পূর্ণিমাতিথি পর্ব ৩০

পূর্ণিমাতিথি পর্ব ৩০
লেখিকা-তাসনিম জাহান রিয়া

উনি সেদিন খুব সূক্ষ্ম ভাবে আমার প্রশ্নটা এডিয়ে গিয়েছিলেন। তারপর থেকে উনাকে কোনোদিনই এই প্রশ্নটা করি নাই। কিন্তু উনার সাথে কথা বলা কমিয়ে দিয়েছি। যে আমার হবে না তার প্রতি মায়া বাড়িয়ে তো লাভ নেই। প্রয়োজনের বাইরে একটা কথাও উনার সাথে বলি না। এতে উনারও কোনো হেলদুল নেই। আমি যে উনার সাথে কথা বলি না এতে হয়তো উনার কিছু আসে যায় না বা উনি লক্ষই করেননি বিষয়টা। উনি আগের মতো আমাকে বাসায় আটকে রাখেন না।

আমাকে আমার নিজের মতো ছেড়ে দিয়েছেন। উনি উনার মতো থাকেন আর আমি আমার মতো।
আমার যখন ইচ্ছে তখন বাসা থেকে বের হয়ে যায়। রুদ্র এখন আর এসবের খোঁজ খবর রাখেন না।
মেডিক্যালে চান্স হয়েছে। যেদিন খবরটা জানতে পারি সেদিন আমার অনুভূতি কেমন হয়েছিল বলে বুঝানো সম্ভব না। আনন্দ আমি কথা বলার ভাষা হারিয়ে ফেলেছিলাম। কেঁদেছিলাম সেদিন খুব কেঁদেছিলাম। আব্বুকে জড়িয়ে ধরে। আব্বুর চোখের কোণে অশ্রু কণা ভীড় জমিয়েছিল। তবে সেটা দুঃখের নয় আনন্দের।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

গাড়ি থেকে নামতেই শত শত ছাত্রের সমাবেশ দেখতে পেলাম। কেউ গেইট দিয়ে ঢুকছে আবার কেউ বের হচ্ছে। সবার গায়েই সাদা এপ্রোন। আমার গায়েও আছে। আরেকবার কলেজটায় চোখ বুলিয়ে নিলাম। ঘাড় ঘুরিয়ে পিছনে তাকালাম। এক পলক রুদ্রের দিকে তাকালাম। রুদ্রের সাথেই আমি এসেছি। রুদ্রও এই মেডিক্যালের ডক্টর। রুদ্রের মুখে অমায়িক হাসি। রুদ্রের গায়েও সাদা এপ্রোন।
কোথা থেকে ত্রয়ী এসে আমার হাত ধরে গেইট দিয়ে প্রবেশ করে। ত্রয়ীর চোখে মুখে উচ্ছ্বাস। আমাদের খুশিটা তো তখনি দ্বিগুণ হয়ে গিয়েছিল যখন জানতে পেরেছিলাম আমরা দুজন একই মেডিক্যালে চান্স পেয়েছি। আমরা দুজন বরাবরের মতো এক সাথে থাকতে পারবো।

আজকের দিনটা বেশ ভালোই কেটেছে। এতো এতো অপরিচিত মুখের মাঝে একটা অর্ধ পরিচিত মুখ দেখতে পেয়েছিলাম। দীর্ঘ সময় পার করার পর ইফাদের সাথে দেখা। উনি এখন আমার টিচার। উনাকে প্রথম দেখে যেমন আমি চমকে গিয়েছিলাম, ঠিক তেমনি উনিও চমকে গিয়েছিলেন। চমকা চমকির পালা শেষ হতেই আমরা দুজনেই হেসে ফেলি।
ইফাদ স্যার হেসে বলেছিলেন,

আপনার সাথে আবারও দেখা হয়ে গেলো। তখন আমাদের পরিচয়টা একরকম ছিল এখন আরেক রকম। তখন আমাদের পরিচয়টা ছিল এই ব্যস্ত শহরে ব্যস্ত রাস্তায় হঠাৎই দেখা হয়ে যাওয়া দুই মানব মানবী। এখন আমাদের সম্পর্কটা টিচার স্টু়ডেন্ট।
পড়ার টেবিলে বসে বই নড়াচড়া করছি। নতুন বইয়ের গন্ধ আমার বরাবরই ভালো লাগে। সেটা পাঠ্য বই হোক বা গল্পের বই। তবে আগের মতো বই হাতে পাওয়ার আনন্দটা আর হয় না। সবাই মিলে এক সাথে বই আনার অনুভূতিটাই অন্য রকম।

