পারলে ঠেকাও পর্ব ৬

পারলে ঠেকাও পর্ব ৬
লেখিকাঃ দিশা মনি

মধুজা অক্ষরের রুমে চলে আসে। অক্ষর বিছানায় হেলান দিয়ে শুয়ে আসে। মধুজাকে রুমে আসতে দেখে ক্ষীণ স্বরে বলে,
‘আমার মাথাটা একটু টি’পে দেবে হানি। খুব ব্যাথা করছে।’
অক্ষরের সরল আবেদন ফেলতে পারে না মধুজা। বিছানায় বসে তার মাথা টি’পে দিতে থাকে। অক্ষর আচমকা মধুজার হাত ধরে ফেলে।

‘আমার জন্য তোমাকে অনেক কথা শুনতে হচ্ছে তাইনা? তোমার ফ্রেন্ড, কাজিন সবাই নিশ্চয়ই বলছে যে, কেমন পরিবারে বিয়ে করলা যে তোমার দেবর একজন আসামী। কিন্তু বিশ্বাস করো আমার ভাই এমন নয়। ও অনেক মেধাবী একজন স্টুডেন্ট। ছাত্র রাজনীতিতে জড়িয়ে ও বিপথগামী হয়ে গেছে। আমাদের বিয়ের দিন বিরোধীদলের সাথে এক হা’তাহাতিতে জড়িয়ে পড়ে ও। যার কারণে সেদিন আহত হয়ে গেছিল।’
মধুজা এবার ব্যাপারটা বুঝতে পারে।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

‘তার মানে এই কারণে আপনি ওকে হসপিটালে নিয়ে গেছিলেন এবং সেখান থেকে এম্বুলেন্সে করে,,,’
‘হুম। জানো আম্মু, আব্বু সবাই বর্ণর থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। কিন্তু আমি চাইলেও মুখ ফিরিয়ে নিতে পারছি না। হাজার হোক নিজেরই তো ভাই। আম্মু বরাবরই চাপা স্বভাবের মানুষ। বাইরে থেকে যতোটা শান্ত আর স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করুন না কেন আমি জানি উনি ভেতরে ভেতরে অনেক কষ্ট পাচ্ছেন। বরাবরই আমাদের দুই ভাইকে শাসনে মানুষ করেছেন উনি। আমাদের ভালোর জন্যই।’

আর কোন কথা হয়না তাদের মাঝে। মাথা টি’পে দেওয়ার এক মুহুর্তে অক্ষর ঘুমিয়ে যায়। মধুজা অক্ষরের মাথা বালিশে রেখে, তার গায়ে কম্বল জড়িয়ে দেয়। অক্ষরের পাশেই গুটিশুটি হয়ে শুয়ে পড়ে। ঘুমন্ত অবস্থায় খুব নিষ্পাপ লাগছিল অক্ষর চৌধুরীকে। মধুজা অক্ষরের নাক টিপে বলে,
‘পাগলা ডাক্তারকে খুব ইনোসেন্ট লাগছে।’
আচমকা অক্ষর বলে,

‘আমার ঘুমানোর সুযোগ নিচ্ছ হানি। এটা কিন্তু ভালো ব্যাপার নয়।’
মধুজার পুরো শরীর কেপে ওঠে অক্ষরের কথায়। সে মনে মনে বলে,
‘এই পাগলা ডাক্তারটা তাহলে ঘুমায় নি। উফ পাগল করে রেখে দিল আমায়।’
অক্ষর কোন উত্তর না পেয়ে মশকরা করে বলে,

‘আমার কিন্তু ঘুমানোর সময় গায়ে পা তুলে দেওয়ার অভ্যাস আছে। তাই একটু সাবধানে থেকো।’
মধুজা অদ্ভুত একটি কান্ড ঘটিয়ে ফেলে। বিছানা থেকে উঠে গিয়ে নিজের ব্যাগ থেকে একটি ওড়না নিয়ে আসে। ওড়নাটি দিয়ে অক্ষরের পা বেধে দেয়। অক্ষর পুরো ঘটনায় হতবিহ্বল হয়ে যায়। মধুজা বাকা হেসে বলে,
‘এভাবে থাকুন দেখবেন বদভ্যাসটা চিরতরে হারিয়ে যাবে।’
‘এটা কিরকম শাস্তি হানি?’

