নেশাক্ত ভালোবাসা পর্ব ৫৫+৫৬+৫৭

নেশাক্ত ভালোবাসা পর্ব ৫৫+৫৬+৫৭
লেখিকাঃ Tamanna Islam

দেখতে দেখতেই কেটে যায় চার-চারটে মাস। আইরাত আগে থেকে অনেকটা স্বাভাবিক জীবনে ফিরেছে। আইরাত-রনিত-ইলা মিলে একটা ছোট্ট পরিবার এখন। আইরাত আব্রাহামের অফিসে যায়। হ্যাঁ, আইরাত নিজে এখন আব্রাহামের অফিস টা পরিচালনা করে। ভবতেই অবাক লাগে তাই না! আব্রাহামের মতো এতো স্ট্রিক্ট তো হতে পারে নি তবে খুব ইজি ভাবেই সব কিছু সামলে নেয়। অফিসের যেই কেবিন গুলো পুড়ে গিয়েছিলো সেগুলো রিকভার করেছে। এখন আর সেগুলো খালি পরে থাকে না। সেগুলো তেও অনেক স্টাফ রা কাজ করে।

আব্রাহাম আগে যে যে কাজ গুলো করতো এজ এ হ্যাড লিডার এখন সেই কাজ গুলো আইরাত করে। আব্রাহামের যে কেবিন টা ছিলো এখন তা আইরাতের। অবশ্য সেটা আইরাতেরও কেবিন ছিলো। কেননা দুজনের কেবিন তো একটাই ছিলো। কিচ্ছু পালটায় নি আইরাত। না ই অফিস আর না ই তার অন্য কোন কিছু। তবে কয়েকদিন পর পর শুধু তাদের কেবিন কে সুন্দর করে সাজানো হয় অর্থাৎ গোছগাছ করা হয়। আব্রাহামের প্রত্যেক টা জিনিস আইরাত পরম যত্নে নিজের কাছে রেখে দিয়েছে। এমন একটা দিনও নেই যে আইরাত এগুলো বের করে আব্রাহামের জন্য নিজের চোখের পানি ফেলে না।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

আইরাত;; রনিত স্কুল বন্ধ দেখে একদম বাইরে বাইরে ঘুরবি না।
ইলা;; যা তুই আমি ওকে সামলে নিবো।
আইরাত;; আচ্ছা থাকো তাহলে তোমরা আমি যাই।
আইরাত এই কথা বলেই বের হয়ে পরে অফিসের উদ্দেশ্যে। আইরাত ড্রাইভার কে নেয় না। আর ড্রাইভার বলতে আইরাত শুধু আব্দুল কেই রেখেছে আর গুলোকে বিদায় করে দিয়েছে। তাদের অফিসেই কোন কাজ দিয়েছে। আইরাত গাড়িতে উঠে পরে।

এটা আব্রাহামের মেইন গাড়ি। অর্থাৎ আব্রাহামের এটা পারসোনাল গাড়ি ছিলো। আইরাত তাতে উঠে পরে স্টেয়ারিং এ হাত দিয়ে দেয়। আব্রাহামও এভাবেই ড্রাইভ করতো। আইরাত তার পাশের সীটে তাকায়। আইরাতের হঠাৎ মনে পরে যে আব্রাহাম যখন তাকে হুট করেই বাড়ি থেকে নিয়ে এসে পরতো তখন সে গাড়িতে আব্রাহামের সাইডেই বসে থাকতো কত্তো চিল্লাতো কিন্তু আব্রাহাম ছিলো নাছোড়বান্দা। আইরাত ড্রাইভ করে অফিসে পৌঁছে যায়। আইরাত আসতেই রোদেলার দেখা পায়।

রোদেলা;; গুড মর্নিং।
আইরাত;; ভেরি গুড মর্নিং।
রোদেলা;; তোমার কেবিন রেডি।
আইরাত;; কেবিন থেকে কিছু সরানো হয় নি তো?
রোদেলা;; কিচ্ছু না যেমন ছিলো সেম তেমনই। শুধু ডেস্কের কাচ টা পাল্টে আরেকটা কাচ লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে।
আইরাত;; আচ্ছা।
রোদেলা;; আমার ফাইল গুলো রেডি।
আইরাত;; কেবিনে দিয়ে এসো। আর রাশেদ কোথায়?
রোদেলা;; ও এসেছে, হয়তো ভেতরে।
আইরাত;; আচ্ছা।

আইরাত ভেতরে চলে যায়। আইরাত ভেতরে যেতেই কেউ কেউ সালাম দিচ্ছে আবার কেউ কেউ মর্নিং উইস করছে। আইরাত সবার উত্তর দিয়েই কেবিনে চলে আসে। কেবিনে এসেই আইরাত থেমে যায়। চারিদিকে চোখ ঘুড়িয়ে ঘুড়িয়ে দেখছে। আব্রাহাম থাকতে যেমন ছিলো এখনো হুবাহু সেইম। আইরাত এগিয়ে গেলো সামনে। টেবিলের ওপর আব্রাহাম-আইরাতের একটা ছবি আছে। যেখানে আব্রাহাম তাকে পেছন দিক থেকে জড়িয়ে ধরে আছে। আইরাত তা তার হাতে তুলে নেয়। কতোক্ষন ভরা আব্রাহামের দিকে তাকিয়ে থাকে। হঠাৎ টুপ করেই এক ফোটা পানি ছবির ওপর পরে। আইরাতের চোখে পানি কিন্তু মুখে ফুটে ওঠেছে এক চিলতে হাসি। আইরাত ছবিটা হাতে নিয়েই দাঁড়িয়ে ছিলো তখনই দরজাতে কড়া নাড়ে রাশেদ।

রাশেস;; ম্যাম ভেতরে আসবো?
আইরাত দ্রুত হাতের উল্টো পাশ দিয়ে চোখ মুছে ফেলে।
আইরাত;; হ হ্যাঁ এসো।
রাশেদ;; ম্যাম আসলে আব্রাহাম স্যার যখন লাস্ট একটা ডিল সাইন করছিলো সেইদিন তো ডিল টা বাদ দেওয়া হয়েছিলো। আর সেই লোক গুলো ফরেইন কান্ট্রি থেকে এসেছিলো। সেইদিন তো আর আসতে পারে নি তাই আজ আবার এসেছে।

আইরাত;; বুঝলাম। কেবিনে পাঠিয়ে দিও।
রাশেদ;; জ্বি।
রাশেদ চলে যাওয়ার কিছুক্ষন পর সেই লোক গুলো আসে।
ক্রিস্টোফ;; হেই মিসেস.আইরাত।
আইরাত;; হ্যালো। কাজের কথায় আসি। এই ডিল টা হবে। আব্রাহামের সাথে আপনাদের কতো লক্ষ টাকার কথা হয়েছিলো?
ক্রিস্টোফ;; আসলে আমিও চাই যাতে এই ডিল টা হোক। কিন্তু আমি শুনেছি আব্রাহাম স্যারের নাকি এক্সিডেন্ট…..
আইরাত;; হ্যাঁ হয়েছে। কিন্তু সবার জন্য আব্রাহাম না থাকলেও আমার জন্য সবসময় আছে আর থাকবে।
এবার বলুন কতো টাকা লাগবে?

