প্রজাপতি আমরা দুজন শেষ পর্ব 

প্রজাপতি আমরা দুজন শেষ পর্ব 
ইলমা বেহরোজ
শাহেদ আলতাফ চৌধুরীর বাড়ি এসে টুনির কাছে শুনেন তিতলির এক্সিডেন্টের কথা।তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন।তারপর যখন শুনলেন,এখন ঠিক আছে তিতলি।ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে যাবে।আর নিঝুম পাশে আছে।নিঝুমের বিয়েও হয়নি।তখন তিনি শান্ত হোন।
বাসে উঠে চলে আসেন ঢাকা।মেয়ের কেবিনে এসে দেখেন তিতলি ঘুমাচ্ছে।পাশে নিঝুম বসে আছে।শাহেদকে দেখে নিঝুম উঠে দাঁড়ায়।সালাম করে।শাহেদ নিঝুমকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠলেন।হতভম্ব হয়ে যায় নিঝুম।শাহেদ ভেজা কণ্ঠে বলেন,
— “আমার মেয়েটা আমার সামনে প্রত্যেকদিন ছটফট করছে বাপ।একটা দন্ডও শান্তি পায়নি।”
নিঝুম মৃদু হেসে বললো,
— “আর কাঁদবে না।এবার শুধু হাসবে।”
শাহেদ মেয়ের পাশে এসে বসেন।তারপর নিঝুমের দিকে তাকিয়ে বললেন,
— “বিয়ে করবে না বলে হাতে চুড়ি আর নাকে নাকফুল পরে থাকতো।নিজের যত্ন নেওয়ার কথা তো ভুলেই গেছিলো।”
— “দেখতেই পাচ্ছি।মুখের ব্রণ বুঝিয়ে দিচ্ছে কত রাত জেগেছে।”
— “আমি ওরে অনেকবার বলছি একবার খোঁজ নিয়ে জানতে।কিন্তু ভাগ্যের উপর এতো অভিমান ছিল ওর…”
তিনি কাঁদতে থাকেন।তিতলি জেগে উঠে।মেয়ের সাথে কিছু কথা বলে বেরিয়ে যান শাহেদ।রোমেনা যাওয়ার পূর্বে তিতলির গালে চুমু দেন।বলে যান, নিঝুম আছে।চিন্তা করিস না।নির্জন নিয়ে যায়।ওরা সবাই আজ বাড়ি ফিরবে।নিঝুম আরো চার পাঁচ দিন এখানে থেকে তারপর তিতলিকে সিলেট হাসপাতালে ট্রান্সফার করবে।
নিঝুম তিতলির পাশে এসে বসে।বললো,
— “কিছু খাবেন?”
— “খাবো তো।চুমু খাবো।”
ভারী ইনোসেন্ট গলা তিতলির।নিঝুম বিস্ফোরিত চোখ নিয়ে তাকায়।পরক্ষণেই তিতলি বলে উঠলো,
— “না থাক লাগবে না।আপনার মুখ ভর্তি দাঁড়ি-গোঁফ।ব্যাথা পাবো।আর এটা কি রূপ আপনার?ডাকাত লাগছে একদম!”
নিঝুম হাসে।তিতলির নাকে নাক ঘষে বললো,
— “তোমার স্পর্শ আমায় রাঙ্গিয়ে দেয়, নতুনভাবে,নতুনরূপে।আরেকবার ঘুমিয়ে ঘুম থেকে উঠে দেখবেন এসব কিছু নেই।”
তিতলি মৃদু হাসে।বললো,
— “ক্লিন সেভ কিন্তু করবেন না।”
— “আপনি যা বলবেন বেগমসাহেবা।”
তিতলি হাত বাড়িয়ে নিঝুমের চুল ঝাঁকায়। নিঝুম বললো,
— “পায়ে ব্যাথা করে?”
— “হু।”
— “বেশি?’
— “হু।”
— “একটু সহ্য করো।কয়দিন ব্যাথাটা বেশি ই করবে।”
— “আচ্ছা।”
— “স্যুপ আনবো?”
