পূর্ণিমাতিথি পর্ব ২৬

পূর্ণিমাতিথি পর্ব ২৬
লেখিকা-তাসনিম জাহান রিয়া

হুট করেই কলিংবেল বেজে ওঠলো। সবাইকে বলে আমি দরজা খুলতে গেলাম। দরজা খুলে দরজার সামনে ইলান ভাইয়াকে দেখে থমকে গেলাম। আমার বিশ্বাসই হচ্ছে না ইলান ভাইয়া আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। আমি স্তব্ধ নয়নে তাকিয়ে আছি ইলান ভাইয়ার দিকে। মনে হচ্ছে আমি স্বপ্ন দেখছি। ইলান ভাইয়া অনেকটা বিধস্ত অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে। মাথায় ব্যান্ডেজ, হাতে ব্যান্ডেজ গালের পাশে তিনটা সিলি। আমাকে দরজার সামনে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে রুদ্র আমার দিকে এগিয়ে আসতে আসতে বলেন,

তুমি এভাবে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছ কেনো? কে এসেছে?
রুদ্র দরজার সামনে ইলান ভাইয়াকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে স্থির হয়ে গেলো। স্তব্ধ নয়ে অনিমেষ তাকিয়ে আছে ইলান ভাইয়ার দিকে। রুদ্র ইলান ভাইয়ার দিকে এক হাত বাড়িয়ে দিলো। উনার হাতটা অসম্ভব রকম কাঁপছে। ইলান ভাইয়াকে ছুঁতে গিয়েও ছুতে পারছে না।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

উনার হাতটা থরথর করে কাঁপছে। ইলান ভাইয়া খপ করে রুদ্রর হাতটা ধরে ফেললেন।
আমি ইলান। তোর সামনেই দাঁড়িয়ে আছি। আমাকে ভিতরে আসতে দিবি না।
ইলান ভাইয়ার গলা শুনে ইতিমধ্যে রুনা আপু আর আন্টিও ছুটে এসেছে। দুজনেরই আঁখি অশ্রুতে টলমল করছে। শরীর দুর্বল থাকায় ইলান ভাইয়া পড়ে যেতে নেয়। পড়ে যাওয়ার আগেই রুদ্র ইলান ভাইয়াকে খপ করে ধরে ফেলে। ইলান ভাইয়া সবার দিকে তাকিয়ে অমায়িক হাসে। ইলান ভাইয়ার মুখে সব সময় হাসি লেগেই থাকে। আজকেও তার ব্যতিক্রম হলো না। ঠিক করে দাঁড়াতে পারছেন না কিন্তু উনার মুখে মুচকি হাসি লেগেই আছে। চোখ দুটো ছলছল করছে। হয়তো এতোদিন পর নিজের পরিবারের মানুষগুলোকে দেখে কেমন রিয়েকশন দিবে বুঝতে পারছে না।

রুদ্র আর রুনা আপু ইলান ভাইয়াকে ধরে ধরে ভিতরে নিয়ে যায়। আমিও দরজা লাগিয়ে উনাদের পিছন পিছন আসি। ইলান ভাইয়াকে নিয়ে সোজা রুমে যান। ইলান ভাইয়াকে আধ শোয়া করে বিছানায় বসাতেই রুনা আপু আর আন্টি ঝাঁপিয়ে পড়ে ইলান ভাইয়ার বুকে। হু হু করে দুজন কেঁদে দেয়। ইলান ভাইয়া দুজনের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে কান্না থামানোর চেষ্টা করছে। এতো সহজে কী কান্না থামে? এতোদিনের জমে থাকা চোখের অশ্রু আজকে উপচে পড়ছে। রুনা আপু কান্না জড়িত কন্ঠে বলে,

এতোদিন তুমি কোথায় ছিলে? এই কয়েকটা দিন আমার আর মার কীভাবে কেটেছে তুমি জানো? তোমার হাতে পায়ে এতো আঘাত কেনো? কী হয়েছিল তোমার?
তোমরা কান্না বন্ধ করো প্লিজ। আমি তো ফিরে এসে। দেখো আমি একদম ঠিক আছি। হাত পায়ে একটু ছুট লেগেছে শুধু।
ইলান ভাইয়া অনেক কিছু বলে দুজনকে শান্ত করে। রুনা আপু বাচ্চাদের মতো বিহেইভ করছে। কতোদিন পর নিজের ভালোবাসার মানুষকে কাছে পেলো। ইলান ভাইয়া রুদ্রকে উদ্দেশ্য করে বলে,

