নীলপদ্ম গেঁথে রেখেছি তোর নামে পর্ব ৩৭

নীলপদ্ম গেঁথে রেখেছি তোর নামে পর্ব ৩৭
ইফা আমহৃদ

“আরুপাখি, আজ নিজের ইচ্ছায় তুই আমার কাছে এসেছিস। আমার গলা জড়িয়ে ধরেছিস। তুই কি সত্যি আমার আরুপাখি?” দুহাত আরুর পিঠে রেখে অপলক দৃষ্টি নিবদ্ধ করে প্রেমময় কণ্ঠে বলে অপূর্ব। আরু আজ লজ্জা পায় না, নিজের দৃষ্টি অপূর্বর চোখে নিবদ্ধ করে বলে, “এই যে আংটি পরিয়ে আপনি আমাকে জীবন সঙ্গিনী হিসেবে বেছে নিয়েছেন। তাই তীব্র অধিকার বোধ থেকে আপনার সান্নিধ্যে এসেছি।”

“এই কথাটা যাতে আগামী শুক্রবার পর্যন্ত তোর মুখ শুনতে পারি। তখন যাতে তোর মাথা নতজানু হয়ে না যায়।”
“শুক্রবার কী?”
“আনুষ্ঠানিকভাবে তুই চিরতরে অপূর্ব আহসানের হয়ে যাবি।” অপূর্ব ও আরুর এই মধুমাখা মুহুর্তে খলনায়িকা হয়ে প্রবেশ ঘটে তুর ও শেফালীর। দুই মানবের আগমনে তুই তৃষ্ণার্ত কপোত কপোতী বিচ্ছিন্ন হলো। অপূর্ব উঠে পোশাক ঠিক করতে করতে নিজেকে স্বাভাবিক করার প্রয়াস করে বলে, “তোরা এখানে কেন এলি? ডাকলেই তো পারতি।”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

“আমাদের আরুর সাথে কথা আছে। বাবা আপনাকে ডাকছে, কিছুক্ষণের ভেতরে আমরা বাড়ির দিকে যাত্রা করব।” নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে কথাটা বলে তুর হেলে পড়ে শেফালীর কাঁধে। অপূর্ব দুকদম এগিয়ে বোনদের আড়ালে আরুর হাতে বাটন ফোনটা গুঁজে দেয়। আরু খানিক প্রশ্ন করে, “কী এটা?”

“প্রেম বার্তা পাঠানোর মাধ্যম। সবসময় সাথে সাথে রাখবি, কল করলে যাতে সাথে সাথে পাই। কলে কথা বলতে না পারলে মেসেজ পাঠাবি।” অপূর্ব চঞ্চল পায়ে বেরিয়ে গেল আরুর ঘর থেকে। অপূর্বর অনুপস্থিতে আরুকে ঝোঁকে ধরল দুই বোন।

আহসান বাড়িতে লেগেছে বিয়ের আমেজ। নারীরা অপূর্বর জন্য হলুদ মেহেদী বাটছে পাটায়। অপূর্বর পরনে লুঙ্গি ও সেন্টো গেঞ্জি, গলাতে লাল গামছা ঝুলানো। অপূর্ব ঘরের ভেতরে লজ্জানত হয়ে আছে, তাকে পচাচ্ছে তিয়াস। তিস্তা ও সুজন গতকাল রাতে ফিরেছে। বৈঠকখানায় বোনদের আনন্দের ঢেউ উচ্ছে পড়ছে। তখনই পান, সুপারি ও মিষ্টি নিয়ে কালাচাঁন ও তার মা সুন্দরী উপস্থিত হয় আহসান বাড়িতে। আনন্দপূর্ণ লগ্নে কালাচাঁনের আগমনে দফায় দফায় বিরক্ত হয় সদস্যরা। তিস্তা সবাইকে টপকে বলে, “আপনারা আমাদের বাড়িতে কী করছেন? এখানে আমার ভাইয়ের সাথে আরুর বিয়ে হচ্ছে, এই মুহুর্তে আপনারা কোনো ঝামেলা করবেন না।”