— “হু।”
— “আচ্ছা নার্স তো আছেই।আমি যাবো আর আসবো।”
— “সাবধানে যাবেন।”
— “হু যাবো।”
নিঝুম বেরিয়ে যায়।তিতলি প্রাণভরে নিঃশ্বাস নেয়।পৃথিবীটা যেন পাল্টে গেছে।চারিদিকে সুখ,শান্তি।সবকিছু পূর্ণ।কিছু আর পাওয়ার নেই।শরীরে অনেক ক্ষত থাকা সত্ত্বেও নিজেকে সুখী মনে হচ্ছে অনেক বেশি।ভালবাসার কত শক্তি!
ঠিক পাঁচদিন পর ওসমানী মেডিকেল নিয়ে আসে তিতলিকে।নিঝুম ডাক্তারিতে আবারো পদর্পণ করে।এখন তো আর বেকার থাকা যাবে না।তিতলি আছে।অপারেশনের ফাঁকে ফাঁকে তিতলিকে দেখে যায়।খাইয়ে দেয়।নিজের শরীরের যত্ন সহ, তিতলির যত্ন সাথে প্রত্যেকদিন রোগিদের হার্ট সার্জারি করা দু’হাতে সামলাচ্ছে নিঝুম।একমাস পর তিতলিকে বাসায় নিয়ে আসে।তবে,নিঝুমের ছাদের রুমে আসেনি।অন্য দুইটা রুমে দুজন উঠে।
ছাদের রুমে বিয়ের রাত থেকে থাকবে।তাঁদের সাদাময় সংসার হবে।দুই-তিনটা নার্স রেখে দেয়।নিজে তো আছেই।প্রত্যেকদিন বিকেলে হুইলচেয়ার করে তিতলিকে নিয়ে ঘুরে এলাকার অলিগলি।মাঝে মাঝে তিতলির আবদারে চলে ফুসকা খাওয়া।তারপর ধীরে ধীরে তিতলিকে হাঁটানোর সাহায্য করে।নিজের শরীরের দিকে যত্নবান হয়।তিন বছরে অনেক ক্ষতি হয়েছে সব পূরণ করতে নেমেছে নিঝুম।
নির্জন যেন ঠিক আগের মতো হুট করে চঞ্চল হয়ে উঠেছে।ডাক্তারিতে মন টিকে না।রোহিকে নিয়ে ঘুরে।বাচ্চাদের সামলায় আলতাফ চৌধুরী আর আঞ্জুমান।দীর্ঘ চার মাস পর তিতলি ধীরে ধীরে একা একা হাঁটার ক্ষমতা লাভ করে।।তখন মৌনতা মোহনাকে বিয়ের পিড়িতে বসায় দুই ভাই।বোন দু’টো চলে যায় শ্বশুর বাড়ি।শ্বশুর বাড়ি যাওয়ার পূর্বে ঘটে আশ্চর্য কান্ড।দু’বোন বাচ্চাদের মতো কাঁদতে থাকে।কিছুতেই শ্বশুর বাড়ি যাবে না।দুজন রুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দেয়! সেকি অবস্থা।অনেক বুঝিয়ে শুনিয়ে পাঠানো হয় শ্বশুর বাড়ি।
ছয় মাস পর তিতলি পুরোপুরি সুস্থ হয়।হুটহাট মাথা ব্যাথাটাও কমেছে। সেই সাথে হাঁটতে পারে স্বাভাবিক ভাবে।একদিন নিঝুম মৌনতা,মোহনা, রিদি,শাহেদ,রোমেনা,অরুণ সবাইকে ডেকে আনে।কেউ বুঝতে পারছেনা নিঝুম কেনো ডেকেছে।সবাই ড্রয়িং রুমে বসে আছে।তিতলিও জানেনা আসলে কি হবে?নিঝুম কাজী নিয়ে আসে।সাথে একটা লাল কাতান বেনারসি,ডায়মন্ডের চিকন দুইটা চুড়ি,নাকফুল।ব্যাপারটা সবাই বুঝে যায় তখন।তিতলি লজ্জায় মাথা নত করে ফেললো।রোহি, মৌনতা তিতলিকে নিয়ে উপরে যায়।রিদি যেতে পারেনি,কারণ কোলে তাঁর ছোট মেয়ে।
