প্রজাপতি আমরা দুজন পর্ব ৪৬

প্রজাপতি আমরা দুজন পর্ব ৪৬
ইলমা বেহরোজ
বর্তমান।অরুণ এসে দেখে নিঝুম খাটে হেলান দিয়ে ফ্লোরে বসে সিগারেট টানছে।গা খালি।ট্রাউজার পরা।
— “দরজা এভাবে খোলা রাখিস সবসময়?” রুমে ঢুকতে ঢুকতে অরুণ বললো।নিঝুম তাকায়।সিগারেট আরেকবার টেনে বললো,
— “হু।”
— “চোর আসবে।”
— “তিতলিও আসতে পারে।”
অরুণ দীর্ঘশ্বাস ফেলে।নিঝুমের পাশে বসে।বললো,
— “কতদিন হলো তোর এই জীবনের জানিস?”
— “হু।” নাক-মুখ দিয়ে ধোঁয়া উড়িয়ে বললো নিঝুম।
— “কতদিন?”
— “দুই বছর এগারো মাস দুই দিন।”
— “নেশাটা ছেড়ে দে।”
— “তিতলিকে এনে দে।ছেড়ে দেব।”
অরুণ নখ কামড়ায়।নিঝুম বললো,
— “তোর মেয়ে কেমন আছে?হাঁটে?”
— “দৌড়ে।”
নিঝুম হাসলো।
— “যেগুলো খাস সবগুলোর নাম কি?”
— “খাবি নাকি?”
— “না এমনি।’
—- “মদ,ইয়াবা,ফেনসিডিল,হিরোইন,গাঁজা,সিগারেট  ইত্যাদি ইত্যাদি।”
নিঝুম হেসে উঠে।অরুণ বলে,
— “ফুসফুস টা এখনও কাজ করে?”
নিঝুম ম্লান হেসে বললো,
— “হ্যাঁ করে।মরিনি।”
— “আর কত কাল অপেক্ষা করবি?”
নিঝুম নিশ্চুপ।অরুণ টাকার একটা ব্যান্ডেল নিঝুমের সামনে রাখে।তারপর বললো,
— “নিজের ক্ষতি করিস বলে আমরা বাধ্য হয়ে তোকে টাকা দেই।নয়তো কখনো দিতাম না।”
— “জানি আমি।তিতলি আসলে সব ফেরত দিয়ে দেবো।”
— “দিতে হবে না।”
— “ধার নিচ্ছি।ফোনে আমাদের তাই কথা হয়।”
অরুণ গলায় তেজ নিয়ে বললো,
— “আরস,আলম,রঞ্জন,মহোন,সবাইকে মানা করে দেব।তোকে আর টাকা না দিতে।”
নিঝুম তাচ্ছিল্য হেসে বললো,
— “আই ডোন্ট কেয়ার।”
— ” হ তুই কেয়ার করবি কেন?টাকা যখন হাতে না থাকে নিজের ক্ষতি করতে চিনিস।তোর হাত দেখলে মনে হয় তুই ডাকাতি করিস।’
— “এতো হট হচ্ছিস কেন? তোদের কি টাকার অভাব? এতো বড় বিজনেস সামলাচ্ছিস।”
— “ফ্যাক্ট তো সেটা না।নিজেকে তিলে তিলে নিঃশেষ করে দিচ্ছিস।আর সেসব দ্বারা নিঃশেষ হচ্ছিস সেসব কেনার টাকা আমাদের দিতে হয়।কতোটা কষ্ট হয় জানিস?”
— “আমার বয়স কত হলোরে?”
— “আমার বত্রিশ।তাহলে,তোর একত্রিশ।”
— “তাহলে এখন তিতলির বয়স কত?”
— “তোর কতটুকু ছোট?”
নিঝুম হাত থেকে সিগারেট ফেলে ছাই স্ট্রেতে।তারপর দু’হাতের আঙ্গুল দেখিয়ে বললো,
— “দশ।”
— “একুশ।তাহলে।”
নিঝুম অরুণের দিকে ফিরে বসে।পা ভাঁজ করে।বলে,
— “ও আগের মতোই গুলুমুলু আছে? নাকি শুকিয়ে গেছে?দেখতে বোধহয় বড় হয়েছে আরেকটু তাই নারে?”
