প্রজাপতি আমরা দুজন পর্ব ৫০

প্রজাপতি আমরা দুজন পর্ব ৫০
ইলমা বেহরোজ
সন্ধ্যার দিকে ভ্যানিটিব্যাগে ফোন খুঁজতে গিয়ে তিতলি আবিষ্কার করলো তার ফোনটা নেই।অনেক খোঁজাখুঁজি করেও পেল না।বিকেলে বের হয়েছিল।নির্ঘাৎ চুরি হয়েছে নয়তো কোথাও পড়ে গিয়েছে।তার জন্য তিতলির একটুও কষ্ট হচ্ছে না।এমনকি রোমেনা,শাহেদ কারোরই না।ইন্ডিয়া আসার পর থেকে তিতলি হারিয়ে যাওয়া বাটন ফোনটা ব্যবহার করছে।রোমেনা টেবিল থেকে পানি মুছতে মুছতে বললেন,
— “কাল সিলেট যাচ্ছিস।ফোন দরকার।একটা কিনে নিয়ে আসবি?”
তিতলি কিছু না বলে ভ্যানিটিব্যাগ হাতে নেয়।এরপর বলে,
— “কিনতে তো হবেই।”
তিতলি বের হয়ে গেইট অব্দি যায়।তখন রোমেনা ডেকে বলেন,
— “আবার বাটন কিনিস না।এই বয়সের মেয়েরা কি বাটন ফোন চালায়?”
তিতলি জবাবে কিছু না বলে চলে যায়।
ভোর পাঁচটা।
— “বাবা আসছি, আম্মু আসছি।”
 তিতলি কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে বললো।
— “তাহলে সত্যিই আমাকে নিবি না।” শাহেদ অভিমানী স্বরে বললেন।
তিতলি হেসে এগিয়ে আসে। বাবার পাশে সোফায় বসে। তারপর বললো,
— ” বাবা তুমি না অসুস্থ?এই অবস্থায় আমার সাথে তুমি যাবা?”
শাহেদ কিছু বললেন না। সত্যিই তিনি খুব অসুস্থ। হার্টের সমস্যা টা বেড়েছে আবার মেয়েকেও তো একা যেতে দিতে পারেন না। আবার না করতেও পারছেন না। মেয়েটার যদি নিঝুমের সাথে দেখা হয়, সব ঠিক হয়ে যায়। সেই আশায় একা ছাড়ার সিদ্ধান্ত নেন।এছাড়া তিতলি একা ইন্ডিয়ার অনেক জায়গায়ই গিয়েছে।তিতলি শাহেদকে ধাক্কা দিয়ে বললো,
— “ও বাবা?”
— “আচ্ছা যা।সাবধানে যাবি।আর ঢাকা রেল স্টেশনে নেমে সিলেটর ট্রেনে উঠবি। তারপর সিলেটের ট্রেন স্টেশনে নেমে সিএনজি নিয়ে উপশহর চলে যাবি।মনে থাকবে?”