নিঝুম-তিতলি পাশাপাশি বসে।কাজী সাহেব তিতলির পাশে বসে বললো,
— “১০১ টাকা দেনমোহর ধার্য্য করিয়া আপনি শাহেদ সরকারের ছোট কন্যা মুমতাহিনা তিতলি,আলতাফ চৌধুরীর পুত্র আহনাফ মুত্তাকী নিঝুমের সাথে বিবাহে রাজি থাকিলে বলুন ‘কবুল…”
তিতলি একবার নিঝুমের দিকে তাকায়।তারপর মাথা নত করে বললো,
— “কবুল,কবুল,কবুল।”
নির্জন,রোহি,মৌনতা,মোহনা চিৎকার করে উঠে,হিপ হিপ হুররে বলে।
কাজী এবার নিঝুমকে বললো,
— “১০১ টাকা দেনমোহর ধার্য্য করিয়া আপনি আলতাফ চৌধুরীর পুত্র আহনাফ মুত্তাকী নিঝুম, আবদুল মিয়ার ছোট কন্যা মুমতাহিনা তিতলিকে বিয়ে করতে রাজি থাকিলে বলুন ‘কবুল…”
নিঝুম বলার আগে নির্জন বললো,
— “রাজি না থাকলে কি আপনাকে ধরে আনছে?”
সবাই হো হো করে হেসে উঠে।কাজী হেসে বললো,
— “বলুন ‘কবুল…”
 নিঝুম উচ্চস্বরে বললো,
— “আলহামদুলিল্লাহ কবুল,কবুল, কবুল!”
জোড়া লাগলো একজোড়া প্রেমিক-প্রেমিকের সম্পর্ক।এ সম্পর্ক পবিত্র সম্পর্ক।যে সম্পর্কে পাপ নেই।পবিত্রায় পরিপূর্ণ এই সম্পর্ক।বিষাক্ত সব সময়কে পিছনে ফেলে চার হাত এক বাঁধনে আটকে গেল।এই একটা দিনের অপেক্ষায় থাকে প্রত্যেকটা প্রেমিক-প্রেমিকা।এই দিন তাঁদের জীবনের শ্রেষ্ঠতম দিন,শ্রেষ্ঠতম সময়।আয়না দেখার সময় রিদি নিঝুমকে প্রশ্ন করে,
— “আয়নায় কাকে দেখতে পাচ্ছিস?”
নিঝুম ভালো করে দেখে।আয়নার ভেতর তিতলি হাসছে।নিঝুম উচ্চস্বরে বলে,
— “সহস্র শত বছরের আরাধণায় পাওয়া জান্নাতের হূরকে দেখছি।”
উপস্থিত সবাই ‘ওহ,হো ‘ বলে চেঁচিয়ে উঠলো।তিতলি লজ্জায় রক্তলালবর্ণ ধারণ করেছে।এবার তিতলিকে প্রশ্ন করা হয়, সে কি দেখছে।তিতলি লজ্জায় মিনমিনে গলায় বললো,
— “আমার ভয়ংকর স্বামীকে…”
এরপরই লজ্জায় ফিক করে হেসে উঠে।আমার স্বামী কথাটি নিঝুমকে আলোড়িত করে তুললো।
তিতলিকে একা পেয়ে নিঝুম কাছে টেনে আনে।এরপর দু’হাতে কোমর পেঁচিয়ে বললো,,
— “খুশি তো? ১০১ টাকা দেনমোহর দিয়েছি আপনার কথায়।”
— “হুম খুশি।বেহুদা সেদিন তর্ক করলেন কেনো?”
নিঝুম হাসলো।বললো,
— “অবশেষে আমাদের সাদাময় সংসারে পা পড়বে আজ রাতে।”
রাতের কথা শুনে তিতলি লজ্জায় মাথা নত করে।নিঝুম চিবুকে এক হাত রেখে মুখ তুলে বললো,
— “এখনও এতো লজ্জা?”