ক্রিস্টোফ;; ৩৭ লক্ষ।
আইরাত;; পেয়ে যাবেন।
ক্রিস্টোফ আইরাতের সাথে কথা বলেই বের হয়ে পরলো। আইরাত চেয়ারে মাথা এলিয়ে দেয়। চেয়ার টা রোলিং চেয়ার ঘুড়ে শুধু। আইরাত কিছুটা জানালার কাছে গেলো। সব জানালা গুলোই কাচের। আইরাতের চোখ হঠাৎ নিচের দিকে গেলো। দেখে নাফিজ মানে ওই ড্রাইভার টা কাউকে কিছু না বলেই গাড়ি নিয়ে সোজা বের হয়ে গেলো। আইরাত কিছুটা কপাল কুচকায়। এভাবেই সেই সময় টুকু চলে যায়।

বেশ কয়েক ঘন্টা পর আইরাতের কি যেনো কাজের ফলে বাইরে যেতে হয় তাই আইরাত বাইরে নেমে আসে। আইরাত বাইরে যেতেই অফিসের সাইড থেকে বেশ ধস্তাধস্তির আওয়াজ আসে। আইরাত সেদিকে চলে যায়। দেখে একজন লোক নাফিজ কে এক প্রকার থ্রেইট দিচ্ছে আর নাফিজ ভয়ে চুপসে আছে। তাদের কথা গুলো আবছা ভাবে শোনা যাচ্ছে। আইরাত আড়াল থেকে তাদেরই দেখে যাচ্ছে। কথার এক মাঝেই হঠাৎ রায়হানের নাম উঠে আসে। আইরাতের যেন এবার টনক নড়ে। সেই লোক টা নাফিজের কাছ থেকে চলে যায়। নাফিজ যেই তার পেছনে তাকায় তখনই সে আইরাতকে দেখে। এটা দেখেই যেনো নাফিজের আত্না শুকিয়ে যায়। সে খুব বেশি ঘাবড়ে যায়। আইরাত খেয়াল করে দেখে নাফিজের হাতে ড্রাগসও আছে। আইরাত কিছু একটা বলতে যাবে তার আগেই নাফিজ ভয়ার্ত কন্ঠে বলে ওঠে…..

নাফিজ;; ম ম ম্যাম আম আম আমি কিছু জানি না। আমি কি কিছু করি নি। আমি জানি না কিছু। আমাকে ছেড়ে দিন।
আইরাত কিছু বলতেই পারছে না। নাফিজ যে এখন নিজের মাঝে নেই তা তাকে দেখেই বুঝা যাচ্ছে। ড্রাগস বেশি সময় যাবত না নেওয়ার ফল এইটা। নাফিজ হঠাৎ এক নাগারে আবল-তাবোল বলতে বলতে এমদম রাস্তার মাঝখানে চলে যায়। তখনই আইরাতের পাশে কিছু গার্ড আসে। হঠাৎ নাফিজ বকবক করতে করতে একদম রাস্তার মাঝখানে চলে যায়। আর মূহুর্তেই একটা ট্রাক এসে নাফিজ কে একদম পিশে ফেলে। সোজোরে ধাক্কা দিয়ে ছিটকে নিয়ে যায়। আইরাত মুখে হাত দিয়ে দেয়। সারা রাস্তায় রক্ত ছিটকে পরেছে। নিজের চোখের সামনে এমন এক আকস্মিক ঘটনা দেখে আইরাত অবাক হয়ে গেলো।

গার্ড;; ম্যাম ম্যাম প্লিজ আপনি আগে গাড়িতে উঠুন প্লিজ।
আইরাত;; ওর সাথে আরো একটা লোক ছিলো যে নাফিজ কে ধমকাচ্ছিলো। সব খোজ করো।
গার্ড;; জ্বি।
আইরাতকে দ্রুত গাড়িতে তুলে দিলো গার্ডরা। আইরাত এসে পরে। সে এটাই বুঝতে পারছিলো না যে নাফিজ আইরাতকে দেখে এতো টা ভয় কেনো পেয়ে গিয়েছিলো। আর রায়হানের কথাও তাদের মাঝে উঠেছিলো। কোন না কোন ভাবে এই নাফিজ রায়হানের সাথে জড়িত না তো। আর এখন বা জড়িত থাকলেও কি নাফিজ তো মরলোই আর রায়হান জেলে পরে আছে। আইরাত এইসব কিছুই ভাবছে আর ড্রাইভ করছে।

বেশ কয়েক মাস ধরে রায়হান জেলে পচে মরছে। তাকে জেলের পোশাক পড়ানো হয়েছে। যেনো কোন এক হিংস্র পশু হয়ে গেছে রায়হান। এই জেল থেকে বের হবার জন্য কতো কিছুই না করেছে সে কিন্তু কোন লাভই নেই। জেলের ওই কালো অন্ধকার ঘরে পরে পরে শেষ হয়ে যাচ্ছে সে। এক পুলিশ অফিসার এসে তার চেয়ারে বসে তখন রায়হান জেলের দরজার একদম সামনে এসে দাঁড়ায়।
রায়হান;; বলছি না আমি কিছু করি নি। আমাকে যেতে দে। ভালো হবে না কিন্তু। কত্তো দিন, কত্তোটা দিন ধরে আটকে রেখেছিস। ছেড়ে দে আমায়।
পুলিশ;; লাভ নেই এগুলো কৃত কর্মের ফল।
রায়হান রাগে জেলের লোহা গুলোতে বারি মেরে চিল্লিয়ে ওঠে।

এভাবেই দিন যাচ্ছে। নাফিজের লাশ টা পুলিশ দের দিয়ে দেওয়া হয়েছে। লাশ চেক করার পর স্পষ্ট তার বডিতে ড্রাগস পাওয়া গেছে। আর হ্যাঁ আইরাতের সন্দেহ স্পষ্ট ছিলো৷ নাফিজ রায়হানের সাথে জড়িত ছিলো। রায়হান কে শাস্তি আর কি করে দিবে যেখানে রায়হান শাস্তি পাচ্ছেই, আর নাফিজ মরে ভূত। বাড়ি থেকে অফিস, অফিস থেকে বাড়ি। ব্যাস এই এতো টুকুই থেকে গেছে আইরাতের জীবন। নিজের ইচ্ছে গুলোকে যেনো এক প্রকার মাটি চাপা দিয়ে দিয়েছে আইরাত। শখ-ইচ্ছে কোন কিছুই আর নিজের মাঝে নেই।

তার তো এটাও মনে নেই যে সে প্রাণ খুলে লাস্ট কবে হেসেছিলো। সব কেমন চুপসে গেছে। জীবন থেকে খুশির ঝলকই সরে গিয়েছে। সময় যাচ্ছে দিন যাচ্ছে কিন্তু আইরাত যেমন ছিলো তেমনই। আব্রাহাম কে ভুলতে পারে নি সে আর না ই কখনো পারবে। মাসের পর মাস চলে যায়। কিন্তু কিছুই ঠিক হবার নাম নেই। কেমন যেনো সব এলোমেলো হয়ে গেছে। তবে আইরাত নিজে যেমনই থাকুক না কেনো ইলা বা রনিতের ক্ষেত্রে কোন কমতি রাখেনি। আইরাত নিজে যথেষ্ট হাসি-খুশি থাকে তাদের সামনে। যেনো সে একদম ঠিক আছে। কিন্তু ভেতরে ভেতরে তো সেই কবেই মরে গিয়েছে। তার মাঝেও অনেক দিন চলে গিয়েছে। রনিত আগে থেকে বড়ো হয়েছে।
একদিন আইরাত বসে বসে কাজ করছিলো তখন ইলা আসে আইরাতের রুমে। ইলা এসে আইরাতের পাশে চুপ মেরে বসে আছে তা দেখে আইরাত নিজেই বলে ওঠে।

আইরাত;; দাদি!
ইলা;; হুমম।
আইরাত;; কি বলবে জলদি বলো।
ইলা;; কি করে বুঝলি তুই?
আইরাত;; বুঝি বুঝি সবই বুঝি। এবার বলো।
ইলা;; না মানে বলছিলাম যে না থাক বাদ দে।
আইরাত ল্যাপটপ টা রেখে দিয়ে ইলার দিকে ঘুড়ে তাকায়। তার হাত দুটো নিজের কাছে নিয়ে নেয়।
আইরাত;; বলো তো কি বলবে!
ইলা;; বলবো?
আইরাত;; অবশ্যই।

ইলা;; দেখ কারো জীবন থেমে থাকে না। আব্রাহাম যেমন আমার কাছে প্রিয় ছিলো তুইও তাই। তোরা কেউই আমার কাছে আলাদা ছিলি না। আমি তোর এমন কষ্ট দেখতে পারবো না নিজের চোখের সামনে। আমি জানি যা হয়েছে খুব খারাপ। ধরে নে এটাই লিখা ছিলো কপালে কিন্তু শোন এভাবে একা একা তো আর কারো জীবন কাটে না তাই না। কাউকে না কাউকে লাগেই।
আইরাত;; দা………

