পূর্ণিমাতিথি পর্ব ২৮

পূর্ণিমাতিথি পর্ব ২৮
লেখিকা-তাসনিম জাহান রিয়া

আমার ঘাড়ের দিকে ইশারা করে বলে। আমি আপুর দিকে তাকিয়ে মেকি হেসে বলি,
এতো ফাস্ট না দৌড়ে একটু স্লো যাও। এটা তোমার ভাইয়ের দেওয়া না তোমার মেয়ের দেওয়া চিহ্ন। তোমার ভাই করবে রোমান্স? তোমার ভাই রোমান্সের ‘র’ ও বুঝে না।
একদম আমার ভাইকে অপমান করবি না।
ভাইয়ের জন্য দরদ উতলায়ে পড়ছে। ভাইয়ের কথা বাদ দিয়ে এই বোনের একটু সেবা করো। মাথায় একটু হাত বুলিয়ে দাও। মাথাটা প্রচণ্ড ব্যথা করছে। একটু ঘুমাবো।

রুদ্র আমার দিকে ক্রমশ এগিয়ে আসছে আমি পিছিয়ে যাচ্ছি।
আপনি পিছিয়ে যাচ্ছেন কেনো? রোমান্স করবেন নাহ? আপনি রোমান্স সম্পর্কে এ টু যেট সব বুঝেন। আমি তো রোমান্সের ‘র’ ও বুঝি না। তাই না? আপনার তো রোমান্স করার অনেক সখ। আসেন রোমান্স করি।
সরি সরি আমার ভুল হয়ে গেছে।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

আপনার কোনো ভুল হয়নি। ভুল তো আমার হয়েছে ঘরে এতো সুন্দর বউ থাকার পরও তার দিকে ভালো করে তাকায়নি। এতো সুন্দর একটা বউ থাকলে রোমান্স না করে থাকা যায়।
উনি কথাটা বলেই ঠোঁট কামড়ে আমার পা থেকে মাথা পর্যন্ত স্ক্যান করলেন। উনার এমন দৃষ্টি দেখে বুকের ভিতর ধড়ফড় ধড়ফড় করছে।

উনি ধাক্কা দিয়ে আমাকে বিছানেই ফেলে দিলেন। উনার এক ভাঁজ করে আমার একপাশে রাখেন। হাঁটুর ভর দিয়ে আমার দিকে ঝুঁকে আসেন। আমার হাত পা প্রচণ্ড রকম কাঁপছে। এর আগে তো এমন হয়নি। উনি আমার খুব কাছে চলে এসেছেন। হুট করেই প্রচণ্ড মাথা ব্যথা শুরু হয়ে গেলো। অসহ্যকর মাথা ব্যথা। মাথা ব্যথায় চোখ দিয়ে পানি পড়তে শুরু করলো। হঠাৎই মাথা ব্যথার কারণটা বুঝলাম না। উনি আমার খুব কাছে আসতে গিয়েও থেমে গেলেন আমার চোখের অশ্রু দেখে অস্থির হয়ে পড়লেন। আমার চোখের পানি মুছে দিতে দিতে ভীত গলায় বলেন,

এই রিয়া কী হয়েছে? কান্না করছো কেনো? আমি জাস্ট তোমার সাথে ফাজলামো করছিলাম। তুমি সিরিয়াসলি নিচ্ছো কেনো? প্লিজ কান্না অফ করো।
রুদ্র
হ্যাঁ বলো কী হয়েছে?
রুদ্র আমার প্রচন্ড মাথা ব্যথা করছে। অসহ্যকর মাথা ব্যথা। মনে হচ্ছে মাথার নিউরনগুলো ছিঁড়ে যাচ্ছে। আমি আর সহ্য করতে পারছি না।
আমি উনার কলারের কাছের শার্টটা চেপে ধরলাম। উনার শার্টের একটা বাটনও ছিঁড়ে গেলো। উনি এক হাতে আমাকে ধরে রেখেছেন আরেক হাতে কাউকে ফোন করে যাচ্ছেন অনবরত।