আমি আসাতে কী তুই খুশি হসনি? আমার থেকে এতো দূরে কেনো দাঁড়িয়ে আছিস?
রুদ্র গিয়ে ইলান ভাইয়াকে জড়িয়ে ধরে।
তুই নিজেও জানিস না তোকে ছাড়া আমার এতোগুলো দিন কীভাবে কেটেছে। প্রতিমুহূর্তে তোর স্মৃতি আমাকে তাড়া করেছে। যেদিন থেকে তোর সাথে আমার পরিচয় তারপর থেকে একটা দিনও আমি তোকে ছাড়া আমি থাকিনি। তোর মৃত্যুর খবর শুনে আমাদের কী অবস্থা হয়েছিল ভাবতে পারছিস?

মানে? আমার মৃত্যুর মানে? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।
রুদ্র ইলান ভাইয়াকে সব কিছু খুলে বলে।
ঐ দিন তোর সাথে যখন আমি ফোনে কথা বলছিলাম ঠিক তখনি একটা গাড়ি আমাকে পিছন থেকে ধাক্কা দেয়। আমার হাত থেকে ফোনটা ছিটকে পড়ে যায় আর আমি মুখ থুবড়ে নিচে পড়ে যাই। চোখ জোড়া বন্ধ হওয়ার আগে দেখতে পাই কয়েক জোড়া পা আমার দিকে এগিয়ে আসছে।

তারপর যখন চোখ খুলি নিজেকে হসপিটালে আবিষ্কার করি। কতদিন পর ঙ্গান ফিরেছিল সেটা বলতে পারব না। কিন্তু বেশিক্ষণ চোখ খুলে রাখতে পারিনি। যাস্ট এক পলক হসপিটালটা দেখতে পাই। পরের বার যখন চোখ মেলে তাকাই তখন নিজেকে গুদাম ঘরের মতো একটা জায়গায় আবিষ্কার করি। আমাকে একটা চেয়ারের সাথে বেঁধে রাখা হয়েছিল। চারপাশে ছিল ভাঙা জিনিস পত্র। বাইরে থেকে আসা আগন্তুকদের কন্ঠে শুনে বুঝতে পেরেছিলাম তারা বেশ কয়েকজন মিলে আমাকে পাহাড়ে দিচ্ছে আর আমাকে হসপিটাল থেকে কিডন্যাপ করে নিয়ে আসা হয়েছে। দিনে এক থেকে দুই বার খাবার দিতো। খাবারের দিতে আসলেই অল্প কিছুক্ষণের জন্য হা-পা খুলে দিতো। আজকে সুযোগ বুঝে সেখান থেকে পালিয়ে আসি।

তুই জানিস তোকে কে ওখানে আটকে রেখেছিল বা তাকে দেখেছিলি?
না। কে আমাকে হসপিটালে নিয়ে গিয়েছিল বা কার কথায় আমাকে কিডন্যাপ করা হয়েছিল কিছুই আমি জানি না।
আমি একটু আসছি। তুমি এখানেই থেকো, এখান থেকে কোথাও যাবে না। আমি এসে তোমাকে নিয়ে যাব। একদম পাকনামি করে একা যাওয়ার চেষ্টা করবে না। আমি ডক্টরকে ফোন করে দিবো। ডক্টর এসে ইলানকে দেখে যাবে।
উনি আমাকে উদ্দেশ্য করে কথাগুলো বলে চলে গেলেন। ইলান ভাইয়া নড়েচড়ে বসে বলে,
আজকে কয় তারিখ? আমি ঠিক আন্দাজ করতে পারছি না আজকে কয় তারিখ। আমি কয়দিন অঙ্গান ছিলাম সেটাও জানি না।

আমি ফট করে বলে ওঠি, তেরো তারিখ।
তার মানে আজকে তোমার রেজাল্ট দিয়েছে। কংগ্রেস।
আমার রেজাল্ট না শুনেই আপনি আমাকে কংগ্রেস করছেন?
আমি জানি তুমি ভালো রেজাল্ট করেছো। তুমি কখনো খারাপ রেজাল্ট করতেই পারো না। রুনা রিয়াকে আমার আনা গিফটটা দিয়েছো।
রুনা আপু মাথা নেড়ে সম্মতি জানায়। আমি আর আন্টি ইলান ভাইয়া আর রুনা আপুকে স্পেস দিয়ে চলে যাই। রুদ্র ডক্টরকে ফোন করে দিয়েছে আর কিছুক্ষণের মাঝেই ডক্টর চলে আসবে রুদ্র আমাকে মেসেজ করে দিয়েছে।

বাতাসে বহিছে প্রেম,
নয়নে লাগিল নেশা
কারা যে ডাকিলো পিছে
বসন্ত এসে গেছে……..