ইলা;; আইরাত সোনা আমি বলি তুই আরেকটা বিয়ে করে নে না। এতে তোরই ভালো। জীবনের শেষ বয়সে কাউকে না কাউকে লাগে। তুই আরেকটা বিয়ে কর আইরাত।
আইরাত ইলার হাত গুলো ছেড়ে দেয়। ইলা ভেবেছে আইরাত রাগ করেছে আর এখন আবার পাগলামি শুরু করে দিবে। কিন্তু না আইরাত উলটো ইলার হাত ছেড়ে দিয়ে ইলার কাছে এসে বসে।
আইরাত;; আমি জানি তুমি আমাকে অনেক ভালোবাসো। আমার ভালোই চাও। যা বলেছো তা আমার ব্যাপারে ভেবেই বলেছো। কিন্তু দাদি আগে একটা কথা বলো তো। দাদুভাই যখন তোমাকে ছেড়ে চলে গিয়েছিলো তখন তুমি একা একা কীভাবে থেকেছো? আবার বিয়ে কেনো করো নি?
ইলা;; নাহ রে ?। তখন আমাদের তেমন রীতিনীতি ছিলো না। দ্বিতীয় বিয়ে করার মতো এতো পদ্ধতি ছিলো না সেই সময়ে।

আইরাত;; আহা ভুল। কারণ তুমি দাদুভাই কে অন্নেক ভালোবাসতে তাকে ভুলতেই পারো নি। তো তখন আবার এককটা বিয়ে করবে কিভাবে তাই না।
ইলা;;
আইরাত;; আমার অবস্থাও কিছুটা একই রকম। আমার পক্ষে সম্ভব না দাদি। আমি পারবো না আব্রাহামের জায়গায় অন্য কাউকে বসাতে। আমার সেই সাধ্য নেই। আমি যদি মরেও যাই তাহলেও আব্রাহামের স্মৃতি নিয়েই মরবো। আমার আব্রাহামের মতো না কেউ ছিলো, না কেউ আছে আর না ই কেউ হবে। আমি আমার জীবনে আব্রাহাম কে ছাড়া অন্য কাউকে ভাবিতেও পারি না। আমি পারবো না। আমার দ্বারা এটা হবে না দাদি।
ইলা;; হুমম। যা ভালো বুঝিস। আচ্ছা কাজ কর তুই আমি গেলাম।
ইলা উঠে চলে আসে তবে তখন আইরাত আবার ইলাকে পেছন দিক থেকে ডাক দেয়।

আইরাত;; এই যে ইলাবতী!!
ইলা;; কি রে।
এই ইলাবতী ডাক টা ইলার হাসবেন্ডের দেওয়া। তিনিই ডাকতেন শুধু। মাঝে মাঝে আইরাতও ইলা কে এই নাম ধরে ডাক দিয়ে উঠে।
আইরাত;; আজকে না তোমাকে হেব্বি সুন্দর লাগছে ?
ইলা;; চুপ কর।
ইলার ধমকে আইরাত হেসে দেয়। ইলা রুম থেকে চলে যায়। ইলার চলে যাওয়ার সাথে সাথে আইরাতের মুখের হাসি টাও উধাও হয়ে যায়। আইরাত পাশে তাকিয়ে দেখে আব্রাহামের গিটার টা যা তাকে তার মা দিয়েছিলো। সেইদিনের কথা টা মনে পরে যায় যেদিন আব্রাহাম আইরাতের জন্য গান গেয়েছিলো। আইরাত ফট করে চোখ সরিয়ে ফেলে তা থেকে। চোখের কার্নিশ বেয়ে পানি পরার আগেই আইরাত হাত দিয়ে তা মুছে চোখে চশমা পরে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ল্যাপটপের দিকে তাকায়।

সবকিছু পরিবর্তন হয়ে গেছে। আর সবকিছুর সাথে সাথে আইরাত নিজেও। মানুষ পরিবর্তনশীল। আর হবেই না কেনো ঘড়ির কাটা ঘুড়িয়ে, সময় স্রোতের মতো ভেসে গিয়ে কেটে গিয়েছে প্রায় ২ বছর।
২ বছর পর~~
এন্ড দি বেস্ট বিজন্যাস টাইকুন”স এওয়ার্ড গোস টু “মিসেস. আব্রাহাম আহমেদ চৌধুরী”।

বিশাল এক স্টেজের ওপর সুউচ্চ গলায় এটা এনাউন্সমেন্ট হতেই চারিদিকে জনগণের চিল্লাপাল্লার আওয়াজ শোনা গেলো। পরিবেশ টা সবার দুই হাতের মাধ্যমে করতালিমুখর হয়ে ওঠে। চারিদিকে মানুষের হৈচৈ এর আওয়াজ কানে এসে বাজছে। স্টেজের ফোকাস লাইট এসে আইরাতের ওপর পরেছে। যেন আইরাতই এখন পুরো এওয়ার্ড শো-এর মূল কেন্দ্রবিন্দু। আইরাত এতোক্ষন চুপচাপ বসে ছিলো। তারপর সে উঠে সামনের দিকে হাটা ধরে।

যেখান দিয়ে আসছিলো সেখানের সবাই এক চোখে তার দিকে তাকিয়ে ছিলো। সবার হাতের তালি যেনো থামার আর নাম নিচ্ছে না। আইরাত কোন দিকে না তাকিয়েই সোজা স্টেজে এসে পরে। এখানে ফরেইন বা বাংলাদেশি সবাই রয়েছে। তারপর একজন মাঝবয়েসী লোক সসম্মানের সাথে আইরাতের হাতে এওয়ার্ড টা তুলে দেয়। পাশেই একজন বিদেশী মেয়ে দাঁড়িয়ে ছিলো আইরাত তার সাথে সৌজন্যের খাতিরে হাগ করে। তারপর মাউথপিসের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়।

আইরাত;; I really Don’t know that what should i speak now.. But this award means a lot for me and i really honoured by this.. I never thought that i got this award.. And the whole credit gose to my husband Abraham bcz this is his company.. He was an amazing business tycoon and i can never be like him.. Thanks to the whole employees of my company for work hard.. Thank you so much everyone ❤️…

এই বলেই আইরাত মুচকি হেসে এসে পরে। আইরাত এসে আবার আগের জায়গাতেই বসে পরে।
রাশেদ;; Congratulations ma”am!!
আইরাত;; Thanks..
রাশেদ;; গত কিছু বছর যাবত আপনিই এওয়ার্ড পেয়ে যাচ্ছেন। এবারও তার ব্যাতিক্রম না।
আইরাত;; হুমম।
আইরাতের এই কথা বলতেই আইরাতের পাশ দিয়ে ছুটে আসে একটা মেয়ে। চিকন গরনের, ফর্সা। এসেই আইরাত কে পাশ থেকে জড়িয়ে ধরে।
তনয়া;; কংগ্রেচুলেশন”স এন্ড সেলিব্রেশন”স।
আইরাত;; আরে হয়েছে তো।
তনয়া;; আরে আমি ভাবতে পারবো না কি যে খুশি লাগছে তোর জন্য।
আইরাত;; হয়েছে তো।
তনয়া;; ট্রিয় দিতে হবে কিন্তু।
আইরাত;; আমি রাজি।

এই হলো তনয়া রহমান। আসলে এর নিজেরও কোম্পানি আছে তবে তা আইরাতের কোম্পানির আন্ডারে। তনয়া আর আইরাত সমবয়সী হওয়ায় তারা বন্ধুই। খুব ভালো আর তুই-তুকারি সম্পর্ক ওদের। আর আইরাত, সে যে আসলে ঠিক কতো টা পরিবর্তন হয়েছে তা তো বুঝাই যাচ্ছে। যে মেয়ে আগে একটা ফাইল অব্দি অফিসের বুঝতে গিয়েবহিমশিম খেতো সে এখন পুরো অফিস, পুরো কোম্পানিকে একা লিড করে। যার রিভলবার হাতে নিলেই প্রায় জ্বর এসে পরতো সে এখন রাত দিন চব্বিশ ঘন্টা এগুলো অস্ত্র নিয়েই থাকে। আইরাত আগে থেকে অনেক টা বদমেজাজি হয়ে গেছে, কেনো জানি তার মাঝে এই ইগো টা অনেক বেশি পরিমাণে কাজ করে।

