কামড়ে হাসলো। শাহানা বেগম আবার বললো,

–“দুপুর হয়েছে নুহাশ। মেয়েটা কি আজও একই শাড়িতে থাকবে? আমাদের মাথা থেকে বেরিয়ে গেছিলো কিয়ানের বিয়ের ব্যস্ততায়৷ তোর তো মাথায় রাখা উচিত ছিলো। মেয়েটা এখন গোসল করে কি পড়বে শাড়ি?”
নুহাশ ফাজলামো করে বললো,
–“কেন? তোমার বউমা চাইলে আমার টাউজার আর টি-শার্ট পড়তে পারে, আমার কোনো আপত্তি নেই।”
শাহানা বেগম কড়া স্বরে বললো,

–“নুহাশ___”
নুহাশ হো হো করে হেসে উঠলো। হাসি থামিয়ে বললো,
–“তোমার আদরের বউমার জন্যই ড্রেস কিনতে গিয়েছিলাম মা জননি। আগে পড়ে মেয়েলি জামাকাপড় তো কিনিনি, চুজ করতে অনেক বেগ পোহাতে হয়েছে। তাই এত লেট হলো।”
শাহানা বেগম নুহাশের বাহুতে থা/প্প/ড় মেরে বলে,
–“আগে বললেই হতো এটা। শুধু শুধু বাপের মতো কথা পেঁচায়। ফাজিল ছেলে, সবসময় শুধু ফাজলামো।”

ড্রেসিংটেবিলের সামনে বসে চুল আঁচড়াচ্ছে রুজবা। ঘড়িতে তখন বিকেল চারটা বাজে। নুহাশ ড্রয়িংরুমে সোফায় বসে বাপ ভাইয়ের সাথে কথা বলছে। রুজবাও ছিলো এতক্ষণ, মিনিট দুই হলো উঠে এসেছে ও। একমনে আয়নার দিকে তাকিয়ে চুলে চিরুনি চালিয়ে যাচ্ছে ও। দৃষ্টি তখন ওর গলায় আর কান ঘেঁষে একদম গালের কাছে৷ ঘুরেফিরে এই দুই জায়গায় গিয়েই ওর দৃষ্টি স্থির হচ্ছে।

লোকটা কাল বড্ড পাগলামি করেছে৷ পাগলামির চিহ্ন গুলোও খুব যত্ন সহকারে এঁকে দিয়েছে ওর শরীরে৷ ইশ্! কেউ দেখলে কি ভাববে? ভেবে নিজেই লজ্জায় নুইয়ে গেলো। হঠাৎ দরজা খোলার শব্দে ধ্যান ভাঙে রুজবার৷ দ্রুত দাঁড়িয়ে পড়ে বসা থেকে৷ আয়নায় স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে নুহাশ ঘরে ঢুকেই দরজা বন্ধ করে দিলো। রুজবা চট করেই বুঝে গেলো এই ছেলের মাথায় আবার কোনো কিছু ঘুরপাক খাচ্ছে৷ ভাবতে ভাবতেই নুহাশ একদম রুজবার পেছনে এসে দাঁড়ায়। রুজবা নুহাশের দিক থেকে মনোযোগ সরিয়ে চুলগুলো হাতখোপা করায় ব্যস্ত হয়ে পড়ে। খোপা করে হাত নামাতেই নুহাশ পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে। কাঁধে থুতনি রেখে বলে,

–“সত্যি চলে যাবে?”
–“হু, সামনেই এক্সাম। ক্লাস মিস হচ্ছে তো।”
নুহাশ গোমড়া মুখে বলে,
–“এখান থেকেও তো ভার্সিটি যাওয়া যায়, আমি দিয়ে আসবো।”

–“তা যায়, তবে আপনার সামনে আমার পড়াশোনা হবে না। এইটুকু নিশ্চিত ভাবে বলতে পারি।”
নুহাশ রুজবার কোমড় পেচিয়ে ধরে ভালো ভাবে কাঁধে মাথা গুজলো। ইনোসেন্ট গলায় বললো,
–“বিরক্ত করবো না, প্রমিস।”
–“এটা বিশ্বাস করতে হবে আমায়?”
–“আচ্ছা কাল দিয়ে আসবো বাড়িতে পাক্কা, আজ যেও না।”

রুজবা নুহাশের থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে ওর মুখোমুখি দাঁড়ায়। নুহাশ চাতক পাখির ন্যায় রুজবার পানে তাকিয়ে আছে জবাবের আশায়৷ ও বেশ কিছুক্ষণ নিরব দৃষ্টিতে নুহাশের দিকে তাকিয়ে থেকে আলতো হেসে মাথা নাড়াতেই নুহাশ খুশিতে জাপ্টে ধরে তাকে। ড্রেসিং টেবিল ধরে পড়ে যাওয়া থেকে সামলে নেয় নিজেকে। এতবড় ছেলের পাগলামি দেখে মৃদু হাসে সে।

তারপর আলগোছে নুহাশের পিঠে হাত রেখে সে নিজেও জাপ্টে ধরে নুহাশকে। এই মানুষটার সান্নিধ্যে থাকলে ওর কেমন যেন সুখ সুখ লাগে। ইচ্ছে করে সবসময় লোকটার বুকের সাথে এভাবে লেপ্টে থাকতে৷ ছাড়তে ইচ্ছে করে না একদমই। আর সবচেয়ে অবাক করা বিষয় হচ্ছে জারাফের কথা এক মূহুর্তের জন্যও মাথায় আসে না আর৷ রুজবার চিন্তা ভাবনায় নুহাশ’ই চলে আসে সবসময়।

আজকাল জারাফের কথা মনে হলেও আর কষ্ট হয় না রুজবার। তবে কি ও দ্বিতীয় বার কাউকে ভালোবাসতে শুরু করেছে? দ্বিতীয় বার আবার কারো মায়ায় জড়াচ্ছে নিজেকে? সিক্ত হতে চাইছে কি নুহাশের ভালোবাসায়? তবে কি নুহাশের জন্য ওর মনে অনুভূতি’রা জন্ম নিচ্ছে? শেষমেশ ❝নুহাশ ফারদিন❞ তাহলে বেশ পাকাপোক্ত ভাবেই জায়গা করে নিচ্ছে মনে।

অনেক সাধনার পরে পর্ব ৩৮

|এতদিন অনিয়মিত হওয়ার জন্য দুঃখিত। এখন থেকে নিয়মিত দেওয়ার চেষ্টা করবো ইনশা-আল্লাহ|

অনেক সাধনার পরে পর্ব ৪০