প্রজাপতি আমরা দুজন পর্ব ৪৯

প্রজাপতি আমরা দুজন পর্ব ৪৯
ইলমা বেহরোজ
হসপিটাল থেকে নিঝুমকে ছাড়িয়ে রাত দশটা ত্রিশ মিনিটে নির্জন ট্রেনে উঠে।অসুস্থ নিঝুমকে নিয়ে সে এরোপ্লেনে আসতে চেয়েছিল সিলেট।কিন্তু,নিঝুমের শর্ত ট্রেনে গেলেই সে যাবে।নয়তো না।নিঝুম ট্রেনের কামরায় তিতলিকে খুঁজে পায়।মনে হয়,হুট করে একদিন তার কামরার দরজায় টোকা পড়বে।দরজা খুলে দেখবে,তিতলি দাঁড়িয়ে আছে।’ভালবাসি’ বলে ঝাঁপিয়ে পড়বে তার বুকে।কিন্তু কতবার সে ট্রেনে উঠলো আজও পেলোনা তিতলির দেখা।হাল ছাড়েনি তবুও। আসতেও তো পারে তিতলি…!
ট্রেন একটা জোরসে আওয়াজ তুলে যাত্রা শুরু করে।নিঝুম বার্থে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ে।নির্জন নিঝুমের সামনের বার্থে বসে।হসপিটাল থেকে বেরিয়ে শপিং করেছে নির্জন।নিঝুমের গায়ের কাপড়ের অবস্থা খুবই খারাপ ছিল।এতোটা রাস্তা তো আর স্যান্ডো গেঞ্জি আর পায়জামা পরে যাওয়া যায়না।নিঝুম কান খাড়া করে চুপ হয়ে আছে।এর আগেও বহুবার দরজায় টোকা পড়েছে।কিন্তু,দরজা খুলে চানাচুরওয়ালা, চাওয়ালাকে দেখতে হয়েছে।নির্জন হালকা কেশে নিঝুমের দৃষ্টি আকর্ষণ করলো।নিঝুম তাকায়।নির্জন বললো,
— ” কি হয়েছিল তোর জানতে চাস না?’
নিঝুম কামড়ার ছাদে চোখ রেখে বললো,
— “না।”
নির্জন কপাল কিঞ্চিৎ কুঁচ করলো।বড় করে দম নিয়ে বললো,
— “জানার দরকার।”
— “আচ্ছা বল।”
— “তুই সেন্সলেস হয়ে পড়ছিলি।”
নির্জনের কথা-বার্তা ভালো লাগছে না নিঝুমের।পাশ ঘুরে বললো,
— “জানি।”
— “তুই খুব দূর্বল হয়ে গেছিস।”
— “বুঝি।”
— “তোর ভেতরটা পুড়ে যাচ্ছে।বুঝিস না সেটা?”
নিঝুম ম্লান হাসলো।বললো,
— “তিতলি যেদিন হারিয়ে গেল।সেদিনই ভেতরটা পুড়ে ছাই হয়ে গেছে।”
— “আজ নিয়ে তুই চারবার সেন্সলেস হয়েছিস।ডাক্তার বলেছেন,আর কয়টা মাস এভাবে নেশা করে গেলে মৃত্যুর দোয়ারে তোর জায়গা হবে।বুঝতে পারছিস? কি ভয়ানক পরিণতির দিকে এগোচ্ছিস।এভাবে কি পাচ্ছিস তুই?” নির্জনের কণ্ঠে।
নিঝুম নির্জনের দিকে পাশ ফিরে শুয়ে বললো,
— “হাইপার হচ্ছিস কেনো এতো?”