দরজায় খট করে আওয়াজ হতেই ঘাড় ঘুরিয়ে পিছনে তাকালাম। উনি অলস ভঙ্গিতে দরজাটা বন্ধ করে এসে বিছানায় শুয়ে পড়লেন। উনি বাসায় এসেছেন মিনিট বিশেক হয়েছে। এসে শাওয়ার নিয়েছেন ডিনার করছেন। উনাকে এই রাতের বেলায় শাওয়ার নিতে দেখলে আমারই শীত শীত লাগে। উনার মতে ফ্রেশ হলেই সমস্ত ক্লান্তি দূর হয়ে যায়।
একদিনেই সবার সাথে বেশ ভাব হয়ে গেছে।

আচমকা উনার কথা শুনে একটু ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম,
হুম। সবাই অনেক ভালো। প্রত্যেকটা স্যারই অনেক ফ্রেন্ডলি। ইফাদ স্যার একটু বেশিই ভালো। আমাদের দুজনের মাঝে অনেক মিল আছে। উনিও যেমন আমিও তেমন।
উনি আমার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলেন, একদিনের মাঝেই বুঝে গেলে ড. ইফাদ অনেক ভালো? ওখানে পড়াশোনা করতে গিয়েছিলে নাকি ড. ইফাদ আর তোমার মাঝে মিল খুঁজতে গিয়েছিলে।

একদিনে বুঝবো কেনো? উনার সাথে আমার আরো দুই বার দেখা হয়েছে। মনে আছে ঐ দিন আমার এক্সিডেন্ট হতে যাচ্ছিল। ঐ দিন তো উনিই আমাকে বাঁচিয়ে ছিলেন। ভালো বা খারাপ বোঝার জন্য একদিনই যথেষ্ট আর আমি মানুষের মুখ দেখে বুঝতে পারি কে ভালো আর কে খারাপ।
উনি ঠাট্টার সরে বলেন, আসছে জ্যোতিষি। মুখ দেখে মনে কথা বলে দিতে পারে। নিজের মন কি চায় সেটাই বুঝতে পারে না আবার অন্যেরটা।

আমি রেগে বললাম, দেখুন একদম মজা করবেন।
উনি সিরিয়াস ভঙ্গিতে বলেন, তুমি বললে ড. ইফাদের সাথে তোমার দুই বার দেখা হয়েছে। ঐ ঘটনার দিন একবার। আরেকদিন কবে দেখা হয়েছিল?

উনার প্রশ্ন শুনে আমি দমে গেলাম। রাগী দৃষ্টি শীতল হয়ে এলো। পরে গেলাম অথৈয় সাগরে। উনাকে যদি কলেজের ঘটনা বলি তাহলে উনি রাস্তা থেকে ইট তুলে এনে আমার মাথা ফাটিয়ে দিবেন। ঐদিন উনাকে না বলে একা একা কলেজে যাওয়ার জন্য উনি আমার ওপর রেগে ছিলেন। এখন যদি বলি ঐদিন কলেজে আমাকে একটা ছেলে হ্যারাস করছিল ইফাদ স্যার আমাকে ঐ ছেলেটার কাছ থেকে বাঁচিয়ে ছিলেন। তাহলে উনি আর আমাকে আস্ত রাখবেন না। আমি আমতা আমতা করে বললাম,

ঐ তো একদিন কোচিংয়ে দেখা হয়েছিল।
উনার হয়তো আমার উত্তরটা বিশ্বাস হয়নি। তাই উনি ধীর গলায় বললেন,
তুমি সত্যি বলছো তো? এখানে অন্য কোনো কাহিনী নেই তো?
আমি তাড়াহুড়ো করে বলে ওঠলাম, আমি একদম সত্যি কথা বলছি। আর কোনো কাহিনী নেই।
উনি আমার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে চোখ বন্ধ করে ফেললেন। উনার মুখ দেখে মনে হচ্ছে না উনি আমার কথা বিশ্বাস করেছেন। আপাতত এই টপিক অফ করেছেন এটাই অনেক।

