প্রজাপতি আমরা দুজন পর্ব ৪৫

প্রজাপতি আমরা দুজন পর্ব ৪৫
ইলমা বেহরোজ
দু’দিনে বিচ্ছেদের আঙ্গারে পুড়ে কয়লা নিঝুম।তিতলি এতদিন যে রুমটায় ছিলো নিঝুম সেই রুমের ফ্লোরে সটান হয়ে শুয়ে আছে।যে নিজের ইচ্ছায় নিখোঁজ হয় তাকে কি আর পাওয়া যায়? নিঝুম অপেক্ষা করছে!যন্ত্রনাময় অপেক্ষা!হুট করে কোনো এক মুহূর্তে তিতলি আসবে।এসে বলবে,
— “ডাক্তার আমি আপনাকে ছাড়া ভালো নেই।আমি ফিরে এসেছি।”
কিন্তু না সে আসছে না।পঞ্চাশ ঘন্টা পার হয়ে গেলো।প্রেয়সীর দেখা নেই।নিঝুম এখনও বিশ্বাস করেনা তিতলি তাকে ছেড়ে পালিয়েছে।আচ্ছা কেনো পালিয়েছে? একটাবার বলতে পারতো না সমস্যাটা?আশেপাশের মানুষজন বলছে,
— “মেয়ে পালিয়েছে।নিঝুমের চেয়েও মূল্যবান রত্ন(বয়ফ্রেন্ড)পেয়েছে।তাই পালিয়েছে।”
কিন্তু নিঝুম বিশ্বাস করেনা।সে জানে তিতলি তাকে সীমাহীন ভালবাসতো।যে ভালবাসার শেষ নেই।কিন্তু পালালো কেনো? কেনো বিয়েটা করলো না?নিঝুম ধাঁধাঁর মাঝে পড়েছে।যতক্ষণ সেই ধাঁধাঁ সমাধান না হবে।সে কিছুই করতে পারবে না।শুধু তিতলির ব্যবহৃত বিছানার চাদরটা আঁকড়ে ধরে রাখা ছাড়া।
কুমিল্লা থেকে ফেরার পর দিন সকালে নিঝুম ঘুম থেকে উঠে দেলো সে নিজের রুমে।তড়িঘড়ি করে উঠে বসে।রাতে কি হয়েছিল ঠিক মনে নেই।সে মনে করতেও চায়না।চোখ খোলার পরই মনে হলো সাদা রঙের দুনিয়ায় সে ঢুকে পড়েছে।চোখ ঘুরিয়ে চারপাশটা দেখে মনে হলো এটাতো তারই রুম।যে খাটে সে আছে এখন সে খাট টা তার আর তিতলির বাসর রাতের জন্য সাজানো।চারিদিকে সাদা পর্দা।সে তো আছেই, কিন্তু তিতলি?কই তিতলি?
আচমকা মাথার রক্ত গরম হয়ে উঠে।টেনে ছিঁড়ে ফেলে সবগুলি পর্দা।আর চেঁচাতে থাকে,
— “আম্মু,তিতলি কই।আম্মু…”
চিৎকার শুনে দৌড়ে আসে নির্জন।নিচ তলা থেকে আঞ্জুমান,মৌনতা-মোহনা,মাহফুজ সহ নিঝুমের সব কাজিনেরা উপরে আসে দৌড়ে।নির্জন রুমে ঢুকে দেখে নিঝুম পাগলের মতো করছে।দৌড়ে এসে জাপটে ধরে।বললো,
— “ভাই,ভাই শান্ত হ।তিতলি আসবে।তোকে ছাড়া থাকতে পারবে না দেখিস।চলে আসবে।”
নিঝুম কান্না,রাগ আটকাতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছে।দু’হাতে মুখ ঢেকে ফ্লোরে বসে পড়ে।ততক্ষণে বাকিরা রুমে উপস্থিত হয়।আঞ্জুমান উত্তেজিত হয়ে দৌড়ে আসেন।বললো,
— “আব্বা আমার।আব্বা এমন করেনা।তিতলি চলে আসবে।”
নিঝুম মমতাময়ী মায়ের স্পর্শ পেয়ে নরম হয়ে আসে।জাপটে ধরে মাকে।বুকে মাথা রেখে ঠোঁট কামড়ে কেঁদে উঠে।আঞ্জুমানের ভেতরটা খাঁ খাঁ করছে।তার সোনার টুকরা শান্ত ছেলে এভাবে কাঁদছে?আঞ্জুমান অশ্রুসিক্ত চোখে নির্জনের দিকে তাকায়।নির্জন মাথা নত করে ফেলে।তার কিছু করার নেই।কই খুঁজবে তিতলিকে?নিঝুম মায়ের বুক থেকে মাথা তুলে বললো,
— “নির্জন,ভাই আমার?একটা নিখোঁজ বিজ্ঞপ্তি দেওয়ার ব্যবস্থা কর।”
নির্জন ভারি অবাক হয়ে বললো,
— “যে নিজের ইচ্ছায় চলে গেল তাকে পাব্লিকের মাধ্যমে খুঁজে পাওয়াটা কেমন দেখায়না? তিতলি হয়তো…”
নির্জন থেমে যায়।নিঝুম ক্ষীণ স্বরে বললো,
— “তুইও ভাবছিস? তিতলি আমায় ভালবাসে না?”
