পূর্ণিমাতিথি পর্ব ৫৬

পূর্ণিমাতিথি পর্ব ৫৬
লেখিকা-তাসনিম জাহান রিয়া

রিয়া আমার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। বুকের ভিতরটা জ্বলছে। রুনার আগে থেকেই শ্বাসকষ্টের সমস্যা ছিল। কিন্তু বেশ কিছু বছর যাবৎ শ্বাসকষ্ট সমস্যা দেখা দেয়নি। নতুন করে এই সমস্যা দেখা দিচ্ছে। এদিকে রক্তও পাওয়া যাচ্ছিল না। রুনার অবস্থাও বেগতিক। বার বার মনে হচ্ছিল রুনার জায়গায় আজ যদি তুমি থাকতে তাহলে আমি কী করতাম? কীভাবে নিজেকে সামলাতাম? ইলান তো তবুও নিজেকে সামলাতে পেরেছে আমি তো শেষ হয়ে যেতাম। তোমাকে ঐ অবস্থায় দেখার সাধ্য আমার নেই।

কষ্ট না করলে কী আর কেষ্ট মিলে। ভালো কিছু পাওয়ার জন্য একটু তো কষ্ট করতেই হয়। রুনা আপু যে এতোটা কষ্ট পেয়েছে সেটা কিন্তু নিজের সুস্থ সবল সন্তান দেখে বেমালুম ভুলে গেছে। সন্তান জন্ম দেওয়ার মাঝেও এক আনন্দ আছে।
আজ যদি রুনার কিছু হয়ে যায় ইলানের কী হবে ভাবতে পারছো? এই ছেলেটাকে নিয়ে কী ভালো থাকতে পারবে?
চুপ আর কোনো কথা নয় এখন একটু রেস্ট নিন।
আমি কিন্তু পারতাম না। আমার বেঁচে থাকার জন্য তোমাকে প্রয়োজন। নিশ্বাস নেওয়ার জন্য তোমাকে প্রয়োজন।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

সুখের সময়গুলো খুব দ্রুতই কেটে যায়। দেখতে দেখতেই কেটে গেলো দুইটা বছর। আজ আমি পূর্ণ নারী। আমার মাঝেও বেড়ে ওঠছে একটা প্রাণ। আমার আর রুদ্রর সন্তান। আমি পাঁচ মাসের প্রেগনেন্ট। আর তো কয়েক মাসের অপেক্ষা। তারপরই তো কেউ একজন আমাকে আদো আদো গলায় মা বলে ডাকবে। ছোট ছোট নরম তুল তুলে হাত দিয়ে আমাকে স্পর্শ করবে। পেটের ওপর আলতো করে হাত রাখলাম। একে নিয়েই তো রুদ্রর কত শত পাগলামো। স্মৃতির পাতায় স্মরণীয় হয়ে আছে সেই দিনটি। যেদিন প্রথম আমি জানতে পেরেছিলাম আমার মাঝেও বেড়ে ওঠছে একটা ছোট প্রাণ। রুদ্রকে বলার পর রুদ্র কিয়ৎক্ষণ আমার দিকে স্তব্ধ নয়নে তাকিয়ে ছিল। চমকে থমকে কেটে গেলো কয়েক মুহূর্ত। পর পরই রুদ্রর আমাকে জড়িয়ে ধরে সেকি কান্না। রদ্রকে কাঁদতে দেখে আমি স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। এমন প্রখর ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন মানুষও কাঁদতে পারে। হয়তো বাবা হওয়ার অনুভূতিটাই এমন।
পেটে আলতো স্পর্শ পেয়ে আমার ভাবনার ছেদ ঘটলো। রুদ্র আমার কোলো মাথা রেখে শুয়ে পড়েছেন। এটা উনার প্রতিদিনের অভ্যাস। হসপিটাল থেকে এসেই দৌড়ে ফ্রেশ হয়ে এসে আমার কোলে ধপ করে শুয়ে পড়বেন। আধ ঘন্টা, এক ঘন্টা শুয়ে থাকবেন। তারপর বাকি কাজ। রুদ্র আমার গালে আলতো করে ছুঁয়ে দিয়ে বলেন,