রুদ্র ড্রাইভ করছে আর আমি রুদ্রের পাশে বসে আছি। রুদ্রকে দেখে অনেকটা চিন্তিত মনে হচ্ছে। মনোযোগ দিয়ে ড্রাইভ করছেন না। কেমন জানি অন্যমনস্ক। জিঙ্গেস করেও লাভ নেই। কারণ উনি বলবেন না। আমি রুদ্রের চিন্তা বাদ দিয়ে বাইরে তাকালাম। একটা ফুলের দোকানের সামনে ভাইয়াকে একটা মেয়ের সাথে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আমি অবাক হলাম। মনে ঘুরপাক খাচ্ছে অনেক প্রশ্নই। ভাইয়ার তো এ সময় অফিসে থাকার কথা তাহলে এখানে কী করছে? ভাইয়া মেয়েটার সাথে এখানে দাঁড়িয়ে আছে কেনো? মেয়েটা কে?

আমি তাড়াহুড়ো করে বলে ওঠলাম,
গাড়ি দাঁড় করান।
আচমকা আমার বলা কথায় রুদ্র থতমত খেয়ে গেলেন। দ্রুত দক্ষ হাতে গাড়ি দাঁড় করালেন। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে গম্ভীর গলায় বলেন,

এভাবে হুট করে কেউ চিৎকার করে গাড়ি দাঁড় করাতে বলে? এখনি তো এক্সিডেন্ট হয়ে যেতো। কবে একটু ঠিক হবা?
উনার কথা শুনে চট করে মাথাটা গরম হয়ে গেলো। উনি সব সময় নিজের দোষ আমার ওপর চাপিয়ে দিবেন আর আমিও বাধ্য মেয়ের মতো মেনে নিবো। তাতো হবে না। আমি উনার দিকে চোখ রাঙিয়ে বলি,

আপনার স্বভাবই নিজের দোষ অন্যের ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়া। এক্সিডেন্ট এমনিতেই হতো। আপনি অমনোযোগী হয়ে গাড়ি চালাচ্ছিলেন। আর আমি চিৎকার করে গাড়ি দাঁড় করাতে বলিনি। আপনি অন্যমনস্ক ছিলেন তাই মনে হয়েছে আমি চিৎকার করে বলেছি।
উনি আরো কিছু বলতে চেয়েছিলেন কিন্তু তার আগেই আমি গাড়ি থেকে নেমে পড়লাম। ঐ দোকানটার সামনে গিয়ে আর ভাইয়াকে ধরতে পারলাম না। ততক্ষণে ভাইয়া মেয়েটাকে নিয়ে গাড়িতে ওঠে চলে গেছে। আমি হতাশ হয়ে ফিরে এলাম।

ক্লাস শেষে গাড়িতে এসে বসলাম। আজকে উনার হাফ ডিউটি থাকায় আমার সাথেই যাবেন। আমি গাড়িতে বসা মাত্রই উনি আমাকে উদ্দেশ্য করে প্রশ্ন ছুড়ে দেন,
ড. ইফাদের সাথে এতো কীসের হাসাহাসি হ্যাঁ? তোমার বরের কী টাকা অভাব পড়ছে যে বাইরের লোকের কাছ থেকে তোমাকে খেতে হবে? ওখানে তো আমিও ছিলাম। তাহলে তুমি ড. ইফাদের সাথে কেনো লাঞ্চ করলে?

পূর্ণিমাতিথি পর্ব ২৯

আমি কাঠ কাঠ গলায় বললাম, আপনাকে উত্তর দিতে আমি বাধ্য নই।
উনি আমার প্রশ্নে অতিরিক্ত মাত্রাই রেগে গেলেন। রেগে গিয়ে উনি হিতাহিত ঙ্গান শূন্য হয়ে পড়লেন। এক টানে উনি আমাকে সিট থেকে উনার কোলে বসিয়ে দিলেন।

পূর্ণিমাতিথি পর্ব ৩১