— “আচ্ছা বাবা মনে থাকবে।”
তিতলি বাবাকে সালাম করে উঠে দাঁড়ায়। রোমেনা একগ্লাস দুধ নিয়ে দৌড়ে আসেন। তিতলি দুধ দেখে ভ্রু কুঁচকায়।রোমেনা বললো,
— “তুই ও তো অনেক অসুস্থ।দুধটুকু খেয়ে যা।শরীরে বল পাবি।রাস্তায় বেহুশ হয়ে যাবি।”
তিতলি নাকচ করতে গিয়েও করেনি।রোমেনা হাত থেকে গ্লাস নিয়ে চট করে দুধটুকু খেয়ে বললো,
— “এবার আসি।”
রোমেনা হেসে তিতলির মাথায় হাত বুলিয়ে বললো,
— “সুখবর নিয়ে আসিস।”
তিতলি ম্লান হাসলো।তারপর বেরিয়ে পড়ে।
তিতলি প্রথম ভেবেছিল কামরা নিবে। কিন্তু সেটা একা একা রিক্স হয়ে যায়। তাই সিট নেয়।নানা জাতির মানুষের সাথে মিলেমিশে একসাথে যাবে। প্লাটফর্মে থাকা দোকান থেকে এক বোতল পানি, চিপস, বিস্কুট নিয়ে সিটে এসে বসে।যথাসময়ে ট্রেন ছাড়ে।তড়িঘড়ি করে একজন ভদ্রমহিলা তিতলির পাশের সিটে বসে। মহিলার পরনে শার্ট,জিন্স আবার ঘাড় অব্দি লম্বা চুল। কালার করা। তিতলি একটু সরে বসে। জানালার বাইরে তাকায়।তাঁর ভেতর কাঁপছে উত্তেজনায়।তিন বছর পর সে অতীতে ফিরে যাচ্ছে। যেখানে তার ফেরার কথা ছিল না!
— “কুত্তার বাচ্চা তুই আমারে কল দিচ্ছিস কেন? আমি তোর সংসারে আর আসবো না! তুই আমারে কল দিবি না। আমি চলে যাচ্ছি!”
ভদ্রমহিলার ভাষা শুনে তিতলি চমকায়।ঘুরে তাকায়।মহিলা কারো সাথে ফোনে কথা বলছে আর চিল্লাচ্ছে।তিতলি আবার চোখ ঘুরিয়ে নেয়।কিন্তু মহিলার গালিগালাজ কমছেই না।গালি দিয়ে যাচ্ছে একটার পর একটা।দেখতে যতটা ভদ্র, তার চেয়েও নিকৃষ্ট বিবেক।আত্মসম্মান নেই নাকি?পাবলিকের সামনে এভাবে কেউ কথা বলে? পোশাকেই কি নিজেকে স্মার্ট প্রমাণ করা যায়? আধুনিক প্রমাণ করা যায়?
— “তুই আমার মেয়েরে আমার কাছে দিবি ফকিরের বাচ্চা। নয়তো আমি পুলিশের কাছে যাব। তোর নামে মামলা করব। আমি আমার মেয়েকে চাই ই চাই!”
ভদ্র মহিলা বললো ফোনের ওপাশের মানুষটাকে।
কথাবার্তায় তিতলি ততক্ষণে পরিষ্কার বুঝে গেছে, ভদ্রমহিলা এতক্ষণ নিজের স্বামীর সাথে কথা বলছিল এবং বলছে। তাদের মাঝে হয়তো কোনো ভেজাল হয়েছে। যার জন্য মহিলা সব ছেড়ে ছুড়ে চলে যাচ্ছে।তিতলি চোখ ঘুরিয়ে আশপাশ দেখে নেয়।উপস্থিত সব মানুষেরা হা করে তাকিয়ে আছে ভদ্রমহিলার উপর। এবং কান খাড়া করে শুনছে। যাকে বলে বিনোদন নেওয়া!তিতলির মেজাজ চটে যায়।এমনি পাশের মহিলা চেঁচাচ্ছে তার উপর মানুষগুলা এমনভাবে হা করে ভদ্রমহিলার উপর তাকিয়ে আছে, ফাঁকে ফাঁকে তাকেও দেখছে।
অবশেষে ভদ্রমহিলা ফোন রাখে।তিতলি একটু ঘেঁষে বসে।কপট রাগ নিয়ে চাপা গলায় বললো,