উত্তরে নির্জন নিশ্চুপ। আর কোনো অপশন নেই তার কাছে।নিঝুম চেঁচিয়ে উঠলো,
— “লাগবেনা কারো সাহায্য। একাই পারবো আমি।একাই খুঁজবো তিতলিকে।”
কেউ আটকাতে পারেনি।নিঝুম বেরিয়ে যায় বাড়ি থেকে।তিতলিকে তার চাইই চাই।
আট ঘন্টা হলো নিখোঁজ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের।কোনো খবর আসছে না।নিঝুম ছটফট করছে।কখন তিতলির খবর পাবে? কখন কেউ একজন কল করে বলবে, পেয়েছি তিতলিকে।রাত বাড়ছে ধীরে ধীরে সেই সাথে ভেতরের কষ্টগুলো জেগে উঠছে আপন শক্তিতে।দগ্ধ হচ্ছে হৃদয়! আঞ্জুমান আসেন।ছেলে তার খালি গায়ে ফ্লোরে শুয়ে।চোখ বন্ধ।কপালে এক হাত রাখা। আঞ্জুমান ডাকলো,
— “আব্বা?খাবি আয়?”
কপাল থেকে হাত না সড়িয়েই নিঝুম উত্তর দিলো,
— “না।”
আঞ্জুমান এগিয়ে আসেন।ছেলের পাশে বসেন।স্নেহমাখা গলায় বললো,
— “আম্মু খাবার নিয়ে আসি এখানে? নিজের হাতে খাইয়ে দেবো আমার আব্বাকে।”
নিঝুম নিশ্চুপ। আঞ্জুমান সাবধানে বললো,
— “নীরবতা সম্মতির লক্ষন।মানে আমার আব্বা তার আম্মুর হাতে খাবে।”
নিঝুম দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,
— “সব নিরবতা সম্মতি দেয়না আম্মু।”
তারপরই উঠে বসে।বিছানা থেকে শার্ট টা নিয়ে পরে।আঞ্জুমান উদ্বিগ্ন হয়ে বললো,
— “রাত ১১ টা বাজে।এখন কই যাবি আব্বা?”
নিঝুম উত্তরে কিছু বললো না।সে তিতলিকে খুঁজতে যাচ্ছে।আর এক মুহূর্ত থাকা যাচ্ছে না রুমে।দম বন্ধ হয়ে আসছে।মা’কে পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে পরে রুম থেকে।আঞ্জুমান প্রতিবাদ করেনি।জানে, লাভ নেই।
ড্রয়িং রুমের পাশ ঘেঁষে যখন নিঝুম যাচ্ছিলো।আরমান চৌধুরীর গলা কানে আসে।থমকে দাঁড়ায়।তিনি বলছেন,
— “আলতাফ ভেঙ্গে পড়িস না।কয়দিন নিঝুম এমন করবে।তারপর ঠিক হয়ে যাবে।”
আলতাফ চৌধুরীর চোখে পানি ছলছল করছে।তিনি বলেন,
— “আমার ছেলেটা উন্মাদ হয়ে যাচ্ছে ভাইজান।”
— “বললাম না।কয়দিন পর ঠিক হয়ে যাবে।রিদি আছেনা? ও খুবই বুদ্ধিমতী একটা মেয়ে।নিঝুমকে যখন ভালবাসে।ঠিক করে ফেলবে।ভাবিস না এতো।”
— “রিদি কোথায়?”