তিতলি নিঝুমের বুকে মুখ লুকোয়।এরপর ক্ষীণ স্বরে বলে,
— “আমি যে আপনার লাজুকলতা। “
নিঝুম হাসে।প্রশস্ত সেই হাসি।বলে,
— “আমার রুমে যখন তোমাকে নিবে বালিশের নিচে দেখো।”
তিতলি মুখ তুলে তাকায়।বলে,
— “কি আছে?”
— “সেটা পরেই জেনো?”
রাত একটা।তিতলি লাল বেনারসি পরে অপেক্ষা করছে নিঝুমের জন্য।তখন মনে পরে, নিঝুম বালিশের নিচে কিছু দেখতে বলেছিল।বালিশ সরিয়ে দেখে একটা চিঠি।তিতলি হাসলো। চিঠি খুলে পড়ে,
” মনে আছে তিন বছর আগে বিয়ের রাত নিয়ে আমার ইচ্ছে জানতে চেয়েছিলে?কিন্তু বলিনি।আজ তো সেই কাঙ্খিত রাত।বিছানার ডান পাশে যে সাদা ওয়ারড্রব আছে।সেখানে খুঁজতে থাকো।কি আছে বলবো না।তোমার চোখের সামনে পড়লেই  বুঝবে।”
তিতলি ওয়ারড্রবে খুঁজতে থাকে কিছু একটা।কিন্তু কি জানে না!আকস্মিক চোখের পর্দায় ভেসে উঠে সাদা সিল্ক শাড়ি,ব্লাউজ,সাদা ফুল আর একটা চিরকুট।তিতলি হা হয়ে যায়।চিরকুট খুলে পড়ে।লজ্জায় লাল হয়ে যায়।নিঝুম চিরকুটে বর্ণনা দিয়েছে কীভাবে শাড়ি পরতে হবে।নিঝুম এ’কদিন যে রুমে ছিল সে রুম থেকে বেরিয়ে দেখে বাড়িতে কেউ নেই। একদম নিশ্চুপ চারিদিক।অবাক হয়ে নির্জনকে কল দেয়,
— “হ্যালো? তোরা কি কেউ বাড়ি নাই?”
নির্জন বললো,
— “সব রোহিদের বাড়ি যাচ্ছি।খালি বাড়ি এনজয় কর।”
— “এসব তোর প্ল্যান না?”
— “রাগছিস কেন? আমার বাসর রাতে এমন সুযোগ দেস নাই বলে কি আমিও দেবোনা নাকি?”
নিঝুম কিছু বলার আগে কল কেটে দেয় নির্জন।নিঝুম মাথা চুলকিয়ে হাসে।দ্রুত পায়ে ছাদে এসে অবাক হয়।পুরো ছাদ লাইটিং করা।ফুলের পাঁপড়ি ছড়ানো।তিতলির জন্য গিফট কিনতে বের হয়েছিল সে।তখন হয়তো এসব করেছে নির্জন।নিঝুম ঠোঁট কামড়ে হাসি আটকায়।বড় বড় পা ফেলে রুমে আসে।
নিঝুমের রুমে ড্রেসিং টেবিল ছিলো না।তিতলির জন্য আনা হয়েছে।তিতলি আয়নার সামনে বসে মাথায় ফুল দিচ্ছিল।নিঝুম গলা খাঁকারি দেয়।তিতলি উঠে ঘুরে দাঁড়ায়।তিতলিকে দেখে নিঝুমের দু’ঠোঁট নিজেদের আপন শক্তিতে আলাদা হয়ে যায়।  কল্পনায় যেমনটা ভেবেছিল তার চেয়েও বেশি সুন্দর লাগছে তিতলিকে।ছোট হাতার ব্লাউজ।গলা বড়।শাড়ি কুচি ছাড়া এমনভাবে পরেছে শরীরের চার ভাগের দুই ভাগই ফুটে আছে।