— “ভাই বিশ্বাস কর,তোরে আমার মারতে ইচ্ছে হচ্ছে।খুব মারতে ইচ্ছে হচ্ছে।”
নিঝুম হাসলো।নিঝুমের হাসি দেখে নির্জনের রাগ বেড়ে যায়।নিঝুম বললো,
— “আগে তোরে মেরে মেরে বুঝাতাম।এখন না হয় তুই মার।কিন্তু বুঝানোর কিছু নাই তোর ভাষার ভান্ডারে।”
কপট রাগ নিয়ে নির্জন বললো,
— “মজনু হবি মজনু? মইরা তোরে মজনু হতে কেউ বলেনি নিঝুম।”
— “আমার তিতলি চাই।মজনু হতে চাইনা।”
নির্জন চোখ বুজে নিজের মেজাজ নিয়ন্ত্রনে আনে।মেরে,ধমকিয়ে নিঝুমকে বুঝানো বড় দায়।কয়েক সেকেন্ড চুপ থাকে। তারপর বললো,
— “ধর,আরো কয়টা মাস গেল তোর মরণব্যাধি কোনো রোগ হলো।বাঁঁচা অসম্ভব। তখন যদি তিতলি আসে!কি বলবি ওরে? তুই আর বাঁঁচবিনা বলবি?”
যেন টনক নড়লো।নিঝুম উঠে বসে।জানালার বাইরে তাকায়।তারপর বললো,
— “আমি মরতে চাইনা।আমি তিতলিকে নিয়ে বাঁচতে চাই।”
নির্জন নিঝুমের পাশ ঘেঁষে বসলো।কাঁধে হাত রেখে বললো,
— “নেশাটা ছেড়ে দে ভাই।”
নিঝুম নির্জনের চোখে চোখ রাখে।আবার চোখ সরিয়ে নেয়। বললো,
— “নিত্যদিনের অভ্যেস, একদিনে ছাড়া কি সম্ভব?”
— “কমিয়ে দে।ধীরে ধীরে কমাতে থাক।তবে,দ্রুত চেষ্টা করবি।দেখবি ২-৩ মাস গেলেই আর খাচ্ছিস না।”
নিঝুম হেসে বললো,
— “তার আগে যদি তিতলি চলে আসে।আগেই ছেড়ে দেব।এক্কেবারে ছেড়ে দেব।”
নিঝুমের ঠোঁটের হাসি নির্জনের ঠোঁটেও হাসি ফুটিয়ে তুললো।নির্জন বার্থে এসে শুয়ে পড়ে।নিঝুমও শুয়ে পড়ে।
— “আচ্ছা নিঝুম,তিতলির মামা-খালা নেই?” নির্জন আচমকা প্রশ্ন করলো।
— “দুইজন মামা আছে।”
— “ওদের বাসায় খোঁজ নিয়েছিস?তিতলি আছে নাকি?”
— “পুরান ঢাকা তিতলির নানার বাড়ি।গেছিলাম তো,এক মামারে পাইছি।তাঁর বাড়ি তিতলি নাই।তিতলির আরেক মামার ঠিকানা চাইছিলাম। কিন্তু পাইনি।’
— “দেয়নি?”
— “উনার কাছে নাই ঠিকানা।”
— “ভাইয়ের কাছে ভাইয়ের ঠিকানা নাই? অদ্ভুত তো।”
— “উনার নাকি ভাইয়ের সাথে দ্বন্দ্ব-ভেজাল ছিল।কেউ কারোর খোঁজ রাখে না।তিতলির ওই মামা নিজের বাড়ির এক অংশ বেঁচে কই গেছে তা কেউই জানেনা।”
নির্জন হতাশ ভঙ্গিতে বললো,
— “ওহ।”
তারপর পরই উৎসাহ নিয়ে বললো,
— “দুই ভাইয়ের এক বোন ছিল? তাহলে এমন তো হতেই পারে যে,তিতলির মামা তিতলির মায়ের সাথে ঠিকই যোগাযোগ রাখতো।বা,তিতলির আব্বু অথবা তিতলির সাথেও।”
নিঝুম বিরক্তি নিয়ে বললো,
— “তিতলি মা দুনিয়াতে আছে যে জিজ্ঞাসা করবো গিয়ে,ঠিকানা আছে নাকি? আর তিতলি আর তিতলির আব্বুকেই তো খুঁজছি।উনাদের পেলে,আর মামার ঠিকানা দিয়ে কি হবে?”
