প্রণয়াসক্ত পূর্ণিমা পর্ব ৪৬

প্রণয়াসক্ত পূর্ণিমা পর্ব ৪৬
Writer Mahfuza Akter

সৌহার্দ্য ড. আরমান আহমেদের মুখোমুখি বসে আছে। আজ বাধ্য হয়ে এই ঘৃণিত মানুষটার মুখোমুখি হতে হচ্ছে। অসহ্যকর একটা অনুভূতি! মাথা নিচু করে হাতে হাত ঘষছে আর আশেপাশে তাকিয়ে হাঁস-ফাঁস করছে সৌহার্দ্য। কেন যেন লোকটার মুখের দিকে তাকাতেই মন চাইছে না ওর!
সৌহার্দ্যকে এভাবে থমথমে মুখ করে বসে থাকতে দেখে কুটিল হাসলেন ড. আরমান। আধপাকা গোঁফের প্রান্তভাগে আঙুল বুলাতে বুলাতে বললেন,

“অনেক দিন যাবৎ তোমার সাথে দেখা করা ও কথা বলার ইচ্ছা মনে পুষে রেখেছি। কিন্তু তুমি তো মনে হয় বেশ ব্যস্ত মানুষ! বেশ বড় মাপের ডাক্তার হয়ে গেছো বলে কথা। আমি তো ভেবেই নিয়েছিলাম তোমার সাথে দেখা করার জন্য একদিন এপয়েন্টমেন্ট নিবো।”
সৌহার্দ্য ভ্রু কুঁচকে তাকালো সামনে বসা মানুষটার দিকে। লোকটা কি অদ্ভুত! এভাবে মুখোমুখি বসে খোঁচা দিয়ে কথা বলে কেউ? সৌহার্দ্য বিব্রতবোধ করলেও সেটা প্রকাশ করলো না। কপট হেসে বললো,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“আপনার মতো গণ্যমান্য ব্যক্তি তো হয়ে উঠতে পারিনি! কিন্তু আপনি নিজেও একজন ডক্টর। আই হোপ আপনি বুঝবেন ডক্টরদের লাইফস্টাইল ঠিক কেমন থাকে। হয়তো আপনার প্রফেশনাল লাইফে ডক্টর হিসেবে আপনি অফুরন্ত সময় উপভোগ করতে পেরেছিলেন! কিন্তু আমি আমার প্রফেশনে একটু মাত্রাতিরিক্ত ডেডিকেটেড।”
ড. আরমান চোয়াল শক্ত করে তাকালেন। সৌহার্দ্য ওনার কথার বিপরীতে এমন ভাবে অপমান করবে, সেটা উনি কল্পনাও করেননি। তাই সরাসরিই প্রশ্ন বললেন,

“তোমার মনে হয় আমি ডাক্তার হিসেবে অফুরন্ত সময় উপভোগ করে সমাজে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেছি? পরিশ্রম ছাড়া এমনটা কখনো সম্ভব?”
সৌহার্দ্য মিটমিটিয়ে হাসলো খানিকটা। সেটা আড়াল করার জন্য আঙুল দিয়ে নাক ঘষে পকেট থেকে ফোনটা বের করলো। অর্ধেক মনযোগ ফোনে রেখে বললো,

“সেটা তো আপনিই ভালো বলতে পারবেন! যাইহোক, এসব নিয়ে কথা বলতে আসিনি আমি।”
ড. আরমান সোজা হয়ে বসলেন। অরুণী এসে দুজনের সামনে কফি রেখে গেল। কিন্তু পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়ে রইলো ওদের কথা শোনার জন্য। ড. আরমান কফিতে চুমুক দিতেই বললেন,
“তুমি কি সত্যি সত্যিই অরিত্রীকে ডিভোর্স দিচ্ছো? অরুণী আমায় বললো, তুমি নাকি…..”
“আপাতত কিছুই সম্ভব না। তবে তরীর আর আমার মাঝের দূরত্ব কখনো মিটবে না আর! আপনি আমাকে এটা বলুন যে, আপনি নিজে কী চান? ওরা দুজনেই তো আপনার মেয়ে! অরিত্রীকে তো আপনি নিজের মেয়ে নাবলে অস্বীকৃতি জানাতে পারবেন না!”

