প্রজাপতি আমরা দুজন পর্ব ৪৪

প্রজাপতি আমরা দুজন পর্ব ৪৪
ইলমা বেহরোজ
ঘোড়া গাড়ি চড়ে রাজপুত্র আসছে রাজকন্যাকে নিয়ে যেতে। রাজপুত্রের ঠোঁটে হাসি লেগে আছে।রাস্তাঘাটের মানুষজন চোখ সরাতে পারছে না। ঘোড়া গাড়িতে বরের বেশে বসে আছে নিঝুম।সিলেট টু কুমিল্লা ঘোড়া গাড়ি দিয়ে!কষ্টসাধ্যই বটে!জ্যাম লাগছে বার বার রাস্তায়।নিঝুম তিতলিকে বলেনি ঘোড়া গাড়ি চড়ে যে আসবে।সারপ্রাইজের জন্য কথাটা লুকিয়ে রেখেছে।কুমিল্লা ঢুকে দুপুর দুই টায়।আরো এক ঘন্টা ত্রিশ মিনিট লাগবে পৌঁছাতে।নিঝুমের বুক ধ্বকধ্বক করছে।সে ভাবছে, লাল বেনারসি পরা তিতলিকে কোলে করে যখন ঘোড়া গাড়িতে এনে তুলবে। কি অবাকটাই না হবে তিতলি!
আর বাকি ত্রিশ মিনিট। উত্তেজনায় নিঝুমের পানি তৃষ্ণা পায়।নিঝুমের পাশে নির্জন বসেছে।নির্জন ভেবেছিল নিঝুমের মতো সে জামাই সাজবে।শুধু পাগড়িটা ছাড়া।কিন্তু আঞ্জুমান তখন বললেন,
— “নতুন কেউ তোদের একসাথে দেখলে এমনিতেই চিনেনা।কে কোনটা!এখন তুইও যদি জামাই সাজ ধরস তখন জামাই কোনটা চিনবে না।”
— “এটাই তো মজা আম্মু।জামাই আমি না নিঝুম চিনবেনা।”
— “এতো দূর থেকে যাচ্ছিস।পৌঁছাতেই বিকেল গড়িয়ে যাবে দেখিস।তার উপর ধাঁধাঁয় ফেলতে হবেনা গ্রাম বাসীকে।আরেকবার একরকম জামা পরে যাইস।মজা নিস।”
নির্জনের আর জামাই সাজা হলো না।নিঝুম নির্জনকে মৃদু গলায় ডাকলো,
— “এই নির্জন?”
নির্জন তাকায়।নিঝুম চশমা পরেনি।তার মতে,তাকে চশমা ছাড়া বেশি সুন্দর লাগে।যেহেতু আজ তার বিয়ে বেশি সুন্দর লাগতে হবে।
— “পানি হবে?”
— “বউ দেখার আগেই গলা শুকিয়ে গেছে?”
— “প্রথম বিয়েতো।তারপর আর গলা শুকাবে না!’
— “মানে আবারো বিয়ে করবি?”
নিঝুম চোখা চোখে তাকায়।বললো,
— “পানি দে।কথা কম বল।”
নির্জন হেসে পানি দিতে দিতে বললো,
— “মিয়া তুমিতো বাংলাদেশের নিউজে নিউজে ভাইরাল হয়ে গেছ।”
নিঝুম পুরো বোতলের পানি খেয়ে শেষ করে বললো,
— “হওয়ার কথা।ঘোড়া গাড়ি চড়ে এতদূর কে আসে বিয়ে করতে?”
তিতলির গ্রামে যখনি ঘোড়া গাড়ি সহ ২৫ টা কার, ৫০টা মোটর সাইকেল প্রবেশ করলো।একটা হুল্লোল লেগে গেল।তিতলির বাবার আবদার ছিলো কম হলেও ৭০০-৮০০ মানুষ নিয়ে আসতে।তিনি মেয়ের বিয়ে দিতে চান রাজকীয় ভাবে।যদিও হাতে ক্যাশ নেই।তবে জমি আছে তো ছিল প্রচুর।হঠাৎ করে নিঝুমের অন্যরকম অনুভূতি হচ্ছে।নির্জন খেয়াল করলো।নিঝুমের চেহারার উজ্জ্বলতা কমে এসেছে যেন হুট করে।বললো,
— “নিঝুম কি হইছে?”