নির্জন উদাস হয়ে বললো,
— “আসলেই তো।”
কামড়ার দরজায় টোকা পড়তেই ধড়মড়িয়ে উঠলো নিঝুম।দ্রুত দরজা খুলে।দেখে, বাদামওয়ালা।নিঝুম হুংকার দিয়ে উঠে,
— “কি চাই?”
বাদামওয়ালা খানিকটা ভয় পেল।বললো,
— “ভাই বাদাম কিনবেন?”
— “কিনলে তো নিজেই বাদামওয়ালা খুঁজে বের করতাম।এভাবে রাত-বিরেতে ডিস্টার্ব না করলে হয়না?”
লোকটি মাথা নিচু করে চলে যেতে নিলে নিঝুম ডাকলো,
— “দাঁড়ান।”
লোকটি ঘুরে দাঁড়ায়। নিঝুম কপাল দেখিয়ে বললো,
— “কি হয়েছে কপালে?”
— “মারছে।”
— “কে?”
— “গতকাইল আপনার মতোই এক লোকরে ডিশটাব করছিলাম।তাই মাইরা দিছে।”
— “তো করো কেন?”
— “বউডা পোয়াতি আমার।আবার ডায়বেটিসও আছে।টাকা লাগে অনেক।বাদাম বেঁচতে না পারলে চলবো না।বাচ্চাডার লগে বউডাও…”
নিঝুমের মায়া হলো।নির্জনকে ডেকে পাঁচশ টাকা নেয় ।লোকটিকে দিয়ে বললো,
— “কয়টা বাদাম দিয়া যাও।আর এইটা নাও।”
লোকটির দু’চোখ ভরে উঠে কৃতজ্ঞতায়।
বিচ্ছদের তিন বছর এক মাস শেষ।তিতলির বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে তিতলির মামি তাঁর বোন এবং বোনের ছেলে আসে শাহেদের কাছে।শাহেদ গম্ভীরমুখে বসে আছেন।রোমেনা পাশেই দাঁড়িয়ে আছে।কিছু না বলে হুট করে এরা চলে এসেছে।যথেষ্ট বিরক্ত হয়েছেন শাহেদ।তিনি ফোনে বার বার তিতলির মামিকে বলেছেন,মেয়ের বিয়ে দেব না।দেব না। তবুও কীভাবে নিয়ে আসলো এদের?
তিতলি মামি সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে বললো,
— “মেয়ে কই মেয়েকে দেখছিনা যে?”
রোমেনা ভার মুখে বললো,
— “ভার্সিটিতে।”
— “কোন ক্লাসে পড়ে মেয়ে?” রবিনের(পাত্র) মা প্রশ্ন করলো।
শাহেদ মেঝের দিকে তাকিয়ে গম্ভীরমুখে বললো,
— “না জেনেই চলে এসেছেন?”
