প্রণয়াসক্ত পূর্ণিমা সিজন ২ পর্ব ২৭ শেষ অংশ 

প্রণয়াসক্ত পূর্ণিমা সিজন ২ পর্ব ২৭ শেষ অংশ 
Writer Mahfuza Akter

“মা, তুমি তরীর হাত ধরে ওভাবে টানাটানি কেন করছো?”
সুজাতা চকিত দৃষ্টিতে তাকালো। তার চোখে মুখে শঙ্কা, ভীতি ও আড়ষ্টতা। সৌহার্দ্যের দৃষ্টিতে কাঠিন্যের রেশ! সুজাতা সেটা প্রথমেই খেয়াল করেছে। সে ছেলেকে ঠিক কী জবাব দিবে ভেবে পাচ্ছে না!

সৌহার্দ্য একটানে তরীর হাত সুজাতার মুঠো থেকে ছাড়িয়ে ওকে নিজের কাছে টেনে নিলো। তরীর হাতটা নিজের আয়ত্তে নিতেই সৌহার্দ্য বুঝতে পারলো মেয়েটা অত্যাধিক কাঁপছে। হাতের শিরার কম্পন দ্রুত গতিতে চলছে। সৌহার্দ্য ভ্রু কুঁচকালো। কী এমন হয়েছে যে, পালস রেট এতো অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গেছে?

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

আহমেদ ভবনের সদর দরজা থেকে মেইনফটক পর্যন্ত সুদীর্ঘ প্রবেশপথ, যার দু’পাশেই উজ্জ্বল ও ফকফকে আলোর স্ট্যান্ড-ল্যাম্প লাগানো হয়েছে। সেই আলোর সুবাদে সৌহার্দ্য তরীর সাদা কব্জিতে রক্তিম বর্ণের আঙুলের ছাপ স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে। সৌহার্দ্য অবিশ্বাস্য চোখে তাকালো সুজাতার দিকে। সে যেন একেবারেই নির্বাক হয়ে গেছে!
সুজাতা সমানে হাত কচলে যাচ্ছে। এতে বাজেভাবে ফেঁসে যাওয়ার ব্যাপারটা তার কল্পনাতেও আসেনি। এতো পরিকল্পনা সাজালো! কিন্তু নিজেকেই নিজের পাতা ফাঁদে আবিষ্কার করে বিমূঢ় হয়ে গেছে সুজাতা।

“তুমি ওর সাথে কী করতে যাচ্ছিলে, মা?”
সৌহার্দ্যের ক্ষিপ্ত বাক্যস্রোত কানে এসে বারি খেল সুজাতার। সে চমকে তাকালো। সৌহার্দ্য কি সত্যিই কিছু বুঝে ফেললো? সুজাতার প্রশ্নের উত্তরের অপেক্ষা না করেই সৌহার্দ্য তরীর দিকে তাকালো। তরীর গাল ভেজা, চোখ দুটো রক্তিম ও পানিতে টলমল করছে। মেয়েটাকে এতোটা অসহায় লাগছে দেখতে! সৌহার্দ্যের ভেতরে যেন তুমুল বেগে র*ক্তক্ষ*রণ হচ্ছে। সে গলা ঝেড়ে নিজেকে স্বাভাবিক করার ব্যর্থ চেষ্টা করলো,

“চাঁদ! আমায় সত্যি সত্যি বলো। কী হচ্ছিল এখানে?”
তরী চোখ তুলে একবার সৌহার্দ্যের দিকে তাকালো। সৌহার্দ্যকে দেখেই মনে হচ্ছে, সে নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা চালাচ্ছে। দাঁতে দাঁত কটমট করে ঠোঁটে ঠোঁট চেপে দাঁড়িয়ে আছে সৌহার্দ্য। আগাম ঝড়ের পূর্বাভাস! তরী কিছু না বলেই চোখ নামিয়ে ফেললো।

সৌহার্দ্যের অতি কষ্টে সামলে রাখা মেজাজটা এবার প্রচন্ডভাবে বিগড়ে গেল। সে তরীকে ঝাঁকিয়ে বলে উঠলো,
“কথা বলতে পারছো না? মুখে এভাবে তালা মেরে রেখেছো কেন? স্পিক আপ! ড্যাম ইট!!”
রাতের সুনশান নীরবতায় সৌহার্দ্যের ধমকটা যেন কয়েকবার প্রতিধ্বনিত হলো কানে! তরী আর সুজাতা দু’জনই কেঁপে উঠলো। তরী কিছু বলবে এমন সময় সুজাতা বলে উঠলো,