আমার ভাবনার রানী কোন ভাবনায় ডুবে আছে হুম? তার ডাক্তারবাবু যে হসপিটাল থেকে এসেছে সেটা কী সে দেখতে পাচ্ছে না হুম?
আমার উত্তরের অপেক্ষা না করেই পেটে আলতো করে ঠোঁট ছুঁয়ে দিয়ে বলেন,
আমার বেবিটা কী করে? মাম্মা কী সারাদিন তার খেয়াল রেখেছে? বেবিটা বুঝি বাবাইয়ের ওপর রাগ করেছে? বাবাই তো আজকে একটু বেশি বিজি ছিল তাই এই পিচ্চিটার খবর নিতে পারেনি। আজকে বাবাই তোমার মতো আরেকটা বেবির বাবাইকে বাঁচিয়ে দিয়েছে।
রুদ্রর এসব পাগলামি রোজকার রুটিন হয়ে গেছে। একা একাই কতক্ষণ বক বক করবেন। আমিও উনার কান্ড দেখে একা একাই হাসি।
রুদ্রর বেবির ডাকার কারণ হচ্ছে উনার আলাদা করে কোনো চাওয়া নেই যে মেয়ে হোক বা ছেলে হোক। আল্লাহ যা দিবেন তাতেই উনি খুশি।

আমি সারা রুম জুড়ে হাঁটছি আর পড়ছি আর রুদ্র আমার পিছন পিছন খাবার নিয়ে ছুটছেন। প্রেগনেন্সির প্রথম এক মাস কোনো প্রবলেম হয়নি। কিন্তু এর পর থেকেই প্রবলেম দেখা দেয়। প্রচন্ড রকমের মুড সুয়িং হয়। এক জায়গায় বেশিক্ষণ বসে থাকতে ইচ্ছে করে না। চেয়ারে বসে পড়তে পারি না। পা ব্যথা করে। বিছানায় বসে পড়তে পারি না প্রচণ্ড ঘুম পায়। তাই এভাবে হেঁটে হেঁটেই পড়ি। রুদ্র আমাকে খাওয়ানোর জন্য পিছন পিছন ঘুরঘুর করছেন। কিন্তু আমি তো খাবো না। বমি বমি পাচ্ছে। খেলেই এখন বমি করে দিব।

বাসায় কেউ নেই। পরে রুদ্রকেই সবটা পরিষ্কার করতে হবে। যা আমি মোটেও চাচ্ছি না। উনি সারাদিন পরিশ্রম করে বাসায় ফিরেছেন। এখন উনার বিশ্রাম নেওয়া প্রয়োজন। রুদ্র আমাকে চেপে ধরে সুপটা খাইয়ে দিলেন। সুপটা খাওয়া শেষ করা মাত্রই আমি বমি করে ভাসিয়ে দিলাম। আমি অসহায়ের মতো উনার দিকে তাকালাম। আমার ভীষণ কান্না পাচ্ছে। মানুষটার আমার জন্য কতোটা কষ্ট করতে হচ্ছে। মাত্রই গোসল সেরেছেন আবার গোসল করতে হবে।
এই বোকা মেয়ে তুমি কাঁদছো কেনো? আমি তোমাকে বকেছি? মেরেছি?
আমি জানতাম খেলেই এখন বমি করে দিব। তাই আমি খেতে চাইনি। কিন্তু আপনি আমার একটা কথাও শুনতে চান না। আপনাকে আবার ফ্রেশ হতে হবে। সারাদিন আপনি কতোটা পরিশ্রম করেন। বাসায় এসেও আমার জন্য একটুও বিশ্রাম নিতে পারেন না।
চুপপ। বোকা মেয়ে। একদম কাঁদবে না। এগুলো করতে আমার একটুও কষ্ট হয় না। এগুলো তো আমি আমার বউয়ের জন্য আর আমার সন্তানের জন্য করছি। তুমি নিজে কতোটা কষ্ট সহ্য করছো। ঠিক করে খেতে পারো না। খেলেও বমি করে দাও।

