মনের কোণে পর্ব ৩১

মনের কোণে পর্ব ৩১
আফনান লারা

দারোয়ান নজির লজ্জা পেয়ে ভেতরের দিকে চলে গেলো সবাইকে নাবিলের আসার খবর দিতে।
লিখি মুখ গুজে চুপ করে আছে,তার কোনো নড়চড় নাই।নাবিল ওর মাথায় হাত রেখে ধীরে বললো,’বাবার লোকদের সামনে, তোমার ভাইয়ার সামনে আমি তোমায় নিয়ে যেতে পারতাম না।যার কারণে মানুষ কমানোর জন্য আমি তোমায় যেতে দিয়েছি।দেখো আমি বাসায় থাকিনি।তোমার খোঁজে ঠিক চলে এলাম।আমাকে ভুল বুঝেছো হয়ত’

‘অনেক’
‘এখন ছাড়ো,কেউ দেখলে কি ভাববে?’
নাবিলের কথা শুনে লিখির হুশ ফিরলো।ওকে ছেড়ে সোজা হয়ে দাঁড়ালো সে।
নাবিলের মুখে ওকে ফিরে পাবার হাসি ভাসছিল কেবল।নজিরের ডাকে লিখির বাবা আর মা অবাক হয়ে কৌতূহল নিয়ে ছুটে আসলেন দেখতে।সে বলতেছে লিখির নাকি বর এসেছে।এটা কি আদৌ সত্যি??
সত্যি নাকি মিথ্যা তা যাচাই করতে তারা ছুটে এসেছিলেন বাসার বাইরে।এসে দেখলেন সত্যি তাই।লিখির পাশে একটি ছেলে দাঁড়িয়ে আছে।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

লিখি বাবাকে দেখে ভয় পেয়ে নাবিলের হাতটা ধরে ফেললো।বাবা কাছে আসতেই নাবিল সালাম দিলো তাকে।তিনি সালাম নিলেননা নাকি মনে মনে নিলেন,বোঝা গেলোনা।শুধু দেখে যাচ্ছেন নাবিলকে।নাবিল লিখির মাকেও সালাম দিলো।তিনি অবশ্য সালাম নিয়েছেন এবং মুচকি মুচকি হাসছেন নাবিলকে দেখে।লিখি মাথা নিচু করে ছিল।বাবা নাবিলের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে বাগানে থাকা চেয়ারে ধপ করে বসে গেছেন।মা ইশারা করলো নাবিলকে।নাবিল ও গিয়ে চেয়ারের পাশে এসে দাঁড়ালো।রুহুল আমিন এখনও দেখছিলেন ওকে।লিখি মায়ের পাশে গিয়ে জানতে চাইলো এবার কি হবে।মা চুপ থাকতে বলেছে।

‘তোমার বাবা কি করে?’
‘ব্যবসা’
‘আমাদের মতন ব্রান্ডেড নাকি অখ্যাত’
‘বিখ্যাত ‘
‘তোমার পরিবার নাকি আমার মেয়েকে মানে নাই?’
‘হুম,এটা সত্যি।কিন্তু আমার মা মেনে নিয়েছে’
‘বাড়ির কর্তা না মানলে বাড়ির পেয়াদা মেনে কি হবে?’
‘বাবাও মেনে যাবে’
‘কবে?’
‘সময় লাগবে, আমার মনে হয় আপনাদের দু পক্ষের দেখা সাক্ষাৎ হয়ে গেলে….. ‘
‘এসব ব্যাপারে ছেলেরা আগায়।আমি মেয়ের বাপ হয়ে কেনো তোমার বাবার জন্য লাইনে দাঁড়াবো?তোমার বাবা কি পারেননা এখানে এসে দেখা করতে?আমাদের কি কিছুর অভাব আছে যে উনি ভাব দেখাচ্ছেন?আমার তো মনে হয় না আমাদের মতন তোমার বাবার ব্যবসা।যদি খবর পেয়ে দেখি মাসে আমি যত ইনকাম করি তার চেয়ে তোমার বাবা একটু কম ইনকাম করে তবে এই বিয়ে আমি মানবোই না।আমি আমার মেয়ের জন্য কোটিপতি ছেলের পরিবার খুঁজছি সেটা জানতে?তোমায় যে মেনে নেবো তার কারণ তো দেখাতে হবে তবে’
নাবিল লিখির দিকে তাকালো।দুজনে মনে মনে বললো তাদের দুই পরিবার একই ম্যাটেরিয়ালের।
দুজনেই নিশ্বাস ফেললো তারপর।

