অনেক সাধনার পরে পর্ব ৪৩

অনেক সাধনার পরে পর্ব ৪৩
অরনিশা সাথী

নদীর স্রোতের মতো সময় তার নিজস্ব গতিতে বয়ে যায়। সময় ধরে রাখার বা তাকে থামিয়ে রাখার মতো সাধ্য আমাদের কারো নেই। সময় তার অপার গতিতে এগিয়ে যায়। তেমনি ভাবে দেখতে দেখতে নুহাশ আর রুজবার বিয়ের চারটে মাস পেরিয়েছে। আগের তূলনায় দুজনের সম্পর্কের উন্নতি হয়েছে বেশ। এর মাঝে প্রায়শই এসেছে নুহাশ। রুজবাকে আর নিজ বাড়িতে নেয়নি।

সন্ধ্যা ছয়টা বাজে এখন। রাত সাড়ে বারোটায় নুহাশ রুজবার ফ্লাইট। সদূর আমেরিকার উদ্দেশ্যে পাড়ি দিবে দুজনে। নুহাশের পরিবারের সকলেই উপস্থিত এখানে৷ রায়হান সাহেবের অনুরোধেই আসা সকলের৷ আদরের মেয়েকে নিজ বাড়ি থেকেই বিদায় দিতে চান তিনি। যদিওবা রুজবার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে নেই নিজের বাবা মা পরিবারকে ছেড়ে ১৩২১৯ কিলোমিটার দূরে যাওয়ার।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

কিন্তু নুহাশ? এই ছেলেকে বোঝাবে কে? অফিসের কাজে তাকে সেখানে পাড়ি জমাতে হবে। কবে দেশে ফিরবে তার কোনো নিশ্চিয়তা নেই। তাই তো সে রুজবাকে সাথে নিয়ে যাবে। ফ্যামিলি ভিসার জন্য নুহাশের মামা এপ্লাই করেছেন, কাগজপত্র সবকিছুর ব্যবস্থা নুহাশের মামা নিজে করেছে। রুজবার ভিসার জন্যই এত দেরী হয়েছে নয়তো নুহাশ তো আরো তিন মাস আগেই চলে যেতো।

রুজবা কাঁদছে বসে বসে। ওর যেতে ইচ্ছে করছে না সবাইকে ছেড়ে। শারমিন বেগম রুজবার লাগেজ গুছিয়ে দিচ্ছে। রুজবার রাগ হচ্ছে নুহাশের উপর। সে তো চাইলে যখন তখন দেশে এসে ঘুরে যেতে পারবে কিন্তু রুজবা কি পারবে কার্ড না হওয়া অব্দি আসতে? এই লোকটা এমন ক্যান? এত এত দিন ও কিভাবে থাকবে সবাইকে ছেড়ে? ছেলেটা বহুত ধুরন্ধর। কিভাবে ওর বাবাকে রাজি করিয়ে দিলো।

রুজবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠলো তিন মাস আগের সেই মূহুর্তগুলো____❝সেদিন ছিলো শুক্রবার। সন্ধ্যার দিকে নুহাশ ওর বাবা-মাকে নিয়ে হাজির হয় রুজবাদের বাড়ি। যদিওবা সবাই উনাদের আসার কথা জানতো, কিন্তু কারণটা জানতো না। শারমিন বেগম রাতের খাবারের জন্য বিশেষ আয়োজন করেছে। হাতে হাতে সাহায্য করেছে রুজবা। সন্ধ্যায় হালকা নাস্তার পর নোমান সাহেব নিজেকে প্রস্তুত করলেন রায়হান সাহেবকে খোলাখুলি ভাবে সব বলার জন্য৷ নোমান সাহেব একবার বিরক্তি ভঙ্গিতে নিজের ছেলের দিকে তাকান৷ কি সুন্দর আয়েসি ভঙ্গিতে বসে আছে বেয়াদবটা। চোখে চোখ মিলতেই নুহাশ ওর বাবাকে ইশারা করে কথা তুলতে। নোমান সাহেব গলা ঝেড়ে নিজেকে প্রস্তুত করে বললো,