অরুণ দু’হাতে মুখ ঢেকে নিঃশ্বাস নেয়।নিঝুমের সাথে বেশিক্ষণ কথা বলা যায়না।তিতলি নামক বেদনা জেগে উঠে।সে তখন উন্মাদের মতো আচরণ করে।
— “কিরে বল?” নিঝুম।
— “জানিনা আমি।”
নিঝুম আবার আগের মতো বসে।ছাদের মেঝেতে তাকায়।আবার ঘুরে বসে।অরুণের এক হাতে বুকে চেপে ধরে।অরুণ বলে,
— “কি?”
নিঝুম আরেকটু এগিয়ে আসে।ফিসফিসিয়ে বললো,
— “এইযে এই জায়গাটায় হৃদয় থাকে।হৃদয়টার ভেতরে কেঁচো ঢুকেছে বুঝলি? কেঁচো…কেঁচো।কেঁচোটা খুবলে খুবলে হৃদয়টা খায় প্রতিনিয়ত। আমার ঘুম হয়না।আমার খেতে ভালো লাগে না।আমার কিছু ভালো লাগে না।মন চায়, হৃদয়টা টান দিয়ে ছিঁইড়া ফেলি।এ যন্ত্রণা আর সয় না।”
অরুণের শরীর কেঁপে উঠে।বুকে কান্নার উথাল-পাতাল ঢেউ।নিঝুমের এক হাতের বাহু জড়িয়ে ধরে,মাথা নত করে কাঁদতে থাকে।নিঝুম ঠোঁট কামড়ে হাসে।যন্ত্রনাময় হাসি।তারপর অরুণকে সোজা করে বসায়।বলে,
— “তুই কাঁদছিস কেনো?বউ আছে বাচ্চা আছে।কাঁদবিনা।”
— “তুই এতো কষ্টে কেমনে আছিস?”
নিঝুম ম্লান হাসলো।উঠে দাঁড়ায়।অরুণও উঠে দাঁড়ায়।প্রশ্ন করলো,
— “কোথাও যাবি?”
— “হু।”
টি-শার্ট পরে ড্রয়িংরুমে আসে নিঝুম।ডাইনিং টেবিল থেকে পানি খেতে গিয়ে মনে হয়,জগ তো নেই।ভেঙ্গে ফেলেছে রাতেই।ফিল্টারও নেই।সেটাও……
— “অরুণ চল।”
— “কই?”
— “টং দোকানে।”
— “চা খাবি?”
— “নেশাখোরদের জিভে চায়ের স্বাদ লাগেনা।এক গ্লাস পানি খাবো।”
— “তারপর বাসায় আসবিনা?”
— “উহু।”
— “কই যাবি?”
— “কুমিল্লা।”
দিহানকে পড়াতে এসে তিতলি হাঁপাতে থাকে।দিহানের আম্মু উর্মিলা বললো,
— “হাঁপাচ্ছো কেনো তিতলি?”
— “আপু একটু পানি দেন।”
উর্মিলা পানি এগিয়ে দেয়।তিতলি পানি শেষ করে সোফায় বসে।তারপর বললো,
— “পাঁচ মিনিট দেরি হয়ে গেছে দিহানকে পড়াতে আসতে।সরি আপু।”
— “পাঁচ মিনিট কোনো ব্যাপারনা।তুমি এক ঘন্টা পড়াতে গিয়ে মাঝে মাঝে দু’ঘন্টাও পড়াও।”
তিতলি হাসলো।উর্মিলা বললো,
— “দৌড়ে আসছো?”
— “না আপু।তবে,বাসা থেকে দ্রুত হেঁটে আসছি তো।তাই…”
— “আর এভাবে এসোনা।ধীরে সুস্থে এসো।”
— “জ্বি আপু।”
— “দিহান তো ঘুমিয়ে গেছে।আমি দিহানকে ডেকে দেবো?”
— “না থাক।আমি ডেকে তুলছি।ছোট বাচ্চাদের ঘুম থেকে তুলতে আমার খুব ভালো লাগে।”
উর্মিলা হেসে বললো,
— “আচ্ছা যাও।”
তিতলি উঠে দাঁড়ায়।উর্মিলা বলে,
— “থাক ডেকোনা তিতলি।ঘুমাক।”
তিতলি অবাক হয়ে বসে।মৃদু হেসে বললো,
— “উঠা অব্দি অপেক্ষা করবো?”
