প্রজাপতি আমরা দুজন পর্ব ৪৮

প্রজাপতি আমরা দুজন পর্ব ৪৮
ইলমা বেহরোজ
— “টুনি? কইরে?” আঞ্জুমানের দূর্বল গলা।
টুনি নিচ তলা থেকে দৌড়ে আসে।
— “জ্বি খালাম্মা?”
— “আজ রবিবার না?”
— ”হ খালাম্মা।”
— “নিঝুমের রুমের চাবিটা কই রাখছি দেখছিস?”
— “কেন কি করবেন? অসুখ শরীরলডা লইয়া জিনিসপাতি মুছামুছি করতে হইবো না আপনের।আমি পরিষ্কার কইরা দিতাছি।”
আঞ্জুমান হাসলো।বললেন,
— “নিঝুমের রুমটায় তোদের ঢোকা নিষেধ কতবার বলব?”
টুনি কিছু বললোনা।আঞ্জুমান বললো,
— “দে চাবি দে।”
টুনি শাড়ির আঁচল থেকে খুলে চাবি দেয়।আঞ্জুমান দূর্বল শরীর নিয়ে ধীরে ধীরে হেঁটে যান ছেলের রুমে।দরজা খুলেই দীর্ঘশ্বাস ফেলেন।রুমটা সেই প্রথম দিনের মতোই সুন্দর।আঞ্জুমান প্রতি সপ্তাহে রুমটায় আসেন।জিনিসপত্র মুছেন।ধুলা-বালি দূর করেন।
তাঁর সংসারটা হুট করে কালবৈশাখী ঝড়ে দুমড়ে মুচড়ে গেল।আলতাফ চৌধুরীর সাথে হেসে কথা বলেননা অনেকদিন।প্রতিটা রাত কেঁদে কাটান আঞ্জুমান।নিঝুমের সাথে মাঝে মাঝে দেখা হয়।তাও বিধ্বস্ত অবস্থা দেখতে হয় ছেলেকে।মেয়েগুলোকে দেখলে মনে হয় তাঁরা খাঁচায় বন্দি।আর নির্জন সারাদিন পরিশ্রম করে এক হাতে পরিবারটাকে টানছে।কিছু ঠিক নেই।কারো সাথে কারো সংযোগ নেই,এক বাড়িতে থেকেও।তাঁদের দোষটা কি ছিল?
— “মৌ?তিতলি কি কখনো আসবে না আর?”
মৌনতা ফোন থেকে চোখ সরিয়ে মোহনার দিকে তাকায়।মোহনা ফ্লোরে বসে আছে দেয়ালে হেলান দিয়ে।মৌনতা ক্ষীণ স্বরে বললো,
— “জানিনা।”
— “আমাদের পরিবারের সুখ কি তিতলি?”
— “তিতলি আমাদের পরিবারের একটা অংশ।আজ যদি তুই বা আমি হারিয়ে যেতাম।তাহলেও ফ্যামিলিটা চুরমার হয়ে যেত।আমাদের পরিবারের সবাই একজন আরেকজনকে খুব ভালবাসে।একজন মিসিং হলে বাকিদের হাসি হারিয়ে যায় এবং যাবে।”
— “ঠিক বলেছিস।কিন্তু তিতলির বেলায় একটু বেশি হলো।”
মৌনতা উদাসীন হয়ে বললো,
— “হুম।আব্বুর অতীত জড়িত।”
মোহনা উঠে আসে বিছানায়।মেসেঞ্জারে টুংটাং আওয়াজ হয়।স্ক্রিনে দেখে,সাঈফের টেক্সট। মৌনতাকে ধাক্কা মেরে বললো,
— “এই সাঈফ টেক্সট দিছে।”
— “তো আমাকে বলছিস কেন?তোর বয়ফ্রেন্ড তোরে টেক্সট দিছে,প্রেম কর না।”
মোহনা গোমড়া মুখে বললো,
— “তোর তো হবু দেবর।”
— “আগে বিয়ে হউক তারপর।”
মৌনতা সটান হয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লো।মৌনতা বললো,
— “রাঈফ ভাইয়ের সাথে কথা হয়?”
