অনেক সাধনার পরে পর্ব ৪২

অনেক সাধনার পরে পর্ব ৪২
অরনিশা সাথী

রুজবা নিজের বাড়ি এসেছে ঘন্টা খানেক হবে। আসার পর থেকেই ও নিজের নানুর সাথে লেগে আছে। বছর দুয়েক বাদে দেখা দুজনের। রুজবা ওরা নিজেদের নানু বাড়ি বেশি একটা যায় না। মাঝে মধ্যে শারমিন বেগম একা ঘুরে আসতেন ওরা ভাই বোনেরা যেতে চায়তো না তেমন একটা। রুজবা ওর নানু হাজেরা বেগমের গায়ের সাথে লেপ্টে আছে একেবারে।

উনি আদুরে স্পর্শ করছে নাতনির মাথায়। নুহাশ পেঁচার মতো মুখ করে সোফায় বসে আছে। কিছু সময় পরপর তাকাচ্ছে রুজবার দিকে। কই ওর সাথে তো এরকম লেপ্টে থাকে না। উল্টো একটু ছুঁলেই মেয়েটা ব্যাঙের মতো তিড়িং বিড়িং করে লাফিয়ে উঠে। ভুমিকম্পের মতো কেঁপে উঠে। আর এখন দেখো কি সুন্দর নিজের নানুর সাথে লেপ্টে আছে। হিংসে হচ্ছে নুহাশের। ওর বউ ওর সাথে এভাবে লেপ্টে থাকে না কেন? হাজেরা বেগম ব্যাপারটা লক্ষ্য করে মুচকি হেসে বললো,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

–“কি ভাই? মুখটা ওমন কইরা রাখছো ক্যান? তোমার বউ আমার লগে চিপকে আছে দেইখা সহ্য হইতাছে না তোমার?”
নুহাশ ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায় তার প্রশ্নে। রুজবা ভ্রু কুঁচকে তাকায়। নুহাশ হাসার চেষ্টা করে বলে,

–“সহ্য কিভাবে হবে বলুন তো নানু? আমি ছুঁলেই তো আপনার নাতনি ব্যাঙের মতো তিড়িং বিড়িং করে লাফায়। এখন যে মেয়েকে আমি ছুঁলে লাফিয়ে উঠে সে মেয়ে যদি আপনার সাথে এভাবে চিপকে বসে থাকে তাহলে কি আমার আর সহ্য হবে?”

নুহাশের কথা শুনে রুজবা কেঁশে উঠে। এই লোকটার কি বিন্দু পরিমান লাজ লজ্জা নেই? এটা ভাবা বরংচ রুজবার ভুল। যে ছেলে মা-বাবার সাথে নির্লজ্জ মার্কা ইয়ার্কি করতে পারে সে ছেলে নানু-শাশুড়ির সাথে তো এরকম লাগামছাড়া কথাবার্তা বলবেই। হাজেরা বেগম হেসে বললো,

–“নতুন তো তাই একটু লজ্জা পায়, আস্তে আস্তে ঠিক হইয়া যাইবো।”
নুহাশ মৃদু হাসে। হাজেরা বেগম রুজবাকে বলে,
–“জামাই নিয়া ঘরে যা, অনেক ক্ষণ হইছে আইছোস। ঘরে যাইয়া হাতমুখ ধুইয়া নে।”
রুজবা মাথা নাড়িয়ে উঠে দাঁড়ায়। ঘর থেকে বের হতে গিয়ে আবার দাঁড়িয়ে নুহাশকে বলে,
–“আসুন।”

নুহাশ বাধ্য ছেলের মতো উঠে রুজবার পিছু নেয়। রুজবার আগেই ঘরে ঢুকে বিছানায় হাত পা মেলে শুয়ে পড়ে। রুজবাকে বলে,
–“দরজাটা লাগিয়ে এসো।”
রুজবা ভ্রু কুঁচকে তাকায়। নুহাশ দরজার দিকে ইশারা করতেই রুজবা আশেপাশে এদিক সেদিক তাকিয়ে দরজা আটকে দেয়। বিছানার কাছে যেতেই নুহাশ রুজবার দিকে দু হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলে,

–“ও ঘরে নানুর সাথে যেভাবে লেপ্টে ছিলে এবার আমার সাথেও কিছুক্ষণ লেপ্টে থাকো তো আসো।”
–“মানে?”
–“মানে বুকে আসো।”
কথাটা বলে নুহাশ নিজেই রুজবার হাত ধরে টান দিয়ে রুজবাকে নিজের বুকের উপর নিয়ে আসে। রুজবার মাথা নিজের বুকে এনে আলতো ভাবে হাত বুলায় মাথায়৷ তারপর রুজবার কানের লতিতে ঠোঁট ছুঁইয়ে ফিসফিস করে বলে,

–“আমায় শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বুকে কান পেতে দেখো তো কিছু শুনতে পাও কিনা? তোমার স্পর্শে আমার বুকের ভেতর কিছু হচ্ছে কিনা?”
বাধ্য স্ত্রীর মতো রুজবা নুহাশকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে ওর বুকে কান পাতে। শুনতে পায় নুহাশের বুকের অস্বাভাবিক ধুকপুকানির শব্দ। মাঝে নুহাশের শরীরের মৃদু কম্পন অনুভব করে ও। লোকটা ওর স্পর্শ পেয়ে কাঁপছে? রুজবার’ও তো এরকম হয়৷ তাহলে রুজবা যেমন অনুভব করে লোকটাও কি একই অনুভব করে? দুজনের অনুভূতি গুলোই কি এক?