যার ফলে অনেকে আইরাতকে এরোগেন্ট বা ইগোস্টিক ও বলে। কি আর করার, পরিস্থিতিই আইরাতকে এমন বানিয়ে দিয়েছে। রাগ যেনো নাকের ডগায় থাকে। হাসেও খুব কম। অর্থাৎ সে নিজের পরিবারের কাছে এক রকম আর বাইরের দুনিয়ার কাছে আরেক রকম। আইরাত আগে আব্রাহাম কে বলতো যে সে এমন বদমেজাজি কেনো বা এমন রাগি কেনো। কিন্তু সেই সব বিষয়ই যখন আইরাতের ক্ষেত্রে কাজ করেছে তখন সে বুঝেছে যে আব্রাহাম আসলে কেনো এমন ছিলো। আব্রাহামের ওপর যে মাফিয়া ট্যাগ টা ছিলো সেটা আইরাত যেনো এখন নিজের ওপর নিয়ে নিয়েছে।

নিয়ে নিয়েছে বলতে এসে পরেছে। কেননা সেখানে অনেক ভেজাল, আর যে পরিমাণ টাকা সেই সবে ব্যয় করা হতো তাতে তো এতো সহজে ছাড়া যায় না এইসব। অনেক বাধা-বিপত্তি এসেছে অনেক কিছু সহ্য করতে হয়েছে। অতঃপর এগুলোকে পাড়ি দিয়ে আজ আইরাতের অবস্থান এখানে। আইরাতের বর্তমান পরিচয় ওই নুজাইফা বিনতে আইরাত নামক একটা অতি সাধারণ মেয়ে না। তার বর্তমান আইডেন্টিটি এ সাকসেসফুল বিজন্যাস ওম্যান টাইকুন। আগের আইরাত আর এই আইরাতের মাঝে আকাশ-পাতাল তফাৎ। আইরাতের কাছে মডেলিং এর অফারও এসেছে কিন্তু সেইসব করার আর সময় কই। এমনিতেই সে এখন এক পাবলিক ফিগার। ছেলেরা এক কথায় মরে যায় আইরাতের ওপর। কিন্তু আইরাত যেনো চোখ ফিরিয়েও দেখে না। সবকিছুই পালটে গেছে সব, শুধু আইরাতের মনে আব্রাহামের জন্য ভালোবাসা টা পালটায় নি।

সবাই শান্তিপূর্ণ ভাবে স্টেজেই বসে ছিলো। হঠাৎ করেই তখন গুলি করার আওয়াজ আসে। একসাথে বেশ কয়েকটা গুলি বর্ষণ হয়ে যায়। সবাই তো যার যার জায়গা থেকে উঠে পরেছে। মূহুর্তেই চারিদিকে গোন্ডগোল লেগে গেলো। সবাই নিজ নিজ জায়গা থেকে উঠে দৌড়িয়ে চলে আসছে। বাইরে যে গার্ড রা ছিলো তারা এসে আইরাত কে সাপোর্ট দিতে শুরু করে। পুলিশ অফিসার রাও দ্রুত ভেতরে এসে পরে। আইরাত সেখান থেকে চলে আসে তনয়া কে নিয়ে। যেই না বাইরের রাস্তার দিকে যেতে ধরবে তখনই একজন লোক মুখে কালো মাস্ক পরে আইরাতের সামনে আসে।

হাতে গান নিয়ে আইরাতের দিকে তাক করে রয়েছে। আইরাত আস্তে করে তনয়ার হাত টা ছেড়ে দেয়। তনয়া ভয় পেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আর আইরাতের সামনে থাকা লোকটি আস্তে আস্তে করে তার ট্রিগারে চাপ দিচ্ছে। লোকটি যেই না শুট করতে যাবে তার সাথে সাথে আইরাত কিছুটা নিচে ঝুকে তার পায়ে পরে থাকা শু-এর সাইড থেকে একদম চিকচিক ধারালো একটা ছোট ছুরি বের করে চোখের পলকেই গিয়ে লোকটার গলায় এক ঘা বসিয়ে দেয়। খুব দ্রুত করেছে কাজ টা আইরাত। সামনে থাকা লোকটি আর কিছুই করতে পারলো না। একদম তার শ্বাস নালি বরাবর গিয়ে লেগেছে চাকু টা। শরীর টা নিস্তেজ হয়ে নেতিয়ে পরে যায়। তনয়া ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে ছিলো। তখন আইরাত তাকে নিয়ে দ্রুত বের হয়ে পরে বাইরে এসেই সোজা গাড়িতে বসে পরে। তখন রাশেস এসে আইরাতের গাড়ির জানালার কাছে দাঁড়ায়।

আইরাত;; রাশেদ, সব কটা কে আটকাও। একটাও যেনো বাদ না যায়। সব গুলোকে ধরে আনো।
রাশেদ;; জ্বি ম্যাম আপনি যান।
আইরাত গাড়ি ড্রাইভ করা শুরু করে দিলো। তার পাশেই তনয়া। তনয়া কে নিজের দিকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে আইরাত বলে ওঠে….
আইরাত;; আরে এভাবে তাকিয়ে আছিস কেন?
তনয়া;; এখন বুঝলাম যে তুই সবসময় উঁচু শু পরে কেনো থাকিস।
আইরাত;; কেনো থাকি?
তনয়া;; এই যে এই সব চাকু-টাকু লুকানোর জন্য আর কি।
আইরাত;; হুমম। তুই কি বাসায় নামবি?
তনয়া;; হ্যাঁ।

আইরাত গিয়ে তনয়া কে তার বাসায় সামনে ড্রপ করে দিয়ে এসে পরে। এখন প্রায় রাতের সময়। ২২ তালা একটা বিল্ডিং আর তার ২১ তালার কোন একটা রুমে আইরাত বসে বসে ম্যাগাজিন পড়ছে। তার পাশে থাকা একটা রুমেই কতো গুলো মানুষ কে কুকুরের মতো করে পেটানো হচ্ছে। বাকি সব গুলো আধা মরা আর এগুলোর যে মাস্টার মাইন্ড ছিলো তাকেও তুলে আনা হয়েছে। আর এরাই তখন মানুষ ভর্তি শো তে গুলি চালিয়েছিলো।

আইরাত তার এক হাত কপালের পাশে ঠেকিয়ে ম্যাগাজিনের দিকে চোখ দিয়ে রেখেছে। আর পাশের রুম টা থেকেই মানুষের আত্নচিৎকার ভেসে আসছে। এই চিল্লা-পাল্লা আর যেনো আইরাতের ভালো ঠেকছে না তাই সে তার সামনে টেবিলের ওপর রাখা রিভলবার টা নিয়ে সোজা ওই রুমে চলে যায়। গার্ড রা আইরাতকে দেখে সাইডে সরে যায়। আর আইরাত গিয়েই কোন প্রকার কোন কথা না বলেই ধাই ধাই করে যতো গুলো বুলেট ছিলো সব কটা ওই লোকটার বুকে শুট করে দেয়। ক্ষত-বিক্ষত হয়ে যায় তার বুক টা। নিঃশব্দ রুমে লোকটার নিথর দেহো নিচে লুটিয়ে পরার আওয়াজ টা কানে এসে লাগে।

রাশেদ;; ম্যাম মারলেন কেনো?
আইরাত;; কারণ ভালো কথার মানুষ না এই। যে টর্চার গুলো করা হয়েছে বলার হলে এতোক্ষণ সবকিছু বলেই দিতো। যেহেতু বলবিই না তাহলে মরে।
রাশেদ;;
আইরাত;; বাকি যারা বেচে আছে তাদের দ্রুত হস্পিটালে এডমিট করো। আর এর লাশ এমন জায়গায় ফেলে রেখে এসো যেনো কাক-পক্ষী অব্দি টের না পায় ওকে?!
রাশেদ;; জ্বি ম্যাম।
এই বলেই আইরাত মুখে মাস্ক টা পরে বের হয়ে পরে। বাইরে এসে লিফটে উঠে পরে। তারপর একদম বাইরে এসে গাড়ি করে বাড়ি চলে যায়। বাড়ি যেতেই আবার অয়নের ফোন আসে আইরাতের কাছে।