— “তোর মেয়েদের কাছে আছে।এখন নিঝুমের কাছে না যাওয়াই ভালো।”
নিঝুমের চোখ দুটি রক্তবর্ণ ধারণ করে।অবাকও হয়।রিদি তাকে ভালবাসে? আর তাঁর বাপ,চাচার ব্যবহার অদ্ভুত।মুহুর্তেই তার মস্তিষ্ক তাকে জানিয়ে দিয়েছে –  এদের কাছেই আছে উত্তর।এরাই জানে তিতলি কেনো পালালো।
নিঝুম উল্টোঘুরে উপরে উঠে আসে।বোনদের রুমে ঢুকে। রিদির এক হাতে শক্ত করে ধরে দাঁড় করায়।গলায় তেঁজ নিয়ে জিজ্ঞাসা করে,
— “তিতলি কই?”
রিদি সীমাহীন আশ্চর্য হয়।ঘাবড়ে যায়।আমতা আমতা করে বললো,
— “আ…আমি কেমনে জানবো?”
— “তুই জানিস না? তুই সরিয়েছিস তিতলিকে।তুই!”
— “নিঝুম কি বলছিস আমি কেনো সরাবো?আমার কি স্বার্থ?তোর গার্লফ্রেন্ডের তোকে ভালো লাগেনি তাই সে পালিয়েছে।”
নিঝুম সজোরে থাপ্পড় মারে রিদির গালে।রিদি টাল সামলাতে না পেরে পড়ে যায়।দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
— “তুই আমাকে ভালোবাসিস। তাই হিংসে করে তিতলিকে সরিয়ে দিয়েছিস।আমি জানিনা? ভালোই ভালোই বলে দে।ও কোথায়? কি করেছিস ওর সাথে?”
ভাইয়ের এমন রূপ দেখে মৌনতা ভরকে যায়।ড্রয়িংরুম থেকে চাচা-বাবা কে ডেকে আনে।সেই সাথে রোহি,নির্জন,আঞ্জুমান,হামিদ চাচা,টুনিও এসে রুমে ভীর জমায়।মোহনা দ্রুত বাথরুম থেকে বেরিয়ে আসে চেঁচামেচি শুনে।নিঝুম রিদিকে টেনে তুলে।রাগে শরীর কাঁপছে তার।আরমান চৌধুরী রুমে ঢুকেই দেখেন নিঝুম রিদিকে থাপ্পড় মেরেছে।ক্রোধ নিয়ে তিনি এগিয়ে আসেন।রিদিকে নিঝুমের হাত থেকে ছাড়িয়ে নিজের কাছে টেনে আনেন।নিঝুম চাচার দিকে চোখ গরম করে তাকায়।কিড়মিড় করে বললো,
— “তিতলি কই?”
— “সেটা তোর বাপ জানে।”
মেয়ের গায়ে নিঝুম হাত তুলেছে।তা দেখে আক্রোশে মুখ ফসকে কথাটা বেরিয়ে আসে আরমান চৌধুরীর মুখ থেকে।আলতাফ চৌধুরীর বুকটা ছ্যাঁৎ করে উঠলো।নিঝুম ঘুরে তাকায়।আলতাফ চৌধুরী অপ্রস্তুত হয়ে পড়েন।চোখ নামিয়ে ফেলেন।শরীর ঘামছে। তিনি যুবককালে অনেক তেজীয়ান থাকলেও ছেলেদের সামনে অপরাধ করে মাথা তোলার সাহস নেই।উপস্থিত সবাই হতবাক।নিঝুম নির্বিকার হয়ে বললো,
— “কি জানেন আব্বু?”
আলতাফ চৌধুরীর জিভ ভারী হয়ে গেছে।তিনি দ্রুত বেরিয়ে পড়েন মেয়েদের রুম থেকে।নিঝুম চিৎকার করে বললো,
— “আপনি আমার প্রশ্ন এড়িয়ে যেতে পারেন না আব্বু।”
আলতাফ চৌধুরী ড্রয়িং রুমে এসে বসেন।এসি আছে।তবুও তিনি ঘামছেন।খুব ঘামছেন।কি জবাব দিবেন?যে জন্য এতো বড় পাপ করলো সেটা তো সামনে আসবেই সেই সাথে আবার নতুন পাপ যুক্ত হলো।নিঝুম দ্রুত গতিতে বড় বড় পা ফেলে ড্রয়িংরুমে আসে।বাকিরাও আসে।রিদি বাকরুদ্ধ! তার বাবা আর চাচা মিলে কিছু একটা করেছে সেটা পরিষ্কার বুঝা যাচ্ছে।
— “আপনি তিতলিকে সরিয়েছেন?কোথায় সরিয়েছেন?কেনো করেছেন?”