— “জানিনা ভাই।”
নির্জন নিঝুমকে পরখ করে বললো,
— “অনুভূতি কেমন?”
— “শূন্যতা।”
— “একটু পরই পূর্ণ হবে।”
নিঝুম স্মিত হাসলো।
তিতলিদের বাড়ির সামনে একটা গোল বড় মাঠ আছে।ঘাসে ভর্তি ছিল।মাঠ ঘিরে বড় বড় গাছপালা।মাঠের ঘাস-আগাছা কেটে ডেকোরেশন করা হয়েছে।দূর থেকে বরযাত্রীর নজরে পড়ে।সবাই মুগ্ধ হয়ে তাকায়।এ যেনো সত্যি কোনো রাজার মেয়ে নিতে আসা হয়েছে!রাজকীয় আয়োজন চারিদিকে!
যত কাছে আসা হচ্ছে,মনে হচ্ছে কোনো আনন্দ নেই চারপাশে। নিঝুম অজানা আশঙ্কায় ঘামতে থাকে।নির্জনও অবাক হচ্ছে খুব।মিউজিক বক্স দেখা যাচ্ছে বড় বড়।অথচ,গান নেই!হৈ-হুল্লোড় নেই।
বর এসেছে শুনে মুরুব্বীরা এগিয়ে আসেন।নিঝুমের ফুফু-ফুপারা আগে নেমে যান।নিঝুমও অজানা আতঙ্কে যত দ্রুত সম্ভব নেমে পড়ে।একজন বৃদ্ধ লোক বলেন,
— “বউ পালিয়েছে।”
নিঝুমের মেরুদণ্ড বেয়ে যেন ঠান্ডা শীতল স্রোত হামাগুড়ি খেলো।ততক্ষনে মৌনতা,মোহনা, রোহি আঞ্জুমান সহ পরিবারের প্র‍ত্যেক মানুষ চলে এসেছে।আঞ্জুমান বলেন,
— “শাহেদ ভাইজান কোথায়?আমি উনার সাথে কথা বলবো।”
মধ্য বয়স্ক একজন লোক কিছু বলার আগেই,নিঝুম সবাইকে ঠেলে তিতলির বাড়ির ভেতর ঢুকে।চিৎকার করে ডাকলো,
— “তিতলি।এই তিতলি।তিতলি।”
তিথিয়া আর তার মা বেরিয়ে আসে।দুজনেরই মাথা নিচু। নিঝুম আহত চোখে তাকায়।চারপাশ যেন তাই বলছে,তিতলি পালিয়েছে!নিঝুম কাঁপা গলায় রাগ এনে বললো,
— “তিতলি কোথায়?”
তিথিয়া মাথা নত রেখেই বললো,
— “দুপুর ১২ টা থেকে আমরা সবাই আব্বু আর তিতলিকে খুঁজছি।কিন্তু পাচ্ছি না।”
নিঝুমের চারপাশ চক্কর দিয়ে উঠে।দু’পা পিছিয়ে যায়।নির্জন এসে ধরে।নিঝুম যেন কিছুই বুঝছে না।তারপরই নিজেকে সামলিয়ে তিথিয়া আর তার মা’কে ঠেলে রুমের ভেতর ঢুকে।তিতলি,তিতলি করে ডাকতে ডাকতে বাড়ির আনাচে-কানাচে দেখে ফেলে।ইতিমধ্যে গ্রামের সব লোক আবার জড়ো হয়েছে।বর এসেছে শুনে।দুপুর দু’টো অব্দি নানারকম কথা বলে চলে গিয়েছিল।এখন আবার এসেছে।আলতাফ চৌধুরী গ্রামের এক বন্ধুর বাড়িতে ছিলেন।তিতলি পালিয়েছে খবরটা অনেক আগেই শুনেছেন।অবাক হয়েছেন,আহত হয়েছেন সেই সাথে একটা শান্তি অনুভবও যেন হয়।কিন্তু আসেন নি এদিকে।নিঝুম আসার অপেক্ষা করছিলেন।তিনি তিতলির বাড়িতে ঢোকার সাথে সাথে আঞ্জুমান আক্রমণ করে,
— “কই ছিলা তুমি? অঘটন ঘটে গেছে এখানে।নিঝুমকে এখন কে সামলাবে?”