কেটে গেছে অনেকগুলো দিন। পরিবর্তন না হলেও তো পরিবর্তন তো একটু হয়ই। মানুষ মাত্রই পরিবর্তনশীল। এর মাঝে কয়েক বারই আমাকে মারার চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু কে বা কারা আমাকে মারতে চায় সেটা আমার অজানা। রুদ্র আমার কাছ থেকে যে কিছু লুকাচ্ছে সেটা আমি ভালো করেই বুঝতে পারছি। বেশ কয়েকটা মেডিক্যালে ভর্তি পরীক্ষা দিয়েছি। প্রিপারেশন ভালো ছিল। পরীক্ষাও ভালো দিয়েছি। বাকিটা আল্লাহর হাতে।

দুই দিন হয়েছে আমাদের বাসায় আসছি। রুদ্র প্রথমে আসতে দিতে চায়নি। কিন্তু লাস্ট পর্যন্ত উনি আর মামুনির সাথে পেরে ওঠলেন না। তাই বাধ্য হয়েই আমাকে এখানে আসতে দিয়েছেন। উনার নিষেধাজ্ঞা আমার ওপর থেকে তুলে নেননি। যাবার আগে বার বার বলে গেছেন আমি যেনো বাসা থেকে একা বের না হই। কিন্তু আমি তো আমিই উনার কথাগুলো এক কান দিয়ে ঢুকিয়ে অন্য কান দিয়ে বের করে দিয়েছি।

উনি চলে যাবার পর থেকে বাঁধন হারা পাখির মতো উড়ে বেড়াচ্ছি। আজকে ত্রয়ীকে ফোন করে বলেছি গন্থাগারে আসতে। কতদিন হলো এক সাথে দুই বান্ধবীর সময় কাটানো হয় না। গল্প করা হয় না। আজকে একটা কালো রঙের ড্রেস পড়লাম। এটা উনি গিফট করেছিলেন। পরীক্ষায় ভালো রেজাল্ট করার উপহার হিসেবে এই ড্রেসটা দিয়েছিলেন। ড্রেসটা আর পড়া হয়নি। কিন্তু আজকে কেনো জানি ভীষণ পড়তে ইচ্ছে করছে।

রেডি হয়ে আম্মুকে বলে বাসা থেকে বের হয়ে এলাম। গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে চলেছি গলি দিয়ে। দুই পাশে বড় বড় বিল্ডিং। গলির শেষ মাথা পর্যন্ত যেতেই ত্রয়ী ফোন করে। ফোন করে বলে আজকে সে আসতে পারবে না। তাদের বাসায় তার ফুফি আসছে। আরো অনেক মেহমান আসছে। বাসায় অনেক কাজ। তার আম্মু একা হাতে সব করতে পারবে না। তাই সে আসতে পারবে না। তার জন্য সরি বলতে বলতে মুখে ফেনা তুলে ফেলেছে।
আমি শুধু মুচকি হাসলাম। এই মেয়েটা যে আমাকে ভীষণ ভালোবাসে সেটা আমি জানি।
আমি রাগ করলে ওর কষ্ট হয়।

আমি আবার আনমনে হাঁটতে শুরু করলাম। এখন আর বাসায় ফিরে যেতে ইচ্ছে করছে না। রাস্তার পাশ দিয়ে হেঁটে চলেছি। গলি পেরিয়ে মেইন রাস্তায় ওঠার আগেই কেউ একজন আমার হাত টেনে ধরে। আমি ঘাড়টা হালকা ঘুরিয়ে পিছনে তাকালাম। আমার ঠিক পিছনেই আমার হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছে বিহান। বিহানকে দেখেই মেজাজটা খারাপ হয়ে গেলো। আমি বিহানের দিকে অগ্নি দৃষ্টিতে তাকাতেই বিহান আমার হাত ছেড়ে দেয়। অতঃপর অনুনয় করে বলে,
প্লিজ রিয়া চিৎকার করো না। তোমার সাথে আমার কিছু কথা ছিল। প্লিজ একটু শুনবে?

