অনেক সাধনার পরে পর্ব ৪৪

অনেক সাধনার পরে পর্ব ৪৪
অরনিশা সাথী

১৩২১৯ কিলোমিটার পাড় হয়ে লম্বা একটা জার্নি শেষে আমেরিকার এয়ারপোর্টে এসে পৌঁছেছে নুহাশ আর রুজবা। প্রায় একদিন সময় লেগেছে ওদের। নুহাশের ছোট মামা আগে থেকেই গাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছিলো। নুহাশের যেহেতু ড্রাইভার চেনা তাই আর বেশি বেগ পেতে হয়নি গাড়ি খুঁজতে।

নিজেদের সব লাগেজ টাগেজ নিয়ে গাড়িতে উঠে বসে ওরা। আমেরিকায় পা রাখার সাথে সাথেই রুজবার বুকটা হুঁ হুঁ করে কেঁদে উঠে। অনেক অনেক দূরে এসে পড়েছে এখন। চাইলেই হুটহাট পরিবারকে ছুঁয়ে দেখতে পারবে না। তাদের সাথে অবসরে একসাথে বসে গল্প করা হবে না। নুহাশ রুজবার মনের অবস্থা বুঝতে পেরে একপাশ থেকে জড়িয়ে ধরে। মাথায় চুমু দিয়ে বলে,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

–“বাসার কথা মনে হচ্ছে?”
প্রশ্নটা করতেই রুজবা নুহাশের বুকে মুখ গুজে ওর শার্ট খামচে ধরে ক্ষানিকটা শব্দ করে কেঁদে উঠে। নুহাশ আলগোছে রুজবার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকে। নুহাশ নরম স্বরে বলে,
–“বাসায় গিয়ে ফ্রেস হওয়ার পর সবার সাথে কথা বলিয়ে দেবো কেমন?”
রুজবা নাক টেনে বলে,

–“এখনই কথা বলবো আমি।”
নুহাশের মামার যিনি ড্রাইভার সে বাঙালী। তার নাম হাসান। হাসানকে মূলত নুহাশের জন্যই রাখা হয়েছিলো। নুহাশের সাথে বেশ সখ্যতা উনার। নুহাশ বললো,
–“হাসান ভাই? একটা সিম কিনে রাখতে বলেছিলাম, কিনেছেন?”
হাসান একগাল হেসে বললো,
–“হ্যাঁ ভাই, আছে দেবো?”

নুহাশ সম্মতি জানাতেই হাসান নুহাশের জন্য কিনে রাখা সিমটা এগিয়ে দিলো। নুহাশ নিজের ফোনে সিমটা কানেক্ট করে রায়হান সাহেবের নাম্বারে ফোন দেয়। এখানে যেহেতু এখন রাত সাড়ে এগারোটার কাছাকাছি সে হিসেবে বাংলাদেশে এখন দুপুর সাড়ে বারোটা বাজে। দু’বার রিং হতেই রায়হান সাহেব ফোন রিসিভ করে৷ নুহাশ প্রথমে সালাম দিয়ে ভালোমন্দ জিজ্ঞেস করে।

তারপর রুজবা’র কাছে ফোন দিতেই ও বাবার কন্ঠ পেয়ে আবারো কেঁদে উঠে। রায়হান সাহেব মৃদু হেসে মেয়েকে বোঝাতে থাকেন। মা, আব্বু, ভাই, বোন সকলের সাথে কথা বলে রুজবা এখন কিছুটা স্বাভাবিক হয়েছে। এই ফাঁকে নুহাশ নিজের বাড়িতেও ফোন করে জানিয়ে দেয় ওরা পৌঁছেছে ঠিকঠাক মতো, এখন গাড়িতে আছে বাসায় যাচ্ছে। রুজবা’ও কথা বলে সকলের সাথে। সবার সাথে কথা বলে এবার রুজবার বেশ হালকা লাগছে।

নুহাশের মামা নুহাশ আর রুজবার জন্য আলাদা ফ্ল্যাটা ভাড়া করে রেখেছিলেন আগে থেকেই। এখানে আসার আগেই নুহাশ শর্ত জুড়ে দিয়েছিলো এখানে আসলে নুহাশ আলাদা বাসায় উঠবে৷ নুহাশের মামা আর আপত্তি জানাননি। কারণ তিনি লিয়ার কর্মকান্ডের কথা সবটাই জানতেন। তাই নিজের বাড়ি থেকে আধ ঘন্টার দূরত্বে নুহাশের জন্য ফ্ল্যাট রাখেন।