— “বাইরে শুনেছি।ভেবোনা তুমি আমি দেখছি।”
নিঝুম বাগানটা ঘুরে আসে।মাথা হ্যাং হয়ে এসেছে তাঁর।উঠোনে সবাই ছিলো।নিঝুম হেঁটে আসে ধীরে ধীরে।তারপরই হুট করে,উঠোনে থাকা পানি ভর্তি বালতিটা লাথি মেরে দূরে সরিয়ে দেয়।কান দিয়ে গরম ধোঁয়া বের হচ্ছে।চোখ-মুখ লাল।দু’হাতে মুখ ঢেকে জোরে নিঃশ্বাস ফেলে। ভাবে,আসলে কি হয়েছে? পাগড়িটা মাথায় নেই, কোথাও পড়ে গেছে অনেক আগেই।মুখ থেকে হাত সরিয়ে তিতলির সৎ মায়ের দিকে সে তাকায়।ক্রোধ নিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
— “আপনি লুকিয়েছেন তাই না? শোধ নিচ্ছেন? কত টাকা লাগবে আপনার? বিক্রি করেন আমার কাছে! যত লাগে দিবো।তিতলিকে বের করে দেন।”
তিতলির সৎমা আক্রোশে ফেটে পড়েন।বলেন,
— “আমি কেনো লুকাবো?তাঁর সাথে আমার কথা নেই সিলেট যাবার পর থেকেই।”
নিঝুম ঝাঁঝালো আরো কয়টা কথা বলতে যাওয়ার পূর্বেই তিথিয়া বললো,
— “ভাইয়া বিশ্বাস করেন সত্যি আম্মা এসবে নাই।আব্বা হঠাৎ করে তিতলিকে নিয়ে কোথায় চলে গেছেন আমরা জানি না।”
নিঝুমের চোখ রক্তের মতো লাল হয়ে গেছে।শরীর কাঁপছে।তিতলি…তিতলি নাই! আজ না বিয়ে? লুকোচুরি খেলছে? কই লুকিয়েছে?নিঝুম ভাবতে পারছে না তিতলি নাই।আজ তাদের বিয়ে অথচ তিতলি নেই।কই গেছে? নিঝুমের ফুসফুস, কিডনি,হৃৎপিণ্ড,কলিজা সবকিছু উত্তেজিত হয়ে উঠেছে।সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।হাত মুঠো করে।চোখ রাখা মাটিতে।আলতাফ চৌধুরী, নির্জন,এমনকি কেউই সাহস পাচ্ছে না সামনে এগোতে। নিঝুম রক্ত বর্ণের চোখে ঘুরে তাকায়।উপস্থিত সবাই আৎকে উঠে চোখ দেখে।
