মনের কোণে পর্ব ৩২

মনের কোণে পর্ব ৩২
আফনান লারা

‘এক বাবা পছন্দ করেন তো আরেক বাবা করেন অপছন্দ।একজনকে রাজি করানো গেলে আরেকজন হয়ে যান নারাজ।
কেন যে ঐ নকল রেজিস্ট্রির পাল্লায় পড়তে গেলাম আর কেনোই বা এত বড় ঘরের মেয়েকে বিয়ে করতে গেলাম।চোর পুলিশ খেলা ভালোই চলছিল।
সব দোষ লিখির,

না সে আমার জুতা চুরি করত আর না আমাদের দেখা হতো আর নাই বা ওকে ধরার উপায় খুঁজতে আমার জীবনের পথ আমি নিজে পাল্টাতাম।বাসা থেকে বেরিয়েছিলাম কিসের উদ্দেশ্যে আর এখন কিসের উদ্দেশ্যে ঢাকা টু বরিশালের কাউনিয়াতে পৌঁছে গেলাম।হায়রে জীবনের মোড়!!!’
নাবিল গালে হাত রেখে আফসোস করছিল লিখির রুমের শেষ প্রান্তে বসে।ওখান থেকে নিচের বাগানটা গোটা দেখা যায়।গুটি কয়েক নাম না জানা ফুলের বাগানের মাঝে পায়ের উপর পা তুলে বসে পান খাচ্ছিলেন রুহুল আমিন।
হাতে পিতলের বাটি।যেখানে সেখানে পিক ফেলেননা তিনি।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

নাবিল তার পান খাওয়া দেখে তার ও পান খাওয়ার স্বাদ জাগলো।রুহুল আমিন এত সুন্দর করে পান চিবোন যে তার পাশে বসে যে তার পান খাওয়া দেখবে,, সে পান খাইতে চাইবে।কোনে বাধা মানবেনা।নাবিলেরও হয়েছে তাই।চোখ বুজে আবার মেলতেই দেখলো চোখের সামনে বানানো পানের খিলি।
চোখ ডলে সে আবারও তাকালো।ওমা সত্যি পানের খিলি।যে ধরে রেখেছে সে হলো লিখি।মুখে হাসি ফুটিয়ে নাবিলের গালে পান ভরে বললো,’বাবার বাটুয়া থেকে নিয়ে এসেছি।আমাদের রেওয়াজ আছে,নতুন জামাই ঘরে ঢুকলে পান খাওয়াতে হয়।’
নাবিল পান চিবোতে গিয়ে স্বাদ পেয়ে চোখ বুজে ফেললো।তারপর বললো,’আহা এত স্বাদ!বাবাকে সবার আগে পান খাইয়ে নেওয়াতে হবে তাহলে আর ধরে কিছু বোঝাতে হবেনা’

‘যখন শুনবেন পানে জর্দা দেওয়া খুব বকবে কিন্তু’
‘কে শোনাবে?শোনাতে হবেনা।স্বাদ পেলে উপকরণ জিজ্ঞেস করবেনা।তুমি বাটুয়া সাজিয়ে রাখো।বাবা এলে জোর করে পান খাইয়ে দিবে’
লিখি হঠাৎ নাবিলের পাশে বসে হা করে বললো,’দিন পান’
‘পাগল নাকি!!মুখের পান খাবে?’
‘মায়ের থেকে অনেক খেয়েছি,মা বলেছে বিয়ের ওর বরের থেকে নিয়ে খেতে,আমার মাও খায়।এতে নাকি প্রেম বাড়ে’
নাবিল ঠোঁট খিঁচিয়ে বললো,’আরেহনা,এটা হয়না।তুমি ক্যান আমার মুখের পান খাবে?

ধরো নতুন খিলি খাও’
‘না,না,আমার আপনার মুখেরটাই চাই।প্রেম বাড়াতে চাই’
নাবিল তাও দিলোনা।লিখির বাচ্চামোতে সাঁই দেয়নি বলে লিখি গেলো চটে।রাগ করে চলেই গেছে।নাবিল বিছানায় হেলান দিয়ে ওর রুমের দিকে ভাল মতন তাকালো এবার।এতক্ষণ দেখা হয়নি।
একটা দেয়াল জুড়ে লিখির অনেক পুরোনো একটা বিশাল বড় ছবি ঝোলানো।তারপর এপাশের দেয়ালে ওর স্কুলের /কলেজের সার্টিফিকেট ফ্রেম আকারে বাঁধাই করে ঝোলানো।এর বেশি দেয়ালে আর তেমন কিছু নেই।নাবিলের ফোন বাজছে,বাবার কল।সে রাগ করে রিসিভ করলোনা।বাবা আবারও কল দিলো, এবার তো ধরতেই হবে।
(দুজনেই চুপ।)