হাসান নুহাশকে ফ্ল্যাটের চাবি বুঝিয়ে দিয়ে চলে যায়। ব্যাগপত্র নিয়ে নুহাশ রুজবা দুজনেই ভেতরে ঢুকে। লং জার্নির ফলে দুজনেই বেশ ক্লান্ত। দুজনে দুই ওয়াশরুমে ঢুকে পড়ে লম্বা শাওয়ার নিতে। শাওয়ারের পর যদি ক্লান্তি ভাবটা কমে।

–“জাস্ট একটা প্রশ্ন করবো, হ্যাঁ বা না এক কথায় উত্তর দিবে।”
নিদ্রা ফোন থেকে মনোযোগ সরিয়ে বলে,
–“কি প্রশ্ন?”
–“বিয়ে করবে কি করবে না?”

জারাফের প্রশ্নে ডোন্ট কেয়ার ভাব নেয় নিদ্রা। পালটা প্রশ্ন ছুঁড়ে,
–“আমার হাবভাবে কি মনে হচ্ছে তোমার? কিছু কি বুঝতে পারছো না তুমি?”
–“কে ছেলেটা? কতদিনের সম্পর্ক?”
–“পাঁচ মাস।”
প্রচন্ড রেগে যায় জারাফ। ক্ষিপ্ত গলায় প্রশ্ন ছুঁড়ে,

–“হবু বরের সামনে বসে বয়ফ্রেন্ডের কথা বলছো? লজ্জা করছে না তোমার?”
–“তোমার থেকেই তো শিখেছি।”
–“নিদ্রা___”
–“ডোন্ট শাউট জারাফ। আমার সাথে একদম গলাবাজি করবে না। আমি আগেও একবার বলেছি এখন আবার বলছি আমি রুজবা না।”

–“হ্যাঁ সে তো আমিও জানি তুমি রুজবা না। রুজবা কখনো কষ্ট দেওয়ার কথা চিন্তাতেও আনেনি, একটু ভালোবাসার জন্য পেছন পেছন ঘুরেছে মেয়েটা। আমাকে পাওয়ার জন্য নুহাশের সাথে ওর বিয়ে ভেঙেছে নুহাশের পায়ে পড়েছে। আর সেখানে তোমাকে আমি বিয়ে করতে চাচ্ছি আর তুমি আমায় ঘুরাচ্ছো তোমার পেছন পেছন?”
নিদ্রা বেশ শান্ত স্বরে বললো,

–“আর সে মেয়েটাকে তুমি কিভাবে ঠকালে জারাফ? কিভাবে পায়ে ঠেলে দূরে সরালে? একটুও মায়া হয়নি? এতদিনের সম্পর্কে একটুও ভালোবাসোনি ওকে? পাগল ছিলো তো তোমার জন্য৷ শুধু একটুখানি ভালোবাসা’ই তো চেয়েছিলো মেয়েটা। বিনিময়ে কি দিয়েছো ওকে?”

জারাফ এবার একেবারেই নিশ্চুপ হয়ে গেলো। সত্যি ও এখন বুঝতে পারে। রুজবাকে যে ভীষণ ভাবে ঠকিয়েছে। একটুখানি ভালোবাসা চেয়েছিলো তার প্রতিদানে দু’চোখ ভরে অশ্রু দিয়েছে। ও নিজেও তো ভালোবেসেছিলো মেয়েটাকে, এখনো ভালোবাসা আছে ওর জন্য। কিন্তু মাঝে কি যেন হয়ে গেলো ওর, টাকা আর ক্যারিয়ারের পেছনে ছুঁটতে গিয়ে নিজের ভুলে রুজবাকে হারিয়ে ফেললো। জারাফ বুকে হাত দিয়ে বলতে পারবে রুজবা ওকে যতটা ভালোবেসেছে অন্যকেউ তার ধারের কাছেও আসতে পারবে না। নিজের সমস্ত প্রতারণার কথা মনে পড়ে যায় তার। আজকাল যে আয়নার সামনেও দাঁড়াতে পারে না ও। নিজের চোখের সাথেই চোখ মেলাতে পারে না। নিদ্রা ফের বলে,

–“আমাকে মই বানিয়ে সফলতার উচ্চ শিখরে পৌঁছাতে চেয়েছিলে না? সেটা তো হয়ে গেছে। এত বড় কোম্পানির ম্যানেজার পদে আছো। পরিবার সচ্ছল হয়েছে। তোমার ফ্যামিলির মতো আরো দুই চারটা ফ্যামিলি চালানোর ক্ষমতা তোমার এখন আছে।”
–“কি বলতে চাও তুমি?”