শাহেদের কথার ধরন যেন অপমানের ছিঁটা দিল শরীরে।রবিনের মা অপমানের সাথে বিব্রতবোধ করলো।তিতলির মামি হেসে বোনকে বললো,
— “তোরে না বলছি বিবিএ ফাইনাল ইয়ারে আছে আমাদের তিতলি।”
রবিন প্রশ্ন করলো,
— “ইন্ডিয়া এসেছে তিন বছর।তাহলে,ফাইনাল ইয়ারে কেমনে?থার্ড ইয়ারে আমার সাথে থাকার কথা।”
— “বাংলাদেশ ফার্স্ট ইয়ারে ছিল তিতলি।যখন এক্সামের দুই মাস বাকি তখন ইন্ডিয়া চলে আসে।তোর খালু বাংলাদেশ থেকে ট্রান্সফার করে আমাদের পানিহাটি ভার্সিটিতে ভর্তি করে দেয়।ঠিক দুই-তিন মাস পরই এক্সাম দিয়ে সেকেন্ড ইয়ারে উঠে।তাইলে হিসেব করে দেখ,এখন তো ফাইনাল ইয়ারেই থাকার কথা।কয়দিন আগে না থার্ড ইয়ারের এক্সাম গেল।”
ধীরে-সুস্থে বুঝালো রবিনকে তিতলির মামি।
রোমেনার রাগ হয় খুব।কয়টা কথা শোনাতে গিয়েও শোনায়নি।উনি চান না,তিতলির আম্মুর আত্মীয়দের সাথে খারাপ ব্যবহার করতে।রবিনের মা হেসে বললো,
— “ভাইসাহেব আমার ছেলেকে দেখে নিন।আপনার মেয়ের জন্য এমন খাঁটি ছেলে আর একটাও পাবেন না।মা বলে বলছি না।সত্যিই আমার ছেলে হীরার টুকরা।”
শাহেদ চোখ তুলে রবিনের দিকে তাকান।দাঁড়ি মোটেও নেই।চুল গলা অব্দি লম্বা।আবার স্ট্রেইট করা।সাথে কালারও আছে।প্যান্টে হাঁটুর দিক পুরোটাই ছেঁড়া।এই ছেলে হয়তো তিতলির চেয়ে ১-২ বছরের বড় হবে অথবা তিতলির সমানই কিন্তু দেখে মনে হচ্ছে তিতলির ছোট ভাই।তিনি চোখ সরিয়ে নেন।সেই মুহূর্তে সেই জায়গায় তিতলির আগমন ঘটলো।তিতলির ভুরু কুঁচকে যায়।মায়ের দিকে ফিরে বললো,
— “এরা এখানে কেন?”
রোমেনা ঢোক গিলে।এই জায়গা যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হবে আজ।বিয়ের কথা শুনলেই তিতলি মেজাজ আসমানে উঠে,সেখানে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে লোক এসেছে বাসায়!
— “মামি?তোমার বোন আর বোন ছেলে কেন আমার বাড়িতে?”
তিতলির কণ্ঠ ঝাঁঝালো শুনাল।তিতলির মামিও যে ভয় পাচ্ছে না তা নয়।সেও ভেতরে ভেতরে তিতলিকে অনেকখানি ভয় পায়।মেয়েটা আগের মতো নেই।যতবার সে রোমেনাকে কথা শুনিয়েছে ততবার তিতলি তাকে ধুয়ে দিয়েছে।তবুও ভয়টা গোপনে রেখে বললো,
— “রবিন তোকে বিয়ে করতে চায়।”
তিতলি দুর্বোধ্য হাসলো।হাত তালি দিয়ে বললো,
— “কিরে রবিইন্না? বিয়া করবি আমারে?তোর দাঁড়ি উঠছে? বিয়া করতে যে আসছস?”
রবিনে ফোঁসেসে উঠলো।বললো,
— “তুই তুকারি করবেনা।”
— “কি করবি করলে? তুই এখনি বাড়ি থেকে বের হ।” তিতলির হুংকার।
রবিনের মা উঠে দাঁড়ায়। নাক-মুখ কুঁচকে বললো,
— “ছিঃ ছিঃ!একজন শিক্ষকের মেয়ের কি ব্যবহার।”
— “ভালোই ভালোই বলতাছি।বেরিয়ে যান আপনার লুইচ্ছা পোলারে নিয়া।গিয়া ললিপপ খাওয়ান।দাঁড়ি তুলান।তারপর বিয়ের জন্য মেয়ে খুঁজেন।”
তিতলির মামি ধমকে উঠলো,
— “তিতলি।এমন করছিস কেনো?”
— “এইযে আসল আসামি। সাহস কেমনে হয় তোমার?বিয়ের প্রপোজাল নিয়ে আসা? আমার বাপ না করে নাই? আমি  না করি নাই? তবুও ছেঁচড়ামি করলা কেমনে?”