–“বেয়াই সাহেব আজ একটা বিশেষ কারণে আমাদের এ বাড়িতে আসা।”
রায়হান সাহেব নড়েচড়ে বসলো। উনি ভাবছেন নোমান সাহেব হয়তো রুজবাকে আনুষ্ঠানিক ভাবে নিজের ঘরে তোলার আবদার নিয়ে এসেছে। কিন্তু উনাকে অবাক করে দিয়ে নোমান সাহেব বলেন,

–“আপনি তো জানেনই নুহাশ আমেরিকায় ওর ছোট মামার কোম্পানিতে বেশ উচ্চপদে আছে। এতদিন ও এখান থেকেই ওর মামার কোম্পানির হয়ে কাজ করেছে। কিন্তু রিসেন্টলি সেখানে কিছু সমস্যা হয়েছে। তাছাড়া নতুন দুইটা প্রোজেক্টের কাজ শুরু করবে এখন নুহাশের সেখানে যাওয়াটা প্রয়োজন।”
–“হ্যাঁ সে যাবে। ও তো যখন তখন যাওয়া আসা করতে পারে।”

নোমান সাহেব দাঁত কিড়মিড়িয়ে নুহাশের দিকে তাকায় এক পলক। তারপর শান্ত স্বরে বলে,
–“সমস্যাটা সেখানেই। ও চাইলে যখন তখন আসতে পারে, কিন্তু এবারের যাওয়াটা অনির্দিষ্ট কালের জন্য৷ ওখানকার কাজ শেষ না হওয়া অব্দি আসতে পারবে না।”
রায়হান সাহেব নড়েচড়ে বসলো আবারো। এবার উনি আন্দাজ করতে পারছে কিছুটা। রায়হান সাহেব শান্ত চোখে তাকিয়ে নুহাশের দিকে। কিছুটা সময় নিয়ে নুহাশকে প্রশ্ন ছুঁড়লো,

–“আনুমানিক কত দিন লাগতে পারে তোমার?”
–“সে বছর খানেক বা তারও বেশি সময় লাগবে। এখনই সিয়র ভাবে বলা যাচ্ছে না। তবে মামা বলেছে হাতে বেশ লম্বা সময় নিয়ে যেতে হবে। কম হলেও দেড় দুই বছর হবে।”

নুহাশের কথায় রায়হান সাহেব এবার পুরোপুরি নিশ্চিত হলো। রান্নাঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে এসব শুনে বুকটা ধক করে উঠে রুজবার। নুহাশ চলে যাবে? এতগুলো দিনের জন্য? রুজবার কষ্ট হচ্ছে, দু’চোখ ভরে উঠলো নোনাজলে৷ এখন থেকেই যেন বুকের ভেতর শূণ্য শূণ্য লাগতে শুরু করছে। মনে হচ্ছে খুব কাছের কেউ দূরে চলে যাবে। হ্যাঁ কাছেরই তো। নুহাশ তো ওর কাছের মানুষ, এখন বাবা-মায়ের পরে সবথেকে বেশি কাছের তো নুহাশ’ই আছে। টুপ করে জল গড়িয়ে পড়লো গাল বেয়ে। অতি দ্রুত সে পানি মুছেও নিলো সবার আড়ালে। নোমান সাহেব বললো,

–“তাই বলছিলাম আপনার আপত্তি না থাকলে রুজবা মা’কেও নুহাশের সাথে পাঠাতে চাচ্ছি। অনেকটা সময়ের ব্যাপার, বুঝেনই তো। তাছাড়া ওদের নতুন বিয়ে হয়েছে এখনই যদি সম্পর্কে এতটা দূরত্ব চলে আসে তাহলে___”
নোমান সাহেব আর কথা পুরো করলো না। নুহাশ এবার নিজ থেকে বললো,