–“আমাকে তো কখনো ভালোবাসোনি ভালোবেসেছো আমার বাবার টাকাকে। এখন তো স্যাটেল তুমি। তাই বলছি ভুলে যাও আমাকে। চিন্তা করো না তোমার চাকরি হারাবে না। চাকরি থাকবে, কিন্তু আমি তোমায় বিয়ে করছি না। পাঁচমাস ধরে যার সাথে সম্পর্কে আছি আমি ওকেই বিয়ে করবো। বাবাকেও জানানো হয়ে গেছে। বাবা রাজি, যদিও প্রথমে মত দেয়নি কিন্তু একমাত্র মেয়ে তো তাই মেনে নিয়েছে। তুমিও তোমার মায়ের পছন্দ মতো কোনো মেয়েকে বিয়ে করে নিও। আজ সব ক্লিয়ার করে দিলাম আই হোপ নেক্সট টাইম বিয়ে প্রসঙ্গে কোনো কথা আর তুলবে না তুমি ”

কথাটা বলেই চলে যেতে নেয় নিদ্রা। আবার থেমে গিয়ে বলে,
–“এতদিন তোমাকে ঘুরানোর ইচ্ছে আমার ছিলো না জারাফ। তবে তোমাকে এটা বোঝানোর ছিলো যে কারো কাছ থেকে ঠকলে, প্রতারিত হলে কেমন লাগে৷ তুমি যখন রুজবাকে ঠকিয়েছো তখন ওর কেমন লেগেছে কিসবের মধ্য দিয়ে ও গেছে জাস্ট সেইটুকু বোঝানোর জন্যই এতদিন কিছু ক্লিয়ার করি নি৷ আজ ক্লিয়ার করে দিলাম, নাও বাই।”
কথাগুলো বলে আর এক মূহুর্ত দাঁড়ায় না নিদ্রা। জারাফ ছাদে রাখা মাটির টব’টাতে লাথি মেরে উলটে ফেলে দেয়৷ ফলে সেটা ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে পড়ে রয়৷ দু’হাতে নিজের মাথার চুল খামচে ধরে ধপ করে বসে পরে ফ্লোরে।

লাল কামিজ পড়ে ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে চুল সামনে নিয়ে চুল মুছছে রুজবা। গায়ে উড়না নেই, বিছানার এক কোনে ফেলে রাখা। সেসময়েই বেরিয়ে আসে নুহাশ পড়নে টাওজার আর আর গলায় ঝুলানো টাওয়াল। টাওয়ালের এক মাথা দিয়ে চুল মুছতে মুছতেই বেরিয়েছে ও।

আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে রুজবাকে চুল মুছতে দেখে সেদিকে এগিয়ে যায় ও। রুজবা তখনো খেয়াল করেনি। ঠান্ডা দুটো হাত আচমকা কামিজের ভেতর দিয়ে পেট পেচিয়ে ধরতেই মৃদু কেঁপে উঠে ও। চমকে পেছন ফিরে তাকায়৷ নুহাশ’কে দেখে দ্রুত উড়নার দিকে এগিয়ে গেলেই নুহাশ হাত ধরে টেনে কাছে নিয়ে আসে। দুই কাঁধে হাত রেখে রুজবার মুখের দিকে ঝুঁকে বলে,

–“কি লুকাবে আমার থেকে? কোনো কিছু কি আমার অ-দেখা আছে?”
সরাসরি নুহাশের এমন কথায় লজ্জায় নুইয়ে যায় রুজবা। নুহাশ মৃদু হাসে। রুজবার নাকের ডগায় চুমু খেয়ে বলে,
–“এখন থেকে তুমি চাইলে বাসায়, আমার সামনে ওয়েস্টার্ন পড়েও থাকতে পারো যেমন, টি-শার্ট, শর্ট প্যান্ট, থ্রি কোয়াটার, মিনি স্কার্ট, শার্ট জিন্স আরো যা যা মনে চায় তোমার৷ আমার কোনো আপত্তি নেই। তবে হ্যাঁ ওয়েস্টার্ন পড়ে বাইরে বেরোনো যাবে না৷ আমি চাই না আমার বউয়ের অন্যরুপ আমি ❝নুহাশ ফারদিন❞ ব্যাতিত অন্য পুরুষ দেখুক।”