— “এতোটা সিনক্রিয়েট না করলেও পারতেন।সবাই তাকিয়ে ছিল,হাসছিল।মনে হচ্ছিলো আপনি জোকার।আত্মসম্মান রাখতে শিখুন।”
ভদ্রমহিলা চারপাশটা দেখে নেন।সত্যি সবার মনোযোগ তাঁর উপর।এরপর গলা খ্যাঁক করে আওয়াজ করে,সিটে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করেন।তিতলি আর কথা বাড়ায়নি।সেও সিটে হেলান দিয়ে চোখ বুজে। চোখে ভেসে ওঠে অতীত।অনেকক্ষণ কেটে যায় স্মৃতিচারণে।সময় যাচ্ছে না।নতুন কেনা ফোনটা নেড়েচেড়ে সেকেন্ড কয়েক দেখে।এরপর এমবি কিনে ফেসবুক, মেসেঞ্জার ইন্সটল করে।আইডি লগইন করে।প্রথমে সার্চ দেয় আহনাফ মুত্তাকী নিঝুম।সবার উপরে নিঝুমের আইডি আসে।তিতলি আইডিতে ঢুকে।দেখে,তিন বছর আগের প্রোফাইল পিক এখনো আছে।এক্টিভ দুই দিন আগে।রিলেশনসিপ স্ট্যাটাসে কিছু নেই।তিতলি অবাক হয়।মেসেঞ্জারে ঢুকে।সবার উপরে নিঝুমের টেক্সট।৯৯+ টেক্সট শো করছে!শেষ মেসেজটা দু’দিন আগের।তিতলির পা থরথর করে কাঁপতে থাকে।নিঝুমের মেসেজ কেনো?কিসের এতো মেসেজ?ইনবক্সে শেষ মেসেজটা তিতলি পড়ে,
 “লাজুকলতা?আসবানা? অপেক্ষা করছি তো।”
তিতলির ফোন বন্ধ করে দেয়।এ যে স্বপ্নেও ভাবেনি সে।ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে।পাশের ভদ্রমহিলা চোখ খুলে তাকায়।তিতলি ছটফট করতে থাকে।আবার ফোন অন করে মেসেঞ্জারে ঢুকে।২০ মিনিট স্ক্রল করার পর তিন বছর আগের প্রথম মেসেজে আসে।প্রথম মেসেজ –
 “টুকটুকি তুমি ছাড়া আর কাওকে বিয়ে করা সম্ভব নয়।কেমনে ভাবলে তুমি? আর চলে গেলে? আমি রিদিকে বিয়ে করবো কি করে ভাবলে?আর আব্বুর ডিভোর্স হবে ওই মহিলার সাথে আর আমরা কিছুই জানতে পারবো না? মিথ্যে কখনো চাপা থাকে না তিতলি।কখনো না।তুমি ফিরে আসো।আমি অপেক্ষা করছি।”
তিতলির ফোঁপানোর বেগ বেড়ে যায়।যত সে পড়ছে মেসেজ তত গুণে বৃদ্ধি পাচ্ছে কান্না।ভদ্রমহিলা তাকিয়ে আছেন অনেকক্ষণ।কিন্তু কিছু বুঝছেন না।উপস্থিত মানুষগুলির খেয়ালেও আসে ব্যাপারটা।অনেকে বলাবলি করছে,সামনের সিটের দুইটা মহিলাই পাগল।
ভদ্রমহিলা তিতলিকে বললো,
— “কাঁদছো কেন?এখন তোমাকেও সবাই দেখছে।”
কিন্তু সেই কথা তিতলির কানে ঢুকেনি।সে আফসোস করছে, বড্ড কঠিন আফসোস।একবার আইডিটা লগ ইন করলে কি হতো?একটাবার মানুষটার খোঁজ নিলে কি হতো? এতগুলি দিন প্রতিনয়ত যন্ত্রনায় ছটফট করতে হতো না।কেনো সে খোঁজ নিলোনা?কেনো?কীভাবে সে ভাবলো রিদিকে নিঝুম একদিন বিয়ে করবে।একটু ভরসাও ছিল না!তিতলির এক হাতে ফোন, অন্য হাত দিয়ে মুখ চেপে কাঁদছে।পাশের মহিলা এতো কথা বলেও তিতলির মনোযোগ আনতে পারেনি।এক ধ্যানে মেয়েটা কিছু দেখছে আর কাঁদছে।পাশ থেকে একজন মহিলা উঠে বললো,
— “জিনে আছর করছে নাকি?”