ড. আরমান তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বললেন,
“হাহ্! মেয়ে? ওকে আমি নিজের মেয়ে মানলে তো! আর সেও আমাকে বাবা বলে মানে না। ও তো আফনাদ শাহরিয়ারের মেয়ে!”
“ওকে মানবেন কেন আপনি? ও তো আপনার কোনো কাজে আসেনি! ওকে নিজের স্বার্থে ব্যবহার করতে পারেননি, বরং আপনার বিরোধী ছিল সবসময়। অরুণীকে আপনি নিজে মতো ব্যনহার করেছেন, নিজের স্বার্থসিদ্ধি করেছেন। অরুণী এতো বোকা না। আমার তো মনে হয়, আপনি ওকে নিজের প্রয়োজন মেটানোর জন্য সাইকো বানিয়ে ফেলেছেন। যা মন চেয়েছে, ওকে দিয়ে তাই করিয়েছেন!”

ড. আরমান কেমন যেন গা-ছাড়া ভাব করলেন যেন এতে তার কিছু যায়-আসেই না। মুখে অদ্ভুত হাসি রেখে বললেন,
“হ্যাঁ, করিয়েছি। আমার মনে তোমাদের মতো এসব ঠুনকো মায়া-মমতা-ভালোবাসা নেই। আমি সবসময় সবকিছু নিজের জন্য করেছি। বলতে পারো, আমি স্বার্থপর, অথবা এটা আমার নিজের প্রতি ভালোবাসা।”
অরুণী নিজের বাবার মুখে এমন কথা শুনে নির্বাক, স্তব্ধ, বিমূঢ় হয়ে গেল। তার বাবা তাকে কখনো ভালোই বাসেনি? সে জানে তার বাবা স্বার্থপর। তাই বলে এতোটা!! ওড়না খামচে ধরে অরুণী নিজেকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করলো।
সৌহার্দ্য তাচ্ছিল্যের দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,

“সত্যিই মায়া-মমতা নেই? আরে পশুপাখির মনেও তো মায়া নামক অনুভূতিটা থাকে! এতোটা নিম্ন মানসিকতা নিয়ে কীভাবে নিজেকে মানুষ বলে গন্য করেন আপনি?”
“হা! হা!! তাহলে কী বলতে চাইছো? আমি মানুষ না?”
“আপনাকে জাজ করার কোনো ইচ্ছে বা রুচি কোনোটাই আমার নেই। কোনো মানুষ কি তার নিজের স্ত্রীকে নিজের হাতে মে*রে ফেলতে পারে? আপনিই বলুন?”
আরমান আহমেদের মুখের রঙ বদলে গেল মুহুর্তেই। তিনি কাঠিন্য মিশ্রিত কন্ঠে বললেন,
“মানে কী বলতে চাইছো তুমি?”

সৌহার্দ্য এবার হালকা ঝুঁকে হাঁটুতে কনুই ভর দিয়ে বসলো। দুই হাতে আঙুলগুলো একত্রিত করলেও হাত থেকে ফোনটা সরালো না। কপট হেসে বললো,
“বুঝতেই তো পারছেন যে, সত্যটা আমি জানি! আমার থেকে লুকানোর বৃথা চেষ্টা করবেন বলে মনে হয় না। আফটার অল, আপনার ব্রেইন অস্বাভাবিক শার্প।”
আরমান আহমেদ বিরক্ত হয়ে বললেন,

“কোনো জিনিসের প্রয়োজন ফুরিয়ে গেলে সেটা ফেলে দিতে হয়। আর সেই জিনিসটা যদি পথের কাঁটা হয়ে দাঁড়ায়, তাহলে সেটাকে পথ থেকে পুরোপুরি সরিয়ে ফেলার ব্যবস্থা করতে হয়৷ আমিও সেটাই করেছি!”
সৌহার্দ্য হতভম্ব হয়ে বললো,
“মানে কী বললেন? কাকীমনিকে আপনার পথের কাঁটা মনে হয়েছে? সিরিয়াসলি!! আপনার দুই সন্তানের মা উনি। তাছাড়া…..”

