পূর্ণিমাতিথি পর্ব ২৫

পূর্ণিমাতিথি পর্ব ২৫
লেখিকা-তাসনিম জাহান রিয়া

মাথার ওপর কারো হাতের ছোঁয়া পেয়ে ধড়ফড়িয়ে ঘুম থেকে ওঠলাম। সজাগ হয়ে নিজের মাথায় কারো হাতের উপস্থিতি অনুভব করতে ব্যর্থ হলাম। আশেপাশে ভালো করে চোখ বুলিয়ে দেখলাম কেউ নেই। উনি তো বাসায় নেই। আজকে উনার হসপিটালে নাইট সিফটে ডিউটি। নিজের মনের ভুল ভেবে আবার শুয়ে পড়ি। বাকি রাত আর দু চোখের পাতা এক করতে পারলাম না। রেজাল্ট নিয়ে ভীষণ টেনশন হচ্ছে। আগামীকালের রেজাল্টের ওপর নির্ভর করবে আমার স্বপ্ন পুরণ হবে কী না।

ভোর রাতের দিকে রুদ্র বাসায় আসলো। আমি উনার সাথে কথা বললাম না। উনি উনার মতো ফ্রেশ হয়ে নিলেন। আমার মনটা কেমন অস্থির অস্থির লাগছে। কোনো কিছুতেই মন বসাতে পারছি না। আজান দিতেই আমি ফ্রেশ হয়ে ওযু করে নিলাম। উনি মসজিদে চলে গেলেন। নামাজ পড়লে পড়লে অশান্ত মনও শান্ত হয়ে যায়। অন্য রকম এক প্রশান্তি অনুভব হয়।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

উনি মসজিদ থেকে এসেই শুয়ে পড়লেন। আমি নামাজ শেষে না শুয়ে ছাদে চলে এলাম। নামাজ পড়ার পর মনের অস্থিরতা অনেকটাই কেটে গেছে। সকালের নির্মল হাওয়া, শান্ত পরিবেশ আমাকে মুগ্ধ করে দিচ্ছে। একদিকে ভালো লাগা কাজ করছে আরেক দিকে টেনশন হচ্ছে। রেজাল্ট কি হবে এটার চিন্তাই মাথা ফেটে যাচ্ছে। যদি এ+ না আসে তাহলে আমার স্বপ্ন আর পুরণ হবে না।

ছাদে একটা দোলনা আছে। অবশ্য এই বাসার ছাদটা আমিই সাজিয়েছিলাম আমার মনের মতো করে। এই ছাদের প্রত্যেকটা গাছ আমার হাতে লাগানো। ফুলের পাশাপাশি ফলের গাছও রয়েছে। ফুল গাছের সংখ্যায় বেশি।
ছাদের রেলিংয়ের ওপর বসে পড়লাম। ফোনে টুং টাং শব্দ করে মেসেজ আসছে। মেসেজ দেখতে একদমি ইচ্ছে করছে না আর আমি জানি ত্রয়ী মেসেজ দিচ্ছে। এই মেয়েটা প্রত্যেকটা রেজাল্টের সময়ই এমন করে। ফোন দিয়ে মেসেজ করে আমাকে পাগল বানিয়ে দেয়। যতক্ষণ না রেজাল্ট দিবে ততক্ষণ পর্যন্ত এমনি করবে।

৯ টার দিকে ছাদ থেকে নিচে নেমে আসলাম। ড্রয়িংরুমে চাঁদের হাঁট বসেছে। আব্বু, আম্মু, ভাইয়া, রিদি আপু, নিয়াম ভাইয়া, নিধি আসছে। কিন্তু সবাইকে দেখে আমি মোটেও অবাক হলাম না। আমি জানতাম সবাই আসবে। যদি না আসতো তাহলে ভীষণ অবাক হতাম। কারণ এই মানুষগুলো আমার জীবনের এমন কোনো বিশেষ মুহূর্ত নেই যখন তারা আমার পাশে ছিল না।

ভাইয়া বেশ আয়েশ ভঙ্গিতে সোফায় বসে মিষ্টি খাচ্ছে। আমাকে দেখেই ভাইয়া বলে ওঠলো।
ঐ তো রিয়া চলে এসেছে আর কাউকে যেতে হবে না। রিয়ু এতো টেনশন করিস না। আয় এদিকে মিষ্টি খা। আমি জানি তুই ফেইল করবি।
আমি ভাইয়ার দিকে চোখ পাকিয়ে তাকাই। তারপর আম্মুর দিকে তাকিয়ে ইনোসেন্ট মুখ করে বলি, আম্মু দেখো ভাইয়া কী বলছে?

