প্রজাপতি আমরা দুজন পর্ব ৪৭

প্রজাপতি আমরা দুজন পর্ব ৪৭
ইলমা বেহরোজ
তিতলি জামা চেঞ্জ করে চুল ছেড়ে বিছানায় বসেছে।মাথার উপরে সিলিং ফ্যান দ্রুতগতিতে চলছে।রোমেনা দরজার সামনে এসে দাঁড়ান।তিতলি দেখে বললো,
— “কি আম্মু?কিছু বলবা?”
রুমের ভেতর ভেতর ঢুকতে ঢুকতে রোমেনা বললো,
— “বিয়ের প্রস্তাব আসছে তোর।”
তিতলি তীক্ষ্ণ চোখে তাকায়।বললো,
— “কেমনে আসে বিয়ের প্রস্তাব? বলোনি আমি বিবাহিত? “
— “তোর মামা প্রস্তাব নিয়ে আসছে।তাঁর বউয়ের বোনের ছেলের জন্য।”
— “মামির কোন বোনের ছেলে? “
— “মেজোটার।”
— ” ওইটার বয়স আমার সমান হবে।আর মামা বলেনি আমি বিবাহিত?”
— “হ বলছে।কিন্তু তোর মামি বলে দিছে সত্যিটা।’
তিতলি ফোঁস করে উঠে,
— “মানে?”
— “তোর বিয়ে যে হয়নি।”
— “আজব।এইটা মামি না স্বয়ং আজরাইল। এখন এই কথা রটে যাবে চারিদিকে দেখো।”
— “একা আর কতদিন থাকবি?” সাবধানে প্রশ্ন করলো রোমেনা।
তিতলি কয়টা কথা শুনাতে গিয়েও শোনায় নি।মায়ের চোখে চোখ রাখে কড়াভাবে। তারপর হাতে ধরে টেনে বিছানায় বসায়।কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়ে।রোমেনা তিতলির মাথায় হাত বুলায় আর বললো,
— ” মিথ্যে মিথ্যে চুড়ি পরে কয়দিন নিজেকে বিবাহিত প্রমাণ করে রাখতে পারবি? আগের পাড়ায়,দেখস নাই মহিলারা কানাকানি করতো তোর  চরিত্র খারাপ তাই বিয়ে হওয়া সত্ত্বেও বাপের বাড়ি থাকিস।”
— “চুড়ি না পরলে বিয়ের প্রস্তাব আসবে।ইভ-টিজিংয়ের স্বীকার হতে হবে।আর এসব ভেজালে যেতে চাচ্ছি না আমি।আমার এসব ভালো লাগে না।”
— “বিয়ের প্রস্তাবতো এখনও আসে।”
তিতলি উঠে বসে।রাগে বলে,
— “বিয়ে হয়ে গেছে শুনেও যেগুলা বিয়ে করতে চায়, এরা ভালানি?এদের গোলামের ঘরে গোলাম বলে।বুঝছো আম্মু?”
রোমেনা হাসলো।টেনে মেয়েকে কোলে শোয়ায়।বললো,
— ” কিন্তু বিয়ের প্রস্তাব তো আসে।”
— “কম।”
— “আচ্ছা,বাদ এসব খেতে আয়।”
— “খাবোনা।”
— “মাইর দিবো আমি।মানুষ আমাকে বলে,তোরে নাকি খাওয়াই না।কি চিকন হয়েছিস দেখেছিস আয়নায়? মানুষ যদি জানতো আমি তোর সৎ মা।সরাসরি বলে দিতো, সৎ মেয়ে তাই তোরে কম খাওয়াই।”
তিতলি উঠে বসে।অভিমানি স্বরে বললো,
— “কতদিন বলছি নিজেকে সৎ মা আর আমাকে সৎ মেয়ে বলবা না।”
রোমেনা মৃদু হেসে বললো,
— ” আচ্ছা আর বলব না।খেতে আয়।নাকি খাইয়ে দেবো?”
— “সেকেন্ড টা।”
— “বস তুই,আসছি আমি।”
তিতলি এক লোকমা খেয়ে বললো,
— “উম! হেব্বি টেস্ট হয়েছে।”
রোমেনা হাসলো।আরো এক লোকমা দিয়ে বললো,
— “ফ্রেন্ডদের মধ্যে কেউ জানেনা তোর কথা?”
— “কোন কথা?”
— “বিয়ের ব্যাপারটা।”
— “না।কেউ না।”
— “জামাইয়ের নাম কি জিজ্ঞাসা করে না?”
— ” করে তো।”
— “কি বলিস? নিঝুম?”
তিতলি মাথা নত করে। তারপর চোখ তুলে তাকায়।হেসে বললো,
— ” আর কার নামই বলবো।”
রোমেনা কিছু বললো না।তিতলি বললো,
— “বাবা আসছে?”
— ” হুম অনেক আগেই।ঘুমাচ্ছে।”
— “খেয়েছো তোমরা?”