“এজন্যই তো বারবার আমার সামনে আসতো! সন্তানের দোহাই দিতো। ওর জন্য কোনোদিক দিয়ে আগাতে পারছিলাম না আমি। আজকে আমার নাম এভাবে প্রতিষ্ঠা করতে পারতাম না আমি ও বেঁচে থাকলে।”
“তাই বলে ওনাকে মে*রেই ফেলবেন? তাও আবার এভাবে পুড়িয়ে মা*রবেন? কীভাবে পারলেন আপনি এমনটা করতে? আর আমাদের চাঁদ? ওকেও পৃথিবীতে থেকে সরিয়ে ফেলতে চেয়েছিলেন? ও তো আপনার নিজের অংশ-ই ছিল!”
আরমান আহমেদ পুনরায় মুখ দিয়ে বিরক্ত সূচক শব্দ করে বললেন,

“আমার ভুলটা এখানেই ছিল। সেদিন ওর প্রতি একটু মায়া জেগে গিয়েছিল বলে ওকে মাটিচাপা দিয়েছিলাম। সব মায়া ত্যাগ করে যদি ওকেও মালিহার সাথে সেদিন পুড়িয়ে ফেলতাম, তাহলে আজ আমায় এতো ভুগতে হয় না।”
সৌহার্দ্য অবিশ্বাস্য চোখে তাকিয়ে রইলো। কিছু বলার শক্তি ওর মধ্যে অবশিষ্ট-ই নেই। সৌহার্দ্য হতবিহ্বল হয়ে আছে এমন সময় হঠাৎ অরুণী তার বাবার সামনে এসে দাঁড়ালো। চোখ ভর্তি টলমলে অশ্রু নিয়ে ফুপিয়ে কেঁদে উঠলো সে,
“তুমি… তুমি আমার মাকে মেরেছো, বাবা?”

সৌহার্দ্য আর আরমান আহমেদ দুজনেই চমকে তাকালো অরুণীর দিকে। বসা থেকে উঠে দাঁড়াতেই আরমান আহমেদের কলার চেপে ধরলো অরুণী। চিৎকার করে বললো,
“মানে তুমি নিজের হাতে পুড়িয়ে দিয়েছো মাকে? আমার মাকে? আর অরিত্রীকে মাটিচাপা দিয়েছো মানে? তুমি এসব কী করেছো, বাবা?”
আকস্মিক ঘটনায় সৌহার্দ্য হতভম্ব হয়ে গেল। অবাক চোখে তাকিয়ে বললো,
“তুমি এসব কিছু জানতে না, অরুণী?”

আরমান আহমেদ অরুণীর হাত ধরতে গেলে অরুণী তাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলো। তার দিকে আঙুল তুলে বললো,
“তোমাকে পশু বললে পশুকেও অপমান করা হবে। তুমি একটা নিকৃষ্ট। আমার মাকে মেরে ফেলেছো তুমি! অরিত্রীর প্রতি আমার মনে হিংসে ঢেলেছো, মায়ের বিরুদ্ধে রেখেছো সবসময় আমাকে শুধু মাত্র আমাকে ব্যবহার করার জন্য। ছেলের বাবা হতে পারোনি বলে আমাকে ব্যবহার করে নিজের ডানহাত বানিয়েছো। নিজের স্বার্থে এতোটাই অন্ধ তুমি!”
ড. আরমান কী বলবেন বুঝে উঠতে পারলেন না। মুখ ঘুরিয়ে চলে গেলেন নিজের ঘরের দিকে। সৌহার্দ্যও বেরিয়ে গেল ওদের বাসা থেকে।

অরুণী কাঁদতে কাঁদতে বসে পড়লো ফ্লোরে। তার সারাটা জীবনই এভাবে বোকার মতো বাবার স্বার্থে বলিদান করলো সে। বিনিময়ে পেল ধোঁকা! নিজের পাপের বোঝা আজ অনেক ভারী পড়ে গেছে অরুণীর ঘাড়ে। এর প্রায়শ্চিত্ত হয়তো অসম্ভব! নিজের চুল খামচে ধরে শব্দ করে কাঁদতে কাঁদতে অরুণী উপরের দিকে তাকালো। বললো,