— ” না আজ পড়াতে হবেনা।”
— “ওহ…..আচ্ছা আসি তাহলে?”
— “একটু গল্প করে যাও আমার সাথে।কয়েক মাস হলো পড়াচ্ছো দিহানকে।তোমার সম্পর্কে কিছুই জানিনা।”
— “জ্বি কি জানতে চান?”
— “এইতো বাসায় কে কে আছে?”
— “বাবা-মা আর আমি।”
— “ভাই-বোন নেই?”
— “জ্বি বোন আছে।কিন্তু সে শ্বশুর বাড়ি।”
উর্মিলা হাসে।আড়চোখে তিতলিকে পরখ করে নেয়।তারপর আমতা আমতা করে বললো,
— “ডোন্ট মাইন্ড! একটা প্রশ্ন করি?”
— ”অবশ্যই।!
— ” তুমি কি বিবাহিত?”
— “জ্বি।”
— “এজন্যই হাতে চুড়ি,নাকে নাকফুল।কিন্তু বললে, মা-বাবা আর তুমি শুধু বাসায়।ব্যাপারটা বুঝলামনা।বর কোথায়?”
— “বিয়েটা একটা অঘটন ছিলো।তাই আলাদা আছি।”
— “কিরকম?”
তিতলি নিশ্চুপ। উর্মিলা বললো,
— “সরি।সরি! মনে হয়,বলতে চাচ্ছোনা।”
— ”ইটস ওকে।”
— “বিয়ের কত দিন হলো?এইটা তো বলা যাবে?”
— “এক বছর।”
— “ওহ।”
— “আসি তাহলে আপু?”
— “কফি খেয়ে যাও।”
তিতলির মুখটা চুপসে যায়।জোরপূর্বক হেসে বললো,
— “একসময় খেতাম।অনেকদিন হলো আমি আর কফি খাইনা আপু।”
তারপরই বেরিয়ে যায়।উর্মিলা হতবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে।মেয়েটা একটা রহস্য।
দিহানের বাসা থেকে বেরিয়ে ধীরে ধীরে হাঁটতে থাকে তিতলি।কলকাতার পানিহাটির এই পাশের রাস্তায় মেয়েদের চলাচল খুবই কম।যতদূর চোখ যায় পুরুষ।তিতলি ভয় পায় না আর আগের মতো।একা চলতে পারে।বিকেল তিনটা ত্রিশ বাজে।পাঁচটায় আরেকটা বাচ্চাকে পড়ানোর কথা।কিন্তু তিতলির মন আর মানছে না।অস্থির হয়ে উঠেছে।ভ্যানিটি ব্যাগ থেকে ফোন বের করে গোপালের আম্মুকে কল দেয়।
— “আদাব দিদি?” তিতলির স্বাভাবিক কণ্ঠ।
ওপাশ থেকে,
— “আদাব।”
— “দিদি আজ আসতে পারবো না।”
— “আচ্ছা।”
— “রাগ করবেন না দিদি।শরীরটা মানছে না।”
— “সমস্যা নেই।তুমি নিয়মিত পড়াও।একদিন না পড়ালে কিছু মনে করবোনা।”
— “ধন্যবাদ দিদি।গোপালের অঙ্কগুলো একটু দেখে নিয়েন আপনি।”
— “আচ্ছা।”
— “আদাব দিদি।!