‘আপনার পাগলামো ঠেকানোর করার জন্য এরকম অনেক শাস্তিই আমাকে দিতে হবে পাগলা ডাক্তার।’
‘দেখি ঠেকাতে পারো কিনা।’

আজ সকাল সকাল উঠে নিজের হাতে সবার জন্য চা তৈরি করেছে মধুজা। সে জানে এই বাড়ির কারো মন মেজাজ ভালো নেই তবুও এই সামান্য প্রচেষ্টা তার। অক্ষর একটু পরেউ হাসপাতালে চলে যাবে৷ তার আবার চা পছন্দ নয়৷ মধুজা তবুও অক্ষরের জন্যেও চা বানিয়েছে। পাগলা ডাক্তারের ওতো খাতির করার ইচ্ছা তাই নাই।
অনীল চৌধুরী ড্রয়িং রুমে বসে খবরের কাগজ পড়ছিলেন। একটু পরেই তার চোখ আটকে যায় একটি খবরে। যেখানে লেখা,

‘বিশিষ্ট ব্যবসায়ী অনীল চৌধুরীর ছেলে’কে মা’রামা’রির জন্য গ্রেফতার করা হয়েছে।’
নিউজটা দেখে তার মেজাজ আরো বিগড়ে যায়। ছেলের জন্য আজ তার এতদিনের তৈরি করা সব মান সম্মান নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
মমতা চৌধুরীও খবরের কাগজে কলামটি দেখেছে। তবুও তার আচরণ বেশ স্বাভাবিক। মধুজা ড্রয়িংরুমে এসে প্রথমে অনীল চৌধুরীকে চা দেয়। মমতা চৌধুরী’কে চা দিয়ে বলে,

‘আমি জানি আপনি কাল রাতে বেলকনিতে এসে কাদছিলেন। মন খারাপ করবেন না। পাগ,,, মানে আপনার বড় ছেলে বলেছে সে গিয়ে আপনার ছোট ছেলেকে ছাড়িয়ে নিয়ে আসবে।’
মমতা চৌধুরী স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেন। বাইরে থেকে সবাইকে যতোই তিনি দেখান যে তিনি ঠিক আছেন কিন্তু তার ভেতরে কি তোলপাড় চলছে সেটা একমাত্র তিনিই জানেন। সন্তান যেমনই হোক না কেন মা কখনো তাকে ফে’লে দিতে পারে না। অনেক সময় শাসন করে, মুখ ঘুরিয়ে নেয়; তবে সেটা সন্তানের মঙ্গলের জন্য।
অক্ষর হাসপাতালে যাওয়ার জন্য বের হচ্ছিল। তখন মধুজা চায়ের কাপ নিয়ে তার সামনে গিয়ে দাড়ায়। চা দেখে ভ্রু কুচকে ফেলে অক্ষর।

‘তুমি জানো না আমি চা খাইনা? আমি তো বললাম কফি তৈরি করতে।’
‘আপনার ওতো কথা শুনে আমার কাজ নাই। চা দিলাম চুপচাপ ভদ্র ছেলের মতো খেয়ে নিন।’
অক্ষর বুঝতে পারে মধুজা তাকে জব্দ করতে চাইছে। অক্ষরও মনে মনে দুষ্টু বুদ্ধি করে নেয়। চা টা হাতে নিয়ে চারিদিকে চোখ বুলিয়ে নেয়।

অনীল চৌধুরী খবরের কাগজ পড়ছিল, মমতাও অন্যদিকে ঘুরে চা খাচ্ছে। অক্ষর এই সুযোগটাই কাজে লাগায়। মধুজা একটু অন্যমনস্ক হতেই তার গালে চুমু খেয়ে নেয় অক্ষর। মধুজা আচমকা এই চুমুর ফলে হতবাক হয়ে যায়।
অক্ষরদের বাড়ির কাজের মেয়ে রাওনাফ এই ঘটনা দেখে নেয়। সে জোরে কেশে উঠতেই অক্ষর লজ্জা পেয়ে হাসপাতালের জন্য চলে যায়। মধুজা তখনো মূর্তির মতো দাড়িয়ে ছিল। রাওনাফ মধুজার কাছে এসে মিটিমিটি হেসে বলে,
‘বড় সাহেব আপনাগো খুব সোহাগ করে তাইনা আপামনি?’

মধুজা ভ্রু কুচকে রাওনাফের দিকে তাকায়। বয়স বড়জোর ১৫-১৬ হবে। তাতেই এত পেকে গেছে। মধুজা রাগী স্বরে বলে,
‘এইটুকু পুচকু মেয়ে তুমি কি বুঝো? তোমার মতো বয়সে আমি বাবার কোলে বসে ভাত খেতাম।’
‘আমরা আপনাগো মতো নই আপামনি। আমাদের গেরামে তো আমার মতো বয়সী কত মেয়ে মা হয়ে বসে আছে। আমি তো বান্ধবীর লগো শুনি তাদের জামাই কেমন করি তাদের লগে আদর করে।’
মধুজা ইতস্তত বোধ করতে থাকে।