রুহুল আমিন নাবিলকে বসতে দিলেননা।বললেন বাবাকে কল করে এখানে আসতে বলতে।
‘বাবা এখন মানছেনা।আমার মনে হয় আপনারা দুজনে কথা বললে ভাল হবে।কল ধরিয়ে দিবো?’
‘ঠিক আছে।তবে সময় দেখছো?ভোর সাড়ে পাঁচটা বাজে।আমি জীবনে এ সময়ে উঠিনা।নজিরের ডাকে উঠেছি। তোমার বাবা বুঝি এত সকালে ওঠে?’
‘তাও ঠিক।বাবা ছয় টার পর ওঠেন।তাহলে ততক্ষণ এখানে একটু বসি?’
রুহুল আমিন ব্রু কুঁচকালেন।তারপর লিখির দিকে তাকিয়ে বললেন,’দাঁড়িয়ে দেখছো কি?আমি বসে বসে এই ছেলের মুখ দেখবো?ওকে ঘরে নিয়ে যাও’
লিখি ভীষণ খুশি হলো।মন চাইছিল বাবাকে ধরে চুমু খেতে।নাবিলের হাত ধরে সঙ্গে সঙ্গে সে নিয়ে গেলো বাসার ভেতর।মা ওনার পাশে বসে বললেন,’তুমি কি মেনে নিয়েছো?’
‘আমি একটু ভাব নিয়ে থাকবো।আগে দেখি ছেলে আসলেই আমাদের মতন বড়লোক কিনা।তারপর যা দেখার দেখা যাবে’

লিখির রুমে এসেই ব্যাগটা টেবিলে রেখে দুম করে বিছানায় শুয়ে পড়েছে নাবিল।চোখে ঘুমের আলমারি পুরে আছে।
সারারাত বাসের জার্নিতে ঠিকভাবে ঘুমটাই হয়নি।লিখি তো নাবিলকে পেয়ে কত খুশি হয়েছে।ইচ্ছে করছে আরও একবার জড়িয়ে ধরতে ওকে।দেরি করা ঠিক হবেনা ভেবে সে বিছানায় উঠে নিচু হয়ে নাবিলের পিঠ জড়িয়ে ধরলো।নাবিল তো অবাক।মাথা না তুলেই বললো,’একদিনে একেবারে দিওয়ানা হয়ে গেলে?’
‘অনেক মিস করেছি”
‘সরো।হাঁড় ভাঙবে এবার,মুটকি!’
লিখি উঠে ওর পিঠে ঠাস করে একটা চড় মে /রে বললো,’আমি মুটকি?আর ঐ বাড়িওয়ালার মেয়ে চিকনি চামেলী?’
‘হ্যাঁ’

লিখি কটা চিমটি কেটে উঠে চলে গেলো।নাবিল মিটমিট করে হাসছে।এত ক্লান্ত যে চোখ মেলে কিছু দেখার সাধ্য কুলিয়ে পারছেনা।
লিখি মায়ের কাছে গিয়ে জানতে চাইলো নাবিলকে কি খেতে দেবে।
‘তোর বাবা তো জানিস মনের দিক দিয়ে বিশাল মনের মানুষ।নজির আর মনিরকে কাঁচা বাজারে পাঠিয়েছে বড় বড় রুই কাতল,মুরগী -খাসি কিনে আনতে।বলেছে সকালের খাবার যেন ফাটাফাটি হয়’
‘কি বলছো!!বাবা কি ওনাকে মেনে নিয়েছে?’
‘শোন মেনে নেবার কথানা।তিনি নাবিলের ব্যাপারে খবর নিতে কাল ঢাকার এক লোককে ধরিয়েছিল।ঐ লোক নাকি জানিয়েছে নাবিল আসলে কার ছেলে।নাম শুনে সে শুরুতেই বলে দিয়েছে বিশাল বড়লোক।তাও আরও খবর জেনে আজ জানাবে বলেছে।এসব দেখে যা খবর তোর বাবার কানে এসেছে মনে হয় মানতে বাধ্য।যেমন ছেলে চাইছিল তেমন পেয়ে যাওয়ার আবাস পেয়েছে বলেই খাতির বাড়িয়ে দিছে।
লিখি আবারও ছুট লাগালো।নাবিল তখন গভীর ঘুমে।কিন্তু এই সুখবর তাকে তো জানাতেই হবে।হাতে কর্ণফ্ল্যাক্সের প্যাকেট নিয়ে নাবিলের কানের কাছে ফিসফিস করে বললো,’বাবা মনে হয় রাজি’