আইরাত;; হ্যালো!
অয়ন;; বউমনি! ঠিক আছো তুমি?
আইরাত;; হ্যাঁ, আমার আবার কি হবে?
অয়ন;; রাশেদের কাছ থেকে জানতে পারলাম এওয়ার্ড শো তে নাকি গুলি চালানো হয়েছে?
আইরাত;; হ্যাঁ কয়েকটা।
অয়ন;; কে করেছে এইসব জানতে পেরেছো?
আইরাত;; পরপারেও পাঠিয়ে দিয়েছি।
অয়ন;; এখন কোথায় তুমি?
আইরাত;; এইতো সবেমাত্র বাসায় আসলাম। আর ভাইয়া প্লিজ দাদি যাতে এইসব কিছুই না জানতে পারে সেইদিকে খেয়াল রাখবে। নয়তো অযথা চিন্তা করবে।

অয়ন;; হ্যাঁ আচ্ছা।
আইরাত;; রাখি।
আইরাতের ভেতরে যেতেই রনিত দৌড়ে আসে। আইরাতও তাকে কোলে তুলে নেয় অবশ্য খুব কষ্টে।
রনিত;; এওয়ার্ড পেয়েছো?
আইরাত;; পেলাম।
রনিত;; কেনো পেলে?
আইরাত;; নিজেও জানি না। কেনো যে দিলো ওরা আমাকে। ওহহ হ্যাঁ মনে পরেছে ওরা আমাকে বললো যে এটা গিয়ে বাসায় রনিত কে দিবে তাই।
রনিত;; এটা আমার তাহলে ??
আইরাত;; হ্যাঁ ?।

ইলা;; রনিত দুধ খেয়ে যা।
আইরাত;; তুই এখনো দুধ খাস নি?
রনিত কিছু না বলে শুধু তার মাথা দুই পাশে নাড়ায় অর্থাৎ না।
আইরাত;; জলদি যা দুধ খেয়ে আয়।
রনিত ইলার সামনে বসলে ইলা রনিতের দিকে দুধ এগিয়ে দেয়। আর আইরাত ধপ করে সোফাতে বসে ওপরের হুডি টা খুলে ফেলে।
ইলা;; অনেক ক্লান্ত হয়ে গেছিস তাই না?
আইরাত;; নাহ তেমন কিছু না।
ইলা;; কি হয়েছে মন খারাপ?
আইরাত;; না আসলে মন খারাপ না তবে ভালোও লাগছে না।
ইলা;; কেনো?
আইরাত;; আজ এই এওয়ার্ড টা আব্রাহাম পেতো।
ইলা;; আব্রাহাম পেলো বা তুই পেলি সেটা একই কথা তো হলো।
আইরাত;; হুমম।
ইলা;; জানিস আমি না মাঝে মাঝে তোর আগের ছবি গুলো দেখি।
আইরাত;; কেনো বলতো?

ইলা;; আগে তুই জামা পরতি মাঝে মাঝেই শাড়ি পরতি কিন্তু এখন তো এত্তো স্মার্ট স্মার্ট ড্রেস পরিস। আগে যা ইচ্ছে খেতি আর এখন, লাস্ট কবে তুই এই ফুচকা আইসক্রিম খেয়েছিলি তোর মনে আছে কি?? অনেক পালটে গেছিস তুই। আগে যারা তোকে চিনতো ওদের যদি না বলা হয় যে এই ই আইরাত তাহলে ওরা তোকে ধরতেই পারবে না।
আইরাত;; রিলেক্স দাদি প্লাস্টিক সার্জারি করাই নি আমি। শুধু একটু বেশ-ভুষায় চেঞ্জ এনেছি এই যা।
ইলা;; কাল কি মনে আছে তো?
আইরাত চোখ তুলে তার দাদির দিকে তাকায়।
আইরাত;; আমি কি করে ভুলতে পারি।
ইলা;; ওপরে যা ফ্রেশ হো।
আইরাত;; হুমম।

আইরাত ওপরে চলে যায়। ওপরে গিয়ে নিজে ফ্রেশ হয়ে ড্রেস চেঞ্জ করে ফেলে। আইরাতের হঠাৎ মনে পরে ইলার কথা। আসলেই অনেক দিন হয়েছে আইরাত আগের মতো আর গোল জামা বা শাড়ি পরে না। আইরাত কাবার্ড থেকে একটা সাদা ধবধবে জামা বের করে পরে নেয়। আইরাত গিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়ায়। বুকের ভেতর টা কেমন যেন মোচড় দিয়ে উঠে। আগের মতো লাগছে তাকে দেখতে।

আইরাতের কেনো জানি মনে হতে লাগলো যে এই হয়তো তার আব্রাহাম তাকে এসে জরিয়ে ধরবে কিন্তু এটা একটা স্বপ্ন মাত্রই। আইরাত ঘড়ির দিকে তাকায় দেখে বারো টা বাজার আর মাত্র ২০ মিনিট বাকি আছে। তখনই আইরাত নিচে চলে যায়। ইলা হয়তো এখন মেডিসিন নিয়ে ঘুমাচ্ছে তাই আইরাত নিচে নেমেছে নয়তো এই জামাগুলো পরে আইরাত আর কখনোই না নিচে নেমেছে আর না ই নামতো।

আইরাত তার গুটি গুটি পায়ে কিচেনে চলে যায়। কিচেনে যেতেই দেখে একটা কেক কে কাচের ঢাকুন দিয়ে ঢেকে রাখা হয়েছে। আসলে কেক টা আইরাত নিজেই বানিয়েছে শুধু স্টাফ দের বলে সেখানে রেখেছিলো। যাই হোক আইরাত খুব সাবধানে কেক টা নিয়ে রুমে চলে যায়। রুমে গিয়েই দরজা লাগিয়ে দেয়।

আইরাত কেক টা বেডের ওপরে রেখে হাতে চকোলেট র‍্যাপার আনে। তারপর তা দিয়েই কেকের ওপর নাম লিখে দেয়। ছোট্ট ছোট্ট বেশ কয়েকটা মোমবাতি লাগানো হয়েছে। আইরাত ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে আর মাত্র এক মিনিট বাকি বারো টা বাজার। সে খুব সাবধানে বিছানা থেকে নেমে গিয়ে রুমের লাইট অফ করে দেয়। আর তার সাথে সাথে বিছানা সহ সারা ঘরে ছোট ছোট মরিচ বাতির মতো সাদা-নেভি ব্লু কালারের বাতি জ্বলে উঠে। দেখেতে ভারি সুন্দর লাগছে। আইরাত গিয়ে কেকের সামনে বসে পরে।
টিকটিক আওয়াজ করে বারো টা বেজে গেলো। আইরাতের মুখে আপনা আপনিই হাসি ফুটে ওঠেছে। আইরাত আস্তে আস্তে হাততালি দিয়ে বলে ওঠে…

“” Happy birthday to you, Happy birthday to me, happy birthday happy birthday,, happy birthday to you & me “”
আইরাতের চোখের পানি গুলো চিকচিক করছে আর মুখে ফুটে ওঠেছে গাঢ় হাসির রেখা। আজ ৫ সেপ্টেম্বর।
আর অবাকের বিষয় হলো এটা যে আজ আব্রাহামের সাথে সাথে আইরাতেরও বার্থডে। অর্থাৎ আব্রাহাম আর আইরাতের বার্থ ডেট একটাই। গত বছর গুলো ধরে এমনই হয়ে আসছে। আইরাত নিজের বার্থডে একা কখনোই সেলিব্রেট করে না। দুজনের টা একসাথে। এমনকি আইরাত তো এটাই ভুলে যায় যে এই দিন টাতে তার নিজেরও বার্থডে। সে শুধু আব্রাহামের কথা মনে রাখে। আইরাত চোখে অশ্রু মুখে হাসি নিয়ে একা একা কেক কাটে। সামনে আব্রাহামের আর তার একটা ছবি আছে।