বিয়ের এ কয়েকদিনে রুজবাকে নিয়ে কোথাও বের হয়নি নুহাশ। তাই আজ ভেবেছে ওকে নিয়ে বের হবে৷ শহরের দিকে যাবে। সেখানে ওদের শো-রুম থেকে ঘুরিয়ে আনবে প্লাস কিছু কেনাকাটা করবে। বাইক নিয়েই যাবে। বাইকে গেলে বেশি একটা সময় লাগবে না। দুপুরের খাবার খেয়ে ক্ষানিকটা রেস্ট নিয়েই বের হবে দুজনে। রুজবাকে আগেই বলে রেখেছে ও।

আড়াইটা নাগাদ দুজনে রেডি হয়ে বের হয়৷ নুহাশকে রেডি হয়ে বের হতে দেখে ক্ষানিকটা সময় ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে থাকে। কালো শার্ট, ন্যারো জিন্স প্যান্ট, সাদা কেডস, কালো ঘড়ি। শার্টের হাতা ফোল্ড করা এবং বুকের কাছের দুটো বোতাম খোলা। এরকম সেজেগুজে যাওয়ার কারণ খুঁজে পায় না রুজবা৷ ওর কাছেই এত সুন্দর লাগছে ছেলেটাকে, অন্য মেয়েরা তো চোখ দিয়ে গিলে খাবে রীতিমতো। ক্ষানিকটা বিরক্ত হয় রুজবা৷ মেজাজ গরম হয় বুকের কাছের দুটো বোতাম খোলা দেখে। তবে সেটা প্রকাশ করে না, নিজের মনেই রাখে।

প্রথমেই নুহাশ দের শো-রুম ঘুরে দেখে। তাদের ছোট সাহেব নতুন বউ নিয়ে গেছে বলে কত উল্লাস কত আনন্দ তাদের। সকল কর্মচারীদের সাথে নুহাশের কি সুন্দর বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক। তাদের খুশি দেখে রুজবা’ও মৃদু হাসে। সেখানে কিছুক্ষণ সময় কাটিয়ে দুজনেই বেরিয়ে পড়ে। বাইক শো-রুমের সামনেই রেখে যায়। এবার দুজনে রিকশায় ঘুরবে। এদিক সেদিক দুজনে রিকশায় ঘুরে, ফুটপাত ধরে হাতে হাত রেখে হাটে। রাস্তার ধারের স্ট্রিট ফুড খায়। সব শেষে দুজনে শপিংমলে যায়। দুই বাসার সকলের জন্যই টুকটাক কেনাকাটা করে। নুহাশের পছন্দ অনুযায়ী রুজবা’ও শপিং করে।

রিকশা এসে নুহাশদের শো-রুমের সামনে থামতেই দুজনেই নেমে পড়ে। নুহাশ ভাড়া মিটিয়ে রুজবাকে নিয় শো-রুমের ভেতর যায়। যাওয়ার আগে আবার সকল কর্মচারীদের সাথে দেখা করে যায় ওরা। শো-রুম থেকে বেরিয়ে রুজবা একপাশে দাঁড়ায়। নুহাশ চলে যায় বাইক আনতে। রুজবার থেকে সামান্য কিছুটা দূরত্বেই বাইক রাখা। নুহাশ বাইকে শপিং ব্যাগগুলো রাখছিলো।

রুজবাদের পেছন পেছন দুইটা মেয়ে বের হয় শো-রুম থেকে। তারাও শো-রুমের সামনেই ছিলো। রুজবা হঠাৎ খেয়াল করে একটা মেয়ে নুহাশের দিকে কেমন অন্যরকম দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে। আবার পাশের মেয়েটাকে’ও কিছু একটা দেখাচ্ছে। দুজনেই বেশ হাসাহাসি করছে এই নিয়ে। রুজবা ক্ষানিকটা কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। প্রথম মেয়েটা বলে,

–“দেখ ইয়ার, ছেলেটা কি কিউট না? নাম্বার নেবো?”
–“দিবে?”
–“দিবে না ক্যান? অবশ্যই দিবে, মেয়েরা নিজে নাম্বার নিতে চাইবে আর ছেলেরা দিবে না তা শুনেছিস কখনো? চল কাছে যাই।”
বলেই মেয়ে দুটো এগোয়। নুহাশের পাশে গিয়ে দাঁড়াতেই নুহাশ ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বাইক ঘুরায়। নুহাশ হাবভাবেই বুঝে যায় কিছু বলতে চায় এরা। প্রথম মেয়েটা বলে,