তিতলির পাশের ভদ্রমহিলা অপর মহিলার দিকে কটমট করে তাকিয়ে বললো,
— “শাট-আপ।”
আগ্রহবশত ভদ্রমহিলা তিতলির ফোনের স্ক্রিনে তাকায়।নিকনেম আমার ব্যাক্তিগত ডাক্তার।মনে হচ্ছে বয়ফ্রেন্ড বা হাসবেন্ড কেইস।উৎসুক চোখ নিয়ে মেসেজের দিকে তাকান।একটা মেসেজ পড়েন।মেসেজটা,
“আজ দুইটা বছর শেষ হয়ে গেল।অপেক্ষার অবসান কি ঘটবে না?বিচ্ছেদের গ্লানি টানতে বড় কষ্ট হচ্ছে।তোমার এই আইডিটা ছাড়া কষ্ট গুলো বলার মতো কেউ নেই।নিঃসঙ্গ আমি, বড্ড একা।”
ভদ্রমহিলার চোখের সামনে সবটা পরিষ্কার হয়ে যায়।তিতলি কাঁদছে আর মেসেজ পড়ছে।তিন চার দিন পর পর নিঝুম অনলাইনে আসে।তিতলিকে মেসেজ করতে।প্রত্যেকটা মেসেজে নিঝুমের যন্ত্রনাময় আর্তনাদ।তিতলির বুকটা ব্যাথায় ভরে উঠছে।মানুষটা এতো ভালবেসেছে তবুও তাঁর একবারো মনে হলোনা নিঝুম কখনো অন্য কাউকে বিয়ে করতে পারেনা।তিতলির কাঁপুনি,কান্না বাড়ে। হাত থেকে ফোন পড়ে যায়।ভদ্রমহিলা কান্নারত তিতলিকে আঁকড়ে ধরে বললো,
— “কেঁদোনা মেয়ে।”
তিতলি চিনেনা এই ভদ্র মহিলাকে। তবুও জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে।
রিদি নির্জনের কাছ থেকে নিঝুমের ঠিকানা নিয়ে তাঁর ফ্ল্যাটে আসে।দরজার সামনে এসে দেখে দরজা খোলা!দরজা ঠেলে রুমে ঢুকে।ড্রয়িংরুম শুরুতে।দুইটা সোফা।একটা ডাইনিং টেবিল।পাশেই রান্নাঘর। তারপর একটা রুম।হয়তো রুমে আছে নিঝুম।রিদি এগিয়ে আসে।দেখে, নিঝুম সটান হয়ে শুয়ে সিগারেট টানছে।রিদি গলা খ্যাঁক দেয়।নিঝুম মাথা ঘুরিয়ে তাকায়।রিদিকে দেখে উঠে বসে ভ্রু কুঁচকায়।রিদি বললো,
— “রুমে আসবো?”
— “কি দরকার?” নিঝুম অন্যদিকে চোখ রেখে বললো।
রিদি হেসে ঢুকে পড়ে রুমে।বিছানায় বসে।নিঝুম বিব্রতবোধ করে।রিদি বললো,
— “আমার বিয়ের দুই বছর শেষ হলো।”
নিঝুম অবাক হয়।রিদির বিয়ে হলো কবে?কিন্তু প্রকাশ করলো না।সিগারেট টানতে থাকে।রিদি আবারো বললো,
— “তুই মামা হবি।পাঁচ মাস চলে।”
নিঝুম বিস্মিত হয়।গোপন করতে পারেনি বিস্ময়তা। রিদির দিকে তাকিয়ে দেখে,গাউন পরেছে রিদি।পেট টা উঁচু।মোটা হয়েছে অনেক।আবার চোখ সরিয়ে নেয়।মেঝেতে চোখ রেখে বললো,
— “কনগ্রাচুলেশনস।”
রিদি হাসলো।বললো,
— “আব্বুকে ক্ষমা করবি?”