— ” হুম।”
— “তিথিয়া আপু কল করে?”
— “হুম।” বিষণ্ণ হয়ে বললো।
— ” কথা হয়েছে?”
— “না।আমি বলতে চাই না।”
— ” একটা নাহয় ভুল করেই ফেলছে।তাই বলে…”
— “বোনের হয়ে দালালি করবিনা।তোরা যখন চলে এসেছিস তিন মাস কতোটা কষ্টে থেকেছি বাপের বাড়ি।তোর বাপ এক টাকাও রেখে আসেনি।জমিজমা বেঁচে হলেও বাঁচতে চেয়েছিলাম সেই জমিও তোর বাপ ছাড়া বিক্রি সম্ভব ছিল না।এইযে মেয়েরে এতো পড়া লেখা করাইলাম।ও পারতো না? ওই সময় কয়টা স্টুডেন্ট পড়িয়ে আমারে নিয়া চলতে? সেটা করেনি।খাইতে-পরতে কম হইতাছিলো বলে,কোন পোলার লগে ভাইগা গেছিলো।আমার কথা একবারো ভাবে নাই।পরেও কোনো খোঁজ রাখে নাই।এমন মেয়ের কণ্ঠও শুনতে চাইনা।”
তিতলি দু’হাতে রোমেনাকে জড়িয়ে ধরে বললো,
— ” আচ্ছা। আর বলবনা।শান্ত হও।”
রোমেনা বাম হাতের তালু দিয়ে চোখের জল মুছেন। প্লেট হাতে নিয়ে আরেকটু ভাত মাখিয়ে তিতলিকে খাইয়ে দেন।আর বলেন,
— “ভাগ্যিস তোর কথায় তোর বাপে আমারে এইখানে আনছে।নয়তো মরেই যেতাম ভাই বউয়ের লাথি খাইতে খাইতে।আর কি বলব, ভাই আমারও অভাবী।”
— “এসব বলোনা তো আর।খাওয়াও।”
রাত তখন অনেকটা।শাহেদ বই পড়ছিলেন।রোমেনা এক গ্লাস অর-স্যালাইন গুলে নিয়ে আসেন।শাহেদের সামনে ধরে বলেন,
— ” নাও খাও।”
— ” স্যালাইন প্রতিদিন খেতে হয়?” বিরক্তি নিয়ে বললেন শাহেদ।
— ” ডাক্তার বলছিলো প্রতিদিন দুই-তিনটা খেতে।আমি তোমাকে শুধু রাতে দেই।”
শাহেদ বইটা রেখে গ্লাস হাতে নেন।রোমেনা বেরিয়ে যেতে চাইলে শাহেদ ডাকেন,
— ” রোমেনা?”
রোমেনা তাকায়।শাহেদ বলেন,
— “বুড়ো বয়সে এসে সঙ্গী পাবো ভাবিনি আমি।”
রোমেনা হেসে বললো,
— “বাপ-মেয়ের মর্ম আমি আগে বুঝিনি।বুঝলে সেই শুরু থেকেই শান্তিতে থাকতে পারতাম।”
— “জানো রোমেনা? আমার আর কোনো কিছু পাওয়ার নাই।মেয়েটার সুখ ছাড়া।”
— “আল্লাহ ভরসা।এতো ভালো মেয়ে তিতলি।সারাজীবন দুঃখে রাখবেনা আল্লাহ।”
রোমেনা রান্নাঘরে ঢুকেন।বাপের বাড়ির আর্থিক অবস্থা ছিল খুব খারাপ।তিন বেলা খাবার জুটতো না।বাপ,ভাই পায়তারা করতে থাকে রোমেনাকে ঘর থেকে বিদায়ের।তাই শাহেদ বিবাহিত হওয়া সত্ত্বেও রোমানাকে হাতে তুলে দেয়।
রোমেনার তখন পুরো যৌবনকাল।বিয়ের দিন থেকে বুঝতে পারে শাহেদের টান প্রথম বউয়ের জন্য।তাকে শুধু বাচ্চা জন্মের জন্য আনা হয়েছে।মন বিষে যায়।এরপর থেকেই কি থেকে কি হয়ে গেল।তিতলিকে কখনো মন থেকে মানতে পারেননি।শাহেদ আর তিতলিকে শত্রুর মতো মনে হতো।তিতলিকে কষ্ট দিয়ে শান্তি পেতেন।কখনো বোঝার চেষ্টা করেনি,নিষ্পাপ মেয়েটি সত্যি নিষ্পাপ। রোমেনা পুরানো কথা ভেবে চোখের জল ফেলেন।এখন খুব ইচ্ছে করে বিয়ের সময়টাতে ফিরে যেতে।শুরু থেকে শাহেদ আর তিতলিকে খুব ভালবাসতে।বুড়ো বয়সে এসে বুঝেছেন,তিনি কি কি করেছেন আর তা কতটা নিচু মানসিকতার কাজ ছিল।পাপের কথা ভেবে দগ্ধ হোন প্রতিনিয়ত।
সকাল সকাল ঘুম ভেঙ্গে যায় নিঝুমের।ক্ষুধায় পেট চোঁ-চোঁ করছে।তিতলির রুমে ঘুমিয়েছিল।তিতলি চলে যাওয়ার কয়দিন পর তিতলির বোন পালইয়েছে শুনেছিল।তারপর,তাঁর সৎ মা বাড়িতে তালা লাগিয়ে বাপের বাড়ি চলে যায়।নিঝুম তখন এসে তালা ভাঙ্গে গেইটের এবং সদর দরজার।এরপর নিজের মতো একটা তালা লাগিয়ে দেয়।নিঝুম কাপড় চোপড়ও নিয়ে আসেনি।রাতে পুকুরে ঝাঁপিয়েছে অনেকক্ষণ।তারপর রুমে এসে শাহেদের স্যান্ডো গেঞ্জি আর পায়জামা পরে নেয়।পায়জামা গোড়ালির ওপর উঠে এসেছে।এই অবস্থায়ই নিঝুম বাজারে আসে।সস্তা হোটেল খুঁজতে থাকে যেখানে ডাল-ভাত পাওয়া যাবে ত্রিশ টাকায়।
— “এ ভাই? ডাল-ভাত কত?”