“তুই যেমনটা ভাবছিস, তেমন কিছু না, বাবা! আমি তো…..”
“আমি কেমনটা ভাবছি?”
সৌহার্দ্যের সোজাসাপ্টা প্রশ্নে সুজাতা ভড়কে গেল। উত্তর দেওয়ার কোনো ভাষা খুঁজে পেল না। সৌহার্দ্য তরীর হাত ছেড়ে সুজাতার সামনে দাঁড়ালো,

“আজ যদি তোমার মেয়েকে কেউ এভাবে রাতের আঁধারে বাড়ি থেকে বের করে দিত, তাহলে তোমার কেমন লাগত, মা?”
“আ….আমি ওকে কেন বাড়ি থেকে বের করে দিতে যাবো? তুই আমাকে ভুল বুঝছিস!”
সৌহার্দ্যের মুখে তাচ্ছিল্যের হাসি ফুটে উঠলো। সুজাতা হকচকিয়ে গেছে সেই হাসি দেখে। নিজের ছেলেকে সে ভালো করেই চেনে। ওর এই হাসির অর্থও সুজাতার অজানা নয়। সৌহার্দ্য মুখে হাসি বজায় রেখেই বললো,

“আচ্ছা? ভুল বুঝছি? তাহলে ঠিকটা কী? তুমি-ই বলো!”
সুজাতা কিছু বলতে যাবে, এমনসময় সৌহার্দ্য তাকে থামিয়ে আবারও বলে উঠলো,
“আচ্ছা, থাক! তোমার আর কষ্ট করে আমাকে বানানো কাহিনী শোনাতে হবে না। সত্যিটা আমিই জেনে নিচ্ছি না-হয়!”

সৌহার্দ্য মেইন গেইটের দিকে তাকিয়ে গলা ঝেড়ে ডাকলো,
“আজাদ চাচা, বেরিয়ে এসো।”
আজাদ দারোয়াকে নিয়ে গেইটের পাশে থাকা বড় গাছটার আড়াল থেকে বেরিয়ে এলো। সুজাতা বিস্ফোরিত চোখে তাকালো দারোয়ানের দিকে। সৌহার্দ্য দারোয়ানকে প্রশ্ন করলো,

“মা ঠিক কী কী করতে বলেছে তোমায়? তুমি কেন বাইরে গাড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলে? সত্যি সত্যি বলো!”
আজাদ এতোক্ষণ দারোয়ানের মুখ চেপে ধরেছিল। সৌহার্দ্যের ইশারায় তার মুখ ছেড়ে দিলো। দারোয়ান জোরে জোরে শ্বাস নিয়ে নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করে বললো,

“আমি কিছু জানি না! আমার কোনো দোষ নেই! বড় বউ-সাহেবা আমাকে যা যা করতে আদেশ দিয়েছে, আমি শুধু তা-ই করতে বাধ্য ছিলাম। আমাকে বলেছিলেন রাতে যেন একটা গাড়ি রেডি রাখি আর তিনি তরীকে নিয়ে আসবেন। আমি যেন তাকে নিয়ে গ্রামের বাইরে ফেলে আসি।”
তরীর বুক ধক করে উঠলো কথাটা শুনে। এই রাতের আঁধারে তাকে একটা লোকের সাথে পাঠিয়ে দিচ্ছিল গ্রামের বাইরে! অবিশ্বাস্য!

সৌহার্দ্য অদ্ভুত শীতল চোখে তাকিয়ে আছে সুজাতার দিকে। তার চোখে তীব্র অবিশ্বাস! সৌহার্দ্য যেন নিজের কানকেও বিশ্বাস করতে পারছে না! তার নিজের জন্মদাত্রী মা এতোটা নিষ্ঠুর! সুজাতার ভেতরটা হাহাকার করে উঠলো ছেলের এমন চাহনি দেখে। সে এগিয়ে এলো ছেলের দিকে!