নিঝুমের চোয়াল শক্ত হয়ে আসে।রিদিকে বাজে কথা শোনাতে গিয়েও শোনায়নি।রিদির এই অবস্থায় তাকে উত্তেজিত করতে চায় না নিঝুম।রিদি দম নিয়ে বললো,
— “সেদিন তোদের বাড়ি থেকে বের হয়ে ফ্রেন্ডের বাড়ি উঠি।ফ্রেন্ডের সাথে ঢাকা চলে যাই।আব্বুর সাথে কোনোরকম যোগাযোগ রাখিনি।এক বছর পর রাফিনকে ঢাকা পাই।প্রপোজ করে বিয়ের জন্য।এক্সেপ্ট করে নেই।বাবাকে না জানিয়েই বিয়ে করে সংসার করি দুই বছর।যখন জানতে পারি আমি মা হবো,বাবার কাছে ছুটে আসি।হাজার হউক বাবাতো বাবাই।এমন একটা খবর তাকে জানানো উচিৎ মনে হলো।ওইতো চার মাস আগেই সিলেট আসি,বাবার কাছে।এসে দেখি,বাবা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে।দুই বার নাকি হার্ট এ্যাটাক করেছে।আর একবার করলে, চলে যাবে দুনিয়া ছেড়ে।তাই আর ছেড়ে যেতে পারিনি।তোর-আর তিতলির অভিশাপে আব্বু নিঃশেষ হয়ে গেছে।শুধু দেহটা বেঁচে আছে।তোরা যদি ক্ষমা করিস, হয়তো একটু সুস্থ হবে। আল্লাহ খুশি হবে।”
একদমে কথাগুলো বললো রিদি।তারপর হাঁপাতে থাকে।নিঝুম পানি এনে দেয়।রিদি পানি খেয়ে বললো,
— “করবি ক্ষমা?”
নিঝুম হাসলো।রিদি বুঝে গেছে উত্তর। নিঝুম জানে প্রিয় মানুষ কাছে না থাকার বেদনা কেমন!সেখানে, আরমান চৌধুরী যে মেয়ের জন্য স্বার্থপর হয়েছিল সে মেয়ে ছাড়াই তিনটা বছর কাটিয়েছে।তাই সে ক্ষমা করে দেয় মন থেকে।নিঝুম ফ্লোরে বসে বললো,
— “শাফির ভাই রাফিন তোর হাসবেন্ড? ওইযে আর্মি? তোরে প্রপোজ করেছিল কয়েক বছর আগে?”
রিদি হেসে মাথা নাড়ায়। বলে,
— “তোকে সত্যি ভালবেসেছিলাম।এখনও মনের এক কোণে আছিস।কিন্তু বাকি তিন ভাগ জুড়ে এখন আমার স্বামী।আমি খুব সুখীরে,খুব।”
নিঝুম হেসে বলে,
— “তোর বেবির নাম কিন্তু আমি রাখবো?”