তিতলি মামি নিজেকে প্রস্তুত করে কিছু কথা শোনাতে।তার আগেই তিতলি নিজের রুমে ঢুকতে ঢুকতে বললো,
— “রবিইন্না তোর মা রে নিয়া বাইর হ।আমি জুতা নিয়া আইতাছি।আইসসা যেনো না দেখি তুই আছস।”
তিতলির কথা রবিনসহ রবিনের মা খালার বোধগম্য হলোনা।ভ্যানিটি ভ্যাগ হাতে নিয়ে তাঁরা তিনজন দ্রুত বেরিয়ে পড়ে।রোমেনা শাহেদ দম নিয়ে নিঃশ্বাস নিল।তিতলি হাতে জুতা নিয়ে এসে দেখে,ওরা নেই।রোমেনা হেসে বলেন,
— “চলে গেছে।”
ছুটির দিনটা বিষাক্ত তিতলির জন্য।ভার্সিটি – টিউশনি কিছু নাই।বাসায় থাকতে হয়।সাথে কিছু যন্ত্রনাময় স্মৃতি। তিতলি বিকেল-বেলা ছাদে আসে।
আরো দুই-বাড়ির পরে যে ছাদটা সেখানে একজোড়া বিবাহিত হিন্দু যুগল দেখতে পায়।গত সপ্তাহতেই বিয়ে হয়েছে।আমন্ত্রণ করেছিল,কিন্তু যায়নি তিতলি।শাহেদ আমন্ত্রণ রক্ষার্থে গিয়েছিলেন।
ছেলেটার নাম অনুপম।বয়স ২৮-২৯ মতোন হবে।বউকে জড়িয়ে ধরে দাঁড়িয়ে আছে।তিতলি দীর্ঘশ্বাস ফেলে চোখ সরিয়ে নেয়।নিঝুমের যখন ২৯ বয়স তখন নিঝুম তিতলির বর হওয়ার কথা ছিল কিন্তু হলো না।তিতলি নিচে নেমে আসে।বাবাকে না দেখতে পেয়ে রোমেনাকে বললো,
— “বাবা কই?”
— “টুকুনদের বাড়ি গেছে নালিশ নিয়ে।স্কুলে নাকি খুব দুষ্টুমি করে।”
তিতলি উত্তরে কিছু না বলে রুমে আসে।বাথরুমে ঢুকে জামা-কাপড় খুলে উড়না পেঁচিয়ে নেয় শরীরে।শাওয়ারের নিচে পা ভাঁজ করে বসে।থ মেরে অনেকক্ষণ বসে থাকে।ব্লেড হাতে নেয়,হাতের রগ কাটতে গিয়ে থেমে যায়।ব্লেড ছুঁড়ে ফেলে দূরে।তারপরই চিৎকার করে কেঁদে উঠে,
— “আমি আপনাকে ভুলতে পারছিনা ডাক্তার।পারছিনা আমি…”
রোমেনা রান্নাঘর থেকে দৌড়ে আসে।বাথরুমের দরজায় ধাক্কাতে থাকে।
— “তিতলি কাঁদছিস কেন? দরজা খোল।”
তিতলির কানে মায়ের ডাক আসছে না।সে অনেকদিন পর প্রাণ-খুলে কাঁদছে।খুব কাঁদছে।রোমেনা দরজায় আওয়াজ করে ডেকেই চলেছে,
— “ও তিতলি।তিতলি,দরজা খোল।খোল না।ও মা।এভাবে কাঁদিস না!”
তিতলি নিজের চুল টেনে ধরে। ভাবে,নিঝুম ভালবাসছে রিদিকে।খুব ভালবাসছে।যত ভাবছে,যন্ত্রনা তীব্র থেকে তীব্রতর রূপ ধারণ করছে। রোমেনা ডাকতে ডাকতে হাঁপিয়ে উঠেন।দরজার পাশে বসেন।উনার চোখে জল।রোমেনা কাঁদছে!
অনেকক্ষণ পার হয়ে গেল ভেতর থেকে কোনো সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না।পানির আওয়াজ ছাড়া।রোমেনার বুক কেঁপে উঠে।অস্ফুটস্বরে ডাকে,
— “তিতলি, ও তিতলি?”