‘শোন এসব আদর সোহাগ বাদ দিয়ে পড়াশোনায় মন দাও৷ শুনলাম তোমাকে নাকি স্কুলে ভর্তি করানো হয়েছে। একবারও বই নিয়ে বসতে দেখলাম না তোমাকে। আসছি থেকে দেখছি কাজের ফাকে খালি টিভি দেখো।’
‘ভালো কথা মনে কইরে দিলেন আপামনি। আমার সিরিয়াল শুরু হয়েছে। গেলাম আমি।’

মধুজার অবসর সময় যেন অতিবাহিতই হতে চাচ্ছেনা! জার্নালিজমের পড়াশোনা তার কমপ্লিট৷ এখন শুধু কোন নিউজ পেপারের সাংবাদিক হিসেবে জব পেলেই হয়। অনেক যায়গায় আবেদনও করেছে মধুজা। কিন্তু কাঙ্ক্ষিত ফল পায়নি। তাছাড়া এই ফ্যামিলি থেকে জব করতে দিবে কিনা সেই নিয়েও বেশ চিন্তায় আছে মধুজা। এসব চিন্তার মধ্যেও মধুজা দেখে মমতা চৌধুরী তার রুমের বাইরে দাড়িয়ে আছে। মধুজা তাকে দেখে বিছানা থেকে উঠে বলে,

‘আপনি কখন এলেন? বাইরে আছেন কেন ভেতরে আসুন।’
মমতা চৌধুরী ভেতরে আসতে আসতে বলেন,
‘আমি এক্ষুনি এলাম। তুমি তো রাতে ডিনার করোনি। চলো এখন করে নাও। অক্ষরের ফিরতে দেরি হবে। তোমার শ্বশুর খেয়ে ঘুমিয়ে গেছে। এখন শুধু তুমি আর আমি বাকি।’

মধুজা মমতা চৌধুরীকে যত দেখে ততোই অবাক হয়। এনাকে দেখলে তার মনে হয় যেন তার শাশুড়ী নয় মা হন। এত কম সময়ে এভাবে কেউ আপন করে নিতে পারে সেটা মধুজা ভাবতেও পারেনি। মধুজা উঠে পড়ে। মমতা চৌধুরীর সাথে নিচে চলে যায় খেতে। রাওনাফ খাবার পরিবেশন করছিল। মমতা চৌধুরী রাওনাফকে বলে,
‘তুইও এখনো খাসনি। টিভিটা বন্ধ করে খেতে আয়। খেয়ে পড়তে বস। টিভি দেখে কোন লাভ নেই, পড়াশোনা কর তাহলে আর এভাবে মানুষের বাড়িতে কাজ করতে হবে না।’

খাওয়া শেষ করে উঠে যাওয়ার সময় মমতা চৌধুরী মধুজাকে উদ্দ্যেশ্য করে বলে,
‘নিজের প্রয়োজনীয় কাপড় চোপড় গুছিয়ে নাও। কাল তোমাকে তোমার বাবার বাড়িতে যেতে হবে। আমি অক্ষরকে বলে দেব ও তোমাকে পৌছে দেবে।’
মধুজা জানতে চায়,
‘কেন যেতে হবে?’
মমতা চৌধুরী মৃদু হেসে বলেন,

‘আরে এটাই তো নিয়ম। কাল তোমাদের একসাথে ওবাড়িতে যেতে হবে।’
মধুজা ‘ও’ বলে নিজের রুমে চলে যায়। রুমে এসে তার ঘুমই আসছিল না। অক্ষরের কথা মনে পড়ছিল। সে থাকলে হয়তো এতক্ষণে বিভিন্ন বিরক্তিকর কথা বলে মধুজার মাথা খারাপ করে রেখে দিত। মধুজা নিজের ভাবনার উপর নিজেই রাগ করে।

পারলে ঠেকাও পর্ব ৫

‘ঐ পাগলা ডাক্তারের কথা ভাবছি কেন? উনি নেই ভালোই হয়েছে।’
মধুজা বিছানা ঠিক করে ঘুমানোর প্রস্তুতি নেয় তখনই মধুজার ফোনে একটি ম্যাসেজ আছে। মধুজা চেক করে দেখে এটা অক্ষরের ম্যাসেজ। অক্ষর লিখেছে,
‘ঘুমিয়ে পড়ো হানি। আমি বাড়ি ফিরে ঘুমন্ত তোমাকে আবার আদর করে দিবো। যেভাবে সকালে আদর করে দিয়েছি।’
ব্যাস আর কি? এই ম্যাসেজ দেখেই আদর খাওয়ার ভয়ে মধুজার ঘুম উড়ে গেল!

পারলে ঠেকাও পর্ব ৭