— “হুম তুইই রাখবি।”
রাত বাড়ছে।আর এক ঘন্টা লাগবে ঢাকা রেল ষ্টেশনে পৌঁছাতে।ভোরেই নিঝুমের সামনে থাকবে সে।ভাবতেই তিতলি শিহরিত হচ্ছে।খুশিতে উঁড়তে ইচ্ছে হচ্ছে।ঠিক প্রজাপতির মতো।ভাবে,দেখা হওয়ার সাথে সাথে কাজী অফিসে গিয়ে বিয়ে করে নিবে।একটা কথা ভাবলেই উত্তেজনা বাড়ছে তিতলির।নিঝুম যখন তাকে দেখবে?কি করবে?তাঁর মতো অজ্ঞান হবে?কি মজা হবে!পাশের ভদ্রমহিলার নাম সোহানা শিকদার।তিনি বিয়ে করেছেন দশ বছর।ছয় বছরের একটা মেয়ে আছে।স্বামীর সাথে ঝগড়া করে, নানার বাড়ি চলে যাচ্ছে।তিতলির কাছে যখন তাঁর পুরো লাভ স্টোরিটা শুনলো তিনি আবেগী হয়ে পড়েন।স্বামীকে কল করে বলে,
— “আমি নেক্সট ট্রেনেই ইন্ডিয়া ফিরছি।”
সোহানার চোখ দু’টো লেগে আসে।আচমকা চেঁচামেচিতে ঘুম ভেঙে যায়।চোখ খুলে দেখে সবাই দৌড়াদৌড়ি করছে।উপস্থিত মহিলারা আল্লাহকে ডাকছে।শুধু এখানে নয় আশপাশ থেকেও মানুষের আর্তনাদ ভেসে আসছে। তিতলি আতঙ্ক নিয়ে বুঝার চেষ্টা করছে কি হয়েছে।কয়েক সেকেন্ড পর, একটা ছেলে আসে।চেঁচিয়ে বলে,
— “কেউ আগুন ছুঁড়ে মেরেছে ট্রেনে।এদিকে আগুন ধেয়ে আসছে।ট্রেন ব্রেক ফেইল করেছে।পুরো ট্রেনকে খেয়ে ফেলবে আগুন।”
তিতলি দ্রুত জানালা দিয়ে মাথা বের করে ট্রেনের পিছনে তাকায়।ভয়ংকর আগুন! আত্মা কেঁপে উঠে।সোহানা হ্যাঁচকা টানে তিতলিকে নিয়ে দরজার সামনে এসে দাঁড়ায়।দরজার বাইরে মুখ বের করে দেখে,অন্য দরজাগুলো দিয়ে যে যেভাবে পারে লাফিয়ে নামছে চলন্ত ট্রেন থেকে।কেউ ট্রেনের নিচে চাপা পড়ছে।কেউ দূরে গিয়ে পড়ছে।আহত হচ্ছে।তবে,বেঁচে যাচ্ছে।সোহানা তিতলিকে চেঁচিয়ে বললো,
— “তিতলি লাফ দাও।নয়তো বাঁচবে না।”
তিতলি ভীতু চোখে তাকায়।বলে,
— “পারবনা।”
— “ট্রেনে থাকলে নিশ্চিত মৃত্যু। আর কয়েক সেকেন্ড লাগবে এই অংশে এসে আগুন লাগতে।আগুনে পুড়ে মরার চেয়ে, রিস্ক নিয়ে লাফ দেওয়া ভালো।”
— “না আমি পারবনা।”
সোহানা আর কথা বাড়ায়নি।তাঁর বাঁচতে হবে মেয়ের জন্য।শরীরের সবটুকু শক্তি দিয়ে লাফ দেয়। তিতলি আৎকে উঠে।দরজার বাইরে তাকায়।ট্রেন এতো দ্রুত গতিতে চলছে যে,নিমিষেই সোহানাকে পিছনে ফেলে দূরে চলে আসে।আগুন প্রায় কাছাকাছি। আরো কয়জন তিতলিকে ঠেলে চলন্ত ট্রেন থেকে লাফ দেয়।তিতলির সারা শরীর কাঁপছে। সেও বাঁচতে চায়।নিঝুমকে সে পেতে চায়।চোখ বন্ধ করে আল্লাহর নাম স্বরণ করে তিতলি লাফ দেয়।লাফ দেওয়ার আগে সে চোখ খুলে দেখেনি কাছাকাছি কোনো পিলার আছে নাকি।তিতলি লাফ দেওয়ার সাথে সাথে পিলারের সাথে অস্বাভাবিক ভাবে ধাক্কা খেয়ে ছিটকে দূরে পড়ে।