আম্মু ভাইয়ার বাহুতে থাপ্পড় দিয়ে বলে, তুই আর ভালো হবি না? দেখছিস মেয়েটা টেনশন করছে। তার মাঝে তুই মেয়েটার পিছনে লাগছিস। আরেকবার কিছু বললে তোর খবর আছে।
এতো টেনশন করার কী আছে? ও জানে না ও কেমন পরীক্ষা দিয়েছে। পরীক্ষা খারাপ দিয়েছে বলেই এতো টেনশন করছে। আমার পরীক্ষার রেজাল্টের সময় আমি কতো চিল মুডে ঘুরতাম।

রিদি আপু মাঝখান থেকে বলে ওঠে, কেমন যে চিল মুডে ঘুরে বেড়াতি আমাদের জানা আছে। পরীক্ষার রেজাল্টের আগের দিন থেকে রুমে দরজা বন্ধ করে বসে থাকতি। যতক্ষণ পর্যন্ত রেজাল্ট না দিতো ততক্ষণ দরজা বন্ধ করে বসে থাকতি। খালামনি যদি বলতো শাওন তুই এ+ পেয়েছিস তাহলেই তুই দরজা খুলতি। জেএসসি পরীক্ষার সময় কী কান্ডটা নায় ঘটিয়েছিলি।

এখনো মনে পড়লে আমার হাসি পায়। রেজাল্টের দুই দিন আগে থেকে খাওয়া দাওয়া বন্ধ করে দিয়ে রুমে দরজা বন্ধ করে বসেছিলি। রেজাল্টের দিন সোজা গিয়ে পুকুরে নেমে পড়লি। তখন কী ভয়াবহ ঠান্ডা ছিল। কেউ বলেও তোকে আটকাতে পারেনি। জানিস রিয়া কেনো পানিতে নেমে ছিল। টেনশনে নাকি তার মাথা গরম হয়ে যাচ্ছে। মাথা ঠান্ডা করার জন্য আর টেনশন কমানোর জন্য সে পুকুরে নেমে গেছে। রেজাল্ট শুনেই অঙ্গান হয়ে গিয়েছিল। ঠিক মতো খাওয়া দাওয়া না করা শীতের মাঝে পানিতে ভিজার কারণে অঙ্গান হয়ে গিয়েছিল। রেজাল্ট নিয়ে আনন্দ করা রেখে সবাই শাওনকে নিয়ে হসপিটালে ছুটে।

রিদি আপুর কথা শেষ হতেই সবাই এক পতন হেসে নেয়। ভাইয়া মুখ কাঁচুমাচু করে বসে আছে। এতক্ষণ পরে নিয়াম ভাইয়া মুখ খুললেন,
রুদ্র কোথায়? আমরা এতো দূর থেকে চলে এলাম। রুদ্রর কোনো খবরই নাই। তার বউয়ের রেজাল্ট দিবে তারই পাত্তা নেই।

রিদি আপু নিয়াম ভাইয়াকে রাগ দেখিয়ে বলে, আমার ভাই তোমাদের মতো চাকরি করে না। তোমাদের মতো সারাদিন শুয়ে বসে টাকা পায় না। ওকে পরিশ্রম করতে হয়।
তুমি আমাকে অপমান করছো। তুমি আমাকে টো টো কম্পানির ম্যানাজার বলছো। আমিও কম পরিশ্রম করি না ওকে।
পরিশ্রম করোই তো শুধু শুধু বসে বসে অর্ডার করো। এটা করো, ওটা করো।