আইরাত;; হ্যাপি বার্থডে জামাইজান। আজ আপনার বার্থডে। ঘুড়ে ঘুড়ে আবার এই দিন টা এসেই গেলো তাই না। আপনি জানেন আমি আপনাকে কত্তো কত্তো মিস করি। আপনি তো মিস করেন না আমি জানি। খুব ইচ্ছে করছিলো শাড়ি পরার কিন্তু পরি নি। পারি না তো তাই। আচ্ছা আপনি এখন কি করছেন? আপনার কি মনে আছে যে আজ আপনার সাথে সাথে আমারও জন্মদিন। আচ্ছা ছাড়ুন বলুন কি গিফট লাগবে? আচ্ছা দাড়ান আমার কাছে একটা জিনিস আছে আপনার জন্য।

এই বলেই আইরাত নেমে গিয়ে কাবার্ড থেকে একটা বক্স বের করে আনে। তারপর সেটা খুলে বসে। ওটার ভেতরে একটা ব্লেক ওয়াচ, একটা ওয়ালেট, একটা পারফিউম, একটা কালো পাঞ্জাবি, হ্যাঁ আর একটা রিভলবারও।
আইরাত;; এগুলো আমি আপনার জন্য কিনেছি। জানি গিফট টা খুব বেশিই সিম্পল কিন্তু আমি নিয়েছি। এবার আমার গিফট দিন।
আইরাত এটা বলেই আব্রাহামের ছবির দিকে তাকায়।

আইরাত;; গিফট না হলেও অনেক বড়ো সড়ো একটা ঝটকা আমায় ঠিকই দিয়েছেন আপনি দুই বছর আগে। যেটা মরার আগ পর্যন্ত ভুলা সম্ভব না আমার পক্ষে। আব্রাহাম, চলে যাওয়া টা কি খুব বেশিই দরকার ছিলো?!
আইরাত মায়া ভরা দৃষ্টিতে আব্রাহামের দিকে তাকায়। আইরাত হেসে দেয় আর তখনই টুপ টুপ করে চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পরে। এটা নতুন কিছু না, এভাবেই কেটে আসছে আইরাতের দিন গুলো। আর তাদের দুজনের বার্থডের দিন তো যেনো পুরোনা ঘা গুলো আবার তরতাজা করে দেওয়ার জন্য আসে। আইরাত এভাবেই আব্রাহামের সাথে কথা বলে একা একাই। নিজেকে কোন ভাবে আশ্বাস, না না আসলে মিথ্যে আশ্বাস দেওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যায়। আইরাত বিছানার এক কোণাতে গিয়ে আব্রাহামের ছবি টা নিয়ে ঘুমিয়ে।পরে। এভাবেই রাত টুকু কেটে যায়।

সকালে আইরাত সিড়ি বেয়ে নিচে নামছে আর হাতে ঘড়ি পরছে। তবে আজ আইরাতকে কেমন যানি একটু ভিন্ন রকমের লাগছে। কালো পেন্ট,, ভেতরে এশ কালারের শর্ট টপ আর ওপরে ব্লেক কালারের জেকেট পরেছে। আইরাতকে এতো দ্রুত নিচে নামতে দেখেই ইলা বলে ওঠে।
ইলা;; এসেছিস?
আইরাত;; হ্যাঁ জলদি যেতে হবে।
ইলা;; এখন তাড়াতাড়ি নাস্তা করতে বোস।
আইরাত;; না না তা করার সময়ও নেই আমার কাছে। জলদি যেতে হবে। তনয়া ফোন করেছিলো আগামী প্রজেক্ট নিয়ে নাকি মিটিং করতে হবে। তাই জলদি যাচ্ছি।
ইলা;; কিছু তো খেয়ে যা।

আইরাত;; না না এখন খেতে বসলেই দেরি হয়ে যাবে। অফিসে খেয়ে নিবো আমি। এখন যাই, রনিত টাটা।
ইলা;; এই হ্যাপি বার্থডে (কিছুটা জোরে)
আইরাত;; হ্যাঁ হ্যাঁ।
রনিত;; হ্যাপ্পি বার্থডে আর আসার সময় চকোলেট।
আইরাত;; আচ্ছা।

আইরাত এই বলেই বের হয়ে পরে গাড়ি নিয়ে। তবে অফিসে যেতেই আইরাত অবাক। কেননা সব স্টাফ রা যার যার মতো কাজ করছে কিন্তু তনয়া তাকে বলেছিলো যে সবাই নাকি কনফারেন্স রুমে।
সে যাই হোক আইরাত তার কেবিনে চলে যায়। তখনই রোদেলা আসে আর তার সাথে তনয়া নিজেও।
তনয়া;; ভেতরে কি আসবো ম্যাডাম?
আইরাত;; আয় এদিকে তোর কানের বোটা ছিড়ি এদিকে আয়।
তনয়া;; যাহ বাবা আমি আবার কি করলাম?
আইরাত;; সকালে ফোন করে কি বলেছিস আমাকে। সবাই কনফারেন্স রুমে তাই না। এই তোর মিটিং?
তনয়া;; আরে ছাড় না। বাই দি ওয়ে হ্যাপি বার্থডে।

আইরাত;; হুম হয়েছে।
রোদেলা;; হ্যাপি বার্থডে।
আইরাত;; থ্যাংক্স।
তনয়া;; চল।
আইরাত;; কোথায়?
তনিয়া;; শোন একটা কনসার্ট আছে বুঝলি। মানে কি যে বলবো আমি এত্তো সুন্দর সেটা, অনেক জমজমাট। আর বিশাল বড়ো সড়ো করে হবে। হাজার হাজার মানুষ আসবে সেখানে। আমার তো আর তর সইছে না চল আমরাও যাই।
আইরাত;; অফিস রেখে এই সকাল সকাল কনসার্টে যাবো আমি!
তনয়া;; আরে না এখন না। রাতে। মানে অফিস শেষ করেই আমরা বের হবো আরকি। তবে আমরা কিন্তু যাবোই। অনেক মজা হবে। আর সবাই সেখানে যাওয়ার জন্য যাস্ট পাগল হয়ে পরেছে।

আইরাত;; ওকে ফাইন যাবো। বাট আগে কাজের কাজ করতে দে। আর তুই যা। এই ফাইল গুলো নে সব করে দে।
তনয়া;; কিইই এত্তো গুলা ফাইল?
আইরাত;; তুই কি চাস তোর কোম্পানির সাথে আমি কাজ ছেড়ে দিই?
তনয়া;; এই না না না।
আইরাত;; তাহলে এগুলো নিয়ে যা আর হ্যাঁ যতো তাড়াতাড়ি এগুলো কমপ্লিট করবি ততো তাড়াতাড়ি আমরা বাইরে যাবো বুঝলি।
তনয়া;; আচ্ছা।

দেখতে দেখতে সময় পার হয়ে গেলো। এর মধ্যে আইরাত বিকেলের দিকে রাশেদের সাথে অনাথ আশ্রমে গিয়েছিলো। সেখানে গিয়ে সব বাচ্চাদের অনেক কিছু দিয়েছে। এই কাজটা আইরাত প্রতি বারই করে। তারপর আবার বিকেলের শেষ সময়ে আইরাত অফিসে আসে। আর অফিসে আসতেই তনয়া ঝাপটে ধরে তাকে।
তনয়া;; এই কোথায় ছিলি?
আইরাত;; তুই জানিস না আমি প্রতি বছর এইদিনে এই সময়ে কোথায় থাকি?
তনয়া;; ওহহ সরি সরি মাই মিস্টেক। আচ্ছা এখন চল যাই।
আইরাত;; না গেলে হয় না কনসার্টে?
তনয়া;; এটা তো কথা ছিলো না আমাদের।
আইরাত;; আচ্ছা খানিক পর যাচ্ছি। গার্ড দের নিতে হবে সাথে।
তনয়া;; সে তুই যাকে ইচ্ছে সাথে নিতে পারিস।