নির্জন বুঝিয়ে শুনিয়ে সবাইকে সিলেট পাঠিয়েছে।বলেছে, সে নিঝুমকে নিয়ে ফিরবে।আঞ্জুমান যেতে চান নি।তিনি কাঁদতে কাঁদতে আধমরা। নিঝুম সেই বিকেল থেকে গাড়ি নিয়ে যেদিক চোখ যায় ছুটছে আর খুঁজছে তিতলিকে।পিছু পিছু নির্জনের গাড়ি।আর বরযাত্রীরা কনে বাড়ি পৌঁছাবার পর থেকেই বাকরুদ্ধ। এমন ঘটনা কখনো দেখেনি তারা।
নিঝুম গাড়ি ড্রাইভ করতে করতে রাস্তার দু’পাশ দেখছে।বুকে ঝড় বইছে।তিতলিকে এই বুঝি পেয়ে গেল,তারপরই কয়টা মার দিবে।তিতলি ব্যাথা পেয়ে কেঁদে দিবে তখন সে বুকে টেনে নিবে।বুকের কাঁপুনি শুনাবে।বলবে, তার নিঃশ্বাস যেন বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছিল।আর যেনো কখনো ছেড়ে না যায়।এবারের মতো ক্ষমা করে দিবে।কিন্তু,পাচ্ছে না! কেনো পাওয়া যাচ্ছে না তিতলিকে? নিঝুমের শরীরের হাড়ে হাড়ে আক্রোশ-ক্রোধ-ভয়।নিজেকে তার পাগল মনে হচ্ছে।বুকের উপর পুরো পৃথিবীটা উঠে লাফাচ্ছে।এতো ভার!গলা শুকিয়ে যাচ্ছে বার বার।দমটা যেন গলায় এসে আটকে গেছে।এখনি বের হয়ে যাবে।চোখে ভাসছে,পিছনে ফেলে আসা সুন্দর সময়গুলো।নিঝুমের ভেতরটা আর্তনাদ করছে,
— “তিতলি কোথায় তুমি? আমি তোমায় ছুঁতে পারছিনা কেন? প্লীজ তিতলি এমন করো না।আমি তোমাকে ছুঁতে চাই।বুকটা পুড়ছে খুব। একটাবার এসে মাথা রাখো।”
শরীরটা ধীরে ধীরে নিস্তেজ হয়ে আসে।রাত অনেকটা হয়েছে।নিঝুম একটা ছোট নদীর পাশে গাড়ি থামায়।গাড়ির দু’পাশের দরজা খুলে দেয়।এদিকটায় অনেক হাওয়া।অনেক নিরিবিলি।মাঝে মাঝে এক দুটো গাড়ি যাচ্ছে,আসছে।নিঝুমের গাড়ি থেকে অনেকটা দূরত্ব রেখে নির্জন গাড়ি থামিয়েছে।নির্জনের সাথে গাড়ির ড্রাইভার রয়েছে। ড্রাইভার বললো,
— “উনার কাছে যাবেন না।”
নির্জন কথা বলতে গিয়ে দেখে কথা আসছে না।কাশি দিয়ে গলা পরিষ্কার করে বললো,
— “একটু একা থাকুক।কাঁদুক।নয়তো সামলানো যাবে না।”
— “মাইয়াডা এমনে ছ্যাঁকা দিলো ভাইটারে।ভাইজান কত সুন্দর।ছাড়ল কেমনে?”