রেজাল্ট দিবে সাড়ে ১১টা নাগাদ। জানি রেজাল্ট হাতে পেতে পেতে ১২ টাই বেজে যাবে। উনি ঠিক সাড়ে ১১ টাই নিচে নামলেন। ১২ টা বাজতেই উনি আর ভাইয়া রেজাল্ট দেখতে বসে পড়লেন। টেনশনে আমার হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে আসছে। আমি একা ধারে পায়চারী করছি। অল্প কিছুক্ষণ পরেই ভাইয়া মুখ কালো করে আমার দিকে তাকায়। ভাইয়ার মুখ দেখে আমার বুকের ভিতর ধক করে ওঠে। আম্মু ভাইয়াকে জিঙ্গেস করে,

রেজাল্ট কী হয়ছে?
রিয়া ফেইল করছে।
কথাটা শুনেই আমি দু পা পিছিয়ে গেলাম। আমার চোখ জলে টই টুম্বুর হয়ে গেছে। আমি দৌড়ে রুমে চলে এলাম। পিছন থেকে ভাইয়া অনেক ডেকেছিল কিন্তু আমি শুনিনি। মাথায় অসহ্য যন্ত্রণা হচ্ছে। রাস্তা বের হলে সবাই বলবে রিয়া ফেইল করছে এটা আমি কিছুতেই মেনে নিতে পারবো না। আমি নিজের স্বপ্ন আব্বুর স্বপ্ন কারোর স্বপ্নই পুরণ করতে পারলাম না।

আমি রুমে এসে দরজা বন্ধ করতে নিলেই রুদ্র এসে বাধা দেয়। রুদ্র আমাকে ঠেলে ভিতরে ঢুকে পড়ে। উনি নিজেই দরজা বন্ধ করে দেন। আমার দুই গালে হাত রেখে চোখের পানি মুছতে মুছতে বলেন,
বোকা মেয়ে শাওন ভাইয়া তো তোমার সাথে ফাজলামো করছিল। সবটা না শুনেই আগেই দৌড়ে চলে আসছো। তুমি ফেইল করো নাই। তুমি এ+ পেয়োছ।

কথাটা মস্তিষ্কে পৌছাতেই আমি উনার বুকে ঝাপিয়ে পড়লাম। উনাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দিলাম। উনি পরম মমতায় আমাকে উনার বুকে আগলে নিলেন। আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলেন,
এখন কাঁদছো কেনো? এখন তো তোমার হাসার সময়। এই কান্না থামাও। সবাই ভাববে আমি তোমাকে মেরেছি তাই তুমি কান্না করছো। এখনি কিন্তু তোমার হিটলার বাপ আমার মাথা ফাটাতে আসবে।

আমি তো আনন্দে কাঁদছি। আমার স্বপ্নের পুরণের আরেকটা ধাপ পার করে ফেললাম। আমার স্বপ্নের খুব কাছে আমি চলে আসছি। এবার আমার স্বপ্ন পুরণ হবে তাই না?
হুম। তোমার নিজের ওপর বিশ্বাস নেই। কিন্তু আমার তোমার ওপর পূর্ণ বিশ্বাস ছিল। আমি জানতাম তুমি সবার আশানুরূপ ফলাফল করবে।

কিছুক্ষণ আগেই ইলান ভাইয়াদের বাসায় আসছি। আমার রেজাল্টের খবর শুনে রুনা আপু আর ইলান ভাইয়ার আম্মু ভীষণ খুশি হয়েছে। আন্টি তো আমাকে নিজের গলার চেইন খুলে পড়িয়ে দিয়েছেন। রুনা আপু আমার হাতে একটা বড় গিফট বক্স ধরিয়ে দিয়েছে। এটা নাকি ইলান ভাইয়া আমার জন্য কিনেছিল। আমার রেজাল্টের দিন দিবে বলে। রুনা আপু কাঁদছে। আমার চোখ থেকে দু ফোটা অশ্রু গড়িয়ে পড়লো।

পূর্ণিমাতিথি পর্ব ২৪

হুট করেই কলিংবেল বেজে ওঠলো। সবাইকে বলে আমি দরজা খুলতে গেলাম। দরজা খুলে দরজার সামনে ইলান ভাইয়াকে দেখে থমকে গেলাম। আমার বিশ্বাসই হচ্ছে না ইলান ভাইয়া আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে।

পূর্ণিমাতিথি পর্ব ২৬