— “আদাব।”
তিতলি ফোন রেখে প্রশান্তির নিঃশ্বাস ফেলে।বাচ্চা পড়ানোর ব্যাপারে সে ভাগ্যবতী বটে।অভিভাবকদের ব্যবহার খুবই ভালো।সুবিধা-অসুবিধা বুঝে।
পানিহাটি শপিং কমপ্লেক্সের সামনে দিয়ে যাওয়ার পথে তিতলির নজরে আসে এক জোড়া বিবাহিত যুগল।
ছেলেটার বয়স ২৭-২৮ হবে।মেয়েটার পরনে শাড়ি।সিঁথিতে সিঁদুর।শপিং ব্যাগ অনেকগুলো ছেলেটার দু’হাতে।অথচ,মেয়েটার হাতে কিছু নেই।সানগ্লাস  পরে দাঁড়িয়ে আছে।মাঝে মাঝে ছেলেটার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসছে।ছেলেটার মুখটা দেখার মতো।তিতলির ঠোঁটে অজান্তে হাসি ফুটে উঠে। মুহূর্তে চোখে ভাসে,সামনের বিবাহিত যুগলদের বদলে সেখানে সে আর নিঝুম।তারপরই মনে হলো, না সে না।রিদি আর নিঝুম হবে।তিতলি চোখ নামিয়ে ফেলে।বুকের হাড়গোড় ব্যাথায় বিষধর হয়ে উঠছে।দ্রুত হেঁটে জায়গা ত্যাগ করে।
— “ও দিদি রাস্তা ছাইড়া হাঁটেন।”
তিতলি ঘুরে দাঁড়ায়।একজন রিক্সা ড্রাইভার কথাটি বললো।আসলেই, সে রাস্তায় চলে এসেছে।মৃদু হেসে সরে যায়।
তিতলি আর তার মা-বাবা কয়দিন হলো পানিহাটিতে ভাড়াটিয়া হয়ে এসেছে।আগে পাশের এলাকায় থাকতো।মামার বাসার পাশে।কিন্তু,মামি তিতলিদের মেনে নিতে পারেনি সেই শুরু থেকে।খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে কথা বলে।রোমেনার সাথে তো মোটেও ভালো ব্যবহার করতো না।বাসায় ফিরতে ফিরতে ঝুম বৃষ্টি নামে।তিতলি বাসায় না ঢুকে আগে ছাদে উঠে।ভ্যানিটি ব্যাগটা দরজার সামনে রেখে যায়।এইখানের প্রায় সব বাসা এক তলা।সব বাসার সামনে ছোট গেইট। ছাদে উঠার সিঁড়ি সদর দরজার পাশে।
ছাদে উঠে ছাদের এক কর্ণারে বসে সে।ছাদের মেঝেতে চোখ নিবদ্ধ। বুকের মাঝে যে ঝড়টা বইছে সেটা সহ্য করতে ঠায় হয়ে বসে আছে।
তিতলির হৃদয়ের অতীব গভীরে যে অবিনশ্বর রুহ আছে,সেই অবিনশ্বর রুহর প্রতিটি বিন্দু থেকে তিতলি আজও ভালবাসে নিঝুমকে।আজও ঘুমিয়ে স্বপ্ন থেকে নিঝুমকে নিয়ে সংসার সাজানোর।ঘুম ভাঙ্গার পর নিজেকে শাসায়, অন্যের স্বামী নিয়ে আর দেখবিনা স্বপ্ন।দেখবিনা।’
ছাদের রেলিংয়ে হেলান দিয়ে ‘দ’ স্টাইলে বসে তিতলি।আকাশের দিকে মুখ করে।বৃষ্টির ফোঁটা পডছে একাধিক হারে।তিতলির বুক উঠা-নামা করছে দ্রুত গতিতে।পোড়া বুকে থাকা কারাগারে বন্দি হৃদয়টা আর্তনাদ করছে,
— “অনেকদিন হলো আপনায় ছুঁয়ে দেখিনি।একসাথে আকাশ দেখিনি।বৃষ্টিতে ভিজিনি।তবুও আপনাকে ভুলতে পারিনি।তবুও আপনায় ভালবাসি।কোনো কিছু ছাড়াই ভালোবাসবো মৃত্যু পর্যন্ত… মৃত্যুর পরেও।”
তিতলির রুহ বলছে,কাঁদ তিতলি।একটাবার কাঁদ।কতদিন তুই কাঁদিস না।’কিন্তু তিতলি কাঁদতে চায় না।দীর্ঘশ্বাসে বের করে দিতে চাচ্ছে যত যাতনা।
কুমিল্লা এসেছে নিঝুম।কয়টাদিন এখানেই থাকবে।অপেক্ষা করবে তিতলির জন্য।হঠাৎ যদি তিতলি আসে নিজের বাড়িটার টানে?তিতলিদের বাড়ির পাশের বাড়িটা দুঃসম্পর্কে নিঝুমের আরেক চাচার বাড়ি।আঞ্জুমানই পরিচয় করিয়ে দিয়োছিলেন।তবে,তিতলির বাবার চাচাতো ভাই তিনি।তিতলির বাড়ির চাবিটা উনার কাছেই রাখে নিঝুম।ডুপ্লিকেট চাবি।
— “রাহমান চাচা?”