মৌনতা ছাদের মেঝেতে চোখ রেখে বললো,
— “কিছুক্ষণ আগেই হলো।”
মোহনা ফোনের পাসওয়ার্ড খুলে মেসেঞ্জারে ঢুকে।মৌনতা কিছুক্ষণ কি যেন ভাবলো।তারপর উঠে বসে বললো,
— “রাঈফ,সাঈফ খুব ভালো নারে?”
মোহনা ফোনে চোখ রেখেই বললো,
— “হুম খুব।”
— “তিন বছর হয়ে গেল ওরা অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য।”
— “আমি অনেকবার বলেছি বিয়ে করে নিতে সাঈফকে।”
— “আমিও রাঈফকে বলেছি।কিন্তু সে নাছোড়বান্দা।”
মোহনা ফোন রাখে বিছানায়।মৌনতার দু’হাত মুঠোয় নেয়।আক্ষেপ নিয়ে বলে,
— “খুব ইচ্ছে হয় আমার আর সাঈফের একটা সংসার হবে।ফাটিয়ে সংসার করবো।কিন্তু দেখ,আল্লাহ হতে দেয়নি।”
মৌনতার বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে।বললো,
— ” নির্জন ভাইয়া নিঝুম ভাইয়া তো অনেকবারই বলেছে বিয়ে করে নিতে।”
— “কেমনে করি? বিয়ের পর সুখে থাকবো না রে।নিঝুম ভাইয়া যতদিন আগের মতো না হচ্ছে।বিয়ে করা সম্ভব নয়।বেহুদা অন্যের বাড়িতে গিয়ে থাকবো।মানিয়ে নিতে পারবো না।”
— “সেটা আমিও রাঈফকে বলছি।রাঈফ বলেছে, সে নাকি সারাজীবন আমার জন্য অপেক্ষা করবে।”
মোহনা এইবার হাসলো।বললো,
— “আমরা জমজ।আমাদের মনও একরকম।ওরা জমজ।ওদের মনও একরকম।”
মৌনতাও হাসলো।উচ্ছ্বসিত হয়ে বললো,
— ” নিঝুম ভাইয়ের জমজ বেবি হবে।আমাদের ও হবে।নির্জন ভাইয়ের তো হয়েছেই।দেখিস,বাংলাদেশ সরকার একসময় আমাদের জমজের অস্কার দিবে।’
দু’বোন একসাথে হেসে উঠে।
আলতাফ চৌধুরী সারাক্ষণ বিছানায় শুয়ে থাকেন।পাঁচ ওয়াক্ত নামাযের জন্য বেরিয়ে যান রুম থেকে।আর নয়তো বের হোন না।যতবার নামাযের জন্য বের হোন ততবার দ্বিতীয় তলায় উঠেন,আঞ্জুমানের সাথে দেখা করার জন্য।একটু কথা বলার জন্য।তিনি যা প্রশ্ন করেন আঞ্জুমান শুকনো মুখে শুধু উত্তর দেয়।কিন্তু,তিনি বুঝেন আঞ্জুমান কাঁদে তাঁর জন্য।খুব কাঁদে।টুনিকে দিয়ে তাঁর খোঁজ রাখে।খেয়াল রাখে।নিজে আসেনা।অভিমানের পাহাড়টা ভেঙ্গে আসতে পারেনা।নিঝুম তিতলি ছাড়া হয়তো এই অভিমান ভাঙ্গবেও না।এই বয়সে এসে তিনি নিঃসঙ্গ।বড্ড একা।সারাক্ষণ দিল দিয়ে জপ করেন, তিতলি যেন ফিরে আসে।তাঁর সোনার সংসারটা আবার যেন আনন্দে ভরে উঠে।তিনি অনুতপ্ত।
তখন দুপুর।রোহি বাচ্চাদের সামলাতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছে।একজন আয়া রেখেছিল বাচ্চাদের জন্য। কিন্তু,সেই আয়ার ব্যবহার ছিলো জঘন্য।বাচ্চাদের ধমকায়।তাই গতকাল তাড়িয়ে দিয়েছে।নির্জন বলেছে, আরেকজন আয়া এনে দিবে।বাচ্চারা এই বয়সে দাদা-দাদির হাতে বড় হয়।তাঁদের সাথে খেলে।অথচ,তাঁর বাচ্চারা!
নির্জন রুমে এসে শার্ট খুলতে খুলতে বললো,
— ” বাচ্চারা কাঁদে কেনো?”