একটা সময় আইরাত আর তনয়া চলে গেলো কনসার্টে। আইরাত একদম হুডি পরে মুখে মাস্ক লাগিয়ে এসেছে কেননা এখানে কেউ তাকে দেখে ফেললে আরেক ঝামেলা বাধবে। কারণ সে এমন সাধারণ পাবলিক প্লেসে বের হয় না বেশি একটা। যাই হোক এখানে অনেক মানুষ। সবার চোখে-মুখে উল্লাসের তীব্র ছাপ। আইরাতের চারিপাশেই গার্ড রা আছে কিন্তু কিছুটা দূরত্ব ম্যানটেইন করে যেনো কেউ না বুঝে। কনসার্টের এক পর্যায়ে এসে সবার মাঝে যেনো আরো হৈচৈ শুরু হয়ে গেলো। আর তনয়া এগুলো বেশ ইনজয় করলেও এখন আইরাতের এগুলো কেমন যেনো বিরক্তিকর লাগছে।
গানের এতো তীব্র শব্দ যে তাতে কানের পর্দা ফাটার মতো অবস্থা।

একে তো এই গানের শব্দ তার ওপর মানুষের এই চিল্লাপাল্লা। আইরাতের রাগ হতে লাগলো ধীরে ধীরে। তার পরেও আইরাত সেখানেই থেকে গেলো আরো বেশ কয়েক সময়। তার প্রায় এক ঘন্টা শেষ হয়ে গেছে। আস্তে আস্তে রাত যতো বাড়ছে মানুষের সমাগম টাও ঠিক ততোই বেড়ে চলেছে। আইরাত আশে পাশে তাকিয়ে তনয়া কে খুজতে লাগে কিন্তু তনয়া নেই। আইরাত আর সেখানে থাকতে না পেরে চলে আসে। কনসার্টের একটু ভেতরের দিকে আসলেই বেশ কিছু আপত্তিজনক সিচুয়েশনের মাঝে পরে সে। কেউ একে ওপর কে জড়িয়ে ধরে আছে, কেউ কিস পর্যন্ত করছে আবার কেউ ড্রাং অবস্থায় একদম হিতাহিত জ্ঞান শূন্য হয়ে পাগলের মতো করে নেচে চলেছে।
আইরাত এই সব কিছু উপেক্ষা করে সাইদ দিয়ে এসে পরে। আরো একটু ভেতরে এসে দেখে তনয়া ফোনে কথা বলছে। তনয়া পেছন ঘুড়েই দেখে আইরাত দাঁড়িয়ে আছে।

তনয়া;; এখানে কি করিস?
আইরাত;; তুই এখানে এইসবের মাঝে কি করিস?
তনয়া;; আরে আমি তো কথা বলতে এসেছিলাম সেখানে কিছুই শোনা যায় না তাই।
আইরাত;; আমি বাড়ি যাবো।
তনয়া;; আরে কিন্তু…..
আইরাত;; দেখ অনেক সময় থেকেছিস আরেকদিন আসা যাবে এখানে। এখন আর না আমার মাথা ধরে গেছে প্লিজ বোন চল এখন এখান থেকে।
তনয়া;; আচ্ছা চল।
আইরাত সেখান থেকে চলে আসতে নেয়। তখনই আইরাতের ফোন বেজে ওঠে।
আইরাত;; এই তনয়া তুই যা আমি আসছি।
তনয়া;; ওকে।

আইরাত একটু সাইডে দাঁড়িয়ে ফোন রিসিভ করে। আবছা আবছা কন্ঠ শোন যাচ্ছে। তাই আইরাত মুখের সাইডে হাত দিয়ে হ্যালো হ্যালো করেই যাচ্ছে। আইরাত কোন রকমে ফোনে কথা বলছে আর বাইরে আসার ট্রাই করছে। অন্যমনস্ক হয়ে হাটার ফলে কিছুদূর যেতেই আইরাত কার সাথে জানি এক প্রচন্ড রকমের ধাক্কা খায়। প্রায় পরে পরে এমন অবস্থা কিন্তু তখনই হুট করে কেউ একজন আইরাতের কোমড় জড়িয়ে ধরে তাকে সোজা করে দাড় করি দেয়। অল্পের জন্য বাচলো নয়তো একদম নিচে পরে যেতো। আইরাত বুঝতে পেরেছে যে তাকে কেউ ধরে দাড় করিয়েছে। কিন্তু আইরাত যখন তার আশে পাশে তাকায় তখন কাউকেই দেখে না। আইরাত কপাল কুচকে আশে পাশে খুঁজেই চলেছে। কিন্তু সে যখন কাউকেই খুঁজে পায় না তখন দ্রুত বাইরে এসে পরে।

তনয়া;; কিরে এতো দেরি করলি যে?
আইরাত;; কিছু না, শোন রাত ৮ঃ৩০ টা বেজে গেছে। আমি তোকে বাড়ি পৌঁছে দেই কেমন।
তনয়া;; আচ্ছা।
আইরাত গাড়ি ঘুড়িয়ে আবার তনয়ার বাসার সামনে থামায়। তনয়া চলে গেলে আইরাত নিজেও এসে পরে। রাশেদ আইরাতের সাথে আসতে চেয়েছিলো কিন্তু আইরাত নিজেই মানা করে দেয়। তবে আইরাত যখন নিজের বাসার উদ্দেশ্য রওনা দেওয়া শুরু করে তখন তার কিছুটা হলেও বুকে এক অজানা ভয় কাজ করতে লাগে। কেননা তনয়ার বাসা আইরাতের বাসার রাস্তা থেকে বেশ উলটো দিকে৷

এখন আইরাত কে তার বাসায় যেতে হলে অন্য রাস্তা দিয়ে যেতে হবে। কি আর করার আইরাত ড্রাইভ করা শুরু করে দেয়। দেখতে দেখতে এক সময় আইরাত এক অতি চেন জায়গার রাস্তায় এসে পরে। সেই পাহাড়ি রাস্তা টা যাতে আব্রাহামের এক্সিডেন্ট হয়েছিলো। কেনো জানি আইরাত যখন ওই রাস্তা টা অতিক্রম করছিলো তখন আইরাতের গায়ে কাটা দিয়ে উঠছিলো। এই রাস্তার মুখও সে জীবনে মোড়াতে চাই নি কিন্তু আজ বাধ্য হয়ে। আইরাত যথাসম্ভব নিজেকে সংযোত রেখে সেই রাস্তা টা পারি দেয়।

যখন সেই রাস্তা টা অতিক্রম করে এসে পরে তখন যেনো আইরাত নিজের বুক ভরে দম ছাড়ে। এবার এই রোড টা হাইওয়ে। একদম ক্লিন রাস্তা, এখানে কোন কিছুর ভয় নেই। আইরাত গাড়ি কিছুটা পিছিয়ে নিয়ে আবার সাই করে স্টার্ট দেয়। আস্তে আস্তে করে গাড়ি চালাচ্ছে। কিন্তু হুট করেই সামনের দিক থেকে একটা গাড়ি ফুল স্পীডে আইরাতের গাড়ির দিকে আসতে লাগে। আইরাত তা দেখে আগে থেকে তার গাড়ির স্পীড আরো কমিয়ে দেয়। কিন্তু গাড়ি টা এসে সোজা আইরাতের গাড়ির গা একদম ঘেঁষে চলে যায়।

এতে আইরাতের গাড়ির একটা সাইড মিরর আর গাড়ির স্কিন বেশ খানি উঠে পরে। আইরাতের এটা দেখে তো মাথা মুথা সব এক্কেবারে খারাপ হয়ে গেলো। আইরাত জিদ ধরে৷ আইরাতের গাড়ির যে পরিমাণ স্পীড ছিলো তা সম্পূর্ণ বাড়িয়ে দিয়ে আইরাত উলটো ঘুড়ে ওই গাড়ির পেছনে যেতে থাকে। আইরাত স্পীড আরো বাড়িয়ে দেয়। প্রায় ৬-৭ মিনিট পর এভাবেই ড্রাইভ করতে থাকে। আরো একটু স্পীড বাড়িয়ে দিয়ে আইরাত একদম সেই গাড়ি ক্রস করে চলে যায়।