নাবিল শুনলোনা কিন্তু ঘুমের ঘোরে লিখির চুল শক্ত করে ধরে ফেললো।লিখি মাথাটা এনে এখন আর নিতে পারছেনা।টানতে টানতে ব্যর্থ হয়ে শেষে চেঁচিয়ে বললো,’ছাড়ুন’
নাবিল চোখ মেলে আস্তে করে বললো,’আজ একটু শান্তি দাও।সবসময় ভোরেই কেন তোমায় এসে আমায় জ্বালাতে হবে?’
‘আরে আমার চুল!!’
‘বকা দিচ্ছো?’
‘না।সত্যি আমার চুল আটকেছে।ছাড়ুন।’
নাবিল আরও টান দিয়ে মুখটা বালিশের দিকে গুজে ফেললো।শেষে লিখি নাবিলের নাক টিপে ধরে বললো,’সরি’
নাবিলের তো দম গেছে আটকে।লাফ দিয়ে উঠে বসে বললো,’কি হয়েছে?কার হয়েছে?কেন হয়েছে?’

‘কারো কিছু হয়নি, আমার চুল ধরে ঘুমাচ্ছিলেন সেটা ছাড়াতে এমনটা করলাম’
‘তোমার চুল আমার হাতে আসলো কি করে? নিশ্চয় পানি ঢালতে এসেছিলে?’
‘একদম না।এই ভুল করতাম না।আপনাকে চিনি।পরে বাবার সামনে আমায় নিয়ে পানিতে চুবাতেন।আমি এসেছি খবর জানাতে’
‘কিসের খবর?’
‘এতবার বলতে পারবোনা’
লিখি ভেংচি কেটে চলে গেলো।

বিশাল আয়োজন করা হয়েছে নাবিলের জন্য।নাবিল নিজের নাম্বার থেকে বাবার নাম্বারে কল করলো সময় নিয়ে।এই নাম্বার বাবার কাছে সেভ করা ছিল বলে তিনি দেখেই রিসিভ করলেন।
গম্ভীর সুরে বললেন,’কোথায় তুমি?’
‘বরিশাল’
‘এতদূর চলে গেছো?’
‘বাবা এখন এসব বলার সময় না।এখন তুুমি লিখির বাবার সাথে কথা বলবে?’
‘আমি কেন বলবো?বিয়ের ব্যাপারে আগে মেয়ের বাবারা কথা বলে।তাছাড়া ওরা কেমন স্টেটাসের সেটা তো জানা হয়নি আমার।কিছু বড়লোক ব্যবসায়ী আছে সারাদিন পেত পেত করে পান চিবোয়।ঐ টাইপের না তো?’
কথাটা শুনে নাবিল মাথা বাঁকিয়ে বাগানের দিকে তাকালো।সত্যি তাই,লিখির বাবা পান চিবোচ্ছেন।ঢোক গিলে সে বললো,’পান খাওয়া তো ভাল বাবা।মুখের দুর্গন্ধ দূর হয়,ডায়াবেটিসের জন্য উপকারী,দাঁত ব্যাথা লাঘব হয়’
‘শাট আপ!আমাকে পান পাতার উপকারীতা জানাতে হবেনা তোমায়।এরকম বেয়াই আমার লাগবেনা’
‘বাবা, পান খাওয়া যার যার ব্যাক্তিগত ব্যাপার ‘

‘তাছাড়া তার চালচলন যদি আমাদের মতন না হয়?লুঙ্গি পরে থাকে নাকি সারাক্ষণ? ‘
নাবিল লিখির বাবার দিকে আবারও তাকালো।তাকিয়ে যা দেখলো তাতে ওর মাথায় হাত চলে গেছে।দম ফেলে বললো,’বাবা ড্রেস আপে কি সমস্যা তোমার?একটা মানুষের ব্যাক্তিত্ব হলো আসল’
‘আমি তার বেয়াই হবো আমাকে তো আমার মতন বেয়াই পেতে হবে’
‘আমি ছেলে তাই বলে কি আমি ছেলেকে বিয়ে করবো??’
‘এটা কেমন উদাহরণ? ‘
‘ঠিকই বলেছি।সব কিছুতে সমান সমান খুঁজতে হয়না।তোমার জন্য জরুরি ছিল লিখিদের সম্পদ।এখন সেটা বরাবর পেয়েছো তাহলে খুঁত কেন খুঁজছো বাবা?বাদ দাও এবার,অনেক তো হলো”

মনের কোণে পর্ব ৩০

কথাটা বলে নাবিল রাগ করে কল কেটে দিয়েছে।লিখি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ওর জন্য তৈরি করা খাবার গুলোর লবণ ঠিক আছে কিনা টেস্ট করছিল।নাবিলকে মন খারাপ করে কোণায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে এগিয়ে এসে জানতে চাইলো কি হয়েছে আবার।নাবিল তাকে কিছু না বলেই চলে গেছে রুমের ভেতর।

মনের কোণে পর্ব ৩২