— “এর পিছনে অবশ্যই কোনো বড় কারণ আছে।তিতলি ওইরকম মেয়ে না।নিঝুমকে পাগলের মতো ভালোবাসে।”
— “নিঝুম ভাইটার জন্য খারাপ লাগতাছে অনেক।কি ভালোবাসতো।”
নির্জন দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। ড্রাইভার সাবধানে বললো,
— “গ্রামের লোকের সাথে আমগোর সাথে আসা মানুষগুলো তিতলি আফারে অনেক খারাপ কথা বলতাছিলো।”
নির্জন নখ খোঁচায়।কিছু বললো না।
ড্রাইভিং সিটে নিঝুম ‘দ’ স্টাইলে বসে আছে।হাঁটুতে দু’হাত রেখে তার উপর মাথা নত করে সে কাঁপছে।বেশি কাঁপছে বুক।বুকের আর্তনাদ সে শুনতে পাচ্ছে।শেরওয়ানী খামচে ধরে নিঝুম।কান্নারা বেরিয়ে আসছে।ঠেলে-ঠুলে বেরিয়ে আসছে।নিঝুমের ঠোঁট কাঁপছে।বুকে রাগ,আক্রোশ,ক্রোধ কিছু নেই।চোখ জ্বলছে।জল গড়াবে। জল জমেছে। বেরিয়ে এসেছে।গাল বেয়ে নিচে নামছে।নিঝুমের বুক পুড়ছে।আগুনে দাউ দাউ করে জ্বলছে।চোখের জল গরম! বুকের আগুন থেকে ঝাঁল হওয়া গরম জল!ঠোঁট কামড়ে ধরে কাঁদছে সে।নির্জন ড্রাইভারকে রেখে এগিয়ে আসে।ড্রাইভিং সিটের পাশের সিটে বসে।দেখতে পায় নিঝুমের শরীর কাঁপছে। বুকটা কেঁপে উঠে নির্জনের।নিঝুমের কাঁধে হাত রাখে।নিঝুম কেঁপে উঠে।ভাবে,তিতলি এসেছে।কিন্তু তাকিয়ে দেখে নির্জনকে।নির্জন নিঝুমের মুখ-চোখ দেখে আৎকে উঠে।বলল,
— “ভাই?”
নিঝুম তাকায়।চাহনিতে বিষাদ যন্ত্রনা।নির্জনের চোখে জল জমে।নিঝুমকে জড়িয়ে ধরে।নির্জন বললো,
— “বাড়ি চল।”
নিঝুম দু’হাতে শক্ত করে নির্জনকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে বললো,
— “ভাই আমার মনে হচ্ছে আমার শরীর পুড়ে যাচ্ছে।কে যেন জীবন্ত আমায় চিতায় ফেলেছে।চারিদিকে আগুনের তাপ।তিতলি কই গেল?কেন গেল?”
নির্জন কাঁপা গলায় বললো,
— “এভাবে বলিস না তুই।তোরে এভাবে মানায় না।সত্যি মানায় না।”
নিঝুম সরে যায়।নিজের চুল টেনে ধরে।নির্জন বাঁধা দেয়।
— “ভাই সব ঠিক হয়ে যাবে।”
নিঝুম বেরিয়ে আসে গাড়ি থেকে।একটু জায়গাতে তিন-চার বার হাঁটে।তারপর পরই একটা বড় গাছের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়।নির্জন দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরে।উত্তেজিত হয়ে বললো,
— “নিজের ক্ষতি করিস না।তুই না ডাক্তার।জ্ঞানী ছেলে।তুই এমনটা করতে পারিস না।”
নিঝুম ছুটার জন্য নির্জনকে ধাক্কা দেয়।ড্রাইভারও বেরিয়ে এসেছে।নির্জন, ড্রাইভার একসাথে নিঝুমকে ধরে।অনেক ধ্বস্তাধস্তির পর নিঝুম শান্ত হয়ে নদীর পাড়ের রাস্তার পাশে মাটিতে বসে পড়ে।কাঁপা গলায় আস্তে করে বললো,
— “বুক জ্বলে।পানি লাগবে।”
— “ভাইজান বাড়ি চলেন।”
— “নিঝুম বাড়ি চল।দেখিস কয়দিনের মধ্যেই তিতলি ফিরে আসবে।”
— “ভেতরটা জ্বলে যাচ্ছে।কতোবার বলব? আমি শান্তি পাচ্ছি না।আমি কোথাও যাবো না।”
নিঝুম চেঁচিয়ে উঠলো।তারপর আবার শান্ত স্বরে বললো,
— “আমার টুকটুকিকে এনে দে ভাই।কই গেল ও?”