একদম না। আমি আপনার মতো মানুষের কথা শুনতে চাই না। আপনার মতো একজন নিচ মানুষের কথা আমি শুনতে চাই না। আপনি মেয়েদের কী মনে করেন? বাজারের পণ্য। মেয়েদের নিয়ে যা ইচ্ছে তা করা যায়। আপনার লজ্জা করে না যে মেয়েটাকে এ্যাংগেইজমেন্টের দিন সবার সামনে অপমান করেছেন তার সাথে কথা বলতে। যার জন্য আমাকে অপমান করেছিলেন তার সাথেও তো বিয়েটা ভেঙে দিয়েছেন। আসলে আপনাদের মতো ছেলেরা এরকমই হয়। একজনকে দিয়ে তাদের হয় না।

বিহানের মুখ মলিন হয়ে আসে। চোখ দুটো জলে টলমল করছে। আমার দিক থেকে চোখ নামিয়ে মলিন গলায় বলে, কিছু না করেও আমি আজকে সবার কাছে দোষী। তোমার কাছে, বাবা-মা, আত্নীয়-স্বজন সবার কাছে। আমার দোষ এটাই একজনকে মন প্রাণ দিয়ে ভালোবেসেছিলাম। তাকে নিয়ে সারাটা জীবন কাটানোর স্বপ্ন দেখেছিলাম। থাক সেসব কথা তোমাকে যাস্ট কয়েকটা কথা বলার ছিল। একটু শুনো প্লিজ।

আমি আশেপাশে তাকালাম। চলার পথে অনেকেই আমাদের দিকে আড় চোখে তাকাচ্ছে। পরিচিত কেউ আমাকে বিহানের সাথে দেখলে সমস্যা হতে পারে। তাই আমি বিহানকে বললাম,
এভাবে রাস্তায় দাঁড়িয়ে কথা বলা ভালো দেখায় না। সামনে একটা ক্যাফে আছে ওঠাতেই চলুন।

কিছু অর্ডার করি?
না আমি কিছু খাবো না। আপনার জন্য অর্ডার করতে পারেন। কথাগুলো একটু তাড়াতাড়ি বললে ভালো হয়।
বিহান আমার দিকে তাকিয়ে আলতো হাসে। তারপর নিস্তেজ গলায় বলে,

সারা পৃথিবীর মানুষের চোখে অপরাধী হয়ে থাকলেও আমি তোমার চোখে অপরাধী হয়ে থাকতে চাই না। সহানুভূতি জিনিসটা আমার বরাবরই অপ্রিয়। আমি জীবনে কখনোই চাই নি কেউ আমাকে দয়া করুক, আমার পরিস্থিতি দেখে তারা মনে আমার জন্য সহানুভূতি জন্মাক।

পূর্ণিমাতিথি পর্ব ২৭

জীবনের এতোগুলো বছর পার করার পর মনে হলো তোমার চোখে আমার জন্য ঘৃণা দেখার চেয়ে সহানুভূতি দেখাও শান্তি। জীবনের ২৭ টা বছর কাটানোর পর এক বাচ্চা মেয়ের প্রেমে পড়ে গেলাম। তার চোখের গভীরে হারিয়ে গিয়েছিলাম। মেয়েটার মুখ আমি দেখিনি। আমি মেয়েটার চোখের প্রেমে পড়েছিলাম। মেয়েটার চোখ দুটো দেখার পর মনে হয়েছিল এই মেয়েটাকে ছাড়া আমার চলবে না।

পূর্ণিমাতিথি পর্ব ২৯