–“আপনি চিন্তা করবেন না বাবা, রুজবাকে ওখানকার ভার্সিটিতে এডমিশন করিয়ে দিবো। তাছাড়া এবরোড গিয়ে পড়াশোনা করবে এটা তো ভালো ওর জন্যই তাই না? প্রত্যেকেরই তো ইচ্ছে থাকে এরকম।”
রায়হান সাহেব দীর্ঘশ্বাস ফেললো। উনার ইচ্ছে ছিলো এরকম। মেয়েকে পাঠাতেও চেয়েছিলেন। কিন্তু রুজবা রাজি হয়নি। বাবা-মা ছেড়ে কোত্থাও যাবে না সে।

এবার যেন একটু আশার আলো দেখতে পেলেন, মেয়ের জামাই সাথে থাকলে আর মেয়েরও আপত্তি থাকবে না নিশ্চয়ই, ওখানে একা থাকতে হবে না নুহাশ তো থাকবেই। কিন্তু রুজবা কি রাজি হবে? দুম করেই রায়হান সাহেব দোটানায় পড়ে গেলেন। অনুমতি দিবেন কি দিবেন না? শেষ পর্যন্ত ভাবলেন না রুজবাকে কাছ ছাড়া করবেন না, মেয়েরও ইচ্ছে নেই আগেপরের আর উনিও আদরের মেয়েকে এতদূর পাঠিয়ে শান্তি পাবেন না যতই নুহাশ সাথে থাকুক, কাছ থেকে মেয়ে দেখতে পাবে না, ছুঁতে পাবে না৷ রায়হান সাহেব স্বাভাবিক স্বরে বলে,

–“মেয়েটাকে এত দূরে পাঠিয়ে আমি শান্তিতে দু দন্ড বসতে পারবো না বেয়াই। এতদূর না যাওয়া’ই কি ভালো না? নুহাশ তো যখন তখন আসতে পারবে, মাঝে মধ্যে সময় সুযোগ পেলে এসে ঘুরে যাবে।”
নোমান সাহেব কিছু বলার জন্য মুখ খোলার আগেই নুহাশ শান্ত স্বরে বলে,
–“আমি রুজবাকে সাথে নিয়ে যেতে চাচ্ছি বাবা।”

মেয়ের জামাই সরাসরি এমন প্রস্তাব ফেলায় রায়হান সাহেব আর দ্বিরুক্তি করতে পারে না। ভাবনা চিন্তা শেষে অনুমতি দেন উনি। আর তাতেই বিশ্ব জয়ের হাসি ফুঁটে নুহাশের ঠোঁটে। ওদিকে রান্নাঘরের দরজায় পিঠ ঠেকিয়ে পরপর শ্বাস নেয় রুজবা। ও না নিজে যেতে চাইছে আর না নুহাশকে কাছ ছাড়া করতে ইচ্ছে করছে। বিশেষ করে নুহাশকে তো একা ছাড়তেই চাইছে না। কারণ লিয়া আছে যে ওখানে।❞
আদিরার ডাকে ধ্যান ভাঙে রুজবার। তিনমাস আগের স্মৃতি থেকে বেরিয়ে আসে। আদিরা রুজবার কাঁধে হাত রেখে বলে,

–“কি ভাবছিস তখন থেকে?”
রুজবা কাঁদোকাঁদো স্বরে বললো,
–“আমার যেতে ইচ্ছে করছে না ভাবী, আমি যাবো না। তোমার দেবরকে বোঝাও না।”
–“লাস্ট মোমেন্টে এসে এসব কেউ বলে? অনেকগুলো দিনের ব্যাপার রুজবা। পারবি এতদিন আমার দেবরকে ছাড়া থাকতে? কষ্ট হবে না?”