না সাড়া নেই।রোমেনা দ্রুত কল করেন শাহেদকে। শাহেদ দ্রুত বাড়ি ফিরেন।দূরে কোথাও যান নি।কাছেই ছিলেন।বাসায় এসে সব শুনে তিনি আৎকে উঠেন।স্বামী-স্ত্রী মিলে শরীরের সবটুকু শক্তি দিয়ে বাথরুমের দরজা ধাক্কা দেন।দরজা খুলে যায় কিছু অংশ ভেঙ্গেও যায়।শাহেদ ভেতরে ঢুকেননি।রোমেনা আগে ঢুকে।তিতলিকে অর্ধনগ্ন অবস্থায় অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে। যত দ্রুত সম্ভব তিতলিকে জামা পরিয়ে দেন।তারপর স্বামীকে ডাকেন।দুজন মিলে তিতলিকে বিছানায় এনে শুইয়ে দেন।শাহেদ ডাক্তার আনতে বের হয়ে যান।রোমেনা তিতলির হাত-পা ঘষতে থাকে।ডাক্তার আসার কিছুক্ষণের মাঝে তিতলির জ্ঞান ফিরে।কিছু ঔষধের নাম লিখে দিয়ে ডাক্তার বেরিয়ে যান।আবদুল মিয়া মেয়ের কপালে চুমু এঁকে বেরিয়ে পরেন ঔষধ আনতে।এই বয়সে এসে দৌড়াদৌড়ির দকল নিতে খুব কষ্ট হয় শাহেদের।কিন্তু কিছু করার নেই…
রোমেনা এক গ্লাস গরম গরম দুধ এনে দেন তিতলিকে।তিতলি খেতে মানা করলে রোমেনা বললো,
— “শরীর খুব দূর্বল।খাওয়া উচিৎ তোর।”
— “প্লীজ আম্মু খাবো না।”
তিতলি ধীরে ধীরে উঠে বসে।রোমেনা জোর করে বুঝিয়ে শুনিয়ে তিতলিকে দুধটুকু খাইয়ে দেন।তারপর বলেন,
— “একবার সিলেট যা মা।”
তিতলি তাকায়।রোমেনা আবার বললো,
— “নিঝুমের কাছে।”
— “উনি বিবাহিত।”
— “তুই শুনেছিস বিয়ে করেছে?”
— “না তবে,উনার আব্বু ছেলের সাথে রিদির বিয়ে দেবার জন্যই আমাকে সরে যেতে বলেছেন।”
— “নিঝুম বিয়ে না করতেও পারে।”
— “সেটা কি আদৌ সম্ভব?”
— “একবার দেখে আসতে সমস্যা কি রে মা?যদি এমন হয়,ছেলেটা তোর জন্য বিয়ে করেনি।এখনও অপেক্ষা করছে?”
তিতলি বিস্মিত হলো।সত্যিকি এমনটা হয়েছে?আমতা আমতা করে তিতলি বললো,
— “বে…বেশি ভাবছো আম্মু।”
— “একবার দেখে আসতে দোষ কি?”
— “যদি এমন হয়? উনি রিদিকে বিয়ে করেছেন ভালো আছেন।কিন্তু উনার মনের এক জায়গায় আমি আছি।আমাকে দেখে যদি উনার সংসার নষ্ট হয়?”
রোমেনা তিতলির মাথায় হাত রেখে বললো,
— “দূর থেকে দেখে আসবি।”
তিতলি দরজার বাইরে ডাইনিং টেবিলটার দিকে তাকায়।সে একটাবার নিঝুমকে দেখতে চায় অনেকদিন ধরেই।একবার লুকিয়ে দেখে আসতে দোষ নেই? আর সত্যি যদি উনি বিয়ে করে না থাকেন? উত্তেজনায় তিতলির গলা শুকিয়ে আসে।রোমেনার কাছে পানি চায়।পানি খেয়ে বললো,
— “আম্মু আমি যাবো সিলেট।কাল সকালেই ট্রেনে উঠবো।কাল সকালেই…”