আজকে ত্রয়ী আর ইফাদ স্যারের বিয়ে। উনাদের দুই বছরের প্রণয়ের পূর্ণতা পেতে চলেছে আজ। ত্রয়ী ইচ্ছে ছিল লং টাইম চুটিয়ে প্রেম করবে তারপর বিয়ে। ত্রয়ীর ইচ্ছেকে প্রাধন্য দিয়ে ইফাদ স্যার আর ত্রয়ী দুই বছর প্রেম করেছে আর আজ তাদের বিয়ে। কালো রঙের একটা গ্রাউন পড়েছি। শাড়ি পড়ার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু রুদ্রর জন্য পড়তে পারি নাই। উনি কিছুতেই আমাকে শাড়ি পড়তে দিবেন না। যদি শাড়িত সামলাতে গিয়ে বা শাড়িতে পা লেগে পড়ে যাই। উনি আমাকে নিয়ে বিন্দু মাত্র রিস্ক নিতে রাজি নন।

দিনকে দিন উনার আমার প্রতি ভালোবাসা বাড়ছে বই কমছে না। এই লোকটাই এক সময় আমাকে সহ্য করতে পারতো না আর এখন আমাকে চোখে হারায়। উনি পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে আমার মাথায় একটা চুমু খেলেন।
আমার বউটাকে আজ পরির থেকেও বেশি সুন্দর লাগছে। আপনাকে এতো সুন্দর হতে কে বলেছিল? কারো নজর যাতে না লাগে।
ড্রেসিংটেবিলের ওপর থেকে কাজল নিয়ে আমার কানের পিছনে ফোঁটা দিয়ে দিলেন। উনার কান্ড দেখে হেসে ফেললাম।
উনি আমার কপালে আলতো করে চুমু খেলেন।
এভাবে হেসো না গো এখানে লাগে।
হইছে আর ঢং করতে হবে না। যান রেডি হয়ে আসুন।
হুহ যাচ্ছি। আমার বউ একটা নিরামিষ।

গাড়িতে বসে আচার খাচ্ছি আর উনি ড্রাইভিং করছেন।
এতো আচার খেয়ো না। পরে তোমার আর ত্রয়ীর বিয়েটা তিন তিনটা রোস্ট খাওয়া হবে না।
তিনটা রোস্ট খাবো কে বলেছে? আমি তো ছয়টা রোস্ট খাবো। আগে যখন বলতাম তিনটা রোস্ট খাবো তখন আমি সিঙ্গেল ছিলাম আর এখন আমি ডাবল। তাই আমি ছয়টা খাবো। আমার বেবিটাও তো খাবে।
এখন সন্ধ্যা হয়ে গেছে। ত্রয়ীর ইচ্ছেতেই বিয়েটা রাতে হচ্ছে। আজকে রাতে থেকে আগামীকাল চলে আসবো। ত্রয়ী তো আমাকে আরো তিন দিন আগে যেতে বলেছিল। কিন্তু রুদ্র আমাকে যেতে দেননি। বিয়ে বাড়িতে গেলে ঠিক মতো ঘুম হবে না। যথেষ্ট স্পেস পাবো না, খাওয়া দাওয়ার সমস্যা হবে। এসব ভেবেই আমাকে বারণ করে দেন। এই নিয়ে ত্রয়ী দুই দিন গাল ফুলিয়ে রেখেছিল। আমার সাথে একটা কথা বলেনি।

পূর্ণিমাতিথি পর্ব ৫৫

রুদ্রর আতঙ্কিত গলা শুনে সামনে তাকালাম। সামনে তাকিয়ে ভয় পেয়ে গেলাম। হেলতে দুলতে একটা ট্রাক আমাদের দিকেই ধেয়ে আসছে। ট্রাকটা দেখেই বুঝা যাচ্ছে ড্রাইভারটা মাতাল অবস্থায় ড্রাইভ করছে। রুদ্র যে সাইডে যাচ্ছে গাড়িটাও সেই সাইডে যাচ্ছে। রুদ্র গাড়িটা সাইড করতে যাচ্ছিল কিন্তু শেষ রক্ষা আর হলো না সামনে থেকে আরেকটা ট্রাক দ্রুত বেগে এসে আমাদের গাড়িটায় ধাক্কা মারে। রুদ্র আমার একটা হাত শুধু চেপে ধরেছিলেন।

পূর্ণিমাতিথি পর্ব ৫৭

2 COMMENTS

Comments are closed.