কিছুদূর গিয়েই আবার ব্রেক কষে সেই গাড়ির সামনে নিজের গাড়ি থামায়। ওই গাড়ি থেকে কেউ নামছে না দেখে আইরাত নিজেই তার গাড়ি থেকে নেমে পরে। আইরাত স্পষ্ট দেখতে পারছে যে ওই গাড়ির ড্রাইভিং সীটে কেউ একজন বসে আছে কিন্তু বের হচ্ছে না। আইরাত জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তার দুই হাত দুই দিকে খানিক ছড়িয়ে দিয়ে রাগে বলে ওঠে….
আইরাত;; আব্বে ওওও রাস্তা কি তোর বাপের। এভাবে গাড়ি চালাস কেনো? না আসলে গাড়ি চালা নাহয় রাস্তায় এরোপ্লেন চালা। না নেই কিন্তু তা অন্যের ক্ষতি করে নয়। গাড়ি থেকে বের হ।

আইরাত;; এখন চুপ করে আছিস কেনো? বের হ গাড়ি থেকে। কি করেছিস দেখ আমার গাড়ির সাইড মিরর ভেঙে দিয়েছিস আর গাড়ির সাইডের সম্পূর্ণ স্কিল তুলে ফেলেছিস। বের হ গাড়ি থেকে।
আইরাত তো রাগে আগুন কিন্তু এদিকে যে অচেনা ব্যাক্তিটি গাড়িতে চুপচাপ বসে আছে সে আছেই। শুধু তার গাড়ির সামনের দুই হ্যাড লাইট বারবার জ্বালাচ্ছে-নিভাচ্ছে।

আইরাত;; খুব এটিটিউড তাই না। তোর এটিটিউড কে কীভাবে চুপসিয়ে দিতে হয় আই নো দ্যাট ভেরি ওয়েল, ওয়েট।
এই বলেই আইরাত তার আশে পাশে রাস্তায় কিছু একটা খুঁজতে লাগে। আর তারপরই একটা বিশাল আকাড়ের পাথর পেয়ে যায়। আইরাত তা হাতে তুলে এনেই বিনা বাক্যে একদম গাড়ির সামনের দুই হ্যাড লাইটে দেয় জোরে বারি মেরে। ঝরঝর শব্দ তুলে সেগুলো ভেঙে গেলো। আইরাত তার জুতোর চিপা থেকে চাকু বের করে তা দিয়ে গাড়ির গায়ে ধরে দেয় ৪-৫ টা আচড় কেটে। তবে আশ্চর্যজনক বিষয় হচ্ছে যে আইরাত যে এতো কিছু করছে তাতে সেই ব্যাক্তিটি একটা টু শব্দ অব্দি করছে না। চুপচাপ বসে আছে ড্রাইভিং সীটেই। এগুলো এত্তোকিছু করার পর আইরাত তার হাত দুটো ঝাড়তে ঝাড়তে ওই গাড়ি টার সামনে এসে দুই হাত ভাজ করে দাঁড়ায়।

আইরাত;; Tit for tat….
এই বলেই আইরাত তার গাড়িতে গিয়ে ধপ করে বসে পরে তারপর সাই করে চালিয়ে চলে যায়।

আইরাত বাড়িতে এলেই একটু সারপ্রাইজড হয়। কেননা হলরুমে অয়ন-দিয়া, রহিত-আরুশি, কৌশল-অবনি সবাই এসেছে। আইরাত তাদের দেখে খুশি হয়ে যায়। ওহহ হ্যাঁ আরেকটা খুশির খবর, আরুশি প্রেগন্যান্ট।
দিয়া;; হে বার্থডে গার্ল, হ্যাপি বার্থডে।
আইরাত;; What a pleasant surprise!!
রহিত;; হ্যাঁ ভাবলাম দিয়েই দেই।
আইরাত;; কখন এসেছো তোমরা সবাই?
ইলা;; অনেক আগেই এসেছে কিন্তু তুই অনেক দেরি করেছিস।
আইরাত;; আব… সরি আসলে রাস্তায় অনেক জ্যাম ছিলো তো তাই আরকি।
অবনি;; যাই হোক। কেমন আছিস তা বল।
আইরাত;; এইতো আব্রাহাম যেভাবে রেখে গিয়েছে এখনো সেভাবেই আছি ?। আব… আ আরুশি আপু কেমন আছো। শরীর ভালো?

আরুশি;; অনেক ভালো।
আইরাত;; হ্যাঁ এখন তো ভালো থাকতেই হবে।
সেই রাত টুকু এভাবেই সবার সাথে হেসে খেলে চলে যায়। সবাইকে আজ রাত টা থেকে যেতে বললে সবাই কিছুটা ব্যাস্ততা দেখায়। আইরাতও বুঝে যে সবারই কাজ আছে। আর এছাড়াও প্রতিদিন কথা তো হয়ই। কারো সম্পর্কে কোন রকম ফাটলের ছিটেফোঁটাও ধরে নি। আগে যেমন ছিলো এখনো তাই।

রাত বাজছে ১১ঃ৪৫ মিনিট। ইলাকে আইরাত মেডিসিন খাইয়ে ঘুম পারিয়ে দিয়েছে। আইরাত এখন একটা বই নিয়ে আরেক কাপ গরম কফি নিয়ে বারান্দায় বসে আছে দোলনাতে। লাস্ট পনেরো মিনিট। আর মাত্র পনেরো মিনিট আছে তাদের দুইজনের জন্মদিনের। আবার আসবে এই দিন টা ঠিক একটা বছর ঘুড়ে। না জানি এই একটা বছরে আবার জীবনে কি কি পাল্টাবে। জীবনে আবার কি কি নতুন মোড় নিবে!! আদৌ বেচে থাকবে কিনা আগামী বছরের এই দিনে। কতো চিন্তা-ভাবনা। হঠাৎ কি যেনো ভেবে আইরাত গুনগুন করে গান ধরে….

আইরাত;;
~Kya hua tera waada
Woh kasam woh iraada
Bhoolega dil jis din tumhe
Woh din jindegi ka aakhri din hoga
Kya hua tera waada
Woh kasam woh iraada ??~
আইরাত;; Happy birthday Abraham…..
ঘড়িতে টিকটিক শব্দ করে উঠলো তা যেনো জানান দিচ্ছে যে সময় শেষ, বারো টা বেজে গেছে।

নেশাক্ত ভালোবাসা পর্ব ৫২+৫৩+৫৪

পরেরদিন সকালে উঠে আইরাত অফিসে চলে যায়। আজ সত্যি বলতে অফিসে তেমন কোন কাজ নেই। আইরাতেরও ভালো লাগছে না তাই আইরাত রোদেলা, রাশেদ, আর তনয়া কে ডাক দেয় নিজের কেবিনে।
রাশেদ;; ম্যাম ডেকেছেন?
আইরাত;; আরে এসো এসো। আসলে ভালো লাগছিলো না তাই ভাবলাম তোমাদের ডাক দেই। আসো সবাই একসাথে লাঞ্চ করি।
আইরাতের কথা শুনে তারা তিনজনেই হেসে দেয়। আইরাত কে দেখে কেউ বলবে না যে এতো বড়ো একটা কোম্পানির মালিক কিনা এতো ফ্রেন্ডলি আর এতো ভালো বিহেভ। তারা একসাথে খেতে বসে।

রোদেলা;; এই চলো ঘুড়তে যাই।
তনয়া;; হ্যাঁ ভালো হবে।
আইরাত;; আরে ঘুড়ে না আসলাম আজ আবার।
তনয়া;; ওইদিন ঘুড়তে দিয়েছিস তুই আমাকে। আমাকে নিয়ে এসে পরেছে জোর করেই। চল আজ যাই না।
রাশেদ;; হ্যাঁ ম্যাম চলুন যাই।
রোদেলা;; এই চলো না যাই প্লিজ প্লিজ।
তনয়া;; যাবি না মানে যেতেই হবে।
আইরাত;; আরে বাবা ওকে ফাইন যাবো যাবো।
বিকেলের দিকে বের হবো।

আইরাতকে যেভাবে আকড়ে ধরেছে তাতে আর কোন উপায় রইলো না আইরাত বাধ্য হয়েই গেলো। তবে তারা কোথায় যাচ্ছে তা আইরাত কে বলে নি। এটা নাকি একটা সারপ্রাইজ তাই আইরাতকে বলা হয় নি। আইরাত আর কি করবে ওকে ফাইন না বললো কেউ। তাদের সাথে সাথে আইরাতও যাচ্ছে।

নেশাক্ত ভালোবাসা পর্ব ৫৮+৫৯+৬০