‘কি হলো কথা বলছোনা কেন?’
‘কি বলবো?’
‘তুমি চাও আমি বরিশাল আসবো?আমি অনাবিল কিনা মেয়ের বাবার সাথে দেখা করতে বরিশাল যাবো?’
‘বড়লোক মেয়ে খুঁজছো,এখন পেয়ে সামাল দিতে পারতেছোনা?’
জনাব অনাবিল এবার থতমত খেয়ে বললেন,’আচ্ছা আমি জানাচ্ছি’
নিজেই কল কেটে দিলেন।নাবিলের কথা তার মনে ধরেছে এবং লজ্জাও পেয়েছেন।
ওদিকে লিখি যে রাগ করে কই চলে গেছে সেদিকে নাবিল খবরই রাখলোনা।লিখির আবার রাগ হলে ঘর ছাড়ার অভ্যাস আছে।নাবিল সেটা ভুলেই গেছিলো।
রুহুল আমিনের কানে এ কথা গেছে যে লিখি বাসা থেকে চলে গেছে।তিনি ভাবলেন নাবিলকে নিয়ে পালিয়েছে।তিনি তো দলবল তৈরি করা ধরছিলেন ঠিক সেসময়ে নাবিলকে দোতলা থেকে নেমে আসতে দেখে বুঝলেন লিখি তাহলে পালায়নি, তবে হন্তদন্ত হয়ে কোথায় বা যাচ্ছিলো।

নাবিল ওনার সাথে কথা বলে ফ্রি হবার জন্য চেয়ার টেনে বসে গেছে, উনি ও বসলেন।দুজনেই চুপ হয়ে ছিল প্রথমে।এরপর তিনি চায়ের কাপ হাতে নিয়ে বললেন,’তোমার বাবাকে কি ফোন করেছিলে?’
‘না,, তবে করবো ‘
‘সমস্যা নেই,সময় করে কল দিবা। তা আমাদের এখানে কেমন লাগছে তোমার? ‘
‘ভালই,তবে কিছু ভাষা বুঝতে কষ্ট হয় এই আর কি।’
‘লিখি বুঝি তোমার ওপর রাগ করে আছে?আসলে ও ছোট বেলা থেকেই এমন।রাগী অনেক।রাগ হলেই বাসা থেকে বেরিয়ে যাবে।বেশি দূর যেতোনা বলে আমরা ওর এই স্বভাবটাকে বদলানোর চেষ্টা করিনি।কিন্তু দেখলে তো!!ওর এই স্বভাব কিসের রুপ নিলো!! আর সে এতগুলো দিন আমাদের থেকে পালিয়ে ছিল।’

নাবিলের ভয় হলো।লিখি আবার কোনদিকে গেছে কে জানে।ছুটে এক দৌড় দিয়েছে সে বাসা থেকে।বেরিয়ে প্রথমে ডান দিকে গেলো।সেখানে পথ শেষ হওয়া অবধি দৌড়েছে তাও পায়নি, শেষে বাম দিকের রোডটাতে গিয়ে দেখা পেলো লিখির।এক বাাড়িওয়ালার মেয়ের সাথে দাঁড়িয়ে কথা বলছে আরামসে।নাবিল ওর পাশে এসে দাঁড়াতেই সে মুখ ঘুরিয়ে সামনের দিকে চললো।
‘আরে হয়েছে টা কি? ‘
‘পান দেননি, রাগ করেছি’
‘আচ্ছা দিব আসো ‘
‘এবার দিলে খাবোনা।লিখি একটা জিনিস একবারই চায় এরপর আর পেলেও গ্রহণ করেনা’

‘আরে তোমার বাবা আর আমার বাবার অভিমান ভাঙতে আমার জীবন শেষ হয়ে যাচ্ছে আর তুমি কিনা এর মাঝে রাগ দেখাচ্ছো?’
‘সবার জায়গা আলাদা,আর আমার জায়গা আলাদা’
নাবিল লিখির হাতটা ধরে বললো,’চলো যাই, বাবাকে কল করে মানিয়ে এখানে আনতে হবে’
লিখি মুখে হাসি ফুটিয়ে চললো ওর সাথে সাথে।খুুব অভিমান ছিল কিন্তু যখনই নাবিল তার হাত ধরেছে সে গলে পানি হয়ে গেছে।

পথ চলতে চলতে নাবিল ফোন দেখছিল,লিখি সেই সুযোগে ওকে শক্ত করে ধরে ফেলেছে।প্রথমে সে টের পায়নি যখন ফোন থেকে মনযোগ হটালো ওমনি দেখলো লিখি তার ডানহাতটা আষ্টেপৃষ্ঠে ধরে চোখ বুজে হাঁটছে তার সাথে সাথে।
‘এরকম দূর্বল হইওনা,তোমার বাবা কিংবা আমার বাবা না মানলে আমাদের আবার আলাদা হয়ে যেতে হবে,তখন নিজেকে সামলাবে কি করে?’
‘কালকের এত বড় ঘটনার পরেও যখন আলাদা হইনি তখন আর আমার কিছুর ভয় নেই’
নাবিল থেমে গিয়ে কোমড়ে হাত রেখে বললো,’একটা কথা বলোতো!!আমার প্রেমে পড়েছো?’
লিখি হাত ছেড়ে বললো,’মোটেও না’
নাবিল ব্রু কুঁচকে বললো,’আর একবার হাত ধরলে ধরে নেবো প্রেমে পড়েছো’
কথাটা বলে নাবিল গেট দিয়ে বাসায় চলে গেলো।লিখি চেঁচিয়ে বললো,’এটা আবার কেমন নিয়ম!আপনি কি পড়েননি?নিজে তো স্বীকার করবেই না উল্টে আমাকে বিপদে ফেলে দিলো’