— “কিছু হয়নি ভাই।বিশ্বাস কর।কিছু হয়নি।সব ঠিক হয়ে যাবে।তুই শান্ত হ।বাড়ি চল।”
নিঝুম মাটিতে সটান হয়ে শুয়ে পড়ে।পৃথিবী যেন থমকে গেছে।নিঃশ্বাস নেওয়া কষ্টকর। কে যেন বিষ ছড়িয়ে দিয়েছে চারিদিকে।
শাহেদ প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র আর মেয়েকে নিয়ে রেল স্টেশনে আসেন।খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন ইন্ডিয়ার ট্রেন রাত এগারো টায় ছাড়বে।দুপুর তখন একটা।এতক্ষণ থাকবে কোথায়?আশেপাশে কোনো হোটেল আছে নাকি তিনি জানেন না।কখনো দরকার পড়েনি তো।একজন যুবক পথচারীকে ডেকে তিনি প্রশ্ন করেন,
— “এই ছেলে এখানে থাকার জন্য কোনো হোটেল আছে?থাকলে সেটা কোন দিকে?”
ছেলেটা একবার শাহেদ আর তিতলিকে দেখে নেয়।তিতলি কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।চোখের পলকও পড়ছে না।প্রাণহীন দেহ দাঁড়িয়ে আছে যেন।
ছেলেটা হোটেল কোনদিকে বলে দিয়ে চলে যায়।
শাহেদ হোটেলের রুম বুকিং করে।একদিনের জন্য!অগ্রিম টাকা দিয়ে দেয়। রাত ১০:৪৫ ই বেরিয়ে যাবে।কলকাতা  যাবে মেয়েকে নিয়ে।জেসমিনের বড় ভাইয়ের বাড়ি।তিতলির মামার বাড়ি।তিতলির জন্মের এক বছর আগে তিনি বাংলাদেশ ছেড়ে কলকাতা আসেন।মাঝে মাঝে কথা হতো ফোনে শাহেদের সাথে।তিতলির খোঁজ নেওয়ার জন্য।বোন না থাকুক,একটা মাত্র বোনের মেয়েটা তো আছে।অনেকবার তিতলির মামা বলেছিলেন,তিতলিকে দিয়ে দিতে তার কাছে।কিন্তু শাহেদ মেয়ের মায়া ছাড়তে পারে নি।দুই বছর আগে একবার মেয়েকে নিয়ে ঘুরতে গিয়েছিলেন শুধু।তাই ভিসা-পাসপোর্ট দুজনেরই আছে।নয়তো আজই কলকাতা যাওয়া সম্ভব ছিল না।
রাত আট টায় শাহেদ রেল স্টেশনে আসেন টিকিট কাটতে।শাহেদ রুম থেকে বের হতেই তিতলি দ্রুত দরজা লাগিয়ে দেয়।বাবার সামনে সে কাঁদতে পারছিলো না।কাঁদলেই তিনি আর কলকাতা যাবেন না।ফেরত যাবে তিতলিকে নিয়ে নিঝুমের কাছে।
তিতলির পরনে গায়ে হলুদের হলুদ শাড়ি।নিঝুমের দেওয়া।তিতলি ফ্লোরে বসে শাড়ির আঁচলটা জড়িয়ে ধরে।অজস্র চুমুতে ভরিয়ে দেয়।বুক কাঁপছে তাঁর।চোখ বেয়ে জল পড়ছে।শাড়ি হাঁটু অব্দি তুলে নেয়।নিজের পায়ের দিকে নিজে তাকিয়ে থাকে।এই পা কতবার ছুঁয়েছে নিঝুম।যতবার ব্যাথা পেয়েছে পায়ে ততবার জোর করে সেবা করেছে মানুষটা।পায়ে একটা পায়েলও আছে।সেটাও নিঝুমের দেওয়া।তিতলির শরীর শিরশির করে কেঁপে উঠে।উঠে দাঁড়ায়।মাথা দু’হাতে চেপে ধরে। নিজেকে তার পাগল লাগছে।এমনটা হওয়ার কথা ছিল না।এটা কি হলো? কেন হলো?রুমের মাঝে পায়চারি করে আর বিড়বিড় করে,