“এক পা-ও এগোবে না আমার দিকে! একদম আমার কাছে আসার চেষ্টা করবে না!”
সৌহার্দ্য হাত উঁচিয়ে সুজাতাকে থামালো। তার চোখ দুটো র*ক্তিম আভায় জ্ব*লে উঠেছে যেন! সুজাতা থেমে গিয়ে বলে উঠলো,

“আমার কথাটা শোন, বাবা! আমি যা করেছি, সবটা তোর ভালো…..”
“ভালো? সিরিয়াসলি, মা! আমার ভালো করার জন্য আমার ভালো থাকার কারণটাকেই আমার থেকে দূরে সরিয়ে দিচ্ছিলে?”
সুজাতা রেগে বললো,

“মাথা খারাপ হয়ে গেছে তোর! এই মেয়েটা তোর মাথা খারাপ করে দিয়েছে।”
“হ্যাঁ, মাথা খারাপ হয়ে গেছে আমার। আর আমার মাথা তোমরা খারাপ করেছো, তরী করেনি। যখন থেকে বুঝতে শিখেছি, তখন থেকে তুমি, বাবা আর দাদীর মুখে শুধু আমার আর তরীর বিয়ের কথা শুনেছি। আর তোমাদের সেই ইচ্ছেটা-ই ধীরে ধীরে আমার নিজের স্বপ্নে পরিণত হয়েছে।

কৈশোর থেকে আজ পর্যন্ত এতো এতো বছর ধরে আমার মন ও মস্তিষ্কে যে অনুভূতিগুলো যত্নে আগলে রেখেছিলাম, তার বীজ তোমরা বুনেছিলে। তরী তো কিছু জানতোই না! ও সবসময়ই আমার থেকে দূরে দূরে থেকেছে। আর তোমাদের জন্য-ই দূর থেকে আমি ওকে অনুভব করতে শিখেছি। শুধুমাত্র তোমাদের জন্য!”
সৌহার্দ্যের কথা শুনে তরী হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছে। সে ভাবতেও পারেনি, তার আড়ালে তাকে নিয়ে এতো কিছু ভাবা হতো। সুজাতা বিরক্তি নিয়ে বললো,

“তখন পরিস্থিতি অন্যরকম ছিল। তখন তো এই মেয়ের বিয়ে ভাঙ্গেনি! আর ওর গায়ে কোনো কলঙ্কের দাগও ছিল না!”
সৌহার্দ্য তরীর হাত ধরে নিজের কাছে টেনে বললো,

“ওর গায়ে কোনো কলঙ্ক নেই, মা। ও পবিত্র, সকল কলঙ্কের উর্ধ্বে! আকাশে চাঁদের গায়ে থাকা দাগ যেমন সারা পৃথিবীর কাছে মূল্যহীন; আমার চাঁদের গায়ে যদি কোনো কলঙ্ক লেগেও থাকে, সেটা আমার চোখে ওর পবিত্রতার কাছে মূল্যহীন। ও সারাজীবনের জন্য আমার হয়ে থাকবে, এটা-ই আমার জন্য অনেক, মা। আমার আর কিছু লাগবে না!”

“কিন্তু এই মেয়ে এ বাড়ির বউ হতে পারে না! ওর….. ”
সুজাতা কিছু বলতে চেয়েও বলতে পারলো না। সৌহার্দ্য তাকে থামিয়ে দিয়ে বললো,
“এই বাড়ির বউ না হলেও আমার বউ ও। এখন তোমার যদি আমাকে এই বাড়ির ছেলে বলে মনে না হয়, তাহলে তুমি মনে করতে পারো।”

সৌহার্দ্য তরীকে নিয়ে গাড়ির দিকে এগিয়ে গেল। সুজাতা ছুটে এসে সৌহার্দ্যের হাত ধরে বললো,
“তুই কোথায় যাচ্ছিস?”
সৌহার্দ্য নিজের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বললো,
“যেখানেই যাই না কেন! এই বাড়িতে আর থাকবো না। যেখানে আমার অর্ধাঙ্গিনীর সম্মান নেই, সেখানে আমি কীভাবে থাকবো?”
সুজাতা কেঁদে উঠে বললো,

“এই মেয়েটার জন্য নিজের মাকে ফেলে চলে যাবি?”
সৌহার্দ্য দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,
“আমি নিরূপায়, মা! তুমি আমাকে এমন এক সমীকরণে এনে দাঁড় করিয়েছো যে, আমি কোনোদিক ছেড়ে কোনোদিকেই যেতে পারছি না! এই মেয়েটাকে তুমি রাতের আঁধারে বাড়ি থেকে টানতে টানতে বের করে দিচ্ছিলে। আবার তাকে একটা লোকের সাথে কোথায় পাঠাচ্ছিলে, সেটা তুমিই ভালো জানো! এতোটা ঘৃণা কীভাবে করতে পারো, মা? মেয়ে হয়ে একটা মেয়ের সম্মানোর কথাও একবার ভাবলে না!”