একটা ছোট বাচ্চা মেয়ে বেরিয়ে আসে।বললো,
— “নানা ভাই বাড়িত নাই।”
— “তোমার নানু আছে?”
— “হ আছে।ঘুমাইতাছে।”
— “একটু ডেকে দাও।”
মেয়েটি ভেতরে চলে যায়।নিঝুম উঠানে পায়চারি করতে থাকে।একটা সিগারেট জ্বালায়।কিছুক্ষণের মাঝে একজন মহিলা আসে।নিঝুমকে দেখে বললো,
— ” নিঝুম বাবা।দাঁড়াও চাবিডা নিয়া আইতাছি।’
চাবি এনে নিঝুমের হাতে দেয়।নিঝুম প্রশ্ন করে,
— “তিতলি এসেছিল?”
মহিলা মাথা নত করে ‘না’ করে।নিঝুম কিছু না বলে বেরিয়ে যায়।
বাড়ির ভেতর ঢোকার সাথে সাথে নিঝুমের শরীর ঝাঁকি দিয়ে উঠে।এই বাড়িটার আনাচে-কানাচে তিতলির স্মৃতি। ছোট থেকে বড় হওয়া।খুব আপন মনে হয় এই বাড়ি,উঠোন, পুকুর।সদর দরজার দিকে তাকায় নিঝুম।তালা দেওয়া!মাথা নত করে ধীরে ধীরে হেঁটে আসে পুকুরে।সিঁড়িতে বসে।চা-বাগানে কাটানো সময়গুলো খুঁচাচ্ছে নিঝুমকে।পায়ে ব্যাথা পাওয়া,তিতলিকে কোলে তুলে নেওয়া,রাতারগুল একরাত থাকা,সুইমিংপুলে বৃষ্টিতে ভেজা।
নিঝুম পুকুরের মাঝ বরাবর তাকায় একদৃষ্টে।চোখে পড়ে রঙ্গিন একটা প্রজাপতি। একই জায়গায় বার বার ঘুরপাক খাচ্ছে।উড়ে এসে নিঝুমের চেয়ে কিছুটা দূরে ঘাসে বসে।নিঝুম মনোযোগ দিয়ে তাকিয়ে থাকে।ইদানীং নিঝুম পিঁপড়া, পাখি,প্রজাপতি এসবের সাথে কথা বলে একা একা।নিজের কল্পনায় ভেবে নেয় প্রাণীটিও তার সাথে কথা বলছে।প্রজাপতির উদ্দেশ্যে নিঝুম বললো,
— “কি রে? তুই ও কি আমার মতো একা?নিঃসঙ্গ?’
নিঝুমের ভাবনায় প্রজাপতি উত্তর দেয়,
— “হু নিঝুম দা।’
নিঝুম ঠোঁট নাড়িয়ে প্রশ্ন করলো,
— “তুই হিন্দু?”
— “হু আমি হিন্দু।”
— “তোর খুব কষ্ট?”
— “তোমার মতো।”
নিঝুম ম্লান হেসে বললো,
— “অথচ তুই দেখতে কতো রঙ্গিন।”
— “দেখতে রঙ্গিন হলেই ভেতরটা রঙ্গিন হয়?”
নিঝুম কিছু বলার আগে দেখতে পেলো আরেকটা প্রজাপতি এসে বসেছে।দু’টো প্রজাপতি পাশাপাশি মিশে আছে।আগের প্রজাপতিটা লাফালাফি করছে।মনে হচ্ছে সে খুব খুশি।নিঝুম প্রশ্ন করলো,
— “কে হয় তোর?”
নিঝুমের ভাবনা থেকে উত্তর আসে,
— “আমার ভালবাসা দাদা।”
— “এবার খুশি তো তুই?”