— “ডাক্তার!আমার ডাক্তার!নিঝুম!আমার নিঝুম! আমার নেই! কেনো নেই?আমার নিঝুম। কি হয়েছে উনার! কই উনি।আমি ছেড়ে এসেছি কেনো?আমি কবুল বলবো না? বউ সাজবো না?।”
তিতলি শ্বাসকষ্ট রোগীর মতো করতে থাকে।শ্বাস নিচ্ছে ঘন ঘন।মাথার ভেতর যা কিছু আছে সব ঘুরপাক খাচ্ছে।তিতলি বিছানায় বসে।আবার উঠে দাঁড়ায়।বাথরুমে আসে।শাওয়ার নেয়।শাড়ি খুলে। শাড়িটা বুকে আঁকড়ে ধরে।আর্তনাদ করে বসে পড়ে।কাঁদতে থাকে অঝরে!ঝর ঝর করে গায়ে পানি পড়ছে সাথে চোখ বেয়েও!কিন্তু শরীরের,মনের জ্বালাপোড়া কিছুতেই কমছে না।তিতলির চোখে ভেসে উঠে,নিঝুমের বিয়ে হবে রিদির সাথে।
ওই রুমটা রিদির হবে।দুজন পাশাপাশি ঘুমাবে।রিদি যখন পা ফসকে কোথাও পড়ে গিয়ে ব্যাথা পাবে নিঝুম কোলে তুলে নিয়ে আসবে ঘরে।যতক্ষণ ব্যাথা না কমে সেবা করে যাবে।নিজের হাতের বানানো কফি রিদিকে খাওয়াবে।ছোট একটা সংসার হবে ওদের।অথচ,সেখানে থাকার কথা তিতলির। আর ভাবতে পারছে না তিতলি।নিজের হাত-পা খামচে রক্তাক্ত করে ফেলে।উন্মাদ হয়ে যাচ্ছে সে।ফ্লোর খামচে ধরার বৃথা চেষ্টা করতে গিয়ে বাম হাতের পাঁচটা আঙ্গুলের বড় নখ গুলো বাঁকা হয়ে ভেঙ্গে যায়।হাত-পা চিরে গেছে!পানি পড়ছে সেখানে। জ্বালা করছে প্রচন্ড।কেউ যেনো মরিচ লাগিয়ে দিয়েছে।কিন্তু তাতে তিতলির খেয়াল নেই।তার চেয়েও লক্ষগুণ পুড়ছে বুকটা।হৃদয়টা পুড়তে পুড়তে ছাই হয়ে যাচ্ছে।সেই পোড়া, ক্ষত জায়গাটা ঠিক করার একটাই ঔষধ।কিন্তু সামর্থ্য নেই!
কোঁকড়া লম্বা চুল ভিজে ফ্লোর ছাড়িয়ে গেছে।তিতলি নিজের সাথে যুদ্ধ করে ক্লান্ত।হাঁটুর উপর মাথা ঠুকে বসে আছে।তিতলির সর্বাঙ্গ ভালবাসার বিচ্ছেদে টুকরো টুকরো হয়ে যাচ্ছে।জোড়া লাগানোর কেউ নেই।সে নিজে সে পথ বন্ধ করে দিয়েছে।ইচ্ছে হচ্ছে ছুটে যেতে নিঝুমের কাছে।
শাহেদ রুমে ঢোকে মেয়ের দিকে তাকান।তিতলি তাকায় না।নিজেকে আড়াল করার চেষ্টা করছে।শাহেদ বলেন,
— “এদিকে তাকা মা?”
তিতলি নত হয়ে থাকে।আবদুল মিয়া মেয়েকে টেনে বিছানায় বসিয়ে তিনিও বসেন। বলেন,
— “তাকাবিনা বাবার দিকে?”