“তুই যাস না, সৌহার্দ্য! তোকে ছাড়া আমি কীভাবে থাকবো? আমার একটা মাত্র ছেলে তুই! আমার অনেক শখের, অনেক আদরের তুই!”
“তোমার কাছে আসতে হলে তরীকে ছাড়তে হবে! আমি ওকে ছেড়ে দিলে ও কোথায় যাবে, মা? তোমার তো থাকার জন্য এই বাড়ি আছে, অনেক কাছের মানুষ আছে, বেঁচে থাকার সম্বল আছে। কিন্তু এই মেয়েটাকে দেখো! আমি ছাড়া এই মুহুর্তে ওর কেউ নেই। আমি ওর হাত ছেড়ে দিলে ও বাঁচবে না, মা! আর ওকে ছাড়া আমি কীভাবে থাকবো?”

“ওর জন্য আমাকে ছেড়ে দিবি?”
সৌহার্দ্য হতাশ গলায় বললো,
“তুমি আমার মা! আমি তোমাকে ছাড়তে পারি? কিন্তু তোমার জন্য তরীকে ছেড়ে নিজেকে অপরাধী বানাতে পারবো না। তরীর সাথে অনেক অন্যায় করেছো তুমি। তোমার অন্যায়টা ক্ষমার যোগ্য না। তরী তোমায় কোনোদিন ক্ষমা করতে পারলেও, আমি পারবো না। ভালো থেকো।”

সৌহার্দ্য সুজাতার হাত থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে গাড়ির দিকে এগিয়ে গেল। সুজাতা স্থির মানবীর মতই চেয়ে রইলো। সৌহার্দ্য গাড়ি স্টার্ট দেওয়ার শব্দে তার হুশ এলো। সে ছুটে গাড়ির দিকে এগিয়ে গেল।সৌহার্দ্য গাড়ি ঘুরিয়েও এগোতে পারলো না। সুজাতার কান্নার শব্দে তার ভেতরটা হাহাকার করছে। তার মা নিশ্চয়ই পেছনে দাঁড়িয়ে কাঁদছে।

সৌহার্দ্য গাড়ি থেকে নেমে সুজাতার কাছে এলো। সুজাতা চিৎকার করে কাঁদছে,
“যাস না, বাবা! তুই আমাকে ফেলে চলে গেলে, আমার কোলটা একেবারে খালি হয়ে যাবে! ঐ ন*ষ্টা মেয়েটার জন্য আমাকে ফেলে যাস না!”

সৌহার্দ্য ফিরে আসার জন্য বেরিয়েছিল। সে তরীকে নিয়ে এ বাড়িতেই থাকতো। নিজের মাকে ছেড়ে যেত না। কিন্তু তরীর প্রতি সুজাতার “ন*ষ্টা” সম্বোধনটা শুনে হতাশ হলো সে। এখানে আর থাকা সম্ভব নয়। তার মায়ের মনে নিজের করা অন্যায়ের জন্য কোনো অনুতাপ নেই। সৌহার্দ্য সুজাতার দু’হাত নিজের মুঠোয় নিয়ে চুমু দিলো,
“ভালোবাসি, মা। আমি তোমায় অনেক ভালোবাসি।”

সৌহার্দ্য গাড়িতে গিয়ে বসে গাড়ি স্টার্ট দিলো। সুজাতা গাড়ির পেছনে ছুটে গেল। কিন্তু সৌহার্দ্য গাড়ি নিয়ে মেইন গেইট অতিক্রম করে ফেলেছে। উড়ন্ত ধুলোয় গাড়িটা চোখের আড়াল হয়ে গেল। সুজাতা ধপ করে মাটিতে বসে পড়লো। তার শাড়ি ধুলোয় মাখামাখি হয়ে গেছে। সুজাতা আকাশের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে বললো,

প্রণয়াসক্ত পূর্ণিমা সিজন ২ পর্ব ২৭ 

“আমি আমার ছেলেকে সারাজীবনের জন্য হারিয়ে ফেললাম, আল্লাহ! আমার কোল খালি হয়ে গেল।”

প্রণয়াসক্ত পূর্ণিমা সিজন ২ পর্ব ২৮