গলায়, হাতে,কোমরে,মাথায়,কানে সাদা ফুলের মালা।খোলা কোঁকড়া চুল।নিঝুমের হেঁচকি উঠে।তিতলি মাথা নত করে ছিল।হেঁচকির শব্দ শুনে মুখ তুলে তাকায়।দেখে, নিঝুম সাদা পাঞ্জাবি-পায়জামা পরেছে।চোখে চশমা নেই।গোসল করে এসেছে হয়তো।কিছু চুল কপালে ছড়িয়ে।কি সুন্দর দেখাচ্ছে!তবে,এই মুহূর্তে নিঝুমকে বোকাসোকা লাগছে।তিতলি কলকলিয়ে হেসে উঠল।নিঝুম সেন্টার টেবিল থেকে এক গ্লাস পানি তুলে নেয়।খেয়ে তিতলির দিকে তাকায়।তিতলি তখনো হাসছিল।নিঝুম এসে সামনে দাঁড়ায়।তিতলি তাকায়।সেই ভয়ংকর দৃষ্টি।তবে,এইবার ভয়ংকর প্রেমিক নয় ভয়ংকর স্বামীরূপে সামনে!তিতলির ঠোঁটের হাসি কমতে থাকে।নিঝুম বিড়বিড় করে উঠে,
— “আকাশের চাঁদ নেমে এসেছে আমার কুটিরে।”
তিতলি আবারো হেসে উঠে। মানুষটা কত পাগল।
নিঝুম তিতলির চোখে চোখ রেখে বলে,
— “সাদাতে শুদ্ধতম,পবিত্রতার রানী।”
তিতলি হাসতে হাসতে বলে,
— “আর আপনি রাজা।”
নিঝুম তিতলিকে পাঁজাকোলা করে নেয়।তিতলি হেসে দু’হা নিঝুমের গলা জড়িয়ে ধরে।নিঝুম বললো,
— “অন্যবার কোলে তুলে নিলে তো চিৎকার দাও।আজ দিলেনা?”
তিতলি নিঝুমের গলা আরো শক্ত করে ধরে বলে,
— “স্বামী পেয়েছি মন মতো এখানে আবার চিল্লাপাল্লার কি আছে?”
নিঝুম হোহো করে হেসে উঠে।তিতলি মুগ্ধ নয়নে দেখে।অনেকটা ফিসফিসিয়ে বললো,
— “আপনার প্রত্যেকটা স্পর্শ আমার ভেতরটা তোলপাড় করে দেয়।’
নিঝুম হাসি থামিয়ে তিতলির নাকে নাক ঘষে বলে,
— “আজ কি হবে?”
তিতলি হেসে নিঝুমের বুকে মুখ লুকিয়ে বলে,
— “মরেই যাবো।”
নিঝুম তিতলিকে বারান্দায় নিয়ে আসে।সোফায় বসিয়ে দেয়।হাতের ইশারায় গোল একটা স্বচ্ছ কাচের বক্স দেখায়।তিতলি তাকিয়ে দেখে, দুইটা প্রজাপতি বন্দি।তিতলি আর্তনাদ করে বলে,
— “মরে যাবে তো।”
নিঝুম হাসে।বলে,
— “উহু মরবেনা।আর, এই প্রজাপতি দুইটা হাসবেন্ড-ওয়াইফ!”
