পূর্ণিমাতিথি পর্ব ৫৫

পূর্ণিমাতিথি পর্ব ৫৫
লেখিকা-তাসনিম জাহান রিয়া

উনি সাইকেল চালাচ্ছেন। আর আমি সাইকেলের সামনে উনার কোমড় জড়িয়ে ধরে বসে আছি। মৃদু বাতাস বইছে। কেমন অদ্ভুত শির শির অনুভূতি হচ্ছে। মাঝে মাঝে আমি হাত দিয়ে উনার চুলগুলো এলোমেলো করে দিচ্ছি। গ্রামের মতোই আঁকাবাঁকা পথ। হুট করে উনি ব্রেক করাই আমি হালকা সামনে ঝুঁকে গেলাম। উনি এক হাতে আমাকে সামলে নিলেন। উনার দৃষ্টি অনুসরণ করে সামনে তাকাতেই আমি চমকে গেলাম। উনি অস্পষ্ট বললেন,

বিহান।
বিহান উল্টো দিকে ঘুরে ছিল। তারপর রুদ্র একটু জুড়েই ডাক দিল বিহান বলে। আমিও ততক্ষণে সাইকেল থেকে নেমে পড়েছি। বিহান রুদ্রকে দেখেই একটা হাসি দিলো বিনিময়ে রুদ্রও আলতো হাসলো। রুদ্র এগিয়ে বিহানকে জড়িয়ে ধরলো। রুদ্র বিহানের কানে কিছু বললো। আমি ওদের দেখছি আর অবাক হচ্ছি। আগে তো দুজন দুজনকে সহ্য করতে পারতো না। আর এখন এমন আচারণ করছে যেনো তারা কতোদিনের বন্ধু।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

দুজন কিছু নিয়ে আলোচনা করছে। আমি উনাদের থেকে একটু দূরে থাকাই কিছু শুনতে পাচ্ছি না। অস্পষ্ট দুয়েক কথা কানে আসছে। এতটুকু বুঝতে পারছি উনারা প্রীলিয়া আপুর মৃত্যুর ব্যাপারে কথা বলছেন। আমি আগেই সন্দেহ করেছিলাম উনারা প্রীলিয়া আপুর মৃত্যুর ব্যাপারে জানেন। উনারা পুরো ব্যাপারটা আড়াল করার চেষ্টা করছেন। আমার আবার প্রীলিয়া আপুর মৃত্যুর ব্যাপারে জানার আগ্রহও নেই। প্রীলিয়া আপু আমার জীবনটাকে বিভীষিকাময় করে তুলেছিল। প্রীলিয়া আপুর মৃত্যুটা অনেকটা রহস্যময়। আর কিছু রহস্য অজানা থাকাই ভালো।
বিহান রুদ্রর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেলো। রুদ্র আবার সাইকেলে চড়ে বসলো। আমি এবার পিছনে বসে উনার কোমড় জড়িয়ে ধরলাম।
উনি এখানে কী করছেন?
নিজের বাড়িতে বেড়াতে এসেছিল। বিহানের বাবা-মা এখন এখানেই থাকে। আজকেই চলে যাবে বিহান।
আমাদের মাঝে আর কোনো কথা হয়নি। দুজনেই নিশ্চুপ হয়ে সময়টা উপভোগ করছিলাম ।

সময়গুলো খুব দ্রুতই কেটে যায়। সময় এবং স্রোত কারো জন্য অপেক্ষা করে না। বিয়ের সব রিচুয়াল শেষ করে নিজ নিজ কর্মজীবনে ফিরে এসেছি আজকে দুই দিন। বিয়ের সময়টা হাসি আনন্দের মাঝে খুব তাড়াতাড়িই কেটে গেলো। দুই দিন আগেই এই বাসাটা মানুষ জনে একটা রম রমা ভাব ছিল। আজকেই বাসাটা খালি হয়ে গেলো। নাইম ভাইয়া আর এনাম ভাইয়া ছাড়া সবাই চলে গেছেন। উনারাও আগামীকাল চলে যাবেন। এনাম ভাইয়া আর নাইম ভাইয়ার দুজনের বিয়ে ফিক্সড হয়ে গেছে। সামনের মাসে ওনাদের বিয়ে। দুজনের বিয়ে এক দিনেই হবে। যাকে বলে জোড়া বিয়ে।