রোহিতা ভ্রু নাচিয়ে বললো,
— “কি জানি।বুঝতেছিনা।”
নির্জন শার্ট পাল্টে বিছানায় এসে বসে।মেয়েকে কোলে তুলে নেয়।গাল টেনে বলে,
— “ওয়াজিফা আম্মু।কি হইছে? এতো কাঁদো কেনো? আম্মু বিরক্ত হয় তো।”
রোহি স্বাভাবিক কণ্ঠে বললো,
— “আমি বরং দুই-তিন মাসের জন্য বাপের বাড়ি যাই।”
নির্জন অবাক হয়ে তাকায়।বললো,
— “এতোদিন!”
— “কি করবো আর?সারাজীবন কোনো বাচ্চাকে কোলে নেইনি।আর সেখানে সারাক্ষণ বাচ্চাদের নিয়ে থাকতে হচ্ছে।কিছুতেই কন্ট্রোল করা যাচ্ছে না।বাচ্চারা ধীরে ধীরে তাজা হয়।আর আমার বেবিরা শুকিয়ে যাচ্ছে।ওদের কথা ভেবেই বাপের বাড়ি যেতে চাচ্ছি।আম্মু সামলাবে।” রোহির কণ্ঠে আর্তনাদ টের পায় নির্জন।বললো,
— “আচ্ছ।”
নির্জনের নাম্বারে কল আসে।মেয়েকে কোলে নিয়েই ফোন রিসিভড করে বেলকনিতে আসে।
— “আসসালামু আলাইকুম?”
রোহি নির্জনের দিকে তাকায়।নির্জনের কপাল কুঁচকানো।ফোনালাপ শেষে নির্জন রুমে আসে।রোহিতা প্রশ্ন করলো,
— “কে?”
নির্জন মেয়েকে বিছানায় রেখে আলমারি খুলে।টাকা বের করতে করতে বললো,
— “থানা থেকে। ‘
রোহি আর কথা বাড়ায়নি।বুঝে গেছে নিঝুমের ব্যাপার।অভ্যস্ত এসবে সে।জিজ্ঞাসা করলো,
— “সিলেটই না কুমিল্লা? নাকি অন্য জেলা?”
— “কুমিল্লা।”
রাতের ট্রেনে নির্জন কুমিল্লা আসে।সকাল সকাল নিঝুমকে ছাড়িয়ে আনে।ওসির কাছ থেকে জানতে পারলো নিঝুম নাকি জ্বালিয়ে মেরেছে।গাঁজা খেতে চাচ্ছিলো।নির্জন শুনে অনেক হাসে।পুলিশের কাছে তাঁর ভাই গাঁজা চেয়েছে!
রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে নিঝুম বললো,
— “কেমন আছিস?”
— “ভালো।”
নির্জন দাঁড়ায়।নিঝুম বললো,
— “কি?”
— “বাড়ি চল।”
নিঝুম মুখ ঘুরিয়ে নেয়।ছোট করে বলে,
— “না।”
— “আম্মু অসুস্থ অনেক।”
— “আচ্ছা সিলেট চল।ফ্ল্যাটে নিয়ে আসিস আম্মুকে।”
আরো কিছুক্ষণ হাঁটার পর নিঝুম প্রশ্ন করে,
— “ওয়াজিফা আর নাওরাদ কেমন আছে?”
— “ভালো আছে।আম্মু ওদের গুল্টু আর গুল্টি ডাকে।”
নিঝুম হাসে।মাথা ঘুরাচ্ছে তাঁর।একটা টং দোকানের বেঞ্চিতে বসে পড়ে।নির্জন প্রশ্ন করলো,
— “কিরে বসলি কেনো?”
নিঝুম উত্তরে কিছু বললো না।মাথা নত করে বসে আছে।শরীর কন্ট্রোল হারাচ্ছে।হাত পা অবশ হয়ে আসছে।নির্জন নিঝুমের পাশে বসে।কাঁধে হাত রেখে আঁতকে উঠে।নিঝুমের শরীর ঠান্ডা বরফের মতো।কিছু বুঝে উঠার আগে নিঝুম মাটিতে লুটিয়ে পড়ে।নির্জন চিৎকার করে উঠে।আশে-পাশের সব মানুষ দৌড়ে আসে।