তিতলি অবাক হয়ে তাকায়।নিঝুম বলে,
— “প্রত্যেকদিন আমার ফ্ল্যাটে আসতো এরা।দুজন একসাথে উড়ে।একজন আরেকজনকে চুমু দেয়।আমার বিচ্ছেদের মনকে জেলাস ফিল করাতো।তাই আজ ধরে এনেছি,ওদের দেখিয়ে আজ তোমাকে ভালবাসবো।”
তিতলি জোরে হাসে।নিঝুম বলে,
— “এই হাসিটা দেখতেই এতো কিছু।”
গভীর রাতের শীতল বাতাসে খাটকে ঘিরে রাখা পর্দাগুলো মৃদু দুলছে।পুরো রুম জুড়ে একটা হারিকেন জ্বলছে।কথা ছিল মোমবাতির।কিন্তু নিঝুম হারিকেন রেখেছে।নিঝুম তিতলিকে পাঁজাকোলে নিয়ে বিছানার দিকে এগোতে এগোতে চোখে চোখ রেখে ভয়ংকর কবি কণ্ঠে নেশা মিশিয়ে বলে,
বিচ্ছেদের গ্লানি শেষে, অবশেষে বাসর ঘরে
প্রেম স্পন্দনে কাঁপছে হৃদয় থরথর
আজ ভালবাসার নতুন লগ্নে বহিছে বাতাস ঝরঝর
আর,
— “আর কি?” তিতলি কাঁপা গলায় প্রশ্ন করে।
” আর,বিচ্ছেদের সব ক্লান্তি কাটবে কোমল নিঃশ্বাসের তোপে,ভালবাসার ছোঁয়ায় ছোঁয়ায়। “
নিঝুম তিতলিকে বিছানায় শুইয়ে এক কোণা থেকে অন্য কোণে ঠেলে দেয়।তারপর বিভ্রম নিয়ে বলে,
” একে অপরের অস্তিত্বে ডুবে কেটে যাক এই রাত
শরীরের প্রতিটি শিরা-উপশিরা প্রেমের রঙে রঙ্গিন হয়ে বলে উঠুক, প্রজাপতি আমরা দুজন। “
বিয়ের দেড় মাস কাটলো।নিঝুম সেদিন সন্ধ্যার দিকে বাড়ি ফেরে।অবশ্য তিতলিকে কল করে বলা হয়েছিল, ফিরতে এশা হয়ে যাবে।তাই তিতলি সন্ধ্যা লাগতেই সুইমিংপুলের স্বচ্ছ পানিতে নেমে পড়ে।তার ভারী ভাল লাগে রাতে সাঁতার কাটতে।নিঝুম ছাদের দরজা অব্দি এসে থমকে দাঁড়ায়।তিতলিকে জলে দেখে রাগ হয় খুব।কঠিন কথা শোনাতে দু’পা সামনে ফেলে তখন শুনে তিতলি একা একা কথা বলছে।তিতলির খুবই সুন্দর একটি স্বভাব এটি।একা একা নিজেই অন্য চরিত্র সেজে নিজেই কথা বলে।নিঝুম ঠোঁটে মৃদু হাসি রেখে জলে ভাসা জলপরীর দিকে তাকিয়ে থাকে।তিতলি অনুরোধ করে কাউকে বলছে,
— “প্লীজ ডাক্তার,আমি একটু সাঁতার কাটিনা?”
এরপর আবার নিজেই অন্যদিকে ফিরে নিঝুমের ভঙ্গিতে বলে,
— “একদমই না।জ্বর কমুক তারপর।”
তিতলি আবার নিজের অবস্থানে এসে বলে,
— “জ্বর নেই তো।শুধু একটু কাশি।প্লীজ…
তিতলি আবারো নিঝুমের জায়গায় দাঁড়ায়।চোখ গরম করে গম্ভীরমুখে বলে,
— “উহু,আর শুনতে চাইনা।ঠান্ডা কমলে কক্সবাজার নিয়ে যাবো।এখন কিছুতেই সুইমিংপুলে নামা যাবে না।”
পরপরই তিতলি দু’হাতে মুখ ঢেকে হেসে উঠলো।এরপর অনবরত ডুব দিতে থাকে।নিঝুম এইবার গলায় রাগ এনে চেঁচিয়ে উঠলো,
— “তিতলি,এসব কি?সন্ধ্যায় তুমি…”
তিতলি কেঁপে উঠলো।হেঁচকি উঠে।তড়িঘড়ি করে জল থেকে উঠে পড়ে।ভীতু চোখে একবার নিঝুমকে দেখে উল্টো দৌড় দিতে গেলে নিঝুম কাঠকাঠ গলায় বললো,
— “এই দাঁড়াও।”
তিতলি দাঁড়ায়।নিঝুম কাছে আসতে আসতে দৌড়ে রুমে ঢুকে পড়লো।রুমে ঢুকেই সোজা ওয়াশরুমে।নিঝুম ধীর পায়ে রুমে আসে।জুতা খুলে।শার্ট, টাই খুলে।তখন ধীর পায়ে তিতলি ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে আসে।তার বুক ধুকপুক করছে।এখনি এতোগুলা ঝাড়ি খেতে হবে।নিঝুম কিছু না বলে ওয়াশরুমে চলে যায়।তিতলি ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে।নিঝুম ফ্রেশ হয়ে ট্রাউজার পরে বের হয়ে দেখে তিতলি গুমোট মুখ করে বসে আছে।চুল থেকে পানি পড়ছে টুপটুপ করে।নিঝুম তোয়ালে তিতলির মাথায় স্পর্শ করাতেই তিতলি চমকে উঠে তাকায়।অপরাধী স্বরে বলে,