রুজবা চুপ হয়ে গেলো। এর জবাবে কি বলবে জানা নেই ওর। জান্নাত ফারিন আদিরা তিনজনেই ওর সাথে নানা টপিকে কথা বলে মন খারাপটা দূর করতে চাইছে। দেখা যাক কতটা সফল হয় ওরা।

দশটা নাগাদ এয়ারপোর্টে এসে পৌছায় রুজবা ওরা। সাথে নুহাশ আর রুজবা দের দুই পরিবারের সকলেই আছে। কিয়ান আর ফারিনও এসেছে ওদের ছাড়তে৷ জান্নাত আর রিয়ান আসেনি হঠাৎ করেই রিজার ভীষণ জ্বর উঠে যায় সেজন্য। গাড়ি থেকে নেমে বাবা-মাকে ধরে আরেক দফা কান্নায় ভেঙে পড়ে রুজবা। ছোট দুই ভাই-বোনকে জড়িয়ে কাঁদছে। চোখের পানি যেন থামছেই না।

এতটা লম্বা সময়ের জন্য এই প্রথম কোথাও যাচ্ছে রুজবা। কি করে থাকবে আব্বু আর মাকে না দেখে? কিভাবে দিন কাটবে রুপশার সাথে ঝগড়া না করে? বিকেল হলেই বাজার থেকে ঝালমুড়ি ফুচকা আইসক্রিম চকলেট এসব কাকে এনে দিবে রাফাত? এসব ভাবতেই ভিতরটা ঝলসে যাচ্ছে ওর। ফারিনকে জড়িয়ে ধরেও কাঁদে। কারণে অকারণে আর দুজনের আড্ডা দেওয়া হবে না একসাথে বসে। হাসি ঠাট্টা করা হবে না। একসাথে ঘুরতে যাওয়া হবে না লম্বা সময়ের জন্য৷ শ্বশুর শাশুড়ী, আদিরা নিবির সকলের থেকে বিদায় নেয় ওরা৷ রায়হান সাহেব নুহাশের পিঠে হাত বুলিয়ে বলে,

–“আমার মেয়েটাকে দেখে রেখো।”
–“ও বাড়ি ছেড়ে কখনো দুদিনের বেশি থাকেনি নুহাশ। ওখানে একা একা ভালো লাগবে না ওর। একটু বেশি সময় দিও ওকে। মন খারাপ করতে দিও না।”
কথাটা বলেই শারমিন বেগম কাঁদতে শুরু করে। নুহাশ আস্বস্ত করে উনাদের দুজনকে। শাহানা বেগম রুজবার মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,

–“সাবধানে থাকিস মা।”
নুহাশ আর রুজবা কিয়ানের সামনে দাঁড়াতেই কিয়ান মলিন মুখে বলে,
–“সাবধানে যাস আর পৌছে অবশ্যই ফোন করবি।”
নুহাশ জরিয়ে ধরে কিয়ানকে। কিয়ান নুহাশকে ছেড়ে দিয়ে বলে,
–“দুজনে যাচ্ছিস, তিন/চার জন হয়ে ফিরে আসিস।”

অনেক সাধনার পরে পর্ব ৪২

এই মূহুর্তেও কিয়ানের কথা শুনে ছোটরা সবাই ফিক করে হেসে দেয়৷ শুধু ওদের বাবা মায়েরা শব্দ বিহীন হাসে। কান্নারত রুজবাও ফিক করে হেসে দেয় কিয়ানের দুষ্টুমিতে। আবারো একে একে সবার থেকে বিদায় নিয়ে নিজেদের লাগেজগুলো নিয়ে এয়ারপোর্টের ভেতর চলে যায় দুজনে। বেশ কয়েক জোড়া চোখ অশ্রুসিক্ত নয়নে নিজেদের অতি কাছের দুজন মানুষের চলে যাওয়া দেখছে দাঁড়িয়ে। রুজবা নুহাশ চোখের আড়াল হতেই চোখের কোনে জমা পানি মুছেন শারমিন বেগম আর রায়হান সাহেব। তারপর নিজেরাও গাড়িতে গিয়ে বসেন বাড়ি ফেরার উদ্দেশ্যে।

অনেক সাধনার পরে পর্ব ৪৪