— “পঁচিশ টেকা।”
— “এক প্লেট দে।”
নিঝুম ভেতরে এসে চেয়ারে বসে।সে মজার জন্য ভাত খায় না।বাঁচার জন্য শুধু গিলে।তাই যত সস্তা খাওয়া যায় ততই লাভ।টাকা ফুরাবে না।ধার নিতে তাঁর অবশ্য লজ্জা লাগে না।তবুও বার বার চাইতে আলসেমি লাগে।
রায়হান তিতলিদের এলাকায় ঢুকে না ভয়ে।কারণ, নিঝুম থাকে এখন এখানে।দুই বার সে নিঝুমের খপ্পরে পড়েছে।কি মাইরটাই না খেয়েছে।হাত ভেঙ্গে দিয়েছিল।পুলিশ কেইসেও গিয়েছিল রায়হান।কিন্তু কাজ হয়নি।নিঝুমের ভাই নির্জন টাকা দিয়ে কেইস তুলে নিয়েছে।রায়হান মনে মনে শপথ করেছে তিতলিকে পেলে তাঁর পায়ে পড়ে সে মাফ চাইবে।নিঝুমের হাতে আর পড়তে চায় না রায়হান।তিতলি নিরুদ্দেশ হওয়ার পর পরই নিঝুমের হামলা পড়ে তাঁর উপর।বাধ্য হয়ে,একটা ছোকরাকে রেখেছে। দূর থেকে তিতলির বাড়ির উপর খেয়াল রাখার জন্য।নিঝুম আসলেই সাথে সাথে রায়হানকে জানিয়ে দেয়।গতকাল ও জানিয়ে দেওয়া হয়েছে রায়হানকে।
নিঝুম যখনি আসে গ্রামে, সকাল এগারোটার আগে কেউ বের হতে দেখে না বাড়ি থেকে।আজ রায়হানের দরকারী একটা কাজ ছিলো এলাকায়।তাই সকাল সকাল নির্ভয়ে চলে আসে।তার মতে,নিঝুম তো এগারোটার আগে উঠে না।সকাল সাতটায় নিশ্চয় তাঁকে ঘুরঘুর করতে দেখা যাবে না।নিঝুম যে হোটেলে খেতে বসেছে রায়হানও সেই হোটেলেই ঢুকে চা খেতে।নিঝুমকে দেখতে পায়নি।পাশের একটা চেয়ারে গিয়ে বসে। ঠোঁটে তাঁর হাসি।খাওয়ার মাঝে নিঝুমের চোখ পড়ে রায়হানের উপর।
ডালমাখা ভাতের প্লেট ছুঁড়ে দেয় রায়হানের মুখে।রায়হান কেঁপে উঠলো।অবাক হয়ে তাকায়।দেখে নিঝুমকে।সাথে সাথে কলিজার পানি শুকিয়ে আসে।ভোঁ-দৌড় দিতে গিয়ে উল্টিয়ে পড়ে।নিঝুম ধরে ফেলে।বাজারের মানুষজন দৌড়ে আসে।
আবার হবে মারামারি। হবে থানা-পুলিশ।গ্রামের মানুষগুলো কিছু হলেই থানা-পুলিশ নিয়ে আসে।অভিভাবকের নাম্বার চাইলে নিঝুম নির্জনের নাম্বার দিবে।কল যাবে নির্জনের কাছে।দিনগুলো এভাবেই তো চলছে!
আর রায়হানের হাড়ে হাড়ে নিঝুমের দেওয়া মাইরের ব্যাথা।নিঝুম তিতলির অতীতের কষ্টের প্রতিটি দাম রায়হানকে মেরে উসুল করে নিচ্ছে ধীরে ধীরে।