— “সরি।আর নামবো না।”
নিঝুম তিতলিকে ঘুরিয়ে চুল মুছে দিতে দিতে বলে,
— ” এখন নিয়ে চার বার বললে।চারবারই কথা রক্ষা করতে পারো নি।”
তিতলি কাঁদোকাঁদো হয়ে যায়।সুইমিংপুল দেখে সে নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারে না।নিঝুম স্বাভাবিক করেই বলে,
— “তোমার সুইমিংপুলের ব্যবস্থা করতে হবে।”
তিতলি আঁৎকে উঠে অনুরোধ করে,
— “না প্লীজ।আচ্ছা,প্রমিজ এইবার শেষ।যতদিন আপনি না বলবেন আমি নামবো না।সাঁতার কাটবো না।”
নিঝুম কিছু বললো না।মেয়েদের সাথে কথা বাড়াতে নেই।কথার তালে তালে নিজের অপরাধ ভুলে যায়।সে অন্যদিকে চলে যায়।তিতলি নিঝুমের পিছন পিছন হাঁটে আর বলে,
— “আমি সত্যি বলছি।এইবার লাস্ট।ডাক্তার,শুনুন না।আমি খুব সরি।”
প্রায় দশ মিনিট বকবক করেও যখন নিঝুমকে কথা বলাতে পারলো না তিতলি রেগে যায়।নিঝুমের হাতে কামড় দিতে গেলে নিঝুম ছিটকে সরে যায় বলে,
— “কামড়াতে চাইলে পিঠে,পেটে কামড়াও।হাতে,মুখে না মানুষ কিসব ভাবে।”
তিতলি পরমুহূর্তেই নিঝুমের পিঠে কামড় বসিয়ে দেয়।নিঝুমের কপাল কুঁচকে যায়।তিতলি সবসময়ই আস্তে কামড় বসায়।মাঝে মাঝে এতো জোরে দেয়!
কামড়েও কোনো কাজ হলো না।নিঝুম নিজের কাজে মগ্ন।যখনই নিঝুম রুমের বাইরে যেতে পা বাড়ায় তিতলি পিছন থেকে দু’হাতে জড়িয়ে ধরে বলে,
— “এইবার শেষ। প্লীজ সরি।”
নিঝুম হেসে ঘুরে তাকায়।দু’হাতে তিতলিকে জড়িয়ে ধরে কপালে চুমু এঁকে বলে,
— “তিন-চারদিন নিয়ম মেনে চলো।এরপর তুমি স্বাধীন।”
তিতলি বাধ্যের মতো মাথা কাত করে।নিঝুম বললো,
— “বাবা এসেছেন দেখলাম।কথা হয়েছে।”
— “গিফট দিতে এসেছে।”
তিতলির কথা শুনে নিঝুম প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে তাকায়।তিতলি বলে,
— ” হানিমুন টিকিট।”
নিঝুম হাসে।তিতলি আলমারি থেকে নিঝুমের শার্ট বের করতে যায়।নিঝুম বলে,
— “আব্বু দিল হানিমুন টিকিট,নির্জন,বড় চাচ্চু,অরুণ,বড় ফুফি দিলেন।বাকি ছিলেন বাবা।সেটাও পূর্ণ হলো।”
তিতলি উত্তরে হাসে।নিঝুম বলে,
— “আমি মনে হয় একমাত্র জামাই যে বিয়ের গিফট হিসেবে এতো হানিমুন টিকিট পেয়েছে।”
তিতলি নিঝুমকে শার্ট পরিয়ে বোতাম লাগাতে থাকে।নিঝুম আবারো বলে,
— “হানিমুনের জন্য রাখা আমার টাকাগুলোর কি হবে বলোতো? “
— “তোমার ছেলে হানিমুন করবে।”
— “ছেলের বিয়ে বহুত দূর।তার আগেই আরো কয়টা হানিমুন ট্রিপ কেটে যাবে।”
রাতের খাবার শেষ করে রুমে এসে বিশ্রাম করে দুজন।এরপর প্রতিদিন রাত এগারোটায় বাইরে হাঁটতে বের হয়।আজও তাঁর ব্যাতিক্রম হয়নি।তিতলি সালোয়ার কামিজ পরেছে।সবসময় মাথার অর্ধেক অংশ ওড়নায় ঢাকা থাকে।তখন তিতলিকে নিঝুমের নতুন বউ মনে হয়।ঠান্ডা পড়েছে বেশ।তাই তিতলি গায়ে চাদর নেয়।নিঝুমের বাহু দু’হাতে জড়িয়ে ধরে রাতের নিস্তব্ধতায় মোড়া ছমছমে রহস্যময় রাস্তা ধরে হাঁটতে থাকে।নিস্তব্ধতা ভেঙে নিঝুম বলে,
— “এই মুহূর্তটা আমার কত প্রিয় তুমি জানো লাজুকলতা?”