“আমরা বিয়েতে ঝামেলা করতে আসিনি, চেয়ারম্যান সাহেবের সাথে দেখা করতে এসেছি। যদি ওনাকে একটু ডেকে দিতেন।” সুন্দরীর কথায় নিরুপায় হয়ে তিস্তা তার বাবা চাচা ও দাদাকে ডেকে নিয়ে আসে। আনন্দের মাঝে কালাচাঁনদের আপ্যায়নে ত্রুটি রাখা হয় না। সুন্দরী নিজ থেকে ছেলের বিয়ের প্রস্তাব রাখে, “আমার কালাচাঁন আগের থেকে ভালো হয়ে গেছে। এখন তো চাকরি করে কোম্পানিতে। আপনার বাড়ির মেয়ে শেফালীকে সেদিন আমার ভালো লেগেছে। তাই কালাচাঁনের সাথে শেফালীর বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এসেছি।”

“অসম্ভব। এমন একটা ছেলের সাথে আমি আমার মেয়েকে বিয়ে দিয়ে ওর জীবনটা ন/ষ্ট করতে পারব না। আমি শেফালীর জন্য রাজপুত্র খুঁজে দিয়ে আসবো।” কথাটা বলে শাহিনুজ্জামান বসা থেকে উঠে দাঁড়ায়। শেফালীর বিয়ের ব্যাপারে উপস্থিত সবাই আপত্তি জানায়। অপূর্ব আগ বাড়িয়ে বলে, “বাবা, চাচা, দাদু। আপনাদের সাথে আমার জরুরি কথা আছে। যদি সময় করে আমার কথাটা শুনতেন।”

“আমিও যেতে চাই।” তিয়াস বলে। বড় ছেলের মতামতকে প্রাধান্য দিয়ে সাতজন মানুষ চলে গেল আলাদা এক কক্ষে। কিছুক্ষণে তাদের আলোচনা সেরে বের হয়ে অনিতাকে উদ্দেশ্য করে বলে, “ওনাদের মিষ্টি দেওয়ার ব্যবস্থা করো। আমি কালাচাঁনের সাথে শেফালীর বিয়েটা মেনে নিয়েছি।”

একমাত্র মেয়ের জীবনের এমন একটি সিদ্ধান্ত শুনে ছুটে এলো মণি। করুন গলায় বলে, “ভাইজান, আমি সবসময় আপনার মতামতকে গুরুত্ব দিয়েছি। আমার বিশ্বাস আপনি কখনো ভুল করতে পারেননা। কিন্তু তাই বলে, আপনি আজ আমার মেয়ের সাথে এই লম্পট ছেলেটার বিয়ে ঠিক করছেন।”

“আমি ভেবেচিন্তে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আমাকে তোমরা কম বিশ্বাস করোনা, আরেকবার বিশ্বাস করে দেখো। শেফালীর জন্য আমরা কালাচাঁনকে উত্তম বলে মনে করছি।” মোতাহার আহসান মণিকে উদ্দেশ্য করে কথাটা বললে মণি রাগান্বিত হয়ে বৈঠকখানা ত্যাগ করে। শাহিনুজ্জামান স্ত্রীকে বুঝাতে ছুটে গেল। সময় গড়িয়ে গেলেও, পরিবেশটা ছিমছাম থেকে যায়। খানিকক্ষণ পর মণি ফিরে এসে মেয়ের মাথায় হাত রেখে জানায়, “এই বিয়েতে আমি মত দিলাম। তবে আমার মেয়ের ওপর কোনো নির্যাতন হলে সাথে সাথে শেফালীকে নিয়ে আসবো।”

“ঠিক আছে।”
সময় গড়িয়ে যাচ্ছে। এখন আকাশ স্বচ্ছ, বর্ষকাল বলে লহমায় লহমায় বৃষ্টিরা নৃত্য পরিবেশন করে উঠানে। আকাশ মেঘের ভেলা সাজিয়ে ফেলেছে দেখে সুজন ছুটে এলো বাইরে থেকে। বাইকে তাড়া দিয়ে বলে, “চাচি বৃষ্টি আসবে, তার আগে অপূর্ব ভাইয়ের হলুদ শেষ করতে হবে। একবার বৃষ্টি শুরু হলে কখন থামবে তার ঠিক নেই।”

সুজনের কথা শুনে মনে পড়ল, অপূর্বর হলুদের কাজ এখনো শেষ হয়নি। বাড়ির প্রতিটি সদস্যকে নিয়ে চলে গেল সাজানো স্টেজে। প্রথম হলুদ ছোঁয়াল মোতাহার আহসান ও অনিতা। তারপরে এক এক করে সবাই ছোঁয়াল। প্রতিটি দৃশ্য ক্যামেরাবন্দী করতে স্টুডিও থেকে লোক ভাড়ায় আনা হয়েছে। গ্ৰাম্য গানের মাধ্যমে অপূর্বর গোসলের কাজ শেষ হলে সুজন তাকে কাঁধে তুলে কলতলায় নিয়ে গেল। বিয়ের হলুদের ছোঁয়ায় অপূর্বর সুশ্রী দ্বিগুণ হয়ে উঠছে ক্রমশ। আরু প্রথম সাক্ষাতে অপূর্বকে গহীন চোখে দেখেছিল, আজ অপলক চেয়ে থাকত।