পাশের বাসা থেকে রিন রিনে সাউন্ডে গান ভেসে আসছে। পাশের বাসায় কখনোই উচ্চস্বরে গান বাজায় না। আজকে ১৪ই ফেব্রুয়ারি। একদিকে ভেলেন্টাইন্স ডে আরেক দিকে পহেলা ফাল্গুন। আর আমি বইয়ের পাতায় মুখ ডুবিয়ে বসে আছি। আগামীকাল পরীক্ষা আছে কোচিংয়ে। ভেলেন্টাইন্স ডে নিয়ে আমার কখনোই উচ্ছ্বাস ছিল না। আমার মতে ভালোবাসার জন্য নির্দিষ্ট কোনো দিনের প্রয়োজন হয় না। ভালোবাসার মানুষটা ভালোবেসে পাশে থাকলে প্রত্যেকটা মুহূর্তই ভেলেন্টাইন্স ডে হয়ে ওঠে।

আমার যত উচ্ছ্বাস হচ্ছে পহেলা ফাল্গুন নিয়ে। পহেলা ফাল্গুন আর পহেলা বৈশাখের জন্য আমি প্রত্যেক বছরই অপেক্ষা করে থাকি। বান্ধবীদের সাথে শাড়ী পড়ে ঘুরে বেড়াই। রিকশা করে ঢাকা শহরের অলি গলি ঘুরে বেড়াই। হাসানের নতুন বছর নতুন গার্লফ্রেন্ড পাওয়ার ট্রিট। এবার হয়তো আর হাসানের কাছ থেকে ট্রিট পাওয়া হবে না। হাসান আমাদের থেকে দূরে সেই কমলা কান্দা অবস্থান করছে। আমার সব ফ্রেন্ডরা যে বাংলাদেশের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। চাইলেও সবাই একসাথে হওয়া সম্ভব না। যদিও সবাই আসে তবুও ডাক্তারবাবু আমাকে যেতে দিবেন না। উনি তো আমাকে বাসা থেকে এক পা একা হাঁটতে দিবেন না। আর উনি নিজেও আমাকে নিয়ে যাবেন না।

আমার স্বপ্ন ছিল বিয়ের পর প্রথম বসন্তে আমার হাজবেন্ডের হাতে হাত রেখে ঢাকা শহরের অলি গলি হেঁটে বেড়াবো। আমি বাসন্তী কালার শাড়ি পড়বো আর উনি বাসন্তী কালার পাঞ্জাবি। উনি আমার খোপায় বেলি ফুলের মালা জড়িয়ে দিবেন। কিন্তু ডাক্তারবাবু দ্বারা এসব জীবনেও সম্ভব না। উনি তো আস্ত একটা আনরোমান্টিক। রোমান্টিকের ‘র’ ও বুঝে না। এবার ফাল্গুন্টাইনটা হয়তো আমার বইয়ের সাথেই পালন করতে হবে। আহা এতো দুঃখ আমি কই রাখি?
আমি যখন দুঃখ বিলাস করতে ব্যস্ত তখনি রুদ্রের আগমন ঘটে। পড়া রেখে আমাকে এভাবে বসে থাকতে দেখে রুদ্র আমার দিকে ভ্রু কুচকে তাকিয়ে বলে,

পূর্ণিমাতিথি পর্ব ২৫

কী সমস্যা? পড়া রেখে মুখটা এমন করে রেখেছো কেনো?
জীবনের এতগুলো বসন্ত কেটে গেলো কিন্তু কেউ বসন্ত বিলাস করতে নিয়ে গেলো না। এতো দুঃখ আমি কোথায় রাখব সেটাই ভেবে পাচ্ছি না।
একটা বালতি এনে দেই সেটাই ভরে রাখ। যদি বালতিতে না হয় তাহলে একটা ড্রাম এনে দেই সেটাই তোমার দুঃখগুলো ভরে রাখ।

পূর্ণিমাতিথি পর্ব ২৭