— “জানি।”
— “কোনো কোলাহল নেই।চারিদিক ছমছমে নিস্তব্ধতা।মনে হয় পৃথিবীতে একমাত্র তুমি আর আমি।”
তিতলি বড় করে নিঃশ্বাস নেয়।রাতের শীতল আদুরে বাতাসে মন প্রাণ জুড়িয়ে যাচ্ছে।দুজন সাদারপাড়ার বিলের পাড়ে এসে দাঁড়ায়।যতদুর চোখ যায় মাঠ আর জল।শোঁ শোঁ আওয়াজ তুলে বাতাস উড়ে বেড়াচ্ছে।তিতলি দু’হাতে নিঝুমের পেট জড়িয়ে ধরে বললো,
— “এতো প্রেম আমার কপালে ছিল!”
নিঝুম তিতলিকে নিজের দিকে ফিরিয়ে বললো,
— “এতো আদুরে বউ আমার কপালে ছিল!”
তিতলি বড় বড় আঁখিদুটি মেলে নিঝুমের দিকে তাকায়।নিঝুমের খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি।তিতলি দু’হাত নিঝুমের দু’গালে রাখে।বুকের ভেতর নরম,কোমল অনুভূতি ছুঁয়ে যায়।এই মানুষটা তাঁর।একান্ত তাঁর ব্যক্তিগত।আপনের চেয়েও আপন।ভালবাসার চেয়েও বেশি ভালবাসার মানুষ।জীবনে আর কি চাওয়ার? তিন বছরের মৃত্যুযন্ত্রণা সমতূল্য কষ্টকে আর মনেই পড়ে না।নিঝুম এদিক-ওদিক তাকিয়ে দেখে,কেউ নেই পুরো বিলের পাড় এলাকা জুড়ে।তিতলিকে বলে,
— “গান শোনাও।”
নিঝুমের প্রতিদিনের আবদার।এখন যদি তিতলি বলে,ঠান্ডায় গলা বসে আছে।সুর আসবে না।নিঝুম শুনবে না।তাই তিতলি নাকচ করলো না।সে জলের দিকে মুখ করে দাঁড়ায়।নিঝুম তিতলিকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে তাঁর কাঁধে চিবুক রাখে।তিতলি মৃদু কেঁপে গান ধরলো,
” গভীরে আর গভীরে
মনের সাথে যাবে মন
মেঘের বাড়ি থেকে
রঙধনু দিল উঁকি
হুম…বৃষ্টি থেমে গেছে
তুমি আমি মুখোমুখি
এ যেন সাজানো সুখেরি
অন্য ভুবন
চাঁদের প্রদীপ জ্বলে
 ইচ্ছেরা ডেকে বলে
 স্বপ্ন দেখি চল
চন্দ্রিমা আকাশ তলে
জোসনা নেমেছে
প্রেমেরি এই তো লগন
ভালবাসার রং নেব খুঁজে
প্রজাপতি আমরা দুজন “
আল্লাহ হাফেজ।

1 COMMENT

Comments are closed.