দুপুরের দিকে অনাবিল আবারও নাবিলকে ফোন করলেন।এতসময় ধরে ঘেঁটে দেখেছেন কোন বিখ্যাত তেলের ব্যবসায়ী লিখির বাবা।
পরে দেখলেন সত্যি তাই।ইনফরমেশন সত্য।এবার আর তাকে ধরে রাখে কে।কিন্তু সবার আগে বেয়াই বেয়াইনের সাথে আলাপ জরুরি মনে করে তিনি নাবিলকে জানাতে ফোন করেছেন যে তিনি আসতেছেন।

‘বলেন’
‘রেগে আছিস?’
‘হুম প্রচুর’
‘আমি যদি তোর মন ভাল হবার খবর দেই?’
‘কি খবর?’
‘আমি আসতেছি?’
‘সিওর?’
‘ড্রাইভারকে তেল ভরতে বলেছি।ট্যুর দিব বরিশালে।নাহিদ আর তোর আম্মু ও আসবে।বেয়াইকে বল তৈরি হতে’
‘হঠাৎ মত পাল্টে নিলে?কি এমন ঘটলো?’
‘কি ঘটবে?আমার মনে হলো ছেলের পছন্দকে গুরুত্ব দেওয়া উচিত।’
নাবিল তাচ্ছিল্য করে কলটা কাটলো।বাবাকে তার চেনা আছে।

লিখি মায়ের একটা শাড়ী নিয়ে পরবে বলে পা ধরে বসে আছে তখন থেকে।মা দিতে চাইছেননা কারণ লিখি শাড়ী পরতে জানেনা,পরতে গিয়ে শাড়ীটাই নষ্ট করে দিবে।এমন করে অনেক শাড়ী নষ্ট করেছে।
লিখি চায় ওর শ্বশুর আসবে যখন সে একটু বউয়ের মতন সেজে থাকবে যাতে আজই সবাই সব মেনে নেয়।
মা বললো পরে দিবে যখন জনাব অনাবিল আসবেন তার কিছুক্ষণ আগে শাড়ী পরিয়ে দেবেন নিজের হাতে।
লিখি সেটার জন্য চাইছিলনা।সে চাইছিল শাড়ী পরে নাবিলের সামনে ঘুরাঘুরি করবে।কিন্তু মা তো শাড়ী নষ্ট হবার ভয়ে এত জলদি ওকে দিতেই চাইলেননা।
চুরি করতে লিখি শীর্ষে, মা তো এটা জানেননা।সে সোজা মায়ের রুমে গিয়ে আলমারি খুলে পছন্দ মতন শাড়ী নিয়ে পা টিপে টিপে রুমে ফেরত চলে আসলো।এসে দেখলো নাবিল ফোন টিপছে ওখানে।ওকে দেখেই শাড়ীটা সে পেছনে লুকিয়ে রোবটের মতন দাঁড়িয়ে পড়েছে।
নাবিল খেয়াল করেনি,সে গেমস খেলতে ব্যস্ত। লিখি লুকিয়ে ওয়াশরুমে থেকে শাড়ীটা পরা শুরু করলো।যে লাউ সেই কদু।
সে পরতে তো পারলোই না উল্টে শাড়ী পরার পর যে সৌন্দর্য্য বিরাজমান থাকে সেটাই বিনষ্ট।

গেমস খেলা শেষ বলে নাবিল ফোন রেখে বসে বসে আড়মোড়া ভাঙছিল,তখন পাশে এলোমেলো শাড়ীতে লিখিকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে দম ছেড়ে দিলো সে।হাসি আর বাঁধ মানলোনা।হাসতে হাসতে সে বিছানা থেকে নেমে ভাল করে দেখে বললো,’এ কি অবস্থা!এখনও শাড়ী পরা শিখলেনা?এই শাড়ী পরে বউ সেজে বাবাকে ইমপ্রেস করতে বুঝি এত আয়োজন?’

মনের কোণে পর্ব ৩১

‘চোপপপ!আমি কেন শ্বশুরকে ইমপ্রেস করতে যাব?আমি তো !!!’
‘আমাকে?আমাকে শাড়ী পরে ইম্প্রেস করতে চাও?’
‘না!তা কখন বললাম?আমি তো ঐ আমার খালাতো ভাই আসিফ আসবে,ওর জন্য শাড়ী পরেছি।ও শাড়ী অনেক পছন্দ করে’
‘তুমি যেভাবে পরেছো, এই অবস্থা দেখলে ওর আজীবনের জন্য পছন্দ উঠে বাপ বাপ বলে পালাবে’

মনের কোণে পর্ব ৩৩