“আজ তোমার কথা অনেক মনে পড়ছে, মা। তোমার বুকে হামলে পড়ে কাঁদতে ইচ্ছে করছে। তোমায় তো আমি অনেক অবহেলা করেছি, কষ্ট দিয়েছি, মা। আজকে সত্যিটা জানার মাধ্যমে এতো বড় শাস্তি দিলে আমায়? সেদিন তোমার সাথে সাথে আমিও মরে গেলাম না কেন? মা, ফিরে এসো! শুধু একটা মুহুর্তের জন্য তোমায় ঝাপটে ধরার সুযোগ দাও আমায়!”
অরুণীর চিৎকারগুলো চার দেয়ালে প্রতিধ্বনিত হতে লাগলো। কিন্তু কোনো উত্তর এলো না।
সৌহার্দ্য গাড়িতে উঠে বসে প্রহরকে কল দিয়ে বললো,

“অল ডান! ভিডিও পেয়েছিস?”
প্রহর ব্যস্ত গলায় বললো,
“ইয়েস! তুই আয় তাড়াতাড়ি। তারপর আমি মিডিয়া চ্যানেলগুলোতে ফাইল দুটো পাঠাচ্ছি।”
“ওকে!”
সৌহার্দ্য প্রহরের অফিসে পৌঁছাতেই প্রহর ওকে দেখে বললো,
“আরেকবার ভেবে নে, সৌহার্দ্য। তরীর অপারেশনের পর না-হয় এসব করা যাবে! আর মাসখানেকের মতো ওয়েট করি আমরা।”

সৌহার্দ্য দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,
“কিছু হবে না। তরীর কোনো ক্ষতি করতে হলে এতোদিনে করেই দিতেন উনি। ইলেকশনের আর এক সপ্তাহ বাকি। সো, যা করার এখনই করতে হবে।”
প্রহর মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানিয়ে ল্যাপটপে মনযোগ দিলো।

সন্ধ্যার দিকে তরী হসপিটালে এলো অর্ণবের সাথে। আগামীকাল ওর ফ্লাইট। তাই আজকে ফাইনাল চেকাপের জন্য এসেছে তরী। ড. আরমানের নাগালের বাইরের একটা হসপিটালে চেকাপ করায় সে। আঁধার ঘনিয়ে আসার পূর্বে তরী বাসা থেকে বের হওয়ার সাহস পায় না। নিজের জীবনের পরোয়া না থাকলেও নিজের সন্তানের মায়ায় সে প্রচন্ডভাবে আবদ্ধ হয়ে গেছে। হঠাৎ তরীর ফোন বেজে ওঠায় ভাবনা থেকে বেরিয়ে এলো সে। দেখলো, মিস্টার আফনাদ কল দিয়েছেন। রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে ওনার ব্যস্ত কন্ঠ ভেসে এলো,

“তরী! যেখানেই আছিস, বাড়ি ফিরে আয়। সব টিভি চ্যানেলে ড. আরমানের ভিডিও টেলিকাস্ট হচ্ছে। তোর মায়ের গায়ে আগুন দেওয়ার ভিডিও আর ওনার নিজের স্বীকারোক্তির ভিডিও সবাই দেখছে। তুই বাইরে থাকিস না আর। ও তোকে মেরে ফেলবে! তাড়াতাড়ি বাড়ি আয়।”

প্রণয়াসক্ত পূর্ণিমা পর্ব ৪৫

তরীর সারা দেহ অবশ হয়ে গেল যেন! ওপাশ থেকে মোহনার কান্নাকাটির শব্দ শোনা যাচ্ছে। তরীর হাত থেকে ফোন পিছলে পড়ে গেল। অর্ণব অবাক হয়ে গাড়ি থামাতেই তরী বিরবির করে বললো,
“গাড়ি ঘোরাও, অর্ণব ভাই! আমার বাচ্চা দুটোকে বাঁচাও! ”

প্রণয়াসক্ত পূর্ণিমা পর্ব ৪৭+৪৮