–“আপনি___”
–“ম্যারিড।”
মেয়েটাকে থামিয়েই নুহাশ কথাটা বলে। মেয়ে দুটো একে অপরের দিকে তাকিয়ে ফিক করে হেসে দেয়। ভাবছে নুহাশ মজা করছে। দ্বিতীয় মেয়েটা প্রশ্ন করে,

–”নাম?”
–“কার? বউয়ের? রুজবা রায়হান।”
প্রথম মেয়েটা মুচকি হেসে বলে,
–“আপনি তো বেশ মজার মানুষ, আপনার নাম জিজ্ঞেস করেছে ও।”
–“নুহাশ ফারদিন।”

–“ওয়াও নাইস নেম। আপনার নাম্বার দেওয়া যাবে নুহাশ? বা আপনি চাইলে আমার নাম্বারটাও নিতে পারেন।”
নুহাশ এক পলক মেয়ে দুটোর দিকে তাকিয়ে আবার রুজবার দিকে তাকায়। সব কথা’ই শুনতে পাচ্ছে ও। রুজবার হাত রাগে মুষ্টিবদ্ধ করা। তা দেখে ঠোঁট কামড়ে হাসে নুহাশ।

–“আপনার হাসিটা অস্থির নুহাশ আমি তো___”
–“ওই যে মেয়েটা দেখতে পাচ্ছেন, ও আমার বউ। দেখুন রেগে আছে ও আপনাদের সাথে কথা বলতে দেখে। আমার ঘরে অনেক সুন্দর একটা বউ আছে সিস্টার। সো আমার অন্য মেয়ের নাম্বার লাগবে না।”

কথাটা বলেই নুহাশ বাইক স্টার্ট দিয়ে রুজবার সামনে আসে। রুজবা মেয়েগুলোর দিকে একবার আগুন চোখে তাকিয়ে ফটাফট বাইকে উঠে বসে। নুহাশ বাইক স্টার্ট দেয়। রুজবা নুহাশকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে মেয়েগুলোর দিকে এমন একটা লুক দেয় যাতে ও বোঝাতে চাইছে এই ❝নুহাশ ফারদিন❞ কেবলই ওর। রুজবার কান্ডে নুহাশ মুচকি হাসে। আর মেয়ে দুটো একে অপরের দিকে তাকিয়ে ভাবছে, ছেলেটা সত্যিই ম্যারিড?

পুরো রাস্তায় রুজবা একবারের জন্যও নুহাশের সাথে কথা বলেনি। বাসায় এসেছে পর থেকেও কোনো কথা বলছে না। নুহাশ বেশ বুঝতে পারছে, তার বউ ভালোই চটে আছে। রাতে খেয়ে বিছানায় শুয়ে রুজবার অপেক্ষা করছে নুহাশ। মেয়েটা আসছে না এখনো। পুরো আধ ঘন্টা অপেক্ষা করিয়ে রুজবা ঘরে আসে। দরজা বন্ধ করে বিছানায় গিয়ে নুহাশের দিকে পিঠ করে শুয়ে পড়ে রুজবা। নুহাশ সময় নিয়ে প্রশ্ন করে,

–“টেম্পারেচার কি হাই?”
কোনো জবাব আসে না। নুহাশ জড়িয়ে ধরে পেছন থেকে। রুজবা নিজেকে ছাড়ানোরও কোনো চেষ্টা করে না। নুহাশ একটানে রুজবাকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নেয়। বউটা তার রেগেমেগে লাল টমেটো হয়ে আছে। ইচ্ছে করছে টুক করে চুমু খেতে। কোনো ইচ্ছেই অপূর্ণ রাখতে নেই। তাই নুহাশ চট করে রুজবার ঠোঁটে চুমু দিয়ে বলে,

–“তুমি কি জেলাস?”
রুজবা অভিমানে গাল ফুলিয়ে বলে,
–“কেন?”
–“কথা বলছো না কেন? আমি ইচ্ছে করে কথা বলেছি মেয়েদের সাথে? আমি তোমারই থাকবো, যত যাই হোক তোমাকে ছাড়ছি না আমি। এইটুকু নিশ্চয়তা আমি হান্ড্রেড পার্সেন্ট দিতে পারি।”
রুজবা অভিমানে গাল ফুলিয়ে বাচ্চাদের মতো বলে,

–“ভেবেছি, আপনার নামে একটা বিজ্ঞপ্তি দিবো। তাতে লেখা থাকবে, এই মানুষটাকে কেউ গ্রহণ করবেন না, কেউ তাকাবেন না এই মানুষটার দিকে। এই মানুষটা শুধুমাত্র আমার, একান্তই আমার নিজের। এই মানুষটা ছাড়া আমি অসহায়, একদম অসহায়।”

অনেক সাধনার পরে পর্ব ৪১

রুজবার বাচ্চামো কথা শুনে শব্দ করে হাসে নুহাশ। তাতে আরো অভিমান হয় রুজবার৷ অভিমানে নুহাশের থেকে নিজেকে ছাড়াতে গেলেই নুহাশ রুজবাকে বুকের সাথে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলে,
–“হুম, আমি মানুষটা শুধুই আপনার। আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন।”

অনেক সাধনার পরে পর্ব ৪৩