সিঁথি, সাথি, সাবিত ও মেঘলা চাচাতো ভাই বোন ছাড়াও বিয়েতে অংশ নিয়েছে আরুর বিবাহিত বান্ধুবী মিতু ও তন্বী। উপস্থিত সবাই আরুর গায়ে হলুদ ছুঁয়েছে। সবাই একসাথে পানি দিয়ে গোসলের নিয়ম সমাপ্ত করে। হলুদের পর ঘরে পৌঁছানোর আগ পর্যন্ত কাউকে না কাউকে কোলে নিতে হয়। কিন্তু তেমন কাউকে চোখে পড়ছে না পারুলের। ইমদাদ হোসেন মেয়েকে হলুদ দিয়ে রান্নার দিকে গেছেন। পারুলের তখন মনে পড়ল মিহিরের কথা। ভাসুরের ঘরের দিকে পা ফেলতেই নজরে এলো ট্রাভেলিং ব্যাগ নিয়ে বের হয়েছে শিরীনেরা। পারুল তাকে পরিপাটি বেশে দেখে প্রশ্ন করে, “আপা ব্যাগ পত্র নিয়ে কোথায় যাচ্ছেন?”

“আমরা শহরে ফিরে যাচ্ছি। কল এসেছে, জরুরি আমাদের ঢাকাতে যেতে হবে।” শিরীনের একরোখা জবাব।
“আরুর বিয়ের দাওয়াত খেয়ে যাবেন না?”
“না। আমরা আরুর বিয়ে খেতে আসিনি। আমরা যেই কাজে এসেছিলাম, তা যেহুতু হচ্ছে না। তাই ফিরে যাচ্ছি।” বলে রওনা হলেন শিরীন। পারুল তার পথ আটকে দিয়ে অয়নকে পাঠাল ইমদাদ হোসেনকে ডেকে আনতে। বোনের ফেরার কথা শুনে উল্কার বেগে হাজির ইমদাদ। বোনের হাত থেকে ট্রাভেলিং ব্যাগ নিয়ে বলে, “মাথা খারাপ হয়ে গেছে তোদের? কাল আরুর বিয়ে আর তোরা আজ চলে যাবি?”

“মাথা আমার ঠিকই আছে, আপনার খারাপ হয়েছে। আরুকে আমি মিহিরের জন্য পছন্দ করে রেখেছি আর আপনি অপূর্বর সাথে বিয়ে দিচ্ছেন। এরপরেও আমার এখানে থাকা শোভা পায়?” বলতে বলতে শিরীনের চোখে ধরা দিল পানি। উপস্থিত সবাই থমকে গেছে। ইমদাদ নিজেকে সামলে বলে, “তুই কখনো আমাকে বলিস নি, আরুকে মিহিরের জন্য পছন্দ করেছিস।”

“কাল সকালে আমি আপনাকে আকারে ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দিয়েছি, এরপরেও বোঝানো বাকি থাকে?”
আরু পিঁড়ির উপর থেকে নেমে ছুটে গেল ঘটনাস্থলে। সে মিহিরকে কেবল নিজের ভাইয়ের নজরেই দেখেছে। অপূর্বকে ভেবেছে নিজের অর্ধাঙ্গ। শিরীন পুনরায় বলে, “মিহির আরুকে ভালোবাসে, এজন্য কাজের ফাঁকে ফাঁকে গ্ৰামে আসত আরুকে দেখতে। ছেলেটা আমার ভেঙে পড়েছে। কীভাবে সামলাবো আমি?”

নীলপদ্ম গেঁথে রেখেছি তোর নামে পর্ব ৩৬

আরু একপা একপা করে এগিয়ে গেল মিহিরের দিকে। অস্ফুট স্বরে বলে, “তুমি আমাকে পছন্দ করতে মিহির ভাই?”
মিহির তেলেবেগুনে জ্বলে উঠল। দুহাতে আরুর দুই বাহু খামচে ধরে হিংস্র হয়ে বলে,

নীলপদ্ম গেঁথে রেখেছি তোর নামে পর্ব ৩৮