নিঝুমের গলা কাঁপছে।আলতাফ নিশ্চুপ।মাথা নত হয়ে বসে আছেন।মিথ্যা বানোয়াট কিছু বলা আর ঠিক হবে না।আবার সত্যটা স্বীকার করাও অসম্ভব। নিঝুম আলতাফ চৌধুরীর পায়ে পড়ে বললো,
— “প্লীজ আব্বু বলেন।কই ও? আব্বু আমি তিতলিকে খুব ভালবাসি।খুব ভালবাসি।আমার বুকে আপনার হাতটা রাখেন,বুঝবেন বুকটা চুরমার হয়ে গেছে।চুরমার হয়ে যাওয়া হৃদয়টাও পুড়ছে।”
আলতাফ হুহু করে কেঁদে উঠেন।এতো আদরের ছেলে আজ তার পায়ে পড়ে কাঁদছে।যে ছেলে কখনো নিজের ইচ্ছেতে কিছু চায়নি সেই ছেলের বুক থেকে তার ভালবাসাকে কেড়ে নিয়েছে নিজের ভালবাসাকে ধরে রাখতে।নিজের উপর ঘৃণা জন্মে উঠে মুহূর্তে। চোখের জল মুছে নিঝুমকে পাশে বসায়।নিজেকে শক্ত করে।জানেন তিনি, সবটা শুনার পর সংসারটা টুকরো টুকরো হয়ে যাবে।থাক! হউক!এটাই তার শাস্তি।তিনি এক এক করে সব বলেন।
সবটা শুনে নিঝুম আগ্নেয়গিরি রূপ ধারণ করে।উঠে দাঁড়ায়।আগে আরমান চৌধুরীর কলার চেপে ধরে।
— “জোর করে ভালবাসা হয়না।আপনাকে আমি অনেক সম্মান করেছি।কখনো চোখে চোখ রেখে কথা বলিনি।আর সেই আপনি? আমার বাপকে ব্ল্যাকমেইল করে আমার তিতলিকে সরিয়ে দিয়েছেন।কি ভেবেছেন? আপনার মেয়েকে আমি বিয়ে করবো? জীবনেও না।তিতলি ছাড়া আর কোনো মেয়েকে আমার জীবনে আনা কল্পনায় ভাবতে পারেন।বাস্তবে না।'”
আরমান চৌধুরীকে ছেড়ে রিদির দিকে তাকায়।রিদি মাথা নত করে দাঁড়িয়ে আছে।তার জন্য কতো বড় অঘটন ঘটলো।নিঝুম চোখ সরিয়ে নেয়।সামনে যা পায় ভাঙ্গতে থাকে।নির্জন নিজেই আহত!সে নিঝুমকে কি সামলাবে? তাদের বাবার এমন একটা অতীত ছিলো? তার রেশ ধরে নিজ ছেলের বুকে ছুরি চালালো? সে নির্বাক!মৌনতা মোহনা এক কর্নারের সোফায় বসে আছে নতজানু হয়ে।আঞ্জুমান কখন ফ্লোরে দপ করে বসে পড়েছে কেউই জানেনা।নিঝুম যখন ক্লান্ত হয়ে পড়ে থেমে যায়।পা বাড়ায় বাড়ি থেকে বের হয়ে যেতে।তখনই আলতাফ চৌধুরীর গলা,
— “আমায় কিছু বলবিনা?”
নিঝুম না তাকিয়েই, ম্লান হেসে বললো,
— “কুলাঙ্গার সন্তান নয় শুধু, বাপও হয়।”
তারপর পরই বের হয়ে যায় বাড়ি থেকে। আলতাফের শরীরটা ঝাঁকি দিয়ে উঠে।ভেতরটা কেঁদে উঠে।আক্ষেপ করে মনে মনে বিড়বিড় করেন,
— “আর কোনো বাবা আমার মতো কাজ যেন না করে। নিজের সন্তানের মুখে কুলাঙ্গার বাবা যেন না শুনে আল্লাহ।”
নিঝুমের এই একটা কথা আলতাফ চৌধুরীর সারাজীবনের পাপের শাস্তি যেন নিমিষেই পূরণ করে দেয়।আলতাফ চৌধুরীর রগে রগে কথার বানের বিষ ছড়িয়ে পড়ে।