রুজবা আমতা আমতা করে বলে,
–“আপনি যেরকম বলবেন সেরকমই হবে।”
–“আচ্ছা তাহলে কালকেই ওয়েস্টার্ন নিয়ে আসবো। আমার বউকে সব রুপে দেখার অধিকারই আমার আছে রাইট? আমি সবরকম ভাবে দেখতে চাই তোমাকে।”
কথাগুলো রুজবার কানের কাছে মুখ নিয়ে বললো। রুজবা চুপচাপ দাঁড়িয়ে রয়৷ হঠাৎ কলিংবেল বাজতেই রুজবা নুহাশের থেকে দূরে সরে দাঁড়ায়৷ নুহাশ টি-শার্ট গায়ে জড়িয়ে বলে,

–“তুমি এখানেই দাঁড়াও আমি দেখছি।”
চলে যায় নুহাশ। রুজবা চুল আঁচড়ে গায়ে উড়না জড়িয়ে বিছানায় বসে পা দুলাতে শুরু করে। মিনিট দুয়েক বাদেই নুহাশ বাইরে থেকে ডাকে রুজবাকে৷ হন্তদন্ত হয়ে ছুঁটে যায় রুজবা। নুহাশ ডাইনিংয়ে খাবার সাজাচ্ছে। রুজবা ভ্রু কুঁচকে বলে,

–“এতসব খাবার?”
–“হাসান ভাই দিয়ে গেলো, মামি পাঠিয়েছে৷ মামি ফোন করে বললো, আজ রেস্ট নিয়ে কাল একবার তোমায় নিয়ে যেতে ও বাসায়।”

মাঝরাতে ছাদে বসে চন্দ্রবিলাশ করছে কিয়ান আর ফারিন। আকাশে রুপালি চাঁদ উঠেছে আজ। দেখতে ইয়া বড় গোলাকার থালার মতো৷ ছাদে রাখা বড় দোলনায় বসে দুজনে। কিয়ানের কাঁধে ফারিনের মাথা। দুজনেই দোল খাচ্ছে দোলনায়। ফারিনের তো বেশ লাগছে। কিয়ানেরও অনেক আগে থেকেই ইচ্ছে ছিলো এরকম একটা রাতে ফারিনের সাথে বসে আকাশের চাঁদ দেখার, গায়ে চাঁদের আলো মাখার। নিরবতা ভেঙে ফারিন বলে,

–“আমাদের একটা বেবি হলেই বাবা মেনে নিবে আমাদের তাই না কিয়ান?”
ফারিনের এমন প্রশ্নে কিয়ান চমকে তাকায়। পালটা প্রশ্ন ছুঁড়ে,
–“কেন বলছো এসব?”
ফারিন কাঁদোকাঁদো গলায় বলে,

–“দেখো না, আজ ফোন দিলাম বাবাকে। বাবা আমার গলার আওয়াজ পেয়েই ফোন কেটে দিলো। মা’কে ফোন দিয়েছিলাম মা কথা বলেছে তবে সেটা না বলার মতোই। টিভি সিরিয়ালে তো দেখায় নাতি নাতনীর মুখ দেখলে দুই পরিবারের সবাই মেনে নেয়। চলো না আমরা বেবি প্ল্যান করি। আমার যে কষ্ট হচ্ছে এভাবে থাকতে।”

অনেক সাধনার পরে পর্ব ৪৩

কিয়ান ফারিনকে বুকে চেপে ধরে ওর মাথায় হাত বুলাচ্ছে। ফারিন কিয়ানের শার্ট খামচে ধরে নিঃশব্দে কাঁদছে। যদিও এ কান্নার শব্দ হচ্ছে না কিন্তু কিয়ান বেশ বুঝতে পারছে ওর বউটা কাঁদছে। মনে মনে কিয়ান ঠিক করলো কালকেই একবার ফারিনকে ওর বাবার সামনে গিয়ে দাঁড়াবে। তারপর কিয়ান’ও দেখবে আসাদ সাহেব কি করে ওদের মেনে না নেয়।

অনেক সাধনার পরে পর্ব ৪৫