কলেজে আসতেই আশিক স্যারের দেখা। উনি এখানে বহু বছর ধরে আছেন। রুদ্ররও স্যার ছিলেন উনি। আমি উনাকে সালাম দিলাম। রুদ্রও সালাম দিলেন। উনি মুচকি হেসে দুজনের সালামের উত্তর উনি দিলেন। তারপর উনি মুচকি হেসে বলেন,
রিয়া আমি তোমাকে কী বলে ডাকবো বলো তো? নাম ধরে ডাকবো নাকি ভাবি বলে ডাকবো? রুদ্র তো এখন আমার কলিগ। আর তুমি রুদ্রর ওয়াইফ।
আমি লজ্জায় মাথা নিচু করে ফেললাম। স্যারের কথা শুনে রুদ্রও হালকা লজ্জা পেলেন।

ভাইয়ার রুমে পায়ের ওপর পা তুলে বসে আছি। কফি খাচ্ছি আর ভাইয়ার কার্যকলাপ দেখছি। ভাইয়া সারা রুম জুড়ে অস্থির হয়ে পায়চারি করছে। আমি জানি ভাইয়ার অস্থিরতার কারণ। ভাইয়াকে অফিস থেকে দেশের বাইরে পাঠাচ্ছে তিন বছরের জন্য। আম্মু প্রথমে যেতে দিতে নারাজ ছিল। কিন্তু পরে শর্ত দিয়েছে। যদি শর্ত মানে তবেই যেতে দিবে আর নাহলে না। আম্মুর শর্ত হচ্ছে ভাইয়াকে যেতে হলে বিয়ে করে যেতে হবে।
কিন্তু আমার সম্মানিত বড় ভাই তো এখন বিয়ে করবে না। এদিকে আম্মুও ছেলের বিয়ে দিয়েই ছাড়বেন। ছেলের বয়স বাড়ছে।
ভাইয়া আমাকে কিছু বলার জন্য উসখুস করছে। কিন্তু বলতে পারছে না। আমি ভাইয়ার না বলা কথাগুলো জানি। তবুও না জানার ভান করে বসে আছি। ভাইয়া আমার দিকে অসহায়ের মতো তাকিয়ে মিনমিনিয়ে বলে,
রিয়া তোর সাথে আমার কিছু কথা ছিল।
হুম বল। কাল খোলাই আছে শুনতে পাচ্ছি।
শুন না।

আজব না বললে শুনবো কী করে?
রাগ করছিস কেনো? শোন না আমি এখন বিয়ে করতে পারবো না।
আমাকে বলছো কেনো? আমার তো আর তোমার বউ দেখার সখ হয়নি। আম্মুকে গিয়ে বল।
আম্মুকে বলতে পারলে কী আর তোকে ঘুষ খাইয়ে এ বাসায় নিয়ে আসতাম। আমি এখন বিয়ে করবো না সেটা তুই আম্মুকে বুঝিয়ে বলবি।
এখন বিয়ে করবে না সেটা বুঝলাম। কিন্তু কেনো করবে না? রিজনটা বলো।
ভাইয়া আমতা আমতা করে বলে, তুই তো জানিস আমি একটা মেয়েকে ভালোবাসি।
আচ্ছা বুঝলাম। যাকে ভালোবাসো তাকে বিয়ে করলেই তো পারো। আম্মু তো জিঙ্গেস করেছিল তোমার পছন্দের কেউ আছে নাকি। থাকলে বলতে আম্মু তার সাথেই তোমার বিয়ে দিব।
সমস্যা তো আমার শ্বশুর নামক অশুরকে নিয়ে। মেয়েকে এখন উনি কিছুতেই বিয়ে দিবেন না। মেয়ে সবে ইন্টার সেকেন্ড ইয়ারে পড়ে উনার মেয়ে পড়াশোনা শেষ করবে চাকরি করবে তারপর বিয়ে দিবেন আর ততোদিন আমি বুড়ো হয়ে যাব।
বুড়ো কী তুমি এখনি কম হইছো? সময় মতো বিয়ে করলে এখন দুই বাচ্চার বাপ থাকতা। মেয়েটা কেমনে যে তোমাকে পছন্দ করলো আল্লাহ জানে।
দিন আমারও আসবে।