তিতলি তাকায়।বড় বড় আঁখিদুটি নিভু নিভু।চোখের চারপাশ ফোলা। মরা কান্না কেঁদেছে তা দেখেই বুঝা যাচ্ছে।শাহেদের বুকটা হাহাকার করে উঠলো।কেঁদে ফেলেন তিনি।তিতলি ভড়কে যায়।বাবার দু’হাত ধরে বললো,
— “তুমি কেঁদোনা বাবা।তাহলে কি করে বাঁঁচবো আমি? আমার আর কে আছে?”
শাহেদ মেয়ের মাথায় হাত রেখে হুহু করে কেঁদে উঠেন।তিতলির ঠোঁট দুটো ভেঙ্গে আসে।ডুকরে কেঁদে উঠে।বাপ-মেয়ে একসাথে কাঁদতে থাকে।শাহেদ বিয়ের অল্প বয়সে হারালেন যত্নে গড়া ভালবাসাকে।তিতলি জন্মের পর পরই হারালো মাকে।তারপর বাবা-মেয়ে দুজন দুজনকে ঘিরে বেঁচে থাকে আঠারোটা বছর।বাবা যখন বাড়ি না থাকে একাকীত্ব সময় কাটায় সে।একটা সময় জীবনে আসলো সুখ।সুখের নাম নিঝুম!কয়েক মাসে ব্যবধানে অফুরন্ত ভালবাসা সে ঢেলে দেয় তিতলির পদতলে।তারপর হুট করেই যেন সুখের ঘরটা চুরমার হয়ে গেলো এক সর্বনাশা ঝড়ে।তার রেশ কাটাতে পারছে না তিতলি।তিতলির দুঃখে তার বাবা আহত!বাবা-মেয়ে দুজন দুজনকে দুঃখের সাক্ষী রেখে চোখের জল ঝড়াচ্ছে অঝোরে।
শাহেদ আর তিতলি পাশাপাশি বসে আছে সিটে।জানালার পাশে বসেছে তিতলি।জানালার বাইরে সে তাকিয়ে আছে।শাহেদ জিকির করছেন মনে মনে।ট্রেনের চাকার আওয়াজের সাথে মাঝে মাঝে একটা ছোট বাচ্চার কান্নার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে।তিতলির ভেতরের শূন্যতা ধীরে ধীরে বাড়ছে। শুধু শহর নয় দেশ ছেড়ে সে চলে যাচ্ছে।অনেক দূরে!সত্যি নিঝুম তার হলো না।কি করছে মানুষটা? কাঁদছে? হয়তো।কিন্তু ভুলে যাবে একদিন।ঠিক সুখে থাকবে রিদিকে নিয়ে।ভেতরের তিতলিটা পৃথিবী ফাটানো চিৎকারে কাঁদছে।অথচ,উপরের তিতলিটা নিশ্চুপ! নিষ্প্রাণ! তিতলি হৃদয় দিয়ে চিরকুট লিখে,
— “ডাক্তার আমি আপনাকে ছেড়ে চলে যাচ্ছি।ক্ষমা করে দিয়েন আমায়।আমাদের সাদাময় সংসার হলো না।আমি আপনায় কখনো ভুলতে পারবো না।আপনার জায়গাটা দখল করার ক্ষমতা কারোর নেই।বিশ্বাস করুন আমি আপনাকে খুশিতে ছেড়ে যাচ্ছি না।বুকের মাঝে কি যে দহন হচ্ছে।দম বন্ধ কষ্ট হচ্ছে।আপনি আমায় মেরে ফেলেছেন। আপনাকে ছাড়া পথচলাটা কেমন হবে জানি না।কিন্তু আফসোস রয়ে যাবে, আপনার হাত ধরে পথ চলা হলো না।দেহে প্রাণ থাকলেই কি বেঁচে থাকা বলে?তাহলে আমি বেঁচে থাকবো।কিন্তু মনটা?
ভালো থাকবেন ডাক্তার!ভালো থাকবেন।”
তিতলি চোখ বুজে বড় করে নিঃশ্বাস নেয়।হৃদয়ের দোয়াত দিয়ে লিখা চিঠি কি পৌঁছাবে নিঝুমের কাছে? পৌঁছাবে না।