— “হু দাদা অনেক খুশি।এখন আমার ভেতরটাও রঙ্গিন।”
তারপর পরই উড়ে যায় একসাথে।নিঝুম আনমনে বলে উঠে,
— “উড়ে যা অনেক দূরে উড়ে যা।ভালো থাকিস তোরা।”
নিঝুমের চোখ ঝাপসা হয়ে আসে।আকাশের দিকে তাকায়।বলে,তিতলি কোন সমুদ্রের অতল গভীরে লুকিয়ে আছো তুমি?কোথায় গেলে পাবো তোমায়?আমিও রঙ্গিন প্রজাপতিদের মতো হতে চাই।দুজন ভালবাসার দুনিয়ায় উড়তে চাই একসাথে। ভালবাসার রঙে রঙ্গিন হয়ে সুখের উল্লাসে বলতে চাই প্রজাপতি আমরা দুজন।হবে না সেই সুযোগ?তিতলি কোথায় গেলে পাবো তোমার?”
নিঝুম চোখ নামিয়ে ফেলে।নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে।সিগারেট জ্বালায়।ভালবাসা মানে হচ্ছে অমর একটি সুর।যে সুরের স্বরলিপি অনেক আগেই রচনা করেছে নিঝুম-তিতলি।তবে কেনো আজ তারা একসাথে নেই? দুজন দুজনকে এতো ভালবাসা সত্ত্বেও। নিঝুম দাঁড়িয়ে আছে এক সমুদ্রের কিনারে।যেখানে সমুদ্রের ঢেউয়ের তান্ডব নিঝুমকে অমরত্বের গান শোনায়।নিঝুম সেই গানের সুরে তন্ন তন্ন করে খুঁজে তিতলিকে।একটা বার যদি মুখটা ভেসে উঠতো নিঝুমের চোখের সামনে।সেই চোখের আলোড়ন থেকে তিতলিকে সরানোর সাহস স্বয়ং আল্লাহ ছাড়া আর কারোর হতো না।
তিতলির সৎ মা রোমেনা সহ প্রতিবেশী আরো তিনজন মহিলা একসাথে বসে আলাপ করছে।
প্রথম মহিলা প্রশ্ন করলো,
— “দিদি আপনারা আগে কই থাকতেন?”
রোমেনা হেসে উত্তর দেয়,
— “তিন বছর আগে বাংলাদেশ ছিলাম।তারপর  পানিহাটি ইউনিভার্সিটির ডান পাশে যে এলাকাটা ওইখানেই ছিলাম।”
— “মেয়ে কয়টা দিদি?” দ্বিতীয় মহিলার প্রশ্ন।
— ” একটা মেয়ে।”
— “শাদী হয়েছে মেয়ের?” প্রথম মহিলা।
— “জ্বি দিদি হয়েছে।জামাই বাইরের দেশে আছে।মেয়ে এখন আমাদের সাথেই থাকে।”
— “একটা মেয়েকে দেখছি দুই দিন আগে ছাদে।শুকনা দেখতে।ওইটা কি আপনার মেয়ে?” তৃতীয় মহিলা।
— “জ্বি দিদি।”
— “দাদা কি করে?” প্রথম মহিলা।
— “প্রাইমারি স্কুলের প্রধান শিক্ষক আছে।”
— “আমাদের এলাকার?পানিহাটি প্রাইমারি  স্কুলের?” প্রথম মহিলা।
— “জ্বি।”
— “তিন বছর হলো আসছেন।আর প্রধান শিক্ষক পদ পেয়ে গেলো।লোক আছে নাকি?” তৃতীয় মহিলা।
রোমানা যতটুকু সম্ভব হেসে বললো,
— “জ্বি আছে দিদি।মেয়ের মামা।তার খাতিরেই কয়েক মাস পরই এরকম সুযোগ পান উনি।”
— “কপাল বটে।মেয়ে এতো শুকনা কেনো দিদি? খাওয়াবেন বেশি।”
রোমেনা হাসলো।তিতলি সদর দরজা খোলা পেয়ে ঢুকে পড়ে।দরজার সামনেই ডাইনিং টেবিল।ডাইনিং টেবিলের একটু দূরে তিনটা সোফা কম দামী।আর দু’টো রুম।এ নিয়েই সংসার।বাসায় যে আরো মহিলা আছে তিতলি খেয়াল করেনি।হাত থেকে চুড়ি খুলে যেই না টেবিলে রাখতে যাবে, ওমনি রোমেনা বলে উঠলো,
— “কিরে মা? চুড়ি খুলছিস কেন?জামাই বাবাজির অমঙ্গল হবে তো।”