ভাইয়া চলে গেছে আজকে পাঁচদিন। ভাইয়ার ছল ছল আঁখি জোড়া আমার চোখের সামনে ভাসছে। ভাইয়ার যাওয়ার দিকে আমি নিভৃতে তাকিয়ে ছিলাম। খুব ইচ্ছে করছিল ভাইয়াকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে। কিন্তু আমি পারি নাই কেমন অনুভূতি শূন্য পাথর হয়ে গিয়েছিলাম। প্রিয়জন দূরে গেলে এমনি কষ্ট হয়। বুকের ভিতর কী অসহ্য যন্ত্রণা হচ্ছিল। ভাইয়ার আঁখি জোড়া অশ্রুতে টল টল করছিল। কিন্তু গড়িয়ে পড়তে দেয়নি। ছেলেদের সহজে কাঁদলে চলে না। ছেলেদের মন হতে হয় পাথরের মতো শক্ত। আব্বুর বয়স হয়েছে। এখন তো ভাইয়াকেই সংসারের হাল ধরতে হবে।

মধ্য রজনি। আমি বইয়ের পাতা উল্টাচ্ছি। পরীক্ষা সময় ঘনিয়ে আসছে। রুদ্র মাত্রই হযপিটাল থেকে এসেছে। এসে ফ্রেশ অল্প কিছু খেয়ে ক্লান্ত শরীর বিছানায় এলিয়ে দেয়। ঠিক তখনি রুদ্রর ফোনটা বেঁজে ওঠে। ফোন রিসিভ করার পর পরই রুদ্রর চোখ মুখে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। বারংবার জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজাচ্ছেন। এদিকে আমারও অস্থির অস্থির লাগছে। কারো কিছু হয়নি তো। রুদ্র ফোনটা রাখতেই আমি জিঙ্গেস করলাম,
কী হয়েছে? আপনাকে এমন দেখাচ্ছে কেনো? কে ফোন করেছিল?
ইলান ফোন করেছিল। রুনা বিছানা থেকে নামার সময় পড়ে গেছে। রুনার অবস্থা ক্রিটিক্যাল। আমাকে এখনি হসপিটালে যেতে হবে।
আমিও যাই আপনার সাথে।
তোমার হসপিটালে যাওয়ার দরকার নেই তুমি বরং আব্বুকে সাথে করে নিয়ে গিয়ে আন্টিকে এখানে নিয়ে আসো।
রুদ্র শার্ট গায়ে জড়িয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন। আমি মনে মনে আল্লাহকে ডাকছি যেনো রুনা আপুর কিছু না হয়।

ভোর ৬ টার দিকে উনি বাড়ি ফিরলেন। ইলান ভাইয়াকে জোড় করেও হসপিটাল থেকে নিয়ে আসা যায়নি। এনাম ভাইয়াকে হসপিটালে রেখে এসেছেন। রুনা আপু আর ইলান ভাইয়ার ছেলে হয়েছে। ছেলে একদম সুস্থ স্বাভাবিক আছে। কিন্তু রুনা আপুর অবস্থা একটু খারাপ।
উনি ফ্রেশ হচ্ছেন। আমি খাবার নিয়ে উনার জন্য অপেক্ষা করছি। উনি ওয়াশরুম থেকে এসেই আমার পেটে মুখ গুঁজে শুয়ে পড়লেন।

পূর্ণিমাতিথি পর্ব ৫৪

রিয়া আমার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। বুকের ভিতরটা জ্বলছে। রুনার আগে থেকেই শ্বাসকষ্টের সমস্যা ছিল। কিন্তু বেশ কিছু বছর যাবৎ শ্বাসকষ্ট সমস্যা দেখা দেয়নি। নতুন করে এই সমস্যা দেখা দিচ্ছে। এদিকে রক্তও পাওয়া যাচ্ছিল না। রুনার অবস্থাও বেগতিক। বার বার মনে হচ্ছিল রুনার জায়গায় আজ যদি তুমি থাকতে তাহলে আমি কী করতাম?

পূর্ণিমাতিথি পর্ব ৫৬